রক্ষিতা পর্ব ৮

# রক্ষিতা
# Part- 8
# Writer – Taslima Munni

আমার একদিকে যেমন ভয় লাগছে,অন্যদিকে অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করছে আবার আতঙ্কিত হয়েও আছি! এ যেন এক মিশ্র অনুভূতি। ডাক্তার অনেক গুলো টেস্ট করালেন। সামান্য এই সমস্যার জন্য এতো টেস্ট করতে হবে কেন বুঝিনা। কিভাবে যে রোগীর কাছ থেকে টাকা নিবে সেই ধান্ধায় থাকে মনে হয়! এসব মনে মনে ভেবে বিরক্ত হচ্ছি।রিপোর্ট পরদিন দিবে তাই বাসায় চলে আসি।
সন্ধ্যায় আকাশ বাসায় ফিরে এসে দেখে আমি বিছানায় শুয়ে আছি।
– এই সন্ধ্যায় শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ?
– না মাথাটা ধরে আছে। তাই।
– রেডি হও, এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যাবো।
আমি যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম সেটা ওকে জানানো যাবে না। আর এখন নিয়ে গেলে আবার পরীক্ষা করবে আর কি রিপোর্ট আসবে সেটা আকাশ জেনে যাবে, কিন্তু আমি সেটা চাচ্ছি না।আর তাছাড়া সারাদিন শেষে বাসায় এসে আবার আমাকে নিয়ে বের হবে, সেটাও আমার খারাপ লাগবে। তাই বললাম
– আরে তেমন কিছু না। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। আজ ঘুমায়নি তাই মাথা ধরে আছে।
– ওহ! তাই বলো।
জানো, আর মাস দুয়েক এর মধ্যে হাসপাতালের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আমি খুবই এক্সাইটেড।
আকাশের চোখেমুখে খুশি, কত প্রাণখুলে মনে হয় হাসছে।

পরদিন আমি নিজেই রিপোর্ট আনতে গেলাম।
ডাক্তার বললো- আপনার গার্ডিয়ান কেউ আসেনি?
– ডক্টর, আমার আসার মতো কেউ নেই। তাই যা বলার আমাকেই বলুন।
ডাক্তার রিপোর্ট দিলেন আমার হাতে।
রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছি। আমি বসা থেকে উঠতে পারছিনা মনে হচ্ছে আমার। তারপর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম।আমার পা ভেঙে আসছে।
এখন কি করবো আমি?
এখন কাউকে কিছু বলা যাবে না। তারপর বাসায় ফিরে আসি।শোভা দৌড়ে আসে আমায় দেখে।
– ভাবি,ডাক্তার কি বললো?
আমি মৃদু হেসে বললাম – তেমন কিছুই না অতিরিক্ত টেনশনে নাকি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছি।
শোভার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম ও আশা ভঙ্গে ব্যথিত হয়েছে। তারপরও তাকে কিছু বলতে পারলাম না।

প্রায় দেড় মাস পরে হাসপাতালের কাজ শেষ হয়েছে। আকাশ আমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। হাসপাতাল তৈরি হয়ে গেছে, তবে চালু করতে আরোও চার-পাঁচ মাস লাগবে নতুন কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স নিয়োগের প্রসেস শেষ হতে।
আকাশের ব্যস্ততা এখন কমেছে।
আজকাল আকাশ অনেক খোশমেজাজে থাকে। কিন্তু আমার ভেতরে কি চলছে আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না।
আর মাত্র কয়েকটা দিন। দুই বছর পূর্ণ হলেই আমিও চলে যাবো আকাশের জীবন থেকে। কিন্তু আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন?
মনে হচ্ছে আমার ভেতর টা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষজন,এ বাড়ির ছাদ,বাগান সব কিছুর মায়ায় জড়িয়ে গেছি।
এরমধ্যেই আমার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। কাউকে কিছু বলতে পারছিনা।
আকাশের ব্যস্ততা এখন অনেক টা কম হওয়ায় বাসায় থাকতে পারছে অনেক সময়। আকাশ যখন দেখলো একদিন বমি করতে,তখন জিজ্ঞেস করলো-
– কি হয়েছে তোমার?
– তেমন কিছু না। হঠাৎ এমন হলো মনে হয় এসিডিটির জন্য।
আকাশ কিছু না বললেও, ওকে চিন্তিত মনে হলো। এরপরে একদিন আকাশ আমাকে নিয়ে বের হতে চাইছে, কিন্তু আমার প্রচন্ড মাথা ঘুরাচ্ছে যে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ক্লান্তিতে হাত-পা ভেঙে আসে আমার।নিজের ভেতরে নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু শরীর যেন মানছে না।

আজ সকালেও কেমন শরীর খারাপ লাগছে। বমি বমি ভাব, খুব কষ্টে আটকে রাখতে চাইলাম, কারণ আকাশ বাসায় ছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না!
হঠাৎ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কোনোরকমে বিছানায় এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি।মাথা ভার হয়ে আছে। কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাই বিছানার কিনারায়। আকাশ বেলকনিতে ছিল।সে দৌড়ে আসে।
– কাজল কি হয়েছে তোমার?!! কাজল?
আমি জ্ঞান হারাইনি।মাথা চক্কর দিচ্ছিলো।
– কিছু হয়নি।মাথা…
– আর কোনো কথা শুনবো না। এখনই যাবে আমার সাথে।
আকাশকে শত অনুরোধ করেও আটকাতে পারিনি। জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।
এদিকে টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ! যদি রিপোর্ট দেখে? কি হবে তখন?
যাবার সময় আকাশ বললো – কাজল।
– হুম?
– একটা কথা বলতে চাইছিলাম।
– বলুন।
মৃদু হেসে আকাশ বললো – আমার মনে হচ্ছে তোমার সমস্যা অন্যকিছু। আমাকে আবার নতুন করে বাঁধার কিছু করোনি তো?!!
আকাশের কথার মানে আমি বুঝতে পারছি। তাই কিছু বললাম না।
আমি অস্বস্তি বোধ করছি, আকাশ সেটা বুঝতে পেরে সেও আর কিছু বললো না।
ভাগ্য ভালো আগে যে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম সেই হাসপাতালে আসলেও ;সেই ডাক্তার না আজ অন্য ডাক্তার ছিলেন। আবারও টেস্ট করতে দিলো। করলাম। আকাশ বসে আছে রিপোর্ট নিয়েই যাবে।
কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। অনেক বুঝিয়ে আকাশকে রাজি করালাম, আগামীকাল আকাশ রিপোর্ট নিয়ে যাবে। অবশেষে আকাশ রাজি হলে বাসায় ফিরে আসি।

এদিকে আমার ভেতরে ঝড় বইছে। আর মাত্র একটা দিন।আকাশের সাথে সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে আমি চাইছিনা আকাশ কিছু জানুক।
পরদিন। আকাশ অফিসে চলে যায়, সেই সুযোগে আমি নিজেই রিপোর্ট নিয়ে আসি,তবে ডাক্তারকে আর রিপোর্ট দেখাইনি।কারণ ডাক্তার আকাশের খুব পরিচিত। আমি তো জানি রিপোর্ট কি এসেছে।
বিকেলবেলা আকাশ বাসায় ফিরে।আমাকে বললো রেডি হতে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রিপোর্ট আনতে যাবে।
এখন কি করবো? হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আকাশও বের হবার জন্য রেডি হচ্ছে, ঠিক তখনই একটা ফোন আসে।
রাগে আকাশের চোখেমুখ লাল হয়ে গেছে।
একটা বিষয় খেয়াল করলাম,একটা ফোন আসে মাঝেমধ্যে আর আকাশ এইভাবে রেগে যায়।
কে ফোন করে? আর আকাশই বা এভাবে রেগে যায় কেন? হাজার টা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে।
আমি রুমের চলে আসি। কিন্তু হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দেখি আকাশ চেয়ারে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে।
রাগে উচ্চস্বরেই কথা বলছে
– কি চাও আমার কাছে আমি সব বুঝি। একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি আমার সাথে আর ভুলেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। দাদু আমাকে যা যা দিয়ে গেছেন তার কানাকড়িও তোমাদের দিবো না। সব ভুলে যাও কিভাবে তোমরা? ওই মহিলা দাদুকে কম কষ্ট দেয়নি।
কি বললে? মা? হা… মা! আরে অই মহিলা আমাকে ঠিক মতো খেতেও দিতো না! কোথায় ছিলে তুমি তখন?
আমাকে আর কখনো ফোন দিবে না। তোমাদের উদ্দেশ্য আমার জানি। যোগাযোগ করতে চাইলে খুব খারাপ হবে। ‘
মোবাইলটা ছুড়ে ফেলে আকাশ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আমি কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত রাখি।
– আমাকে মা দেখায়! বাবার দায়িত্ব দেখায়!
আরে স্বার্থপরগুলো আমার দাদুর সম্পত্তির জন্য ফোন করে আমাকে। মা!…..
সারাক্ষণ এই বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকতো। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন উনাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। একটা বার আমার কথা ভাবলো না।আমার মা আমাকে ফেলে অন্য একটা লোককে বিয়ে করে দেশ ছেড়ে যায়।আর বাবা! উনার প্রেমিকাকে বিয়ে করেন!
আমি স্কুলে যেতে পারতাম না, বাসা থেকে বের হতাম না।বন্ধু-বান্ধবেরা হাসাহাসি করতো।পিছনে তো বলতোই সামনেও অনেক কিছু বলতো।স্কুল ছেড়ে দিতে চাইলাম, শুধু দাদুর জন্য পারলাম না। বাবা অই মহিলাকে নিয়ে আসে। তখন দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েন।ঐ মহিলা দাদুকে ঠিকমতো ঔষধও এনে দেয়নি,খাবার দেয়নি।বাবা এসবের কোনো খোঁজ রাখেনি। গফুর চাচা না থাকলে দাদু তখন মরেই যেতেন।খাবার খেতে একটু দেরি হলেই আমার সামনে থেকে খাবার নিয়ে যেত।
আমি সবার শেষে স্কুলে যেতাম, সবার পিছনে বসতাম, ছুটি হলে সবার আগে স্কুল ছাড়তাম, শুধু লজ্জায়!
দাদু যখন সুস্থ হয়ে উঠেন উইল করে সব কিছু আমার নামে করে দেন আর বাবাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন।
উনাদের অনেক আছে, অনেক থাকার পরেও দাদু আমাকে যা দিয়েছেন সেটা নেবার জন্য এখন বাবার দায়িত্ব ফলাতে আসে।
সব স্বার্থপর! সব। কাউকে চাই না আমার। আমি রাতে একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম।
– আকাশ শান্ত হোন আপনি।
– তুমি এখানে কি করছো? চলে যাও।তুমিও চলে যাও আমার সামনে থেকে। কাউকে চাই না আমার। কাউকে না। কেউ নেই আমার। চলে যাও।’
আকাশ নিজেই বের হয়ে চলে যায়।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here