রক্ষিতা পর্ব ৯

# রক্ষিতা
#Part -9
# Writer – Taslima Munni

আমি রাস্তায় হাঁটছি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি আকাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। আকাশ অনেক রাতে বাসায় ফিরেছে।এখনো ঘুমাচ্ছে আর আমি রাস্তায়। আকাশের যে দুই বছরের চুক্তি ছিলো সেটা শেষ হয়েছে গতকাল। আজ আমি দায়বদ্ধ নই।আকাশ মানুষটা একদম অন্যরকম। অনেক কষ্ট পুষে রেখেছে মনে। আমার প্রতি যতটা অনুভূতি তার কিছুটা আমি আঁচ করতে পেরেছি। আমি চলে যাচ্ছি, আকাশ আরও একা হয়ে যাবে। কিন্তু আমার কি করার আছে? কিচ্ছু করার নেই। আমি নিজেই নিয়তির হাতের পুতুল। সাইফকে ফোন দিয়েছি।
– সাইফ, তুই একটু আসতে পারবি এখন?
– কোথায় আপু?
– আমি বের হয়েছি।রাস্তায় আছি।তুই আয়।
– কেন আপু? কি হয়েছে?
– কিছু হয়নি।তুই চলে আয় তাড়াতাড়ি।
– আচ্ছা আমি আসছি।কোথায় আসবো বলো।
আমি সাইফকে লোকেশন বললাম। একা যেতে ভরসা পাচ্ছি না। সাইফ আসতে এতো দেরি করছে কেন? আমি একা গাড়িতে উঠবো না।হাত- পা অসার হয়ে আসছে।

এদিকে আকাশ ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু আমাকে কোথাও খুঁজে পায়না। শেষ পর্যন্ত দারোয়ান জানায় আমি খুব ভোরে বের হয়েছি।কোথায় যাবো এতো সকালে আকাশ ভেবে পাচ্ছে না।
রুমে আবার যখন আসলো তখন ছোট চিরকুট চোখে পড়লো।

আকাশ,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি অনেক কিছু করেছেন আমার পরিবারের জন্য। গতকাল আপনার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। আমিও কথা রেখেছি। দুই বছর আপনার প্রতিটি কথা মেনে চলেছি। চলে যাচ্ছি আমি, কিন্তু মনে হয় আপনার বাড়ির মায়ায় জড়িয়ে গেছি। কিন্তু যেতে তো হবেই।ভালো থাকবেন।
– কাজল

আকাশের চোখে পানি। এভাবে চলে যাবো ভাবেনি আকাশ। এখন আকাশ ভাবছে নিশ্চয়ই মামার বাসায় ই যাবো আমি।
অনেক ক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর মনে পড়লো রিপোর্ট আনা হয়নি!সাথে সাথেই সেখানে চলে যায়।
– গতকাল রিপোর্ট নেবার কথা ছিল।
– স্যার আপনার ওয়াইফ কাল সকালে রিপোর্ট নিয়ে গেছেন।
– নিয়ে গেছে?
এমন সময় সেই ডাক্তারও যাচ্ছিলেন এদিক দিয়ে।
– আরে আকাশ সাহেব! আপনার ওয়াইফের রিপোর্ট গুলো দেখালেন না?
তখন হাসপাতালের লোকটা বললো – স্যার উনার ওয়াইফ কাল রিপোর্ট নিয়ে গেছেন। কিন্তু উনি এখন রিপোর্ট নিতে আসছেন।
ডাক্তারকে খুব চিন্তিত মনে হলো।
– আপনার ওয়াইফ কোথায়?
আকাশ একটু ইতস্ততভাবে বললো – ওর বাড়িতে চলে গেছে। আমাকে কিছু জানায়নি।একটু ফ্যামিলি প্রব্লেম।
ডাক্তার বুঝতে পারলেন।।বললেন – আসুন আমার সাথে।
তারপর প্যাথলজিতে গিয়ে খোঁজ করলেন।
– গত পরশু একজন পেসেন্ট ছিলেন কাজল নাম। একটু সার্চ করে দেখবেন?
– স্যার ফোন নাম্বার টা বলুন।
আকাশের ফোন নাম্বার দেবার আগেই আমার নিজের নাম্বার দিয়েছিলাম।
তাই আকাশ আমার নাম্বার টা দিলো।
– জি স্যার। উনি দুই মাস আগেও এই টেস্ট গুলো করিয়েছিলেন ডা.আলতাফ নবী প্রেসক্রাইভডে।
– ডা. আলতাফ নবী! একটা কপি দিন প্লিজ! ইটস আর্জেন্ট!
কপি দিলেন তারা। হাসপাতালের সব রেকর্ড করে রাখা হয়।সব রোগীর রিপোর্ট একবছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়।পরের বছর নতুন করে আবার করা হয়।
– ধন্যবাদ।
ডাক্তারের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেছে।
– আকাশ সাহেব একটু কষ্ট করে আসুন আমার সাথে। আপনার সাথে দীর্ঘ দিনের পরিচয় আমার। তাই ব্যক্তিগত পরিচয় থেকেই আপনার জন্য খোঁজ নিচ্ছি।আসুন ডা.আলতাফ নবীর সাথে দেখা করতে হবে।
– ডা. আলতাফ নবীকে কাজল কেন দেখালো? উনি কিসের ডাক্তার?
– উনি একজন নিউরোলজিস্ট।
– নিউরোলজিস্ট? কিন্তু ডাক্তার…
– প্লিজ আসুন আমার সাথে।
আকাশ ডাক্তারের সাথে ডা.আলতাফ নবীর চেম্বারে যায়।
– স্যার এই রিপোর্ট গুলো দেখেন। কাজল নামের একটা মেয়ের। দুই মাস আগে আপনি এই টেস্ট গুলো করিয়েছিলেন।
ডা.আলতাফ নবী রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে বললেন – হ্যাঁ! আমি করিয়েছিলাম। আমার মনে আছে মেয়েটার কথা। কেন জানেন? মেয়েটা বলেছিলো ওর কেউ নেই, তাই রিপোর্ট গুলো ওর হাতেই দিতে হলো। মেয়েটা রিপোর্ট হাতে অনেক সময় এখানে বসে ছিলো। তারপর সেই যে গেছে আর আসেনি। আমার প্রায় ই মনে হয় মেয়েটার কথা। খুব খারাপ লাগে।
আকাশ কিছুই বুঝতে পারছে না। কি বলছে এসব ডাক্তার!
– ডক্টর, কি হয়েছে বলুন আমাকে? রিপোর্ট কি এসেছে?.
– আপনি কে? মেয়েটার পরিচিত কেউ?
– স্যার, উনি আকাশ চৌধুরী। মেয়েটার হাজবেন্ড।
– হাজবেন্ড! কিন্তু মেয়েটা যে বললো….. আই সি!
– ডক্টর প্লিজ বলুন কি হয়েছে। আমার খুব টেনশন হচ্ছে। প্লিজ বলুন।
ডাক্তার সাহেব একটু সময় চুপ থেকে বললেন – দেখুন আকাশ সাহেব, আমরা ডাক্তার।এধরনের কিছু বলতে আমাদেরও খারাপ লাগে কিন্তু কি করবো বলুন…. আপনার নিজেকে শক্ত রাখতে হবে…
– প্লিজ ডক্টর বলুন কি হয়েছে?
– আপনার ওয়াইফের যে লক্ষণগুলো ছিলো মাথাধরে থাকতো,কখনো খুব ব্যথা করতো,মাথা ঘুরতো,বমি বমি ভাব, হাত-পা অসার হয়ে আসতো এসব দেখে উনি মনে করেছিলেন প্রেগন্যান্সি! তাই অন্য একজন ডাক্তার দেখান।অই ডাক্তার সব শুনে সাথে সাথেই আমার কাছে রেফার করেন। আমি সব টেস্ট করিয়েছি।
এইসব লক্ষণ তারপর চোখে ঝাপসা দেখা সব কিছু আসলে প্রেগন্যান্সির জন্য নয়।
ডাক্তার আরো একটু সময় নিয়ে বললেন – আপনার ওয়াইফের ব্রেইন টিউমার! দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা গুলো হয়ে আসছে, কিন্তু উনি পাত্তা দেননি।’
আকাশের পায়ের নিচ থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে গেছে। ডাক্তারের চেম্বারেই কান্না শুরু করে।
– প্লিজ নিজেকে শক্ত রাখুন। আপনি ভেঙে পড়লে আপনার স্ত্রীকে কে সান্ত্বনা দিবে?
– আকাশ সাহেব আপনি যখন উনাকে নিয়ে এসেছিলেন তখন আমারও এমন সন্দেহ হয়েছিলো। তাই এতোগুলো টেস্ট করিয়েছি। আর তাই স্যারের কাছে নিয়ে এলাম।
আকাশ কান্নাভেজা কন্ঠে বললো – স্যার আমি তাকে কি সান্ত্বনা দিবো! সে গত দুইমাস এই খবর গোপন রেখেছে কাউকে বুঝাতেও দেয়নি!
আকাশ ব্রেইন ও স্পাইনাল সার্জন ডা. আলতাফ নবীর সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসে।
সবাই কেন তাকে ছেড়ে চলে যায়? আকাশের হাত-পা জমে আসছে।কিছু ভাবতে পারছে না আর।

এমন সময় সাইফের ফোন আসে।
– আকাশ ভাই।
– ‘সাইফ,বলো।’ ভেজা গলায় বললো আকাশ।
– আপুর অবস্থা খুব খারাপ।
– কি হয়েছে কাজলের? কাজল এখন কোথায়?
– আপু আমাকে ফোন করে ওকে নিয়ে যেতে বলে, ও রাস্তায় ছিলো। বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই বমি হয়েছে কয়েকবার,তারপর অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি হাসপাতালে নিয়ে আসছি।আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।
– কোন হাসপাতাল?
সাইফ হাসপাতালের নাম বলে ফোন রেখে দেয়।
এক মুহূর্ত দেরি না করে হাসপাতালে ছুটে আসে আকাশ। এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলে সবচেয়ে ভালো হাসপাতালে ইমারজেন্সি ট্রান্সফার করায়।
আমার জ্ঞান ফিরেছে। হাসপাতালে আছি বুঝতে দেরি হয়নি। একটু পর সাইফ আসলো। ওর চোখ দুটো দিয়ে পানি ঝরছে। বারবার চোখের পানি মুছে।
– কিরে? কাঁদছিস কেন? আমি এখন ভালো আছি। কান্না করার কি হলো?
– আপু, তুমি এমন কেন? সারাজীবন অন্যের কথা ভেবেই গেলে।
– কি হয়েছে তোর?
– কিছু হয়নি আমার।
সাইফ বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
পৃথিবীটা এতো নিষ্ঠুর কেন? কেন প্রিয়জনদের ছেড়ে এভাবে চলে যেতে হয়।

আমার শরীর যখন খারাপ ছিলো ভেবেছিলাম আমি কনসিভ করেছি৷ কিন্তু যখন রিপোর্ট হাতে পাই… আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। ডাক্তারের চেম্বারে অনেক সময় ধরে বসে ছিলাম। আমার বুঝি এটা বাকি ছিলো? আমি জানি আকাশ আমাকে কতটা ভালবাসে।আমাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না। শুধু শুধু ওকে আর কষ্ট দিতে চাইনা।এভাবে চলে এসেছি। আসলে কি করা উচিত আমি বুঝতে পারছিলাম না।আমার কাছে কোনো যুক্তি কাজ করছে না।
রিপোর্টের কথা কাকে বলতাম? মামার বাসায় বলে উনাদের কষ্ট দিতে চাইনি।আর আকাশ? এতো কষ্ট পুষে আছে, কি করে নিজের কথা বলে ওর কষ্ট বাড়িয়ে দেই? আমি ভাবতাম আমার কষ্ট আকাশ বুঝে না।কিন্তু তার মনে এই পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছে কে জানতো?
তাই চাইনি রিপোর্ট ওর হাতে পড়ুক।কিন্তু এখন যদি এখানে টেস্ট করায় তবে সবাই জেনে যাবে।

এমন সময় আকাশ কেবিনে ঢুকে। ওকে দেখে আমি অবাক হয়নি।নিশ্চয়ই সাইফ খবর দিয়েছে। আকাশের লাল চোখ দুটো ফুলে গেছে।
আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে বসলো। আকাশের অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট লাগছে আমার। ওর দিকে তাকাতে পারছি না। আকাশ আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
– এভাবে ফাঁকি দিতে চেয়েছিলে? কেন কাজল?
একটা বার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি তোমার?
আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আকাশও অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে।
তারপর চোখ মুছে বললো – কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি ডাক্তারে সাথে কথা বলেছি। তুমি একদম চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার এতো কষ্ট হচ্ছে যে মুখ দিয়ে কোনো কথা আসছে না।
একজন নার্স এসে একটা ইনজেকশন দিয়ে যায়।
আকাশ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। আমার চোখে ঘুম নেমে আসে।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here