রঙ বেরঙের খেলা পর্ব -১২

#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১২

নিজের সর্বস্ব দিয়ে দ্রুত বেগে চলতে চাইছে সাবিহা। উদ্দেশ্য একটাই। ইজ্জতটা সঁচয় করা। সভ্য না হয় ছিলো স্বামী। কিন্তু পেছনে ক্রমাগত ছুটে আসা ছেলেটা যে নরপিশাচের মতো। রাস্তা শুনশান। যেন অভাগীকে দেখে সাগর তার বুকের পানি লুকিয়ে ফেলেছে। না জানি এই অভাগি কতটাই পানি না তার শেষ করে বসে। সবিহা অসীম অসহায়ত্ব নিয়ে এক সময় ডেকে উঠলো চিৎকার করে। ‘সভ্য ভাই’ বলে চিল্লিয়ে উঠলো। সম্মুখের মৃদু আলো আধো অন্ধকারে কাউকে দেখা যায় না। তবুও সাবিহা ডাক দিলো এই আশায়, যদি সভ্যর কানে পৌঁছে যায় ডাক। তিন চারটা ডাক দিয়ে সাবিহা আবার পেছন ফিরে চাইলো। আজিজ এবার খুব নিকটে। ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় সাবিহার দেহের শক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে। রাস্তার একপাশে বিল। বড়সড় এক অন্ধকার বিল। সাবিহা একটা সময় স্থির করলো সভ্যর আগমন না ঘটলে, আর আজিজের হাতের নিচে পরলে সে ঝাপ দিবে এই বিলের মধ্যে। গভীরতা কম হবে না। সাবিহা সাঁতার জানে না। প্রয়োজনে প্রাণ দেবে সে কিন্তু বিভৎস, নোংরা পরিস্থিতির শিকার সে কোনোভাবেই হবে না। সাবিহার এমন ভাবনার মাঝেই আচমকা পায়ে শক্ত চোখা কিছু এসে আঘাত করলো। সাবিহা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আজিজ শক্ত মোটা এক কাঁচা ডাল ছুড়ে দিয়েছে তার দিকে। হেতুতে তার গতি রোধ হলো। ধপ করে পিচ ঢালা রাস্তায় পরতে পরতে বেঁচে গেলেও আজিজের হাত থেকে তার বাঁচা হলো না। খপ করে ধরে ফেলেছে সে হাত। সাবিহা কুলহারা হয়ে কান্নায় ভেঙে পরলো। আজিজ তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে কিছু বের করছে। সাবিহা তার উদ্দেশ্য ধরতে পারলো না। ইতিমধ্যে দুটো ট্রাক ছুটে গেলো তার পাশ ঘেঁসে। সাবিহা রেহাইয়ের জন্য মিনতি কিংবা আকুতি করতো আজিজের কাছে কিন্তু তার আগেই নিষ্ঠুর, পিচাশ আজিজ স্প্রে করলো ক্লোরোফর্ম। কুয়াশা নেমে এলো সাবিহার চোখে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসাড়তা, মস্তিষ্কে অবচেতন ভাব নেমে আসছে। ঠিক পূর্ণ জ্ঞান হারানোর বুঝি সেকেন্ড দুইয়ের আগে কানে এলো ঘৃণা আর গুপ্ত ভালোবাসায় রাখা মানুষটার কন্ঠ। সভ্য সাবিহা বলে ডেকে উঠেছে। সাবিহা একান্তই চাইলো ছুটে সভ্যর কাছে যেতে। কিন্তু তা অসম্ভব। সে দেহের ভারসাম্য ছেড়ে দিচ্ছে। শেষ ক্ষণে এসে বুঝলো তার মাথা পতিত হলো শক্ত এক বুকের মধ্যে।

সাবিহা গা এগিয়ে দিতেই সভ্য তড়িঘড়ি করে আমলে নিলো শুকনো দেহটা। হুমড়ি খেয়ে পরে আছে সাবিহা তার বুকে। আজিজ সভ্যকে দেখেই পালাতে ব্যস্ত। সেকেন্ড লাগেনি তার সাবিহা কে ছেড়ে উল্টো পথে দৌড়াতে। সভ্যর আজ মেজাজ উগ্রে গেলো আজিজকে দেখে। ক্রোধে কাঁপন ধরেছিল তার দেহে। অণুতে সাবিহার দশা তার ক্রোধকে নিস্তেজ হতে বাধ্য করলো। সভ্য আর খামোখা ডাকলো না সাবিহাকে। সে দেখেছে আজিজ ক্লোরোফর্ম স্প্রে করেছে। সাবিহার জ্ঞান ফিরতে অন্তত দশ মিনিট লাগবেই। সভ্য ভাবনা চিন্তা অতি সামান্য করেই কোলে তুলে নিলো সাবিহাকে। আচমকা সে পরখ করলো তার মন ঈষৎ অশান্ত। কি আশ্চর্য! তার হৃদপিণ্ডের গতি হওয়ার কথা বাঁধন ছেড়া। আক্রোশে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসার কথা। কিন্তু এসবের একরত্তি ছাড়া দু রত্তি অনুভূতি হচ্ছেই না। শুধুই মনে হলো আজিজ নোংরা একটা কাজ করেছে। একটা মেয়ের মানের উপর থাবা দেওয়ায় সে শাস্তিযোগ্য। একটা শিক্ষা তাকে দিতে হবে। সভ্য ভাবনার মাঝে চলতি পথে চাইলো সাবিহার মুখের পানে। বুকের সাথে সেঁটে আছে। হুঁশ জ্ঞান তার দেহ হতে বিচ্যুত। সভ্য হাসলো হঠাৎ। তার বুকে এক টুকরো জ্বালাপোড়া লুকোচুরি খেলছে। হাঁটার গতি হঠাৎ মন্থর হচ্ছে। মুখে আপনা আপনি এসে গেছে

— সাবিহা, তুমি যে এখন একটা কালো মানুষের বুকের মধ্যে আছো, তার কোলে উঠে বাসায় যাচ্ছো তোমার অবজ্ঞা আসছে না?

সাবিহার পক্ষ হতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সভ্য জানে সাবিহা অচেতন। কিছু শ্রবণ করতে পারবে না, কিছু জবানে আনতেও পারবে না। তবুও সভ্য অবুঝের মতো দ্বিতীয়বার বুকের চিনচিন অনুভূতি থেকে বিলাপ করে বলল

— তুমি গায়ের রং নিয়ে কেন অহংকার করো বলোতো? আজকে না তোমার বিপদ হয়েছিল ভাগ্যিস আমি কোনো রিকশায় উঠিনি। তোমার ডাক শুনতে পেয়েছিলাম। এরপরও তুমি এমন থাকবে? দেখো, আমরা তো কালো হয়ে পৃথিবীতে আসতে চাইনি। নিজের রং নিজে দেইনি। তুমি এতো অপমান কেনো করো সবাইকে? কালোরা কি মানুষ না? ওদের কি ভালোবাসা যায় না?

আবেগের ঢেউয়ে বেড়িয়ে এলো কথাগুলো সভ্যর অন্তর হতে। সাবিহার সবই রইলো অজানা। সে তো বেশ করে যে বুকে ছুরি চালিয়েছিলো আজ সে বুকেই আশ্রয় পেতে গুটিশুটি হয়ে লেপ্টে আছে।

.
অন্ধকার ফালি দিয়ে বুকে অচেতন সাবিহাকে নিয়ে সভ্য বাসায় ফিরলো প্রায় দশ বারো মিনিটেরও পরে। ততক্ষণে জ্ঞানে ধ্যানে সাবিহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ। সভ্য নীরবে পথ দেখে সাবিহাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। সাবিহা হুঁশ ফেরার পর হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে কি ঘটে গেছে। পরিপ্রেক্ষিতে সে আর মুখ খোলেনি। একটা কথাও ব্যায় না করে গুটিশুটি হয়ে সভ্যর বুকে মাথা রেখে অজান্তে পরখ করেছে সভ্যর হৃৎস্পন্দন।

— দরজাটা ধাক্কা দাও তো, সাবিহা।

দরজার বহির্মুখে এপাশে দাড়িয়ে সভ্য ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বলল কথাটা। সাবিহা মুখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি দিলো দরজার দিকে। হালকা ভিড়িয়ে রাখা দরজা। সাবিহা একহাতে ধাক্কা দিলো। দরজা অভিমানে যেন ধীর গতিতে সরে গেলো। সভ্য পা বাড়িয়ে সাবিহাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ কালে শুধালো

— ড্রয়িং রুমে বসবে নাকি নিজের ঘরে?

— আপনি এতো স্বাভাবিক কিভাবে? আপনার কি রাগ হচ্ছে না ডিরেক্টরের ছেলের উপর?

প্রশ্নের পিঠে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন সাবিহার। সভ্য ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পরলেও পরক্ষণে সাবিহাকে নিয়ে সাবিহার ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল

— হচ্ছে

সাবিহার মন অসন্তোষ হয়ে গেলো। কেমন গা ছাড়া ভাব সভ্যর।

— হচ্ছে না আমি জানি। অসভ্য মানুষদের মনে মায়াদয়া ভালোবাসা থাকে না।

সাবিহার আক্রোশের বাক। সভ্য এ কথার পিঠে জবাব দিলো না। ইচ্ছে হচ্ছে না তার সাবিহার সাথে অহেতুক তর্কবিতর্ক করার। অলক্ষ্যে সময় ও মেজাজ দুটোই বিগড়ে যাবে।

— আপনি কি চলে যাবেন?

বিছানায় বসিয়ে দিতেই সাবিহা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সভ্যর দিকে। সভ্য সাবিহা থেকে সরে গিয়ে লাইট ফ্যানের সুইচ অন করতে করতে বলল

— না যাচ্ছি না। তুমি রেস্ট নাও।

— আমার ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। ভয় লাগে।

— আচ্ছা। ছোট মা, রওনক কোথায় গেছে?

— দিনাজপুর। বাবার ওখানে।

সভ্য আর কিছু জানতে চাইলো না। পকেট থেকে ফোন হাতে নিয়ে ধীর পায়ে চলে গেলো সাবিহার বেলকনিতে। তার কাল থিয়েটারের শুটিং আছে। স্ক্রিপ্ট গুলো দেখে রাখা দরকার।

সভ্য যখন পা বাড়ালো বেলকনির উদ্দেশ্যে তখন সাবিহা আচমকা নেমে পরলো বিছানা থেকে। হেতু বিহীন। সভ্যর পিছু পিছু গিয়ে অবস্থান নিলো বেলকনিতে। ঠিক বেলকনিও বলা যায় না। গ্রীল লাগানো এক অর্ধবৃত্ত ছোট বারান্দা। ঘর থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আসা মৃদু আলোয় চোখ দেখলো সভ্য দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে মসৃণ সচ্ছ টাইলসের মেঝেতে। সাবিহাও ভাব জ্ঞান, কান্ড পরিস্থিতি মাথায় না নিয়ে ধীর পায়ে গিয়ে বসে পরলো সভ্যর পাশাপাশি। খুব নিকটে। যেন পাশ ফিরতেই আচমকা সভ্যর সাথে সংঘর্ষ হয়ে যাবে। সভ্য বুঝলো না সাবিহার এহেন কান্ডর কারণ। কিছুটা অবাকতা আর বেশ খানিকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে ডুবে আছে। সাবিহা চাইলো না সভ্যর পানে। সে নিচু হয়ে আসা অতি কোমন কন্ঠে বলল

— আচ্ছা সভ্য ভাই, সুষ্মিতা যখন আপনার সাথে শুটিং করে তখন আমার বুকের মধ্যে এতো কষ্ট হয় কেন?

অত্যন্ত আবেগ নিয়ে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো সাবিহা। সভ্য তড়াক করে চমকে উঠলো। সে বিস্মিত সাবিহার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে। শুধুই বিস্মিত নয় তার চোখ জুড়ে অবিশ্বাস্য। সাবিহা আপন অনুসন্ধানের কোনো প্রকার জবাব না পেয়ে পাশ ফিরে চাইলো। সভ্যর ওষ্ঠ আর অধরের মাঝে কঞ্চিত ফারাক জন্মেছে। সাবিহা আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। বসুন্ধরার সমস্ত বিতৃষ্ণা কুড়িয়ে এনে বাঁকে ঝাড়িয়ে বলল

— প্রকৃতির নিয়ম খুব নিষ্ঠুর। আমি না হয় ভুল বশত নিজেকে নিয়ে অহংকার করতাম। তাই বলে এভাবে আমায় শাস্তি দিতে হবে?

সভ্য সাবিহার কথার অর্ধাংশের অর্থ উদ্ধার করতে পারলো। শুধুই বুঝলো সাবিহার অহংকারে হয়তো ঘুনে ধরেছে। কিন্তু ঘনে কোণ খানে? বুঝতে পারলো না সভ্য। সে প্রশ্ন করতে চাইলো সাবিহাকে। মুখে কথা আনতেই আচমকা বাঁধা পরলো। তার মুঠোফোন বেজে উঠলো ক্ষীণ সুরে। সভ্য বাধ্য হলো মাথা হতে প্রশ্ন ছুড়ে ফোনের দিকে। সাবিহাকেও ততক্ষণে নজর দিয়েছে সভ্যর ফোনের স্ক্রিনের উপর। দুজনের মাঝে পায়ের নিকট সভ্যর ফোন ছিল। সাবিহা দেখলো তারবিহীনভাবে যোগাযোগ করার জন্য যে মানুষটা আকুল হয়ে সভ্যকে ফোনের মাধ্যমে ডাকছে সে এই জগতের একজন বিরাগের ব্যাক্তি। সাবিহার চোখের বিতৃষ্ণা সুষ্মিতা। সাবিহার কষ্ট আর রাগ একত্রে তেড়ে এলো। সভ্য হাত বাড়িয়েছে ফোনের দিকে। নাগাল পেতে না পেতেই সাবিহা আক্রোশে এক অস্বাভাবিক কান্ড করলো। ঝট করে ডান হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে অজ্ঞান দিকে ছিটকে দূর করিয়ে দিলো ফোন। সভ্য পৃরায় চমকে উঠলো। সাবিহার বাহ্যব্যাপহারে সে এবার রেগেই গেলো। সাবিহা এতো বেয়াদব কেন? কিছু বলতে চেয়েও বলল না সভ্য। নীরবে রাগ মনে চেপে উঠার জন্য প্রস্তুত হতেই অকস্মাৎ টান পরলো শার্টে। সাবিহা চিকচিক করা চোখ নিয়ে অন্যথায় দৃষ্টি রেখে সভ্যর বুকের মাঝে শার্টের একাংশ টেনে ধরে বলছে

— ওর সাথে আপনি কথা বলবেন না। আমার সহ্য হয় না। দুই দুইটা সর্বনাশের কারণ হয়ে এখন আপনি ঢং করবেন? আমি মানবো না।

চলবে…..

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here