রক্ষিতা পর্ব ৫

# রক্ষিতা
# Part- 5
# Writer- Taslima Munni

আমি হঠাৎ ওর এমন চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেছি। ফোনটা আসার পর আকাশের চোখেমুখে ভয়ংকর ক্রোধ দেখেছি। এরপর সারা সন্ধ্যা আকাশকে কোথাও দেখতে পাইনি। অদ্ভুত একটা মানুষ আকাশ। কখন ভালো করে কথা বলে, কখন চট করে রেগে যায় বোঝা দায়।
এই বাড়িতে আসার পর আকাশের পরিবারের কোনো লোকজন, কাউকে দেখিনি। অনেক গুলো কাজের লোক আছে। তারাও আমাকে দেখে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে থাকে। আকাশকে যে জিজ্ঞেস করবো ওর পরিবারে কে আছে, সে সুযোগ ও হয়ে উঠেনি।

বেশ রাতে আকাশ ফিরে আসে। আমি রুম থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন টলতে টলতে আকাশ রুমে ঢুকে। টাল সামলে না পেরে পড়তে গিয়ে আমার উপরে ঢলে পড়ে। ধরে নিয়ে বিছানায় কোনোরকমে শুইয়ে দিয়ে আমি চলে আসবো, তখন আমার হাত টেনে ধরে বললো – কোথায় যাচ্ছো? এসো।
কি পরিমাণ ড্রিংকস করেছে কে জানে!আমি কিছুতেই হাত ছাড়াতে পারছি না। উল্টো টানাটানি করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে তার উপরে পড়ে গেছি।মদ্যপ অবস্থায় আকাশ কতটা হিংস্র হতে পারে তা খুব করে বুঝলাম।
মনে তীব্র কষ্ট নিয়ে তার পাশবিকতা দেখলাম। নিয়তি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না,তবে এটা জানি যে, আকাশের হাতের পুতুল করে দিয়েছে।
পরদিন ব্রেকফাস্ট করে আকাশ অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। সকাল থেকে কোনো কথাই বলেনি আমার সাথে। রেডি হতে হতে বললো – ‘তোমার আজ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। দুদিন পর থেকেই যাবে। রেস্ট নাও। ‘
আমি শুধু চেয়ে দেখলাম,কিছু বললাম না।

দুদিন পর আমি অফিসে আসি আকাশের সাথেই। অফিস আসলাম, কিন্তু একটা অস্বস্তি বোধ করছি।আমি বুঝতে পারছি আমার চারপাশে আড়ালে কানাঘুঁষা চলছে। দু’একটা কথা যে কানে আসেনি তাও নয়।
আকাশের কেবিনে যাচ্ছিলাম, কে যেন নিচুস্বরে বলছে
– এসেই স্যারকে তো হাত করে নিয়েছে।
– ঠিক বলেছেন। দেখে তো মনে হয় না ভাজা মাছ উল্টাতে পারে। আজ দেখলাম স্যারের গাড়ি করে এসেছে! ‘
আমি শুনেও না শোনার ভান করে চলে আসি।মনটা আরও খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে কত সমালোচনা চলছে।
ফেরার সময়ও আকাশের গাড়ি করেই ফিরতে হলো।
পরদিন অফিসে যাবার আগে আকাশকে বললাম – আমি আপনার সাথে যাবো না। আপনি চলে যান।আমি অন্য গাড়িতে চলে যাবো।
আকাশ একটু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো – কেন? কি সমস্যা?
– সমস্যা কিছু না।
– কেউ কি কিছু বলেছে?
– কেউ কিছু বলেনি।তবে প্রতিদিন আপনার একজন পি.এ আপনার গাড়ি করেই যাবে-আসবে, সেটা তো দৃষ্টিকটু হবেই।
– দেখো কাজল,তুমি চাকরি টা এখন না করলেও পারো,তোমার যা প্রয়োজন, যত টাকা প্রয়োজন নির্দ্বিধায় নিতে পারো।কিন্তু আমি চেয়েছি তুমি চাকরি টা করো তোমার নিজের জন্য।না করতে চাইলেও জোর করবো না।
তবে অফিসে যেতে হলে আমার সাথেই যাবে।’
অগত্যা ওর সাথেই গেলাম।
ডেইজির চোখ থেকে ঘৃণা আর আগুন বের হয় সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। অফিসে অন্যকেউ কিছু বলার আগে সেই কথা ডেইজি সবার কানে পৌঁছে দেয়।আর পৌঁছাবেই না কেন? তার পোস্ট টা আকাশ আমাকে দিয়েছে।চাইলেই আর যখন তখন আকাশের কেবিনে যেতে পারছেনা।
কিন্তু পরদিন অফিসে এসে দেখি আমার কেবিনে অন্য একটা মেয়ে।
আমি ঢুকতেই সালাম দিয়ে বললো
– ম্যাম, আমি তুলি, আকাশ স্যারের পি.এ.।আপনি আসুন আমার সাথে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটা অন্য একটা কেবিনে নিয়ে যায় আমাকে।
– মেম, আজ থেকে আপনার কেবিন এটা।
– আমার কেবিন মানে?
-আজ থেকে আপনি কোম্পানির জি.এম.। তাই নতুন কেবিন আপনার জন্য।
মেয়েটা খুব হাসিখুশি। দেখে বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে। তুলি হাসিমুখে বেরিয়ে যায়।
আকাশ কি শুরু করেছে এসব।এমনিতেই নানান কথা উঠছে, তার উপর এখন এই কাজ করলো! সবাই কি ভাবছে কে জানে।
আমি সাথে সাথেই আকাশের কেবিনে যাই।
– কি শুরু করেছেন আপনি?
– কি করেছি?
– জি.এম. করেছেন আমাকে? মানুষ কি ভাববে ভেবে দেখেছেন?
– কে কি ভাবলো তাতে আকাশের কোনোদিন কিচ্ছু যায়-আসেনি, আজও যায়- আসেনা।
– কিন্তু আমার যায়- আসে। আমি সাধারণ ঘরের মেয়ে।আমাকে মানুষের সামনে দাঁড়াতে হয়।
– দাঁড়াও।কে মানা করেছে। তবে ভুলে যেওনা আমি যা বলবো তুমি তা-ই করতে হবে।
এই লোকটার সাথে কথা বলাই বৃথা। আমার কেবিনে আসার সময় শুনলাম
– স্যারের বাসায় নাকি একটা মেয়ে থাকে। আমার পরিচিত একজন নাকি প্রতিদিনই দেখে এক সাথে সন্ধ্যায় যায় আর সকালে একসাথে বেরিয়ে আসে।
– আরে এসব বড়লোকদের ব্যাপার- স্যাপার। টাকা কোথায় কিভাবে খরচ করবে আর কাকে কোথায় রাখে সে সব আমাদের ভাবনার বাইরে।
– মেয়েটা কেমন চিন্তা করেছেন।স্যারের বাসায় থাকে। স্যার তো বিয়েই করেনি।
– আরে টাকার জন্য এসব মেয়েরা সব করতে পারে।

আর কিছু শোনার সাহস হয়নি আমার। বুঝতে পারছি তারা এখনো জানে না সেই মেয়েটি আমি। এতটা জেনে গেছে আর কয়েকদিনের মধ্যে এটাও জেনে যাবে। আর কিছু ভাবতে পারছিনা।
চাকরিটা না শেষ পর্যন্ত ছাড়তে হয়। যতক্ষণ বাইরে ব্যস্ত থাকি ভালো থাকি।চাকরি ছেড়ে আকাশের প্রাসাদে বন্দী হয়ে থাকতে চাইনা।
দম আটকে মরে যাবো।
আরও একটা সপ্তাহ ভালোই কেটে যায়। আকাশও এরমধ্যে এমন কিছু করেনি।আমিই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি এই বাড়ি আর আকাশের সাথে অফিস।
আরও বেশ কিছুদিন কেটে যায়। আকাশকে এতো টা স্বাভাবিক আগে দেখিনি। আমার সাথেও কোন মিসবিহেইভ করেনি।
তারপর একদিন রাতে আকাশ বিছানায় হালকা হেলান দিয়ে বসে আছে। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির আভা।
আমিও বিছানায় বসে চুল ঠিক করছি, শুবো।তখন মনে হলে আমার ঘাড়ে কিছু একটা আছে। আমার হাত কাঁপতে থাকে। ভয়ে ভয়ে হাত দিয়ে ঝাড়তেই আমার সামনে এসে পড়লো। আমি চিৎকার করে আকাশকে জড়িয়ে ধরি,চোখ আর খুলি না। মাকড়সা আমি এতো ভয় পাই।আমি আর চোখ খুলে দেখার সাহস করছিনা।
আকাশও সুযোগ বুঝে জড়িয়ে ধরে বলে – আদর খেতে ইচ্ছে করছে তো মুখফুটে বললেই পারো! এতো নাটক করে আমার বুকে আসার দরকার ছিলো না। একবার বলেই দেখতে।
আকাশের কথার মানে বুঝতে না পারলেও চোখ মেলে বুঝলাম আমি ওকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছি…
আস্তে আস্তে বললাম – নাটক মানে? আমার গায়ে মাকড়সা!
– এটা?
তাকিয়ে দেখি মাকড়সা আকাশের হাতে!
আমি চিৎকার করে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।
– আরে.. ছাড়ো, ছাড়ো। দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো।
এটা ফেলে দিয়েছি।
– কি?সত্যি?
তাকিয়ে দেখি নেই। যাক বাবা বেঁচে গেছি।এতোক্ষণে মনে পড়লো আমি এখনো ওকে ধরে রেখেছি।এবার লজ্জা পেয়ে গেছি।আস্তে আস্তে ওকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আকাশ ছাড়ছে না।
– ছাড়ুন।
– তুমিই তো ধরেছিলে আমি কি ধরতে বলেছিলাম? আদর পেতে নাটক করলে।
– ছিঃ কীসব যা-তা বলছেন।।
– যা সত্যি তা-ই। এখন তো আর ছাড়াছাড়ি নেই।
আজ এক অন্য আকাশকে আবিস্কার করলাম। বিয়ের পর যতবার সে কাছে এসেছে প্রতিবার আমি নরকের যন্ত্রণা ভোগ করেছি। কিন্তু আজ তার স্পর্শে অন্যকিছু ছিলো। নিজের অজান্তেই আমি আবেশে বন্দী হয়ে যাচ্ছি।
কি করছি আমি? মনে পড়তেই সরে যেতে চাইলাম।
– এই মেয়ে! এতো হাত-পা ছুড়াছুঁড়ি করলে মাকড়সা লাগিয়ে দিবো।এইযে ওখানে রাখা আছে।
তাকিয়ে দেখি সত্যিই সাইড টেবিলে রাখা!
ভয়ে হাত-পা জমে আসে। এই লোকের বিশ্বাস নেই,সত্যি – সত্যিই দিবে।
আমার মাথা তখন অন্যদিকে যাচ্ছে। আজ আকাশের ছোঁয়ায় আমি যেন ঘোরে ডুবে যাচ্ছি। সত্যিই অন্যরকম ভালোলাগার ঘোরে ডুবে গেলাম।

সকালে যখন ঘুম ভাঙে নিজেকে আকাশের বুকে আবিস্কার করলাম।উনিও জড়িয়ে রেখেছেন। গতরাতের কথা মনে পড়তেই নিজেই লজ্জা পেলাম। আকাশের হাত সরাতেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বসে এলোমেলো নিজেকে গুছাতে ব্যস্ত।আকাশ ঘুমু ঘুমু চোখে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে।
হঠাৎ মাকড়সার কথা মনে পড়তেই তাকিয়ে দেখি এখনো সেখানেই আছে।
– মরে গেছে নাকি?
– কি?
– রাতের মাকড়সা টা।নড়াচড়া করছে না। এখনো এক যায়গায়ই আছে!
– বোধহয় মরে গেছে। তোমার চিৎকার শোনার পর এটা হার্ট-অ্যাটাক করে মারা গেছে নিশ্চিত।
আকাশের ঠোঁটের কোনে একটা চাপা হাসি আমার কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে।
উঠে এগিয়ে গিয়ে কাছ থেকে দেখলাম। নাহ, নড়াচড়া নেই। আরও ভালো করে খেয়াল করে দেখি এটা নকল!
তারমানে আকাশ ইচ্ছে করে করেছে এসব!
চোখ পাকিয়ে আকাশকে বললাম – আপনি! আপনি ইচ্ছে করে ভয় দেখিয়েছেন এই রাবারের মাকড়সা দিয়ে।
– আমি মোটেও এসব করিনি। তুমি করেছো।তুমি আদর খেতে চেয়েছো এজন্য সব নিজে সাজিয়েছ,আর এখন আমার দোষ দিচ্ছো।এখন সব বুঝতে পারছি আমি।’
আকাশের কথা শোনে রাগে ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়ি।

অফিসে যাবার পথে আকাশকে বেশ ফুরফুরে মনে হলো।আকাশের অনেক কিছুই এখনো আমার অজানা। কত রূপ দেখেছি এই মানুষটার।
– আচ্ছা আপনার বাসায় আপনার নিজের কোনো মানুষজন নেই কেন? কোনোদিন আপনার বাবা-মায়ের কথা শুনিনি। আর একটা বিষয় খেয়াল করলাম, সারাবাড়িতে উনাদের কোনো ছবি নেই কেন?
– আমার কেউ নেই।
মুখশক্ত করে জবাব দেয় আকাশ। তারপর আর কোনো কথায় বলেনি।তবে তার চেহারার রং পাল্টে গেছে এটা চোখে পড়ার মতো। তাই আমিও আর ঘাটাইনি।হয়তো আমার মা-বাবার মতো উনারও….
শুধু শুধু মনে কষ্ট দিলাম উনার।
অফিসে পৌঁছে আকাশ আমার আগে গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে চলে যায়।
তারপর যতক্ষণ অফিসে ছিলো সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে ছিলো।যে সামনে যাচ্ছে সে-ই তোপের মুখে পড়ছে। লাঞ্চের আগেই বেরিয়ে যায় আকাশ।
অফিস শেষে বের হয়ে দেখি আমার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে,কিন্তু আকাশ নেই।
বাসায় ফিরেও আকাশকে কোথাও পেলাম না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here