রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -২৩+২৪

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat

(দুঃখিত আগের পোস্টটা ডিলিট হয়ে গেছে।🥺)

“আশু কি হয়েছে তোর?? হঠাৎ করে এভাবে কান্না করছিস কেন??”

আরশিকে কোনো কথা বলতে না দেখে নীলার অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। নীলা আরশির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে চিন্তিত গলায় বললো-

“আশু আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। প্লিজ তুই বল আমাকে কি হয়েছে!!”

আরশি বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল-

“আমাকে মাফ করে দিস নিলু।”

নীলা আরশিকে জোর করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। আরশি মাথা নিচু করে চোখেরজল ফেলছে। নীলা আরশির দু কাধে হাত রেখে অস্থিরতা সাথে জিজ্ঞেস করল-

“কিসব আবল-তাবল বলছিস?? কি হয়েছে আমাকে একটু বল প্লিজ। এভাবে কান্নাকাটি করছিস কেন??”

আরশি খানিকটা সময় নিয়ে জড়তার সাথে বলল-

“আমাকে মাফ করে দিস নিলু। আদ্রাফ আর কাসফিকে এক করতে গিয়ে আমি জেনে শুনেই তোকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কিন্তু আমি কি করবো বল আমি তো ইচ্ছে করে তোকে কষ্ট দিতে চাইনি। ওরা দুজন একে অপরকে ভালোবেসেও আমার জন্য কষ্ট পেয়ে যাচ্ছিল তাই আমি এমনটা করেছি।”

আরশির কথায় শুনে নীলা হকচকিয়ে উঠে। নীলা তো কখনো আরশিকে এসব বলেনি। তাহলে ও কি করে জানলো!! নীলা অপ্রস্তুত হয়ে বলল-

“তুই এসব কি করে জানলি??”

আরশি হাতের উল্টো পিঠে নিজের চোখ মুছে নিলো। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল-

“আমি ওইদিন থেকেই সব বুঝে গিয়েছিলাম যেদিন তুই আদ্রাফের কথা শুনে নিয়েছিলি। ওইদিন তোর চোখ দেখেই আমি সব বুঝে গেছি।”

নীলা মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি আবারও বললো-

“তুই অস্বস্তিবোধ করবি তাই এসব নিয়ে তোকে সরাসরি কিছু বলিনি। তুই আমাকে মাফ করে দিস নিলু। আমি সব জেনেও তোর ভালোবাসার মানুষকে তোর করে দিতে পারিনি। আদ্রাফ আর কাসফি একে অপরকে ভালোবাসে তাই আমি ওদেরকে এক করে দিয়েছি। তা না হলে তোরা তিনজনই কষ্ট পেয়ে যেতি।”

কাসফিয়ার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আদ্রাফ আর কাসফিয়ার এক হয়ে যাওয়ার কথা শুনে। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে নীলা। কান্না আসতে চাইছে কিন্তু এই মুহূর্তে কান্না করতে চাইছে নীলা। নিজেকে শক্ত রাখতে চাইছে ভেঙে পড়তে চায় না সে। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নীলা মাথা তুলে তাকালো। একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-

“তুই একদম ঠিক করেছিস আশু। আদ্রাফ তো আমাকে ভালোই বাসে না আমিই ভুল সময়ে ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছি। এতে অন্য কারও কোনো দোষ নেই। তোর জায়গায় আমি থাকলেও ওদের সম্পর্কটা ঠিক করে দিতাম। তাই বলছি আর কখনো যদি তোকে দেখেছি আমার কাছে মাফ চাইতে তাহলে তোর খবর আছে।”

আরশি নীলার হাসি মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে নীলার এই নিখুঁত অভিনয়ের কথা। মেয়েটা কত সুন্দর করে পারছে কষ্টের মাঝেও হাসি মুখের অভিনয় করতে। আরশি নীলার দিকে তাকিয়েই শান্ত গলায় বললো-

“আমার সামনেও তুই অভিনয় করছিস নিলু!!”

আরশির কথায় নীলার হাসিটা ঠোঁটেই মিলিয়ে গেল। মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। নীলা আরশি হাত ধরে রাস্তার দিকে হেঁটে যেতে লাগলো। আরশিও চুপচাপ নীলার সাথে হেঁটে যাচ্ছে। শহরের কোলাহলে মাঝে শুধু মাত্র এই দুটি মানুষের মাঝে এক ঝাঁক নিরবতা এসে ঝেঁকে বসেছে। ফুটপাত দিয়ে নীলা আরশির হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে বলল-

“জানিস আশু এই যে আমাদের আশেপাশে এতো ব্যস্ত মানুষ দেখছিস এদের সবার মনেই কিন্তু কষ্ট আছে। কারও কম আবার কারও বেশি। কেউ নিজেদের কষ্ট প্রকাশ করছে আবার কেউ নিজের মনের মধ্যে কষ্ট লুকিয়ে রেখেই হাসি মুখে ঘুরে বেরাচ্ছে। কষ্ট প্রকাশ করলেই সেটা আরও বাড়বে। নিজের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষ গুলোও মন খারাপ করে থাকবে। এর চেয়ে বরং নিজের কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে সবার সামনে হাসিখুশি থেকে আশেপাশের মানুষ গুলোকে ভালো রাখা টা-ই তো বুদ্ধিমানের কাজ তাই না আশু??”

আরশি চুপচাপ নীলার কথা শুনছিল। বোকাসোকা অল্পতেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকা এই মেয়ে আজ কতটা গম্ভীর রূপ ধারন করেছে। বিজ্ঞদের মত করে কথা বলছে। নিজের মাঝেই কষ্ট লুকিয়ে রাখতে শিখে গেছে। আসলেই কষ্ট পেলে মানুষ পালটে যায়, শক্ত হয়ে যায়, আগের থেকেও বেশি জ্ঞানী হয়ে যায়। কষ্ট থেকেই হয়তো মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। আরশি মনে মনে নিজেকেই বলতে লাগলো- “নীলা তো সত্যিই বলছে কষ্ট প্রকাশ করলেই সেটা আরও বেড়ে যায়। আমিও তো সব কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করি যেন অন্য কেউ বুঝতে না পারে। আমার কথা ভেবে মন খারাপ না করে সেই কারনেই তো সব সময় হাসি মুখে থাকি। তাহলে কি নিলুও আমার মতই!!” প্রচন্ড জোরে গাড়ীর হর্নের আওয়াজ কানে আসতেই আরশি ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ খিচে আছে। শহরের এই কোলাহল আরশির একদমই ভালো লাগে না।

“একদম ঠিক বলেছিস নিলু। তুই তো দেখি খুব জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে গেছিস!!”

নীলা আরশির দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে আবারও সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলো। কিছুটা পথ যেতেই নীলা শান্ত গলায় বলল-

“আশু আমি চাই না বাকিরা এসব ব্যাপারে কিছু জানুক। আমার ব্যাপারটা জানলে হয়তো আদ্রাফ আর কাসফি আমার সামনে আসতে অস্বস্তিবোধ করবে।”

“আর তুই???”

আরশির প্রশ্নে নীলা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে। আরশি নীলার কাধে হাত রাখতেই নিম্ন স্বরে বলে উঠলো-

“আমার কিছু হবে না আশু। প্রথম প্রথম খারাপ লাগবে তারপর আস্তেধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ না হোক কাল তো সত্যিটা মেনে নিতেই হবে।”

আরশি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল-

“আচ্ছা এসব বাদ দে। তুই নিশ্চিন্তে থাক আমি এমনিতেও আমাদের মাঝের কথা কাউকে কিছু বলতাম না। তাই এখন এসব বাদ দিয়ে চল ফুচকা খেতে যাই।”

আরশি নীলার হাত ধরে একপ্রকার টেনে ফুচকার দোকানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নীলাও মুচকি হেসে আরশির সাথে যাচ্ছে।

—————————

আরশি একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই আদ্রাফ আরশিকে ফোন দিয়ে অনেক গুলো ধন্যবাদ জানিয়েছে। সবাইকে ট্রিট দিবে বলে প্রমিজ করেছে আর আরশির জন্য স্পেশাল ভাবে ট্রিট দিবে আরশি যা যা চায় সব আদ্রাফ মেনে নিবে। আরও নানারকম কথা বলেছে আদ্রাফ যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে আজ। কাসফিয়ার চোখে মুখেও খুশির ঝলক দেখা যাচ্ছে। একই গল্পের দুই চরিত্র খুশিতে মেতে উঠেছে আর অন্য দিকে আরেকজন এদের খুশি দেখেই হয়তো চোখেরজল ফেলছে। নিজের না পাওয়া ভালোবাসার মানুষটা কথা ভেবেই হয়তো একা একা ডুকরে কেঁদে উঠছে। আরশি একটা দীর্ঘশ্বা ফেললো। আরশি বুঝতে পারছে না এখন তার আদ্রাফদের কথা ভেবে খুশি থাকা উচিত নাকি নীলার জন্য কষ্ট পাওয়া উচিত। আরশি আকাশের দিকে তাকিয়েই নিজের ভাবনার জগৎতে নানারকম চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত হয়ে আছে। কিন্তু অপর বারান্দা থেকে এক জোড়া তৃষ্ণাতুর চোখ অপলকভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে সেদিকে আরশির কোনো খেয়াল নেই। আজ সারাদিন আরশিকে না দেখে রৌদ্রর মন বড্ড বেশিই ছটফট করছিল। কখন আরশিকে এক নজরের জন্য দেখতে পাবে সেই অপেক্ষাতেই সারাদিন কাটিয়েছে। হাজার ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও হুটহাট আরশির চিন্তা তীরের মতো রৌদ্রর মন মস্তিষ্কে এসে আঘাত হানে। এই মুহূর্তে আরশির এই মলিন মুখটাই রৌদ্রর কাছে মোহনীয় লাগছে। অন্ধাকারের মধ্যে চাঁদের আলোতে আরশির মুখে যেন মুগ্ধতা উপচে পরছে। আরশির চোখে জমে থাকা টলমল করা অশ্রুজল মনে হচ্ছে মুক্তার মতো চিকচিক করছে। এতেই যেন প্রচন্ড মায়াবী লাগছে আরশিকে। রৌদ্র মনে হচ্ছে আরশির দিকে এভাবে তাকিয়ে থেকেই হাজারো নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিতে পারবে। হঠাৎ করেই রৌদ্রর চোখ পরলো আরশির চোখে আটকে রাখা নোনাজলের এক ফোটাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। সেই সাথে রৌদ্রর বুকটাও ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠেছে। খানিকটা উত্তেজিত হয়েই আরশিকে জিজ্ঞেস করে বসলো-

“মিস আরু আপনার কি কিছু হয়েছে??”

আরশির কোনো উত্তর পেলো না। আরশি এখনো আগের মতোই গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে আছে। রৌদ্র এবার খানিকটা উচ্চস্বরেই আরশিকে ডাক দিল-

“মিস আরু।”

রৌদ্রর এমন আকর্ষণ কাড়া ডাকে আরশির হুশ ফিরলো। তৎক্ষনাৎ পাশের বারান্দায় তাকিয়ে রৌদ্রকে দেখেই আরশি চমকে উঠলো। রেলিঙের উপর দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। কপালে চিন্তার রেখা ভেসে উঠেছে। আরশি অন্য দিকে ফিরে রৌদ্রর চোখের আড়ালে চোখের পানি মুছে নিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল-

“জ্বি, আপনি ঠিক আছেন তো ডক্টর?? আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।”

রৌদ্র ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললো-

“আমি ঠিক আছি কিন্তু আপনাকেই ঠিক মনে হচ্ছে না। কিছু হয়েছে আপনার?? কি নিয়ে এতোক্ষন ধরে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন??”
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

আরশি মলিন মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত কচলাচ্ছে অনবরত। মনে হচ্ছে সকল অস্বস্তি ভাব এই হাত কচলানোর মাধ্যমেই বিলীন করে দিতে চাইছে। রৌদ্র আরশির হাতে দিকে একবার তাকিয়ে আবারও মুখের দিকে নজর দিল। আরশির মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগছে। রৌদ্র শান্ত গলায় বলল-

“মিস আরু নিচে আসুন আমি অপেক্ষা করছি।”

আরশি চমকে রৌদ্রর দিকে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বলল-

“এই সময় নিচে যাবো মানে??”

রৌদ্র হাত ঘড়িতে নজর দিয়ে বলল-

“তেমন রাত হয়নি। সবেমাত্র দশটা বাজে। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুক্ষনের মধ্যেই আপনার হাতে মৃত্যু ঘটবে।”

আরশি রৌদ্রর কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো। রৌদ্র চোখের ইশারায় আরশির হাতের দিকে তাকাতে বলল। আরশি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই দু হাত আলাদা করে ফেললো। আরশির এভাবে হাত কচলাচ্ছিলো তা আরশির নিজেরই খেয়াল ছিল না।

“আপনি যদি সব সময় অস্বস্তিতে এভাবে হাত কচলাতে থাকেন তাহলে কখন যে আপনি নিজের হাতের চামড়া ছিড়েখুঁড়ে দিবেন সেটা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেনা। যাইহোক নিচে গেইটের কাছে আসুন।”

আরশি ইতস্তত করে বলল-

“কিন্তু এখন…..”

রৌদ্র আরশিকে ইতস্তত করতে দেখে আশ্বাসের সুরে বলল-

“আমাকে ভরসা করেন তো মিস আরু!!”

আরশি রৌদ্রর মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।

“তাহলে আমার উপর ভরসা রেখেই নিচে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।”

রৌদ্র আরশিকে কথাটা বলে বারান্দা থেকে চলে গেল। আরশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বললো-

“তোদের মালিকের হুটহাট করে কি হয় রে!! এই রাতের বেলা বাহিরে গিয়ে কি করবো আমি??”

পাখিগুলো আরশির কথা শুনেই চেচামেচি শুরু করে দিল। আরু নামের পাখিটা “চিরকুট” “চিরকুট” করছে৷ অবিরাম। আরশির নাম রাখা এ্যাংরি বার্ডটা খাঁচার এক পাশে চুপ করে বসে আছে। আরশি পাখিটার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল-

“তোর সাথে তো দেখছি নামটা পুরোপুরিই ম্যাচ করেছে। তুই ও তোর গোমড়ামুখো মালিকের মতই গম্ভীর হয়ে বসে আছিস দেখা যাচ্ছে। হুহ্ অসভ্য একটা।”

আরশি চটপটিয়ে কথা গুলো বলেই রুমে চলে আসবে তখনই পাখিটা পর পর দুবার “অসভ্য” “অসভ্য” বলে উঠলো। আরশি ভড়কে গিয়ে পেছন ফিরে পাখিটার দিকে তাকালো। অসহায় কন্ঠে অনুনয় করে বলল-

“এইটাই তোর শিখতে হলো!! ডক্টর এটা শুনলে নিশ্চয়ই আমাকে ধমকাবে। এ্যাংরি বার্ড প্লিজ এই বকাটা ভুলে যা৷ আর যাইহোক তোর মালিকের সামনে এই শব্দ মুখ দিয়ে বের করিস না।”

রুম থেকে ফোনের শব্দ পেয়েই আরশি দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল। রৌদ্র কল করেছে। আরশি ফোনট রিসিভ না করেই মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে রৌদ্রর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো। আরশি নিচে গেইটের সামনে আসতেই রৌদ্রকে দেখতে পেল। কালো টিশার্ট আর কালো টাওজার পরা। চুল গুলো কিছুটা এলোমেলো হয়ে আছে। হাতে কালো রঙের ঘড়ি। এই মুহূর্তে লোকটা কেমন মুডে আছে তা ওনার মুখ দেখে বোঝা খুব মুশকিল। সব সময়ই গম্ভীরমুখে থাকে লোকটা। আরশি চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে এগিয়ে গেল। রৌদ্রর কাছে আসতেই রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো-

“এতক্ষন কি করছিলেন??”

আরশি পাখিটার কথা মনে পড়তেই আমতা-আমতা করে বলল-

“কই কিছু না তো। আমাকে নিচে আসতে বলেছেন কেন!!”

“এমনি আজকের ওয়েদারটা খুব ভালো তাই ভাবলাম একটু ঘুরে আসি। আর আপনাকেও মনমরা হয়ে থাকতে দেখলাম তাই আপনাকে আমার সাথে আসতে বলেছি।”

রৌদ্র কথা গুলো বলেই পেছনের রাস্তার দিকে হাঁটা শুরু করলো। আরশিও রৌদ্রর সাথে যাচ্ছে। এই রাস্তায় তেমন গাড়ি চলাচল করে না। মানুষও এখন বেশি নেই একটু পর পর দু এক জন দেখা৷ যাচ্ছে। সোডিয়ামের আলো পুরো রাস্তা আলোকিত হয়ে আছে। চারপাশে হাল্কা হিমশীতল হাওয়া বইছে। হয়তো গ্রীষ্মের সমাপ্তি জানান দিচ্ছে৷ বেশ খানিকটা পথ যাওয়ার পর রৌদ্র শীতল কন্ঠে আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-

“কোনো কারনে কি আপনার মন খারাপ মিস আরু!!”

আরশি রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্র আগের মতোই সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলছে। আরশি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল-

“আমাদের জীবনটা খুব অদ্ভুত তাই না ডক্টর!! আমরা একজনে খুশি রাখতে গিয়ে আরেকজনকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। সবাইকে ভালো রাখতে চেয়েও পারি না।”

রৌদ্র আরশির দিকে একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরে নিল।

“সকলকে ভালো রাখা আমাদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আমাদের জীবনে কষ্ট আছে বলেই আমরা সুখ অনুভব করতে পারি। তাই সুখ পাওয়ার জন্য আমাদের সবাইকে অবশ্যই আগে কষ্ট পেতে হয়।”

“সব মানুষ জীবনে শুধু সুখ না ভালোবাসাও চায়। ভালোবাসার মানুষকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু সবার ভাগ্যে ভালোবাসা থাকে না। সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। দুইজন ভালোবাসার মানুষ একে অপরের সাথে ভালো থাকলে হয়তো দূর থেকে অন্য কেউ এক তরফাভাবে ভালোবেসে কষ্ট পায়। নিজের ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করতে না পেরে এক বুক কষ্ট নিয়েও হাসিমুখে বেঁচে আছে।”

আরশি কথা গুলো বলতে বলতে তার গলা ধরে আসছে। চোখ দুটো চিকচিক করে উঠছে। রৌদ্র আরশির কথায় কিছুটা ধারনা করতে পেরেছে কি হয়েছে। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য রৌদ্র শান্ত গলায় বলল-

“মিস আরু চলুন ওই দিকটায় বসি।”

রৌদ্র রাস্তার ডান পাশের একটা মাঠে চলে গেল। মাঠের ঠিক মাঝখানে গিয়েই মাটিতে বসে পরলো। আরশি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। কিন্তু রৌদ্রর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই । সে তো নিজের মতো করে দু’পা সামনে আর পেছনের দিকে দু’হাতে ভর দিয়ে বসে আছে। আরশি মাঠে এসে রৌদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। বেশ খানিকটা সময় পর রৌদ্র আকাশে দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল-

“পুরোটা সময় দাঁড়িয়েই থাকবেন না-কি মিস আরু!!”

আরশি চোখ ছোট ছোট করে বলল-

“তাহলে আপনার মতো মাটিতেই বসে পরবো নাকি!!”

রৌদ্র আরশির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল-

“মাটির উপরে যে সুন্দর সবুজ রঙের ছোট ছোট কচি ঘাস আছে সেটা আপনার চোখে পড়ছে না??”

“আজব, এভাবে তেড়া তেড়া কথা বলার কি আছে!! এখানে ঘাস আছে তা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ঘাসের মধ্যে যদি পোকামাকড় থাকে তখন!!”

আরশির কথায় রৌদ্র কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“আরে এতো কিছু না ভেবে বসুন তো।”

কথা বলেই আরশির ডান হাত ধরে টান দিয়ে জোর করেই ঘাসে উপর বসিয়ে দিল। আচমকা রৌদ্রর এমন কাজে আরশি থ মেরে বসে রইলো। রৌদ্র এখনো আরশির হাত ঘাসে মধ্যে চেপে ধরে আছে শক্ত করে। রৌদ্রর হাতের স্পর্শ পেয়ে আরশির সারা শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। আরশি রৌদ্র আর তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন আলাদা এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। এর আগেও দু একবার রৌদ্র আরশিকে স্পর্শ করেছে কিন্তু তখন তো তার এমন অদ্ভুত ভয়ংকর রকমের অনুভূতি হয়নি। আরশি রৌদ্রর মুখের দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করে রৌদ্র এই নিস্তব্ধ পরিবেশ অনুভব করছে। রৌদ্রর চোখের পাপড়ি গুলো বেশ বড়বড় আর ঘন। একটু পর পর বাতাসের তীব্র ঝাপটায় রৌদ্রর চোখ কেঁপে উঠছে। আরশি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে রৌদ্রকে দেখে যাচ্ছে। রৌদ্র চোখ বন্ধ রেখেই নরম গলায় বলে উঠলো-

“সব সময় এমন মুগ্ধকর পরিবেশ আর আবহাওয়া দেখা যায় না। তাই সুযোগ থাকলেই সেটা উপভোগ করতে শিখুন। পোকামাকড়, ধুলো-বালি, রাতের সময় এত কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা না করে শুধু এই সুন্দর মুহূর্তের কথা ভাবুন। শহরে এমন পরিবেশের দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর। একবার শুধু এই শীতল নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দেখুন। সব দুঃখ কষ্ট নিমিষেই উধাও হয়ে যাবে মাথা থেকে।”

রৌদ্র কথাটা বলেই আরশির হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। আরশি এবার খানিকটা কেঁপে উঠলো। আরশি তৎক্ষণাৎ রৌদ্রর থেকে নজর সরিয়ে নিল। আকাশের গোলাকার উজ্জ্বল চাঁদটার দিকে তাকালো। একটু পরপর কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঁকি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে লুকোচুরি খলছে। আরশি নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো এই নিরিবিলি প্রাকৃতি। এই মুহূর্তে আরশির মন মস্তিষ্কের শুধু একটাই গান বাজছে উঠছে।

একটা ছেলে মনের আঙিনাতে
ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে
বন পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে
বৃষ্টি জলে একলা ভিজে

একটা ছেলে মনের আঙিনাতে
ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে
বন পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে
বৃষ্টি জলে একলা ভিজে

সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে
সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে

আমি তো বেশ ছিলাম চুপিসারে
ছোট্ট মেয়ে সেজে একটা কোণে
সবুজ বনে নীলচে আলো জ্বেলে
স্বপ্ন ভেজা মাটিতে পা ফেলে

আমি তো বেশ ছিলাম চুপিসারে
ছোট্ট মেয়ে সেজে একটা কোণে
সবুজ বনে নীলচে আলো জ্বেলে
স্বপ্ন ভেজা মাটিতে পা ফেলে

সেই ছেলেটা হঠাৎ এলো মনে
সেই ছেলেটা হঠাৎ এলো মনে।

হঠাৎই আরশির ফোন বেজে উঠলো। ফোনের রিংটোনের শব্দে আরশি আর রৌদ্রর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো। আরশি এক ঝটকায় চোখ মেলেই বা হাতে রাখা ফোনটা সামনে আনলো। কাসফিয়া নাম্বার দেখেই ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে রিসিভ করলো। সাথে সাথেই অপরপ্রান্ত থেকে কাসফিয়া ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো-

“এ-ই ফাজিল তুই আমাকে না বলে এই রাতের বেলায় কোথায় গেছিস??”

আরশি ভুলে কাসফিয়াকে না জানিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে পরেছিল। এখন নিজের বোকামি বুঝতে পেরে ভয়ে চুপসে যাচ্ছে। রৌদ্র আরশির দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। আরশি উঠে কিছুটা দূরে গিয়ে কথা বলবে কিন্তু রৌদ্রর হাতের নিচে আরশির হাত চেপে রাখার আরশি উঠে যেতে পারছে না। তাই আরশি একটু নেড়েচেড়ে আবারও বসে পরলো। রৌদ্র ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করতেই আরশি চোখের ইশারায় হাতের দিকে তাকাতে বলল। রৌদ্র হাতের দিকে তাকিয়ে এই অবস্থা দেখে এক ঝাটকায় নিজের হাত সরিয়ে ফেললো। এই মুহূর্তে রৌদ্রর মুখেও কিছুটা লজ্জার আভাস মিলেছে। লজ্জায় বাম হাতে মাথা চুলকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রৌদ্রর নিজেরও খেয়াল ছিলো না ও আরশির হাত ধরে বসে আছে। আরশি রৌদ্রর এমন লাজুক ভাব দেখে খানিকটা অবাক হলো।

“কিরে কথা বলছিসস না কেন?? কোথায় তুই!!”

আরশি উঠে দাড়িয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে বলল-

“আমি বাহিরে হাঁটতে বের হয়েছি।”

“কিইইই এতো রাতে তুই একা একা বাহিরে ঘুরতে বেরিয়েছিস??”

কাসফিয়ার এমন চেচিয়ে কথা বলা শুনে আরশি কান থেকে ফোনটা একটু দূরে নিয়ে বলল-

“উফফফ আস্তে কথা বল তো কাসফি। আমি একা না ডক্টর আছে আমার সাথে।”

কাসফিয়া একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সন্দেহ গলায় বললো-

“বাহহহ রৌদ্র ভাইয়ের সাথে আবার ঘুরতেও যাওয়া হচ্ছে না-কি!!”

“কাসফিইইই প্লিজ আবার শুরু করিস না এইসব।”

কাসফিয়া চিন্তিত গলায় বললো-

“আচ্ছা যাইহোক নিলুর সাথে তোর কথা হয়েছে?? সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু ফোন অফ আসছে বার বার। আর নীলও তো বাসায় নেই যে ওকে ফোন করে কিছু জিজ্ঞেস করবো।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here