রক্ষিতা পর্ব ৬

# রক্ষিতা
# Part -6
# Writer – Taslima Munni

বাসায় ফিরেও আকাশকে কোথাও পেলাম না। এদিকে ঘনকালো কালো মেঘ করেছে। একটু পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়।একা একা বসে আছি। ভালো লাগছেনা। এ বাড়িতে অনেক মানুষ, সবাই সময় মতো সব কাজ করে। আকাশের রুমের এদিকে তারা একটা নিদিষ্ট সময়ে আসে।তাছাড়া উপরে তারা তেমন একটা আসেনা।
আমি নিজে গিয়ে কখনো কথা বললেও তারা খুব গুটিয়ে থাকে। এটা আমার খুব খারাপ লাগে, তারা আমার উপস্থিতিতে জড়োসড়ো হয়ে যায়। এতো মানুষের ভীড়েও আমি একা।

বাবা-মার কথা মনে পড়ছে খুব।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছি, তাও মন খারাপ হচ্ছে। আমি আবার অনেক গান শুনি। মনে হয় গান শুনেই বেঁচে আছি। মন খারাপ হলেই আরও বেশি গান শুনি। রুমে এসে একটা গান প্লে করে আবার বেলকনিতে আসি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির হালকা ঝাপটা চোখেমুখে লাগে। অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে। তখন এই একটা গান আমার চোখ ভিজিয়ে দেয়। মফস্বলে বড় হয়েছি আমি। বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন। যখন ছুটিতে আসতেন বাড়িতে, মনে হতো আমাদের বাসায় ঈদ! বাবার আদরের রাজকন্যা আজ… নিয়তি কোথায় কোথায় নিয়ে যায়। মামির সংসারে লাথি-ঝাটা খেয়ে আজ আকাশের হাতের পুতুল!
ভীষণ মনে পড়ছে বাবা-মার কথা।
‘কেন তোমরা আমাকে ফেলে চলে গেলে? যাবেই যদি নিয়ে যাওনি কেন সাথে? ‘
এই গান আমার কলিজ্বায় লাগছে।

“কাটেনা সময় যখন আর কিছুতে
বন্ধুর টেলিফোনে মন বসেনা
জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা
মনে হয় বাবার মত কেউ বলেনা
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…
আয়রে আমার সাথে গান গেয়ে যা
নতুন নতুন সুর নে শিখে নে
কিছুই যখন ভাল লাগবেনা তোর
পিয়ানোয় বসে তুই বাজাবিরে
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…
.
সিনেমা যখন চোখে জ্বালা ধরায়
গরম কফির মজা জুড়িয়ে যায়
কবিতার বইগুলো ছূঁড়ে ফেলি
মনে হয় বাবা যদি বলতো আমায়
আয় খুকু আয়…….
দোকানে যখন আসি সাজবো বলে
খোঁপাটা বেঁধে নেই ঠান্ডা হাওয়ায়
আরশিতে যখন এই চোখ পড়ে যায়
মনে হয় বাবা যেন বলছে আমায়
আয় খুকু আয়…

হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরে তাকিয়ে দেখি আকাশ এসেছে। উষ্কখুষ্ক চুল, চোখ লাল।
নিজের অজান্তেই আকাশের মনে কষ্ট দিয়েছি ওর বাবা-মার কথা বলে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি আমার চোখ মুছে নিলাম। এমন আকাশ এসে এমন ভাবে হাতে চেপে ধরলো, খুব ব্যথা পাচ্ছি, কিন্তু মুখে বলতে পারছিনা।
– এই মেয়ে, তুমি কি মনে করো নিজেকে?তুমি আকাশকে বদলে দিবে? ইমোশনাল করে দিবে? নো! নেভার! আকাশ যেমন ছিলো, তেমনই থাকবে।’
ব্যথায় চোখে পানি চলে আসে। আকাশ হাতটা ছেড়ে চলে যায়।
আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি।

মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি আকাশ নেই বিছানায়। ভাবলাম হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। কিন্তু অনেক সময় পরেও যখন এলো না, আমি তখন উঠে গেলাম। উঠেই একটা হুঁচোট খেলাম।ড্রিম লাইটের হালকা আলোয় দেখি আকাশ বিছানা সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে দুই হাঁটুতে হাত রেখে মাথা গুঁজে আছে। আমি বেশ অবাক হলাম। কাছে যেতেই বুঝলাম আকাশ কাঁদছে!
আমার ভীষণ মায়া হচ্ছে আকাশের জন্য। কেন জানি মনে হচ্ছে আকাশও আমার মতোই অসহায়। আস্তে করে কাঁধে হাত রেখে বিছানার কিনারায় বসলাম। আকাশ কেন কাঁদছে? কি বলে সান্ত্বনা দিবো?
আকাশ আমার দিকে তাকায়নি, শুধু একটু সরে এসে আমার কোলে মাথা গুঁজে আমাকে আঁকড়ে ধরে অবুঝ শিশুর মতো কাঁদতে থাকে।
– কি হয়েছে আকাশ? আপনি কাঁদছেন কেন?
আকাশ কোনো কথা বলে না। আমি ওর মাথায় হাত রাখি। কি বলবো, বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। একটা সময় আকাশ শান্ত হয়ে যায়। চুপচাপ শুয়ে থাকে।
কিছু সময় পরে আকাশকে বিছানায় নিয়ে এলাম।একেবারে বাধ্য শিশুর মতো সে এসে শুয়ে পড়ে।

বেশ কয়েকটি মাস কেটে যায়। অফিসের লোকদের বাঁকাদৃষ্টিতেও আমি চাকরিটা করছি।
এরমধ্যেই একদিন অফিসে পার্টির আয়োজন করা হলো। নতুন একটা কোম্পানির সাথে চুক্তি উপলক্ষে এই আয়োজন। সবদিক বিবেচনা করে আকাশ সন্ধ্যায় পার্টি রাখে। অফিসে আলাদা হলরুম রয়েছে, সেখানেই এই পার্টি, কনফারেন্স হয়ে থাকে। পার্টিতে সবাই ব্যস্ত। আকাশ ও নতুন যারা গেস্ট তাদের সময় দিচ্ছে। আমি একপাশে সরে চুপচাপ দেখছি।কিছু সময় তুলির সাথে গল্প করলাম। আকাশ তুলিকে ডাকতেই তুলি একটা কাজে চলে যায়।
এমন সময় এই অফিসের একটা লোক এসে উনার সাথে ড্যান্স পার্টনার হতে বললো। আমি খুব ভদ্রভাবেই উনাকে রিজেক্ট করলাম।উনি চলে গেছেন। কিছু সময় পর গেস্টদের মধ্যে একজন এসে অফার করলেন। সেটাও আমি রিজেক্ট করে বললাম – এক্সকিউজ মি! আমি এসবের সাথে কম্ফোর্টেবল নই।ধন্যবাদ।
ডেইজি কোথা থেকে এসে বললো – ঢং দেখে বাঁচি না! যত্তসব ন্যাকামি!
স্যারের সাথে থাকতে তো লজ্জা করে না। ধোয়া তুলসীপাতার ভাব নিয়ে লাভ নেই,স্যারের সাথে যে রাত কাটাও সেসব খবর আমরা জানি।
ডেইজির কথা শুনে আমার কানদিয়ে মনে হচ্ছে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে!
– ডেইজি!
নিজেকে সামলাতে না পেরে চড় দেয়ার জন্য হাত তুলতেই ডেইজি আমার হাত ধরে ফেলে।
– হয়েছো তো স্যারের রক্ষিতা! সাহস হয় কি করে আমার গায়ে হাত তোলার?
তখন দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বললো- তাই নাকি? আকাশ সাহেবের পছন্দ আছে বলতে হবে। ইউ আর সো সেক্সি! তা আমি একবার একটু পরখ করে দেখতে চাই। আকাশ সাহেব পুরো সপ্তাহে যা দেয়, আমি এতরাতে তার দ্বিগুণ দেবো।প্লিজ আপত্তি করবেন না।
এক মুহূর্ত আর সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। মুখে হাত চেপে দৌড়ে বের হয়ে আসি। আকাশ কোথায় নামিয়েছে আমাকে! কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। রাস্তায় হাঁটছি আর চোখ মুছি বারবার।এই ছিলো আমার কপালে?
আকাশ এটাই কি তবে চেয়েছিলো? কিছু ভাবতে পারছিনা। ইদানিং মাথা ভীষণ যন্ত্রণা করে,মাথা ঘুরায়।এখনো আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে।
এমন সময় আকাশের গাড়ি আমার সামনে এসে থামে। আকাশ বেরিয়ে আসে,আমার হাত ধরে বলে – চলো আমার সাথে।
– কোথায়?
– অফিসে।
ঝাটকা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দেই।রাগে আমার চোখে আগুন জ্বলছে।
– কেন? আরও ক্লাইন্ট আছে নাকি আপনার? যারা উনাদের সাথে রাত কাটানোর অফার করবে।
আকাশ ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় আমার গালে।
– চুপচাপ আমার সাথে চলো।
– যাবো না আমি। কোথাও যাবো না।
আকাশ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলতে তুলতে বললো – সবাই জানুক তুমি কে।সবার জানা প্রয়োজন।
– কি জানাবেন? আমি আপনার দুই বছরের চুক্তি করা বউ? আপনার ব্যবসায় যেমন চুক্তি করেন,আজ এটার সাথে- চুক্তি শেষ হলে কাল নতুন কোনো কোম্পানির সাথে!
সবাইকে এটাই জানাতে চাইছেন?
– একদম চুপ থাকো তুমি। চুপচাপ বসে থাকবে।
– ভুল কি বলছি? তারাও ভুল কিছু বলেনি।আপনার চুক্তি শেষ হলে আরেক জন আমাকে একমাসের জন্য চুক্তির অফার করতে পারে! একজন তো একরাতের অফার করলো!
– এই মেয়ে, চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথাও বলবি না।
আকাশ ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো।
আমি কেঁদেই যাচ্ছি।
আকাশ আমাকে অফিসে না নিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। বাসায় আসার সাথে সাথে আমি দৌড়ে রুমে চলে আসি।
মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।আকাশও আমাকে ডাকেনি।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো। আকাশ অফিসে যাবার জন্য রেডি।আকাশকে বললাম
– আমি চাকরি টা করবো না।
– কেন? ওদের জন্য চাকরি ছেড়ে দিবে?
– না। আমি নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আকাশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো – ঠিক আছে। তুমি করতে না চাইলে জোর করবো না। তারপর সে চলে যায়।
লাঞ্চের পরে আকাশ ফিরে এসে বললো – তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, একটু বের হবো।
– কোথায় যাবো?
– এতো প্রশ্ন করো কেন? রেডি হতে বলেছি তাড়াতাড়ি।
শহরের বাইরে এক শান্ত নদীর পাড়ে নিয়ে আসে আমায়।অদ্ভুত সুন্দর, শান্ত,সবুজ এই যায়গা নিমিষেই মন ভালো করে দেয়।
– আমার যখন খুব বেশি মন খারাপ লাগে পার্টি,ক্লাব,বন্ধু- বান্ধবও বোরিং মনে হয়; তখন এই যায়গায় চলে আসি।
– আপনার অনেক পছন্দের যায়গা?
– হুমম।
চুপচাপ বসে আছি দুজন গাছের ছায়ায়। বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে নদীর পানি দেখছি।
আমি ভাবছি তুলির কথা। আকাশ অফিস থেকে বের হবার পরই আকাশের পি.এ. তুলি ফোন করে আমাকে।।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here