লতাকরঞ্চ ৪

#লতাকরঞ্চ (৪)

এক গুচ্ছ ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর ভাই। ফুলগুলো সুন্দর। নাম মনে করতে পারছিনা।
দরজা খুলেই কিশোর ভাইকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিশোর ভাই হচ্ছে আমার আব্বার একজন বিশেষ ছাত্র। আব্বা ম্যাথের টিচার ছিলেন হাই স্কুলে, সেখানে সর্বদাই টপ লিস্টে সবার আগে নাম উঠতো এই ভাইয়ের। নম্র,ভদ্রতার শীর্ষে থাকার জন্যে আব্বার প্রিয় এই ছাত্র এখন আমাদের পরিবারেরই একটা অংশ হয়ে গিয়েছে।

মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আয়োজিত অনুষ্ঠান ও আব্বার নানান অপ্রয়োজনীয় আয়োজনে প্রায়াশই কিশোর ভাইকে দাওয়াত করা হয়, উনি আসেন।
এবার উনি যতই কাজে ব্যস্ত থাকুক না কেন, স্যারের কথা ফেলা যাবেনা। এটা উনার জন্য এক কথায় অধর্ম।

উনি আসলেই আমার সাথে উনার কথা হয়, মেলামেশা হয়। খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ একজন মানুষ বলতে গেলে।
রাগী স্বভাবটা নেই বললেই চলে।
যতবার আসবে আমাদের বাড়িতে; ততবারই ফুল নিয়ে আসবে। একদম কখনো ভুল করেও ভুল করেনা এই ধারায়।

আব্বার জন্য আনেন কিছু নিজের বানানো সরঞ্জামাদি ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বই। আম্মার জন্য কিছু হাদিসী বই ও আনেন। কিন্তু কখনোই লিমা আপুর জন্য কিছু আনেনা। কারনটা জিজ্ঞেস করবো করবো করে আর করা হয়না। কিশোর ভাই অনেক মেধাবী মানুষ।
সবসময়ই মুখে হাসি লেগে থাকে। ম্যাথমেটিক্সে অনার্স,মাস্টার্স শেষ।
________

আমার ধ্যান ভাঙিয়ে দিয়ে বললো,
– কি? এবারের ফুলগুলো পছন্দ হয়নি?
— কি বলেন ভাইয়া!হবেনা কেন! এগুলো কি ফুল?
– এগুলো হচ্ছে… নাহ্। চলো আজকে বিকেলে ঘুরতে যাই। এই ফুলগুলোর সন্ধানে.. ফুলেল সমৃদ্ধ এক বিশাল বাগানেই নিয়ে যাবো তোমায়।
আমি আর না করলাম না। মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তারা দম ধরে আছে। এদের দূর করতে হবে।
•°•
লাঞ্চ টাইমে…
খাওয়ার টেবিল থেকে হঠাৎ উঠে চলে আসলাম।
আমি উঠার সাথে সাথে কিশোর ভাই ও উঠে চলে এলো।

আমি আমার রুমের জানালার পাশে বসে খাচ্ছি।
কিশোর ভাইও পাশের চেয়ারটা টেনে এনে আমার পাশেই বসলো।

আমি মনে মনে ভাবছি, এবার হয়তো প্রান্ত ভাইয়ার মত করে আধো আধো গম্ভীর স্বরে বলবে,
– পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে তোর?
আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে কিশোর ভাই বললো,
– জানো আজ আমার ছোট বোন রাফা কি করছে? তোমার জন্য নিজে গিয়ে, নিজের পছন্দমত ফুল নিয়ে আসছে।

রাফা আমার ৪ বছরের ছোট হয়। খুব দুষ্ট, মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার গানের পাগল। যখনি আসবে বা দেখা হবে কোথাও; তখনি আবদার করে বসবে,
– আপু, একটা গান শোনাও না!
আমি আবার মোটামোটি গান-টান পারি। একদম অল্প। একেবারেই যাচ্ছেতাই গাই। তবে দু:সময়ের এক প্রিয় সঙ্গী হয়ে হানা দেয় আমার এই গানগুলোই। ভালোবাসি গাইতে।

পারিবারিক আড্ডায় একবার একটা গান ধরেছিলাম। সবাই প্রশংসা করলেও প্রান্ত ভাই মুখ বাঁকা করে বলেছিলো,
– এগুলো কি গানের পর্যায়ে পড়ে? কিসব হাবিজাবি গাস,বলদ কোথাকার। গলায় আরো ধার দিবি তারপর গাইতে আসবি।
কথাগুলো খুব গায়ে লাগছিলো।
আমি যেঁচে গান গাইতে যাইনি।
সবাই জোর করাতেই একটা গেয়েছিলাম।
প্রান্ত ভাইয়ের এরকম উপদেশ আমার মোটেও ভাল্লাগেনা। তারপর ফুফু এসেই থামালো এই অটোমেটিক মেশিনকে।

অথচ কিশোর ভাই একদম তার উল্টো।
উনি আমার গান খুব পছন্দ করে।
মাঝেমধ্যে, সাথে করে ছোট বোন রাফাকে নিয়ে আসে মূলত আমার গান শোনার জন্যই। অথচ নিজে কোনোদিন কোনো আবদার করেনি।
যে লতা অমুক গানটা গাও বা এরকম কিছু।
•°•
কিছুক্ষন পর শুনলাম সবাই “প্রান্তিক প্রান্তিক” বলে চিৎকার করছে।
তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম খাবার না খেয়েই হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে সেই ভদ্রলোক।
খাবার ফেলে দিয়ে এভাবে চলে যাওয়ার অর্থ কি তা আমার জানা নেই আর জানতেও চাইনা।

যথারীতি,
কিশোর ভাই আর আমি বেরিয়ে পড়ার জন্য রেডি হয়ে গেলাম।
আকষ্মিকভাবে কিশোর ভাই আর আমার জামা-কাপড়ের কালার এক হয়ে গেলো।
দুজনেই সাদা কালারের শার্ট আর থ্রি-পিস পড়েছি। কেউই আগে থেকে কোনো ডিসিশন নেই নি, প্ল্যানিং তো দূর।

বেরিয়ে পড়ার আগে অবশ্য প্রান্ত ভাইকে দেখেছিলাম। আমি না দেখার ভান করে ক্রস করে চলে আসছিলাম। উনি যে আমাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে আছে একদম; ঠিক তা না। তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি লোকটার উপর।
তবে মুখ দেখে মনে হয় কাউকে বুঝি এখনি খুন করে আসছে এবং সেই দায়েই আজ ফেঁসে গেছে।
নয়তো অমন গোমড়া মুখ করে থাকার কোনো মানে আছে?
___________

কিশোর ভাইয়ের সাথে আমি এমনিতে অনেকটাই ফ্রি। কারন কিশোর ভাইতো প্রান্ত ভাইয়ের মত নয়। উনি হচ্ছে একদম খোলা-মেলা মনের মানুষ। উনার মুখ দেখলেই সব বুঝে নেওয়া যায়..খোলা বইয়ের ন্যায়, যখন যার ইচ্ছা সব পড়ে নিতে পারে।(মানুষ ভেদে)

উনার মধ্যে সাহিত্যরস আছে।
আমার মধ্যেও খানিকটা আছে।
আব্বার ও সাহিত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে লিপ্ততা আছে বিধায় আব্বার কিশোর ভাইকে এত পছন্দ করে।

উনি অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে।
মন খারাপ হলে ১ মিনিটেই ভালো করে দিতে পারে। সেন্স অফ হিউমর অতটা না থাকলেও উনার বোকা বোকা কিছু কথা হাসিয়ে ফেলতে বাধ্য করে।

বের হওয়ার আগে একবার আম্মার রুমে যাচ্ছিলাম। গিয়ে দেখলাম ফুফু, প্রান্ত ভাই আর আম্মা কিসব যেন আলোচনা করছে। আমাকে দেখেই প্রান্ত ভাই এগিয়ে আসলো।
আমাকে বোধ হয় আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগতেছে তাই হয়তো কিছু বলতে আসতেছে…
ভ্রান্ত ধারণাকে পিষে দিয়ে বরাবরের মতই লোকটা পাশ কাটিয়ে চলেই গেলো।

আমি আম্মার কাছে বলে বেরিয়ে পড়লাম।
____________

আমরা এক বিশাল বড় পুকুরের পাড়ে বসে আছি, পিছনটায় আছে প্রকাণ্ড মাঠ। মাঠে কিছু গরু -ছাগল আছে.. এক পাশে আছে বাহারি ধরণের গাছ। দৃশ্যপট ভালো। পাশের মানুষটাও ভালো।
সবকিছু মিলিয়ে ভালোই লাগতেছে সবকিছু। গতকাল রাতের সেই পীড়াদায়ক মুহূর্তের কষ্ট এক নিমিষেই কেটে গেলো।

অনেক গল্প করলাম। অনেক কিছুই শিখলাম।
আমাকে নাকি ফুল দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছে অথচ এখনো ফুলের কাছেই নিয়ে গেলোনা।
– ভাইয়া, ফুলের বাগান? কোথায় সেই ফুল?

কিশোর ভাই মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
– এই পরিবেশে আবার ঐ ফুল খুঁজো?
এখানেও ফুল আছে তবে এরা অবহেলিত।
এই বলে কিছু কচুরিপানার ফুল,ঘাসফুল তুলে এনে দিলো। দামী প্যান্টটা বটে,ইস্ত্রি করা শার্টের হাতা বটে নিয়ে পুকুরের মধ্যে ভাসমান কচুরিপানার ফুল তোলার সময় মানুষটার সাদা শার্টে কিছুটা কাদা লেগে গেলো…
অথচ সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ও খেয়াল নেই।

তারপর বললো,
– সুন্দর না এগুলো? জানো, এগুলো আমার প্রিয় ফুল। কত সুন্দর দেখতে.. তাইনা?
আমি মাথা নাড়ালাম হ্যাঁসূচকভাবে।

ভাই কৌতূহলী কৌতূহলপরবশ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার কোনো কারনে খুব মন খারাপ; তাইনা?
•°•
আমি আচমকা এই কথা শুনে চোখের পাঁপড়ি ঘন ঘন ফেলে ঠোঁট চেপে বললাম,
– না মানে…হ্যাঁ।
ভাই বললো,
– আমি এসেই বুঝতে পারছিলাম। তাছাড়া লিমা আপু বলেছিলো যে কোনো একটা অজানা কারণে তোমার মুড অফ।
আমি কিছুই বললাম না।
ইচ্ছা করতেছে কালকের সব ঘটনা শেয়ার করি।
কিন্তু অজানা কারণে মন সায় দিচ্ছেনা অথচ ইচ্ছেরা তাড়া দিচ্ছে।
___________

” শুনো লতা, জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এনজয় করার চেষ্টা করবা। সবকিছু তোমার মর্জিমাফিক হবে এমন কোনো ধরা-বাঁধা নেই। যাই হয় সবই পজিটিভলি মেনে নিবা; আর যার জন্য হয় তাকে নেগেটিভভাবে নিয়ে নিজের চিন্তাশক্তির বাইরে ছেঁড়ে দিবা। যে তোমায় বুঝবে, পছন্দ করবে তুমিও তাকে তাই করবা। দেখবা মন উৎফুল্লতায় ভরপুর থাকবে। ভালো লাগবে। খারাপ লাগার মত কথাগুলো থেকে শিক্ষা নিবা তারপর পড়ে থাকা বাকি উচ্ছিষ্টগুলো ঝেড়ে ফেলে দিবা। ”

কথাগুলো কিশোর ভাইয়ের মুখ থেকে বেরোচ্ছিলো আর আমার হৃদয়ে একটা- একটা করে গেঁথে যাচ্ছিলো।
কি সুন্দর করে কথা বলে মানুষটা।
•°•
দুজন একসাথে বাড়ি ফিরলাম।
বিকেলে আড্ডার আসর জমেছে।
প্রান্তিক ভাই ও আছে, কিশোর ভাই ও আছে।
আমি গিয়ে আব্বার পাশে বসলাম।
আব্বার থেকে কিছু দূরেই বসে আছে কিশোর ভাই। প্রান্ত ভাই অপোজিট সাইডে বসে মোবাইলের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে।
নিশ্চয়ই ঐ শোভার সাথে প্রেমালাপ(প্রেমের আলাপ) চলছে…
একবার চোখাচোখি হয়ে গেলো প্রান্ত ভাইয়ের সাথে।

এমনভাবে চোখ ফিরিয়ে নিলো যেন আমি উনার বাড়া ভাতে ছাঁই দিয়েছি।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here