রাজমহল পর্ব -১৫ ও শেষ

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৫/অন্তিম পর্ব

বাচ্চাটাকে টেনে হিঁচড়ে পা থেকে কোনোরকমে ছাড়িয়ে দূরে যেতেই এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হলাম। অনিক ভাই আর হাসিবের লাশটা পর্যায়ক্রমে ঘুরতে লাগল শূন্যে। বাচ্চাটার বিভৎস হাসি চারদিকে বাজতে লাগল। এমন সময় ঘরটা হালকা আলোকিত হলো। মনে মনে একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম একটু আলোর আভা পেয়ে। তবে সন্ধিকে উঠে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম ক্রমে ক্রমে সন্ধির চেহারাটা বিভৎস হতে চলেছে। চারদিকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করতে চেয়েও পারছিলাম না। সন্ধিও এবার ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। সন্ধি হাসিব আর অনিক ভাইয়ের লাশটা নিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে উপর থেকে নীচে আঁচড়ে ফেলল। সাথে সাথে লাশগুলো দুটো ভাগ হয়ে গেল। একদিকে মাথা ঝুলছে অপরদিকে বাকি অংশ। মাথাটা শূন্যে উঠে ঘুরছে আর চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। ঘূর্ণনের গতি বাড়ার সাথে রক্তও প্রবল বেগে বাড়তে লাগল। চারদিকে রক্ত যেন ছিটকে ছিটকে পড়ছে। এদিকে বাচ্চাটাও খিল খিল করে অদ্ভুত ভাবে হাসছে। বাচ্চাটার হাসিতে যেন পুরো ঘর কাঁপছে।

সন্ধি এদিকে ভয়ানক রূপ নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে আসছে। এদিকেও বাচ্চাটাও গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। আমরা পিছুতে নিলাম। তারা এগুতে লাগল। পিছুতে পিছুতে হাসিব আর অনিক ভাইয়ের মাথাবিহীন শরীরে পা আটকে তাদের উপরেই পড়ে গেলাম। মাথাবিহীন লাশের হাত পা গুলো আমাদের ঝাঁপটে ধরল। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। চারদিকে বাচ্চার খিলখিল হাসি সন্ধির ভায়ানক রূপ আর মাথাবিহীন লাশের ঝাঁপটে ধরায় যেন দম আটকে যাচ্ছিল। এর মধ্যে বাচ্চাটা এসে আমার বুকের উপর উঠে বসল। দম নিতে যেন এবার আরও কষ্ট হচ্ছিল। আর এদিকে সন্ধি তার বিভৎস চেহারা নিয়ে আপুর গলা চেপে ধরল। অনিক ভাই আর হাসিবের মাথাটা ততক্ষণে আরও জোরে ঘুরতে লাগল।

চারদিকে এতই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বর্ণণা করা দুষ্কর। বাচ্চাটা আমার বুকের উপর উঠে আমার মুখে হাত দিয়ে আঁচড় কাটতে লাগল। তার মুখের ভেতর থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল।আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। হাসিবের মাথাবিহীন শরীরের হাতগুলো আমাকে ততক্ষণে ঝাঁপটে ধরে নিস্তেজ করে ফেলল। অপরদিকে সায়রা আপুরও একই হাল। সন্ধি আপুর গলাটা চেপে এমন ভাবেই ধরল যে আপুর মুখ থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল। মনে হলো আপু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। তবুও সন্ধি আপুর গলাটা ছাড়ল না। আপুর গলাটা সন্ধির হাতের চাপে দুভাগ হয়ে গেল। আর এদিকে আমিও নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলাম। চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। জীবনের শেষ প্রহরটা গুণতে লাগলাম।

এমন সময় মনে হলো চোখে একটু আলোর ঝলক এসে পড়ল। আলোর ক্ষুদ্র রেখায় চোখটা ঝাঁঝিয়ে উঠছে৷ মনে হলো শরীরে বেশ শক্তি পাচ্ছি। বাচ্চাটাও আস্তে আস্তে আমার উপর থেকে সরে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম শূন্য হয়ে আছে। সায়রা আপু,সন্ধি,বাচ্চাটা,মাথাবিহীন হাসিব আর অনিক ভাইয়ার লাশটাও নেই। আমি মেঝেতে শুয়ে হালকা চোখে তাকিয়ে দেখলাম জার্নিভা আমার সামনে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম

– বাকিরা কোথায়? তারা কী মারা গেছে? তোমার একটা প্রতিশোধের জন্য হাসিবের মায়ের বুক খালি হলো,অনিক ভাইয়ার মায়ের বুক খালি হলো। সায়রা আপুর জীবন গেল,সন্ধিও মারা গেল। ওরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করে নি। তাহলে তাদেরকে এত শাস্তি কেন পেতে হলো?

কথাটা শোনে জার্নিভা চুপ হয়ে থাকল কিছুক্ষণ তারপর বলল

– সত্যিই এটা আমার অন্যায় হয়েছে। যা হয়েছে মোটেও উচিত হয়নি। একজনের দোষের ভার অন্যজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আমাকে ক্ষমা করো। কাহিনির ইতি টেনে দিলাম। ঐ বাচ্চাটা আর আসবে না। ঐ বাচ্চাটা ধ্বংস হয়ে গেছে।

জার্নিভা আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময় আমি চিৎকার করে চেঁচিয়ে বললাম

– এখন ক্ষমা চেয়ে লাভ কী বলো? যা যাওয়ার সে তো চলেই গেছে। আমার প্রিয়জনকে তো আর ফিরে পাব না।তাদের তো আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী? আমাকেও মেরে ফেলো।

বলেই জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। কান্না কান্না চোখে তাকিয়ে দেখলাম জার্নিভা উধাও হয়ে গেছে। তার মানে আমি আমার প্রিয়জনগুলোকে আর ফিরে পাব না। কলিজাটা দুইভাগ হয়ে চৌচির হয়ে গেল মনে হচ্ছে। এতটা কষ্ট হচ্ছে বলে বুঝানো সম্ভব না। কান্নাটা আরও প্রবল হতে লাগল। আরও জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। নিঃশব্দ চিৎকারটা যেন এবার স্বশব্দে হলো। এমন সময় মনে হলো কেউ একজন আমাকে ধাক্কাচ্ছে বেশ জোরে সোরে। আমি কোনো রকমে চোখটা মেলে অবাক হয়ে গেলাম। সন্ধি আমার পাশে বসে আছে। আমি শুয়া থেকে তড়িঘড়ি করে উঠলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক। সন্ধি আমার অবস্থা দেখে বলল

– আপু কী হয়েছে তোর? আর এভাবে তাকিয়ে কী দেখছিস?

আমি সন্ধির কথার ভ্রুক্ষেপ না করে পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম

– কিছুই হয়নি। প্র্যাগনেন্সি কিট টা কোথায়?
– কেন বালিশের নীচেই তো।
-বের করতো দেখি।

সন্ধি আমার কথা শোনে বালিশের নীচে থেকে কিট টা বের করে হাত দিয়ে চোখের সামনে ধরে বলল

– এই যে কিটটা। আমি কি এখন টেস্ট করাব?

সন্ধির কথা শোনে বুঝতে পারলাম মনের উদ্ভট চিন্তা থেকে ঘুমানোর পর আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু স্বপ্নটা পুরোই বাস্তবিক মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছে এটা বাস্তব কোনো ঘটনা ইতোমধ্যে আমার সাথে ঘটেছে।আমি হালকা একটা দম নিলাম। এর মধ্যেই সন্ধি আমার বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল

– আমি কি পরীক্ষা করাব এখন?

আমি সন্ধির মাথায় জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বললাম

– আপুর কিট আপুর ঘরে রেখে আয়। এত পাকনামি করতে হবে না। বয়স কত তোর এখনেই এত পাকনামি করছিস। যা রেখে আয়।

সন্ধি আমার কথা শোনে চোখটা নীচে নামিয়ে আপুর রুমের দিকে যেতে লাগল। আর এদিকে আমি চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক কোনো অস্বাভাবিকতার চিন্হ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। স্বপ্নের কথা মনে হয়ে এখনো আমার শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে হাসিবকে কল দিলাম। কিছুক্ষণ কথা বললাম। হাসিব ও ঠিক আছে। চারপাশ আলোকিত হতে লাগল। সন্ধি আমার থাপ্পর খাওয়ার পর এখনো মুখ গোমরা করে আছে। মনে মনে ভাবলাম থাকুক মুখ গোমরা করে। যে স্বপ্ন দেখেছি তারপর এমন অদ্ভুত মনের ইচ্ছা পূরণ করার কোনো শখ নেই। এদিকে আপু নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে লাগল। দৌঁড়ে গেলাম খাবার টেবিলে। আপুর মুখে হাসির রেখা দেখে বুঝতে পারলাম আপু প্র্যাগনেন্ট। নতুন অতিথি আসতে চলেছে আমাদের ঘরে।

নাস্তা শেষে রুমে এসে বাইরে তাকাতেই চমকে গেলাম বেলী ফুল গাছটা দেখে। এ গাছটা তো এখানে ছিল না। তাহলে আসলো কী করে? তার মানে ঐটা আমার স্বপ্ন ছিল না বাস্তব কোনো ঘটনা ছিল? ভাবতেই গা শিউরে উঠল।আর কিছু বলার সাহস হচ্ছে না কাউকে।চুপ করে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম হোক এটা আমার স্বপ্ন বা বাস্তব সব ঠিক হয়ে গেছে এটাই বেশি। এর মধ্যে কলিং বেল বাজতে লাগল। দরজা খুলতেই খেয়াল করলাম অনিক ভাই এসেছে। দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। জানি না ঘটনাটা বাস্তব ছিল নাকি স্বপ্ন।শুধু মনে মনে চাচ্ছিলাম এমন ঘটনা বাস্তব তো দূরে থাকে স্বপ্নেও যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

সেদিনের পর থেকে তৃতীয় লিঙ্গে যারা আছে তাদের কখনো অসম্মান করে কথা বলেনি। তাদের কষ্টটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি।আজকে সাতমাস পর আমাদের #রাজমহলটা নতুন সাজে সাজল। কারণ আমাদের ঘরে একটা পিচ্চি এসেছে। পিচ্চিটাকে নিয়ে আদর করছিলাম। এমন সময় কিছু হিজরার আগমনে আপু আকস্মিক ভয় পেয়ে যায়। আমি আপুর হাতটা ধরে বললাম ওরা শুধু শুধু কিছু করবে না আমি ওদের চিনি। আমার চেনা ওরা। বেশ কয়েকবার রাস্তাঘাটে দেখাও হয়েছে।কিছু টাকা থাকলে ওদের দিয়ে দাও। হিজরা গুলো এসে আমাকে দেখে মুচকি হেসে বলল

– খালামনি হয়ে গেছিস তো এবার মিষ্টি খাওয়া।

আমি হালকা হেসে বললাম

– কেন খাওয়াব না অবশ্যই খাওয়াব।

বলে কিছু মিষ্টি নিয়ে দিলাম। তারা মিষ্টি খেল।তারপর আপু টাকা দিল। তারা টাকাগুলো নিয়ে আপুর মেয়েকে দিয়ে বলল মা টাকে কিছু কিনে দিস আমরা এ টাকা নিব না বলেই চলে গেল। সন্ধি আমার পাশেই বসে আপুর মেয়েকে আদর করতে লাগল। আমি আলোকিত রাজমহলের ছাদে উঠতেই জার্নিভাকে দেখে থমকে গেলাম। জার্নিভা আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে উধাও হয়ে গেল।

ভাবতে লাগলাম সত্যিই কী সেটা আমার স্বপ্ন ছিল নাকি সত্যি। বিষয়টা বেশ দ্বিধায় ফেলে দেয় আমাকে মাঝে মাঝে। কত রহস্যই না ঘেরা এ #রাজমহলে।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here