রক্ষিতা পর্ব ৭

# রক্ষিতা
# Part – 7
# Writer – Taslima Munni

আমি ভাবছি তুলির কথাগুলো। আকাশ অফিস থেকে বের হবার পরই তুলি আমাকে ফোন দিয়ে বলে- মেডাম, আপনি অফিসে আসলেন না?
– তুলি আমি চাকরি টা আর করবো না।
– সেকি! কেন মেডাম?
– আমি আর করতে চাইছি না।
– মেডাম কাল যা হয়েছে তার জন্য সবাই লজ্জিত। আর আপনি যে স্যারের ওয়াইফ সেটা তো কেউ জানতো না।তবে আমি ভেবেছিলাম আপনি স্যারের গার্লফ্রেন্ড! হিহি..
স্যার কালকে যা কান্ড করলেন। আসলেই মেম আপনি অনেক লাকি স্যারের মতো হাজবেন্ড পেয়েছেন।।
– কি করেছেন উনি?
– আসলে কাল যা হয়েছে আমি সবটা দেখেছি, যখন স্যারকে জানাতে গেলাম, তখন আপনি চলে গেছেন। স্যার আসার পর অই লোক স্যারকে বলে – মি. আকাশ আপনার চয়েস আছে বলতেই হবে! আপনার মিসস্ট্রেস তো জোস!
স্যার তখন অই লোকের কলার ধরে বলে – কি বললি? লোকটা ভয় পেয়ে যায়। বলে – আপনার অফিসের তারাই বলেছে – মেয়েটা আপনার রক্ষিতা!
স্যার এলোপাতাড়ি মারতে থাকে লোকটাকে।
অনেক কষ্টে স্যারকে সবাই ফেরায়।
স্যার তখন অনেক চিল্লাচিল্লি করে। বলে – রক্ষিতা শব্দ টা কে দিয়েছে? যে রক্ষা করে সে-ই রক্ষিতা! কিন্তু অদ্ভুত এই সমাজ কো-ওয়াইফকে রক্ষিতা নামে ডাকে!
হা,কাজল আমার রক্ষিতা! কারণ আমাকে রসাতলে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছে।এখানে অনেক মানুষ আছে যারা আমার সুযোগ নিতে চেয়েছে, তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন সবাই – কাজল আমার বিবাহিতা স্ত্রী!
আর যারা এই অফিসে আমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, ষড়যন্ত্র করেছেন সবাইকে আমি চিনি,তাই আমি কোনো ব্যবস্থা নেবার আগেই কালকের মধ্যে স্বেচ্ছায় অব্যবহিত দিয়ে চলে যাবেন।
আর তুলি এখনই ফাইল রেডি করো এই চুক্তি বাতিল! যত টাকা লস হবে হোক! এই বাস্টার্ডদের সাথে কোন চুক্তি হবে না ভবিষ্যতেও না।
মেডাম! আমি তো হা করে স্যারের কথা শুনছিলাম। আপনাকে এতো ভালোবাসে! আপনাদের জুটি সেরা মেডাম। আর ডেইজিসহ দুইজন আজ চাকরি ছেড়ে চলে গেছে।
– থেংকস তুলি।তোমার স্যার এখন কোথায়?
– স্যার তো বেরিয়ে গেছেন একটু আগেই।

তুলির সাথে কথা বলার একটু পরই আকাশ এসে এখানে নিয়ে আসে।
যায়গাটা বেশ ভালো লাগছে আমার।
– কি ভাবছো?
আকাশের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো।
– কিছু না। দেখছি, খুব সুন্দর যায়গা।
– কাজল।
– হুম?
– আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে দেখছি, আমার বাবা মা খুব ব্যস্ত। আমাকে সময় দেবার মতো সময় উনাদের ছিলো না। চাকরদের হাতে বড় হয়েছি বললেই চলে। বাবা অফিস, ইনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আর মা! উনার ক্লাব,সমিতি! কত কিছু নিয়ে ব্যস্ত!
সারাদিনে শুধু ব্রেকফাস্ট করার সময় সবাইকে এক সাথে দেখতাম।তখন আমারও তাড়া স্কুলে যাবার। তারপর রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়তাম তখন উনারা বাসায় ফিরতেন।আমার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। যা চাইতাম, তাই পেতাম। অনেক টিউটর ছিলেন, তারা একজনের পর একজন আসতেন।বাবা-মা এসবের কমতি রাখেনি। তবে একটা বাচ্চার যে বাবা-মার প্রয়োজন সেটা তারা দিতে পারেনি।
তবে একজন মানুষ ছিলো, যাকে আকঁড়ে ধরে বেঁচে ছিলাম – আমার দাদু।
দাদু আমাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন, যাতে বাবা-মার অভাব বোধ না হয়। দাদু আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। আজ প্রায় পাঁচ বছর – দাদু আমাকে একদম একা রেখে চলে গেছেন।দাদুর চলে যাওয়ায় আমি বেপরোয়া জীবন যাপন শুরু করি।এইসব ব্যবসা শুধু দাদুর নাম রক্ষার জন্য আঁকড়ে আছি।
আরেক জন ছিলেন – গফুর চাচা! ছোট বেলা থেকে দাদু আর উনি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। আমি কিংবা দাদু কখনো উনাকে কাজের লোক মনে করিনি।
আকাশের কথা শুনে কি বলবো বুঝতে পারছি না। মৃত্যু এমন একটা বিষয়, যার সান্ত্বনা দেয়া যায় না। যার হারায় সে-ই বুঝে, আমিও বুঝি।
আকাশের বাসায় শুধু ওর দাদুর ছবি কেন সেটা এখন বুঝতে পারছি। কিন্তু ওর বাবা-মা?
– আপনার বাব-মাও কি?
– আমার কেউ নেই, কেউ ছিলো না।শুধু দাদু ছিলো, সে হারিয়ে গেছে!
আকাশের কথার কিছুই বুঝতে না পারলেও এটা বুঝলাম যে বাবা-মার প্রতি একটা কষ্ট আছে ভেতরে কোথাও। তাই এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।

কখন যে দেখতে দেখতে প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।ইদানীং শরীরটা একদম ভালো লাগছেনা।কেমন লাগে সেটাও আমি নিজেই বুঝতে পারছি না । আকাশ শুনলে হুলুস্থুল কান্ড বাধাবে, তাই ওকে কিছু বলিনি।মাথা ঝিমঝিম করে। অবশ্য মাথাব্যথা প্রায়ই হয়।হয়তো এজন্য মাথা ঘুরায়।
এদিকে আকাশ অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। ওর দাদুর নামে একটা হাসপাতাল তৈরি করছে। অফিস- হাসপাতালের কাজ সব তদারকি করতে গিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে। সেই সকালে বের হয়ে রাতে ফিরে। আর আমি সারাদিন বাসায় থাকি। মাঝেমধ্যে মামার কাছে যাই,কখনো সাইফ-সুমনা আসে।এর আগে আকাশ একদিন আমার মামা-মামিকে নিয়ে আসে।আমি এতো খুশি হয়েছিলাম উনাদের দেখে! কারণ আমি ভাবতে পারিনি আকাশ উনাদের নিয়ে আসবেন। মামা-মামিও এখানে এসে খুব খুশি। আকাশ
জোর করেই দুদিন উনাদের এখানে রেখেছে।

আগে যখন অফিসে যেতাম তখন এই বাসার যারা আছে তাদের সাথে মেশার সুযোগটা পাইনি তেমন। এখন হাতে প্রচুর অবসর সময় থাকায় আমি সংসারের সব দেখাশোনা করতে পারছি।যারা এখানে আছে প্রত্যেকেই খুব মিশুক। আগে আমারকে দেখে সবাই একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতো।এর কারণ যে আকাশ তা আমি বুঝতে পেরেছি আগেই। আকাশ আগে বাসায় একদম থাকতো না বললেই চলে, কিন্তু হাসপাতালের কাজ শুরু করার আগে আকাশ বাসায় প্রচুর সময় কাটিয়েছে। খুঁটিয়ে দেখেছে বাগানের প্রতিটি গাছ।এতে এ বাড়িতে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে আসে। এখন অনেক ব্যস্ত তাই সে সময় হচ্ছে না। কিন্তু আমি ভালোই সময় কাটাচ্ছি। শোভা নামের একটা মেয়ে আছে, গফুর চাচার মেয়ে।সেও এখানেই কাজ করে, সবার কাজের তদারকি করে।মেয়েটা ভারী মিষ্টি দেখতে আর ভীষণ মিশুক।আমার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে। আজ কাঁচা আমের ভর্তা,কাল তেতুল,কখনো বাগানের ডাসা পেয়ারা নিয়ে আসে আমার জন্য।
কেমন মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি এই সংসারের।
আকাশের প্রতি আমার ধারণা বদলে যাচ্ছে। কি জানি কেন সারাক্ষণ তার কথায় মনে পড়ে।
আমি কি আকাশের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি?
কি সব চিন্তা করছি আমি? আকাশকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি।না আকাশ আমায় ভালবাসে, না আমি আকাশকে।
দুই বছর পূর্ণ হলেই তো চলে যাবো এ বাড়ি থেকে।

আরও তিন মাস কেটে গেছে।এদিকে হাসপাতালের কাজ প্রায় শেষের দিকে। আকাশের ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেছে। ইদানীং আমার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মাথা ঝিমঝিম করে, মাঝে মধ্যে বমি বমি ভাব হয় খুব।
দুদিন বমিও হয়েছে। আজ যখন আকাশ অফিসে চলে যায়,খুব খারাপ লাগছিলো তাই শুয়ে ছিলাম অনেক সময়। তারপর যখন উঠে গেলাম মাথাঘুরে পড়ে যাই। তখন শোভা উপরে এসেছিলো, সে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি আরও অন্যদের ডেকে এনে রুমে নিয়ে মাথায় পানি দেয়।
কিছুটা সুস্থ বোধ করলেও শোভা জোর করেই ডাক্তারের কাছে পাঠায়। আমি একা যেতে পারবো না ভেবে সে নিজেও আমার সাথে আসে।
তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।
কিন্তু আমার ভীষণ ভয় করছে। শোভা যা ভাবছে সত্যিই যদি তা হয়! কি করবো আমি?
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here