রুপালির রূপ পর্ব -০১

– আপনার বয়স কত হয়েছে বলুন তো! আশি পেরোবে বছর ঘুরলেই,অথচ আপনার নাতির বয়সী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন?

হানিফ সওদাগর ও রাইয়ান শেখ কথা বলছিলেন ড্রয়িংরুমে বসে। আচমকা মেয়েলি কন্ঠ শুনে বিস্মিত নয়নে সেদিকে তাকিয়ে দেখে এক অল্প বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে। হানিফ সওদাগর গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

– রুপালি নিজের রুমে যাও, বড়দের মাঝে কথা বলা বেয়াদবি। কেন এসেছো এখানে?

– আব্বা, দয়াকরে বেয়াদবি নিবেন না। তবে জানতে চাচ্ছি আমি কি বোঝা হয়ে গিয়েছি যে এই বুড়ো লোকটার সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন?

– রুপালি চুপচাপ নিজের রুমে যাও।

উচ্চকন্ঠে হানিফ সওদাগর গর্জে ওঠে। রুপালি মুখ ভেঙচে রুমে চলে আসে।

– আহা হানিফ! কি শুরু করলে? বাচ্চা একটা মেয়ে!

– কাকু তুমি জানো না ও কত বড় ফাজিল একটা মেয়ে! এ অবধি কতগুলো বিয়ে ভেঙেছে হিসেব নেই।

– এবার কোথায় যাবে? এবার ওর কোনো অজুহাত কাজে দিবে না।

রাইয়ান শেখ হাসতে লাগলেন।

—–

রুমে এসেই নখ কামড়ে উপায় খুঁজতে লাগলো রুপালি। তবে এতবড় অপমান করার পরেও যদি বিয়েটা না ভাঙে তবে কি করবে সেটাই ভাবছে। মিসেস রেহানা রুপালির রুমে এসে দেখে নখ কামড়াচ্ছে। মিসেস রেহানা ধমক দিয়ে বললেন,

– রুপালি কি অবস্থা? নখ খাচ্ছো কেন?

– আম্মি, আমার প্রাণের আম্মি ওই বুইড়া লোককে আমি বিয়ে করবো না।

– ওনার সাথে বিয়ে হবে না, বিয়ে হবে ওনার ছেলের সাথে।

– মানে? তার বয়স কত?

– এই ধরো, চুয়াল্লিশ হবে।

রুপালি হুট করেই ঢলে পরলো। মিসেস রেহানা চট করে আগলে নিলেন। যখন বুঝতে পারলেন কেন জ্ঞান হারিয়েছেন তখন নিঃশব্দে হাসলেন। বিছানায় শুইয়ে বাইরে চলে আসেন।

—–

হানিফ সওদাগরের সামনে এসে সালাম দিলো রাদ। রাদকে দেখে ওষ্ঠে হাসি ফুটলো তার। সালামের জবাব দিয়ে বসার জন্য বললেন। রাদ বসার পরেই রাইয়ান শেখ বলেন,

– দাদুভাই, যাকে তোমার জন্য ঠিক করে সেও তোমার মতোই ত্যাড়া। তাই ভেবেছি কাটা দিয়ে কাটা উঠাবো। তুমি রুপালিকে সোজা করে ফেলবে আর রুপালি তোমাকে সোজা করবে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না?

রাদ চওড়া হাসি দেয়। বলে,

– তোমার যেহেতু এতই কাটা দিয়প কাটা তোলা দেখার শখ, তাহলে আর বারণ করবো কেন! দশটা নয় একটা মাত্র দাদু বলে কথা!

———

রুপালির জ্ঞান ফেরে সন্ধ্যার দিকে। চারদিকে আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে। জ্ঞান যাওয়ার আগের মূহুর্ত মনে হতেই আরো একটা জ্ঞান হারাতে ইচ্ছে করছিলো। তবে উপায় নেই। ক্লান্ত দেহ নিয়ে ডাইনিংয়ে আসে। সবাই সন্ধ্যার নাস্তা করছে। সবার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই এতক্ষণ রুপালি এখানে নেই বলে কারো চিন্তা হচ্ছিলো। হতাশ হয়ে চেয়ার টেনে বসে রুপালি। মিসেস রেহানা রুপালির দিকে তাকিয়ে বলে,

– কাল শপিং আমাদের সাথে যাবে?

– কীসের শপিং?

– তোমার বিয়ে,হলুদ,মেহেদী অনুষ্ঠানের জন্য সবাই শপিং করবো।

– আমাকে বিয়ে দিবে অথচ আমার মতামত নেয়ার প্রয়োজন মনে করছো না?

হানিফ সওদাগর গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

– না,মনে করছি না। কারণ অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলাম তোমার মতামত৷ সেটার যথাযথ মূল্যায়ন তুমি করো নি। কারো ঠোঁট কালো, কারো চোখের মনি বেশী কালো,কারো কন্ঠ বেশী মোটা এসব অজুহাতে তুমি আমাদের নাক কেটে বিয়েতে অমত প্রকাশ করেছো। সেগুলো তোমাকে দেয়া আমাদের মূল্যায়ন, এবার আর তোমার কথা শুনবো না। আমাদের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিতে হবে।

– মানবো, তাই বলে ওই বুড়ো লোকটার ছেলের সাথে?

– যে হোক পাত্র! তুমি বিয়ের দিন দেখবে এটা তোমার শাস্তি।

রুপালি কষ্ট ভরা কন্ঠে বললো,

– আব্বা, প্লিজ এমন করবেন না।

হানিফ সওদাগর কথা বাড়ালেন না। অন্যরা নিজেদের কথায় মশগুল হলো।

———

– দাদু মেয়েটার যদি বিয়েতে মত না থাকে তাহলে কেন তাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে?

– দাদুভাই রুপালি ছেলেদের পছন্দ করে না। বিয়েটা করতে চায় না কারণ সেই ছেলে কেমন না কেমন হয় সেই ভয়ে! এই ভয়টা সব মেয়েদেরই থাকে তবে পরিবার বুঝে কেউ সেটা প্রকাশ করে কেউ চুপ থাকে।

রাদ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনে বলে,

– ঠিকাছে দাদু। তবে আমার মনেহচ্ছে একবার সম্মতি জানা উচিত।

রাদের মা মিসেস রাহি শশুড়ের নিকট এসে বলেন,

– বাবা, আপনি সম্মতি দিলে আমি আর মাহি একবার রুপালিকে দেখতে চাই।

– সম্মতির কি আছে বউমা, তোমার ছেলের বউ তুমি তো দেখতে যাবেই।

মিসেস রাহি খুশিমনে মাহির রুমে যায়। মাহিকে ডেকে বলে,

– রেডি হয়ে নে, আমরা কিছুক্ষণ পরে রাদের জন্য পাত্রী দেখতে যাবো।

– সত্যি? তবে ভাইয়ের পছন্দ যদি না হয়?

– তোমার খুঁতখুঁতে ভাইয়ের জন্য তোমার দাদু খুঁতখুঁতে মেয়েই খুঁজে রেডি করে রেখেছে।

– বাহ! দশে দশে বিশ, মিটবে ঝালের হিশ।

——–

কলিংবেলের শব্দে রুপালি এসে দরজা খোলে। সামনে অপরিচিত লোক দেখে সরে দাঁড়ায়। ভিতরে আসতে বলে নিজে ড্রয়িং রুমে এসে বসে। মিসেস রেহানা এসে দেখে মিসেস রাহি এসেছেন। তিনি হাসিমুখে আলিঙ্গন করেন। রুপালি তব্দা দিয়ে তাকিয়ে আছে। মাহি রুপালির কাছে এসে বলে,

– ওওও, তুমিই তাহলে সেই মেয়ে!

রুপালি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

– তুমি আমার কোন জন্মের পরিচিত গো?

মাহি হেসে ফেলে,বলে,

– আসলেই তোমার কথায় দাদার মতো কোনো রসকষ নেই।

রুপালি কাঁদো মুখ নিয়ে বলে,

– তোমরা কেমন গো বলো তো? তোমার ওই বুড়ো দাদুর জন্য আমার মতো কচি মেয়ে ঠিক করলে?

মাহি বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে। মিসেস রেহানা এসে বলে,

– তুমি আমাদের কথার অনেক অবাধ্য হয়েছে তাই তোমাকে শাস্তিস্বরূপ মাহির বুড়ো দাদুর সঙ্গে বিয়ে দিবো।

মাহি চট করে বুঝে ফেলে রুপালিকে জানায় নি তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে হবে,বলেছে দাদুর সাথে বিয়ে হবে। বিষয়টা ভেবেই মাহি খিলখিলিয়ে হেসে দেয়।বলে,

– বেশ বানাবে গো।

রুপালি রেগে আগুন হয়ে রুমে চলে আসে। মুখে হাসি ঝুলিয়ে মিসেস রেহানা মিসেস রাহিকে বসতে বলেন। খাদেমা খালাকে ডেকে নাস্তা দিতে বলেন। নিজেও বসেন আড্ডায়। মিসেস রাহি বলেন,

– আপনার মেয়েটা আর আমার ছেলেটা দু’টোই বেশ বদমাশ। সবার শুধু খুঁত খুজে বের করবে। বেশ হবে এবার।

———

রুপালি রুমে এসে কাঁদতে থাকে। কিছুতেই মানতে পারছে না ওই বুড়ো লোকটার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবে কেনই বা এত পাত্র নিজ ইচ্ছায় রিজেক্ট করলো!

———–

সকাল সকাল ঘুম ভাঙে রাদের। নিজের সহধর্মিণীর জন্য নিজের পছন্দের কেনাকাটা করতে বের হবে সে।

নাস্তা করে বেরিয়ে পরে শপিংমলের উদ্দেশ্যে।

রুপালির বাড়িতে তান্ডব চলছে। সকাল হতেই শপিংমলে যাওয়ার জন্য রুপালিকে তাড়া দেয় সবাই। তখনই চিৎকার করে বলে,

– কোনো কিছুর দরকার নেই আমার। যেখানে জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্তে আমার মতামত নলয়ার প্রয়োজন মনে হয় নি সেখানে সামান্য একদিন পরার জন্য পোষাক কেনার ক্ষেত্রে আমার সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন নেই।

রুপালির কথা শুনে রুপালিকে রেখেই সবাই বেড়িয়ে পরে।

সবাই যাওয়ার পরে রুপালি সারাঘরে পায়চারি করে বেড়ায়। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।

——-

দুই পরিবারের সদস্য একসাথে হয়ে কেনাকাটা আরম্ভ করে।

রাদও যোগ দেয় তাদের সাথে। এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে নিজের সহধর্মিণীকে। কোথাও না দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। মিসেস রেহানাকে বলে,

– মা, রুপালিকে দেখছি না কোথাও, ও আসে নি?

– না বাবা, ও আসে নি। জেদ ধরে বাসায় থেকে গিয়েছে।

রাদ নিচুস্বরে বলে,

– কি মেয়েরে বাবা! আমার চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে।

রাদ সবার থেকে বিদায় নিয়ে রুপালি সাথে দেখা করতে রুপালিদের ফ্লাটে আসে। কলিংবেল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

রুপালি চিন্তা বাদ দিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দ্রুত পা ফেলে দরজা খুলে দেখে অপরিচিত যুবক দাঁড়িয়ে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

– চাই কি এখানে? কলিংবেল দিচ্ছেন কেন?

রাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

– কেন আমাকে চেনেন না?

– চিনলে কি আর বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখি?

রাদ ভাবুক মনে রুপালির দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে…?
রুপালির রূপ
#

#সাইয়্যেদাতুন_নেছা_আফনান

পর্ব:১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here