রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৫০+৫১

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৫০
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“কিসের ঔষধের কথা বলছেন আপনারা?”

রৌদ্র আরশিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে হয়েছে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। রৌদ্র মা কিছুটা ইতস্ততবোধ করছে। আরশি রান্নাঘরে ভিতরে এসে রৌদ্র সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল-

“কেউ কি অসুস্থ রোদ? কার ওষুধের কথা বললেন আপনি এই মাত্র!”

আরশির কথায় রৌদ্র একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আরশি রৌদ্র কথা বেশি কিছু শুনতে পায়নি। আরশি ফ্যালফ্যাল করে রৌদ্র দিকে তাকিয়ে তার প্রশ্নের প্রতিত্তোরের অপেক্ষা করছে। রৌদ্র নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল-

“কারও কিছু হয়নি। এমনি মা’কে কিছু ভিটামিনের ঔষধ খাওয়ার কথা বলেছি।”

রৌদ্র কথার সাথে সাথেই রৌদ্র মা আরশির দিকে এগিয়ে এসে বলল-

“হ্যাঁ আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো তাই আমাকে নিয়ে রৌদ্রর চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে।”

আরশি তাদের দিকে কিছুক্ষন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল-

“এসব কি বলছো মামুনি! তোমাকে তো এখনো যুবতী মেয়েদের মতোই দেখা যায়। তবে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার ছেলেই বুড়ো হয়ে গেছে।”

রৌদ্রর মা আরশির কথায় হেসে ওঠে। রৌদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

“আমাকে বুড়ো মনে হয় আপনার কাছে?”

আরশি হাসি দিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো। সাথে সাথেই রৌদ্রর মা আর আরশি সশব্দে হেসে দেয়। রৌদ্র গম্ভীর গলায় বলল-

“আপনি এখানে এসেছেন কেন? আমি তো আপনাকে বারান্দায় থাকতে বলেছিলাম মিসেস আরু।”

আরশি কোনো কথা বলল না। রৌদ্রর মা’র কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল-

“তোমার ছেলে এমন গোমড়ামুখো কেন গো মামুনি? তুমি কি ওনাকে ছোট বেলা তিতা করলা খাইয়েছিলে না-কি!!”

“মধু খাইয়েছিলাম কিন্তু লাভ হয়নি। একদম বাপের মতো হয়েছে তাই এই অবস্থা।”

রৌদ্রর মা’র কথা শুনে আরশি ফিক করে হেসে দেয়। রৌদ্র তাদের দু’জনের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল-

“কানে কানে কথা বললে এমনভাবে বলবে যেন পাশের জন শুনতে না পায়। আমি আব্বুর মতো হয়েছি কি-না সেটা কাল সকালেই আব্বুকে জিজ্ঞেস করে নিবো ঠিক আছে মা!! আর মিসেস আরু আপনাকে তো আমি পরে দেখে নিবো।”

রৌদ্র গজগজ করে কথা গুলো বলেই হনহনিয়ে চলে গেল। রৌদ্রর মা আর আরশি একে অপরের দিকে কিছুক্ষন অসহায় মুখে তাকিয়ে থেকে হুট করেই হেসে দেয়। রৌদ্রর মা হাসি থামিয়ে বললেন-

“এখন রুমে যা না হলে রৌদ্র আরও রেগে যাবে।”

আরশি মাথা নাড়িয়ে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। দরজার কাছে এসে বড় করে এক শ্বাস টেনে বুকে সাহস জুগিয়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করলো। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে রৌদ্রকে দেখতে না পেয়ে আরশি বারান্দায় চলে যায়। রৌদ্র এক হাতে কফির মগ নিয়ে রেলিঙের উপর হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের টি টেবিলের উপর একটা কফির মগ রাখা। আরশি হাসি দিয়ে রৌদ্র পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল-

“কি করছেন ডক্টর?”

“বৃষ্টিবিলাস করছি।”

রৌদ্র ত্যাড়া কথায় আরশির ভ্রু বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে বললো-

“কিন্তু বৃষ্টি তো হচ্ছে না।”

“মনে মনে বৃষ্টিবিলাস করছি।”

রৌদ্র শক্ত গলায় উত্তর দিল। আরশি অসহায় কন্ঠে বললো-

“আপনি রেগে আছেন আমার উপর? আমি তো মজা করছিলাম রোদ।”

রৌদ্র মগের বাকিটুকু কফি বারান্দায় দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। টেবিলের উপর মগটা রেখে দিয়ে আরশির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আরশির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে গম্ভীর্যতার সাথে জিজ্ঞেস করল-

“আমি বুড়ো হয়ে গেছি?”

আরশি কিছুটা পেছনে গিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে। দ্রুত ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না জানালো। রৌদ্র আবারও জিজ্ঞেস করল-

“আমি গোমড়ামুখো? আমাকে ছোট বেলা তিতা করলা খেয়ে বড় করেছে?”

আরশি আবার মাথা নাড়িয়ে না জানালো। রৌদ্র এবার ধমকের স্বরে বলল-

“এখন মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কেন? তখন তো খুব বক বক করছিলেন আম্মুর সামনে। মাথা না নাড়িয়ে মুখ দিয়ে উত্তর দিন।”

আরশি খানিকটা সময় চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে আচমকাই রৌদ্র ডান গালে টুপ করে কিস করে বসে৷ রৌদ্র হতভম্ব হয়ে ডান গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো বিস্ময়ে গোলাকার ধরন করেছে। আরশি বিশ্বজয়ী একটা হাসি দিয়ে চেয়ারে বসে পরে। কফির মগ তুলে এক চুমুক খেয়ে গলা খেকরিয়ে বলল-

“রোদ আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

আরশির কথায় রৌদ্রর ঘোর কাটে। বিস্ফোরিত চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-

“তুমি আমাকে নিজের ইচ্ছায় কিস করলে রুদ্রাণী! দু’বছরে এই প্রথম তুমি নিজের ইচ্ছায় কোনো দ্বিধাবোধ, লজ্জা, অস্বস্তি ছাড়াই আমাকে কিস করলে?”

আরশি কিছু বলল না। ঠোঁটে এক একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠেছে আরশির। চুপচাপ কফি খেতে লাগলো। রৌদ আরশির পাশে চেয়ার টেনে বসে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল-

“কি হলো এমন অদ্ভুত রকমের আচরণ করছো কেন হঠাৎ করে! কি হয়েছে তোমার?”

আরশি এবার খিলখিল করে হেসে দেয়। কফি মগ রেখে দিয়ে বলল-

“আপনার কাছ থেকেই এসব শিখেছি। আমি রেগে গেলেও আপনি হুটহাট এমন অদ্ভুত আচরণ করেন। তখন আমারও একই অবস্থা হয়। তাই আপনার আইডিয়া আপনার উপরেই কাজে লাগাম।”

রৌদ্র চোখ দুটো ছোট ছোট করে আরশির দিকে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“দিন দিন খুব বেশি চালাক হয়ে যাচ্ছো তুমি। আমাকে কপি করা শুরু করেছো!”

আরশি চেয়ারে হেলান দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল-

“ডক্টর রোদের বউ হয়ে চালাক না হলে কি চলে না-কি!”

আরশি কথাটা বলেই হেসে দেয়। রৌদ্রও তার সাথে তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। এভাবেই এক সাথে বসে অন্ধকার বিলাস করছে রৌদ্র আর তার রুদ্রাণী। রৌদ্র মুগ্ধ নয়নে তার রুদ্রাণীর হাসি মুখ উপভোগ করছে। এ যেন কোনো অন্ধকার বিলাস নয় ভালোবাসাময় এক রঙিন মুহুর্ত।

——————————

“ঈদ মোবারক আদ্রাফ। কেমন আছিস?”

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আদ্রাফ বলল-

“ঈদ মোবারক আশু। আমরা ভালো আছি তোরা সবাই কেমন আছিস? আর ছুটি কেমন কাটাচ্ছিস তোরা সবাই?”

আরশি একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল-

“এই তো ভালোই তবে তোরা থাকলে আরও বেশি মজা হতো।”

“ধুর গাধী আমাদের নিয়ে মন খারাপ করিস না। তোরা আসলে অন্য একদিন সবাই দেখা করবো। এই নে কাসফির সাথে কথা বল।”

আদ্রাফ কাসফিয়ার কাছে ফোন দিতেই কাসফিয়া মুচকি হেসে বলল-

“ঈদ মোবারক আশু। ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।”

“হুম তোকেও ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। কি অবস্থা তোর?”

কাসফিয়া ছোট্ট করে উত্তর দিল-

“ভালো।”

আরশি কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করল-

“আমাদের পুচকির কি অবস্থা? কতটুকু বড় হয়েছে? এখন কি নড়াচড়া করে? আচ্ছা তুই না হয় তোর একটা ছবি তুলে দে দেখি তুই কতটা মোটা হয়েছিস, তোর পেট বড় হয়েছে কি-না!”

আরশির এতগুলো প্রশ্নের জবাবে কাসফিয়া সহজ গলায় বলল-

“আশু মাত্র চার মাসে এতো কিছু বোঝা যায় না।”

আরশি হতাশ হলো। জোড়ালো শ্বাস ফেলে বলল-

“ওহ”

কাসফিয়া আর কোনো কথা বাড়ালো না। ব্যস্ততার তাড়া দেখিয়ে বলল-

“আশু এখন রাখছি একটু কাজ আছে। দুলাভাই আর বাকি সবাইকে আমার পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিস।”

আরশির কথার কোনো অপেক্ষা না করেই কাসফিয়া ফোন কেটে দিল। আরশি ফোনটা কানের কাছ থেকে সামনে এনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আরশি জানে কাসফিয়া মিথ্যা বাহানা দেখিয়েই ফোন কেটে দিয়েছে। আচমকাই রৌদ্র বারান্দায় এসে আরশিকে জড়িয়ে ধরলো। আরশি হকচকিয়ে উঠলো। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল-

“কি হলো হঠাৎ করে এসে জড়িয়ে ধরলেন কেন?”

রৌদ্র কিছু বলল না। আগের থেকেও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আরশিকে। আরশি রৌদ্র পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

“মসজিদ থেকে কখন এসেছেন?”

রৌদ্র শান্ত গলায় বললো-

“কিছুক্ষন আগেই এসেছি যখন ফোনে কথা বলছিলে।”

আরশির আর বুঝতে বাকি রইলো না রৌদ্র কেন তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে। আরশি হাল্কা হাসি দিয়ে বলল-

“আমি ঠিক আছি রোদ। ছাড়ুন এখন।”

রৌদ্র আরশিকে ছেড়ে দিল। আরশি রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্রর ফর্সা ত্বকে নীল পাঞ্জাবিটা একদম ফুটে উঠেছে। বাদামী বর্ণের চোখ গুলোতে এক আকাশ সমান ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে। রৌদ্র দু হাত ভাজ করে শান্ত গলায় বলল-

“বিকেলে আমরা সবাই ঘুরতে যাবো রেডি থেকো।”

আরশি মুচকি হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।

————————

বিকেলে সবাই একসাথে নদীর পাড়ে ঘুরতে বেড়িয়েছে। নীল কিছুটা দূরে ফোনে হেসে হেসে কথা বলতে ব্যস্ত। নির্বান বার বার নীলার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু নীলা আরশির সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর সামনে সামনে হাঁটছে। নির্বান রৌদ্র দিকে অসহায় মুখে তাকাতেই রৌদ্র চোখের ইশারায় নির্বানকে আস্বস্ত করে। দ্রুত পায়ে হেঁটে আরশির কাছে এসে হাত ধরে নীলার উদ্দেশ্যে বলল-

“শালিকা আমি আমার ভালোবাসার বউকে কিছুক্ষনের জন্য ধার নিচ্ছি।”

নীলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রৌদ্র আরশির হাত ধরে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। নির্বান রৌদ্রর উদ্দেশ্যে কিছুটা চেচিয়ে বলল-

“ভাই পাশের বারান্দাকে দেখে রেখো।”

রৌদ্র মুচকি হাসে। আরশি ভ্রু কুচকে ফেলে রৌদ্রর এমন কাজে। নীলাও হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্বান নীলার পাশে এসে শান্ত গলায় বলল-

“তোমার সাথে আমার কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে নীলা।”

নীলা নির্বানের দিকে না তাকিয়েই বলল-

“হুম বলুন শুনছি।”

নির্বান ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। নীলার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে শীতল কন্ঠে বলল-

“প্রায় দু’বছর হয়েছে গেছে আমি তোমার পেছনে লেগে আছি, তোমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছি। আমি জানি কেন তুমি রাজি হতে চাইছো না। কেন তুমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছো ভালোবাসা থেকে।”

নির্বানের কথায় নীলা চমকে তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো।

“ক্রাশ ভাবিদের বাসায় প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম তখনই আমি তোমার চোখে আদ্রাফের জন্য ভালোবাসা দেখেছি। ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট দেখেছি তোমার ওই সিক্ত চোখে। তখনই আমি ভেবে নিয়েছিলাম আমি তোমাকে যে করেই হোক নিজের করে ছাড়বো। একটা মেয়ে যে কিনা একজনকে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না বরং কষ্ট পেয়েও এতোটা গভীরভাবে সেই মানুষটাকে ভালোবেসে গেছে। সেই মেয়েটাকে যদি একটু ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই তার দ্বিগুণ ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে দিবে তাই না!! আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু তোমার মন গলাতে পারিনি। তাই আজ সরাসরি বলতে বাধ্য হলাম। আজ শেষ বারের মতো বলছি। আজ যদি রাজি না হও তাহলে আর কখনো তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না।”

নির্বান একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে আবারও বলতে শুরু করল-

“আমি তোমাকে ভালোবাসি নীলাদ্রি ওরফে নীলা। প্রচন্ডরকম ভালোবাসি তোমাকে। একবার আমার হাত ধরে দেখো কখনো ছাড়বো না। একবার বিশ্বাস করে দেখো কথা৷ দিচ্ছি কখনো তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবো না। সারাজীবন ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবো তোমাকে।”

নীলা কিছু বলল না। নির্বানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বড়বড় মায়াবী চোখগুলোতে প্রচুর ভয়। কোনো মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলার ভয় আঁকড়ে ধরেছে নির্বানকে। নীলা তৎক্ষনাৎ নির্বানের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কপালে বিরক্তির ভাজ পরেছে নীলার।
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৫১
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আমি তোমাকে ভালোবাসি নীলাদ্রি।”

নীলা এবারও কিছু বলল না। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। নীলাকে এভাবে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নির্বান প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। রাগে চোখমুখের অবস্থা পালটে চোয়ালে শক্ত হয়ে আসছে তার। নীলার ডান হাতের কনুইয়ের কিছুটা উপরের দিকে শক্ত করে চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

“আমি এতক্ষণ ধরে কথা বলে যাচ্ছি আর তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে! আমি তোমাকে কিছু বলেছি সেটার উত্তর দাও নীলা।”

নীলা কটমট চোখে নির্বানের দিকে ফিরে তাকালো। নির্বান তার রাগান্বিত চোখ নীলার দিকে নিক্ষেপ করে আছে। নীলা গাল ফুলিয়ে এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। হাত ঘষতে ঘষতে নাক ফুলিয়ে রাগী কন্ঠে বলল-

“আপনি তো দেখছি বেজায় নির্লজ্জ মানুষ। একে তো ফুল না এনে খালি হাতে এসে কিপটে মানুষের মতো ভালোবাসার কথা বলছেন। তার উপর আবার আমাকে রাগ দেখাচ্ছেন! যত্তসব নিরামিষ মার্কা পাব্লিক।”

নীলার কথায় নির্বান রাগে গর্জে উঠে তেজি কন্ঠে বলল-

“কিহহহ… আমি নির্লজ্জ? কিপটা? নিরামিষ মার্কা মানুষ? সামান্য ফুল আনিনি বলে….”

নির্বান থেমে যায়। রাগান্বিত ভাব কেটে দুচোখে কৌতুহলের তারা খেলে গেল। এক দমকা হাওয়ায় এলোমেলো করে দিয়ে গেল সবকিছু। শীতল হাওয়া বয়ে গেল নির্বানের মনে। এই শীতল হাওয়ায় যেন নির্বানের চোখে জ্বলতে থাকা রাগের আগুন নিমিষেই নিভিয়ে দিল। নির্বান নিম্ন স্বরে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল-

“আমি ফুল আনিনি বলে তুমি রাগ করেছো নীলা?”

নীলা দু’হাতে ভাজ করে গুটিয়ে নেয়। গোমড়া মুখে বলল-

“হুম হুম”

নির্বান উৎসাহী চোখে নীলার দিকে চেয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল-

“যদি ফুল এনে দিতাম তাহলে আমাকে মেনে নিতে!!”

নীলা মুখ ঘুরিয়ে উল্টো পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাব নিয়ে বলল-

“সেটা না হয় ফুল দিলেই ভেবে দেখতাম।”

চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা দিলো নির্বানের। খুশির বাধ ভেঙেছে আজ। নির্বান অস্থিরতায় আশেপাশে তাকালো। বড্ড আফসোস হচ্ছে তার। কেন ফুল নিয়ে আসলো না আজ! এতো বড় বোকামি কেউ করে না-কি! নিজেকে এই মুহূর্তে আস্ত এক গাধা মনে হচ্ছে। নিজের প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। ডান হাতে মাথা চুলকে চারপাশে ফুল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো নির্বান। এই নির্জন নদীর পাড়ে কেই-বা ফুল নিয়ে আসবে তার জন্য!! হঠাৎই নির্বানের চোখ পরলো দূরের একটা লালচে-হলুদ রঙের ফুলের উপর। ঝোপঝাড়ের দিকটায় কিছু লালচে-হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে। ফুল গুলোর পাপড়ি খুব ছোট ছোট। ফুলের নাম তার জানা নেই। হবে হয়তো কোনো নাম না জানা এক ফুল। নির্বান দ্রুত পায়ে ফুল গুলোর দিকে এগিয়ে যায়। আলতো হাতে প্রায় চার পাঁচটা ফুল ছিড়ে হাতের মুঠোয় একত্র করে দৌড়ে নীলার কাছে আসলো। খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছে নির্বান। দু হাঁটুতে হাত দিয়ে ঝুঁকে বড়সড় কয়েকটা শ্বাস নিল। নীলা তার গোলগোল আঁখিদুটি দিয়ে নির্বানের দিকে চেয়ে আছে। নির্বান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। একত্রিত করা ফুলগুলো নীলার দিকে এগিয়ে দিয়ে উত্তেজনার সাথে বলল-

“ভালোবাসি নীলাদ্রি৷ এই দেখো ফুল। নাম জানা নেই তবে ফুলটা দেখতে খুব সুন্দর একদম তোমার মতো। এবার আমায় ভালোবাসবে তো! মেনে নিবে আমায়! প্রমিজ করছি প্রতিদিন ফুল কিনে দিবো। তুমি চাইলে ফুলের বাগানও করে দিব। শুধু এভাবের মতো এই নাম না জানা ফুলেই রাজি হয়ে যাও প্লিজ।”

নীলা লাজুক হাসি দিয়ে নির্বানের হাত থেকে ফুল নিয়ে নেয়। ফুল গুলোতে হাত ছুঁয়ে দিয়ে দেখতে দেখতে শান্ত গলায় বলল-

“ফুল গুলো সুন্দর তাই নিয়ে নিলাম তবে প্রেম করার জন্য কিন্তু রাজি হইনি।”

“প্রেম করে সময় নষ্ট করার মতো বোকামি আমি করবো না। সময় ব্যয় না করে রৌদ্র ভাইয়ের মতো ডিরেক্ট বিয়ে করে নিব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে নিজের নামে লিখে নিবো। আমার অর্ধাঙ্গিনী করে নিবো তোমায়।”

নীলার কথার সাথে সাথেই নির্বান ফটাফট করে কথা গুলো একনাগাড়ে বলে দিল। নীলা ড্যাবড্যাব করে নির্বানের দিকে চেয়ে আছে। নির্বানের কথার প্রতিত্তোরে কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে হাঁটতে লাগলো। নির্বান একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে নীলার পাশে হাঁটা শুরু করলো। দূর থেকে নীল ফোনে কথা বলতে বলতে তাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

—————————

গোধূলির শেষ বিকেল। পশ্চিম আকাশের লালচে বর্ণের সূর্যের আলো ছড়িয়ে পরছে চারপাশে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। আরশি আর রৌদ্র নদীর পাড়ে কাঠের পুরনো একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। দুজনের মাঝে নিরবতা বিরাজমান। চারপাশে শুধু পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর দমকা হাওয়া গাছের পাতায় বারি খাওয়ায় সৃষ্টি ঝিরিঝিরি শব্দ। আরশি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। আর রৌদ্র!! সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার রুদ্রাণীর দিকে। রুদ্রাণী আজ রৌদ্রর শার্টের সাথে মিলিয়ে লাল রঙের জামদানী শাড়ি পরেছে। দু’হাতে মুঠ ভর্তি লাল চুড়ি। কাজলহীন চোখ আর ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক। পিঠে ছড়িয়ে রাখা উন্মুক্ত চুল গুলো বাতাসে ঝাপ্টা এসে উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যস এতেই রৌদ্রর অবাধ্য হৃদয় ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে বার বার। রৌদ্র নিরাশ হয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলল-

“রুদ্রাণী তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও!”

রৌদ্র মুখে আচমকা এমন উদ্ভট কথা শুনে আরশি তৎক্ষনাৎ রৌদ্রর দিকে ফিরে তাকালো। জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল-

“মানে! কি বলতে চাচ্ছেন?”

রৌদ্র একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। শার্টের হাতা ঠিক করে বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আরশির দিকে চেয়ে বলল-

“আর কতো আমার হৃদয়টাকে ঘায়েল করবে তুমি! বিয়ের দু বছর হয়ে গেছে অথচ তুমি এখনো বুড়ি হচ্ছো না কেন? দিন দিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছো অদ্ভুত!! আমার মনে হচ্ছে তুমি দিন দিন রাগান্বিত রুদ্রাণীর মতো জ্বলজ্বল করে আমাকে ভিতর ভিতর ঝলসে দিচ্ছো। এভাবে চলতে থাকলে আমি নির্ঘাত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবো রুদ্রাণী।”

রৌদ্র অসহায় কন্ঠে কথা গুলো বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আরশি রৌদ্র দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মুহুর্তেই লজ্জায় চোখ দুটো নামিয়ে ফেলে। শাড়ির আঁচল হাতের মুঠোয় রেখেই দু’হাত কচলাতে শুরু করে দিল। রৌদ্রর চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেল। নিখুঁতভাবে পরক্ষ করছে তার রুদ্রাণীকে। আরশির হলদে ফর্সা গাল গুলো লাল আভা ধারণ করছে। রৌদ্র নিজের মাথায় একটা চাপড় মেরে উঠে দাঁড়ালো। বুকের বা পাশে ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে অসহায় কন্ঠে বলল-

“এই মেয়ে কি করছো তুমি! আমার বুকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে তোমার এই লজ্জারুণ চেহারা। হার্টের ডক্টর-ই যদি হার্ট এট্যাক করে মারা যায় তাহলে আমার রুগীদের চিকিৎসা কে করবে রুদ্রাণী!!”

আরশি রৌদ্র কথা শুনে অবাক চোখে তার দিকে তাকালো। রৌদ্র আরশির সামনেই বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্রর গাঁয়ের জড়ানো লাল শার্ট, কালো প্যান্ট আর হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। রৌদ্রর অবাধ্য চুল গুলো সব সময়ের মতোই কপালে এসে পড়ে আছে। রৌদ্র দ্রুত আরশির কাছে এসে আরশির শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে দেয়। আরশির চোখ মুখ পর্যন্ত ঢেকে যায় ঘোমটায়। রৌদ্র ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল-

“উফফ আরু এভাবে তাকাবে না। তুমি বরং আজ থেকে এভাবে ঘোমটা দিয়েই আমার সামনে থাকবে। ঠিক আছে!!”

আরশি ঘোমটা খানিকটা পেছনে ঢেলে দিয়ে মাথা তুলে রৌদ্রর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। উঠে দাঁড়িয়ে রৌদ্র বুকে আস্তে করে একটা ধাক্কা দিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছেন আপনি জানেন!!”

আরশি কথাটা বলেই হাঁটা শুরু করে দিল। রৌদ্র মুচকি হেসে আরশির পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল-

“রৌদ্র তার রুদ্রাণীর জন্য পাগল হবে এটা স্বাভাবিক।”

আরশি আড় চোখে রৌদ্র দিকে চেয়ে মনে মনে হাসলো। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। রৌদ্র আরশির গাঁ ঘেঁষে আরশিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাতে লাগলো।

——————————

আরশি মলিন মুখে কাসফিয়ার রুমে বসে আছে। গতকালই আরশিরা সবাই ঢাকায় এসেছে। এই প্রথম কাসফিয়াকে ছাড়া ঈদ কাটিয়েছে তাই আরশির মনটা ছটফট করছিল কাসফিয়াকে দেখার জন্য। এই কারনেই ঢাকায় এসে সময় নষ্ট না করেই সকাল সকাল এসে পরলো আদ্রাফদের বাসায়। আদ্রাফ তার বাবার সাথে হাঁটতে বেরিয়েছে। কাসফিয়া আরশিকে রুমে বসিয়ে দিয়ে কাজের বাহানা দেখিয়ে বাহিরে চলে গেছে। প্রায় পনেরো হয়ে গেছে অথচ এখনো কাসফিয়া রুমে আসেনি। আরশি বোরিং হয়ে গেছে এভাবে একা একা বসে থেকে। পুরো রুমে পায়চারি করছে। কিছুটা সময় বাদেই কাসফিয়া রুমে আসলো। আরশির কাসফিয়ার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসে পরে। এক পাশ থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মলিন কন্ঠে বলল-

“কখন থেকে বসে অপেক্ষা করছি তোর জন্য। কিন্তু তোর তো আসার কোনো নামগন্ধই নেই। আচ্ছা কেমন আছিস আর আমাদের পুচকি-টা কেমন আছে? জানিস তোকে খুব মিস করেছি ঈদের দিন। আমরা তো ছোট থেকে সবগুলো ঈদে একসাথেই ছিলাম। একসাথে ঘুরেছি, এটা ওটা রান্না করার চেষ্টা করে আম্মুদের কাছে বকা খেয়েছি আরও কতো মজা করেছি। সব থেকে বেশি কি মিস করি জানিস!! আমরা দু’জন ঈদের দিন যখন আমাদের আব্বু আম্মুর কাছ থেকে জোর করে সালামি হাতিয়ে নিতাম ওই মুহূর্তটা অনেক বেশি মিস করি কাসফি।”

আরশি একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই বড় করে একটা শ্বাস নিল। আবারও মলিন কন্ঠে বলল-

“তুই আর আদ্রাফ আমাদের সবার সাথে গেলেই পারতি কাসফি। বেশি দিন তো না মাত্র পাঁচ দিনেরই কথা ছিল।”

কাসফিয়া আরশির কাছ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। গম্ভীর গলায় বলল-

“আমি আগের মতো অবিবাহিত নেই আশু। আমার স্বামী সংসার আছে। সব সময় তোর সাথে আগের মতো থাকতে পারবো না এটাই স্বাভাবিক। এখন এসব বাদ দিয়ে বল এখানে কেন এসেছিস?”

কাসফিয়ার এমন ব্যবহারে আরশির চোখে নোনাপানি গুলো চিকচিক করে উঠছে। আরশি কাসফিয়ার কাছে এসে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বলল-

“তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন কাসফি? আমি তোকে মিস করছিলাম তাই এসেছি। এখন কি তোর সাথে একটু দেখাও করতে পারবো না আমি!!”

কাসফিয়া গম্ভীর পায়ে রুমের জানালার দিকে চলে যায়। বাহিরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গম্ভীর্যতার সাথে বলল-

“শোন আশু আমি তোকে আবারও বলছি আমি এখন আর আগের মতো সব সময় ফ্রি থাকি না। আমার নানানরকমের কাজ থাকে এখন। আমি তো সংসারের কাজ বাদ দিয়ে তোর সাথে আড্ডা দিতে পারবো না তাই না!!”

কাসফিয়ার কথায় আরশির চোখ থেকে কয়েক ফোটা গরম অশ্রুজল গাল গড়িয়ে পরলো। কাসফিয়ার এমন ব্যবহার আরশি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আরশি আর কাসফিয়া নিজেদের ফ্যামিলির সাথেও এতোটা সময় কাটায়নি যতটা সময় তারা ছোট থেকে একে অপরের সাথে কাটিয়েছে। সব সুখ, দুঃখের স্মৃতি তারা একে অপরের সাথে শেয়ার করেছে। একজনের কষ্টে অন্য জনের চোখ দিয়ে পানি ঝরেছে। কিন্তু এভাবে তাদের মাঝে কখনো এতটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে এটা যেন কল্পানা করাও বেমানান।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here