– “আমি এখন বিয়ে করবো না বাবা,আমার কত পড়াশোনা বাকি আছে। নিজের ক্যারিয়ারটা এখন পর্যন্ত ঠিক করতে পারলাম না আর তুমি বলছ এখনি বিয়ে করতে!নো ওয়ে,কোন ভাবেই সম্ভব না।”
– “আদনান,আমি যখন বলেছি বিয়েটা হবে তারমানে হবেই।ছোট থেকে তোমার সব ইচ্ছা আকাঙ্খা আমি পূরণ করেছি।আজ শেষ বয়সে এসে তোমার কাছে আমি কিছু চাইছি আর সেটা তুমি…
– “বাবা তুমি কিন্তু এবার ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল করছ। মা তুমি কিছু বলোনা বাবাকে,”
– “আমি তোদের ঝামেলার মাঝে নেই বাপু। তবে আদনান তোর বাবা ঠিক বলেছে।মেয়েটাকে আমি দেখেছি একেবারে ফুলের মতো মিষ্টি দেখতে।”
– “কিন্তু আমি বিয়েটা করে মেয়েকে খাওয়াবো কি? আমার এখন পর্যন্ত কোন একটি স্হায়ী চাকুরি হয়নি।
সেই জায়গায় কে আমার মতো ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে।আম্মু তুমি অন্তত আমাকো বোঝার চেষ্টা করো।আমাকে কয়েক বছর সময় দাও প্লিজ!”
– “আদনান,আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।এবার তোমরা বাকিটা বুঝবে।”
নিজের মত জানিয়ে দিলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন আদনানের বাবা মাহমুদ রহমান।
আদনান পেছন থেকে তার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকলো।
– “মা,বাবাকে তুমি একটু বোঝায় না!আমি এই মূহুর্তে বিয়ে করতে পারবো না।আমার একটা ক্যারিয়ার আছে।বিয়ে করলে আমার ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাবে!”
আদয়ানের কথার উত্তর দেন না তার মা শিল্পী খাতুন।চুপ করে রুম থেকে বেরিয়ে যান।
শিল্পী খাতুন চলে যেতেই দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে আদনান।বিয়ের সবচেয়ে বড় বাধা ও সমস্যা হলো তার ক্যারিয়ার।ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল দেশের বাহিরে গিয়ে পড়াশোনা করবে।স্কলারশিপ-ও পেয়ে গিয়েছিল,দুইমাস পর যাওয়ার ডেট।কিন্তু হুট করে মাহমুদ খান তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে।আদনানের ধারণা বিয়ে করলে তার ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাবে,বিয়ের দোহাই দিয়ে তাকে দেশে আটকে রাখবে।
– “দাদুভাই,আসবো?”
নিজর দাদা আব্দুর রহমানের আওয়াজ পেয়ে উঠে বসলো আদনান। দৌড়ে তার হাত ধরে নিজের রুমে থাকা সিঙ্গেল সোফাটার মধ্যে বসিয়ে দিল।
-“কি হয়েছে দাদুভাই?মা-বাবার সাথে তোমার কথার আওয়াজ পেলাম। আমি তো তোমাকে এমন শিক্ষা দেইনি যে তুমি মা-বাবার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলবে!আমি তোমার এমন আচরণে কষ্ট পেয়েছি।”
দৃষ্টি নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল আদনান।নিচু হয়ে বসে রইল।নিজেকে আজ তার ছোট মনে হচ্ছে।
-“আমি এমনটা করতে চাইনি দাদা,কিন্তু বাবা হুট করে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।আর দুইমাস পর আমার বিদেশ যাওয়ার ডেট,আমি এই মূহুর্তে কি করে বিয়েতে রাজি হবো?আমার নিজেরও তো ম্যান্টালি প্রিপেয়ার হওয়া লাগবে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আব্দুর রহমান। আদনানের হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করেন,
-“তোমাকে আজ অনয়রকম কিছু কথা বলব দাদুভাই।যা তোমার পরবর্তী জীবনে কাজে দেবে।
ক্যারিয়ার হলো তোমার জীবনের একটি ভালো থাকার উপায়।নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুখে-শান্তিতে রাখার জন্য অবশ্যই একটি সুন্দর ক্যারিয়ার দরকার।আর ক্যারিয়ার গঠনের সঠিক সময়ও দরকার।যেখানে ভার্সিটি লাইফ থেকে মানুষ ক্যারিয়ার গঠনের দিকে নজর দেয় সেখানে তুমি ছোট থেকেই বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েজ নিজের কর্মজীবন সুন্দর করার জন্য,একটা সুন্দর লাইফের জন্য।যার ফলে এমন অনেক কিছুই আছে যা তুমি মিস করে গিয়েছ। অনলাইন ইভেন্টে যোগ দিতে গিয়ে তুমি বন্ধুদের সাথে যাওয়ার ট্যুর বাদ দিয়েছ।পরিবারের সাথে কম সময় কাটিয়েছ। অতিরিক্ত ঘরকুনো হয়ে গিয়েছ,এমনকি কাজিনদের সাথেও তোমার তেমন ভালো সম্পর্ক নেই।প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গিয়েছ তুমি,সেই সাথে রাগীও।তোমার ভাই-বোনদের মধ্যে অনেকে তোমার রাগের জন্য তোমার কাছে আসতে চায় না আর তুমিও তাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখো।আলাদা একটা একাকিত্বের জগৎ বানিয়ে নিয়েছ তুমি।
মনে রাখবে,ক্যারিয়ার তোমার জীবন সুন্দর করার জন্য।আর আমাদূের জীবন সুন্দর হয় নিজের প্রিয় মানুষগুলো নিয়ে।তোমার মা-বাবা তোমাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে,তাদের একমাত্র ছেলে তুমি।যার কারনে তোমার কোন কিছুতেই তারা কখনো বাধা দেয়নি।তোমায় নিজের মতো কাজ করতে দিয়েছে।আমি জানি যে তুমি নিজেও তোমার বাবা-মাকে ভালোবাসো, তাদূের জন্যই কাজ করছ।কিন্তু যেই ক্যারিয়ারেটা যে প্রিয় মানুষগুলোর জন্য তুমি করছ,ক্যারিয়ার গঠনের পর তারাই যদি তোমার কাছে না থাকে!একবার ভাবতে পারছ কি হবে? তোমার মা প্রতিদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করে রাতের না ঘুমিয়ে,অখচ তুমি কোনদিন তাকে এসে একটাবার জড়িয়ে ধরে তাকে এই কাজের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছ? মা-বাবার থেকে অনেক বড় দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তোমার। আগের মতো এখন বাড়িটা আর প্রাণোচ্ছল না।
তাই তোমার মা-বাবা তোমায় বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে,যাতে একটু হলেও তাদের একাকিত্বটা কাটে।
আর মেয়েটাকে কিন্তু আমার বেশ মনে ধরেছে।বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে।কিছুদিন আগে আমার হাতটা ধরে যেভাবে কাঁদল,আমি নাকি তার নানার মতো দেখতে।মেয়েটাকে দেখলেই তুমি প্রচন্ড অবাক হবে কারন মেয়েটা একেবারে তোমার দাদির মতো দেখতে।আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে তাকে দেখেছিলাম,কথা বলা,হাসি সব তোমার দাদির মতো।তোমার উপর আমি কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেব না,তবে হ্যাঁ যে সিদ্ধান্তই নাও ভেবে চিন্তে নিও।মনে রেখো,’ক্যারিয়ার তোমার জীবন সহজের একটা ধাপ মাত্র,আর প্রিয় মানুষ না থাকলে এই জীবনটাই ফিকে’।”
কথাগুলো বলে লাঠিতে ভর করে আস্তে করে উঠে দাঁড়ালেন আব্দুর রহমান।বয়সটা তার বেশ হয়েছে,আগের মতো আর হাঁটাচলা করতে পারেন না।কে জানে কখন আবার শ্বাসটা বন্ধ হয়ে যায়।
আদনান স্তব্ধ হয়ে আছে তার দাদার কথায়।সে কত বড় একটা ভুল করতে যাচ্ছিল।টাকা-খ্যাতির জন্য নিজের আপন মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলো।তার মনে নেই শেষ কবে মার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে।বাবার সাথে বসে গল্প করেছে,আর বাংলাদেশের ক্রিক্রেট খেলা হারার সংবাদ পেয়ে হা হুতাশ করেছে দুইজন মিলে।কতদিন হলো শুক্রবারে মার হাতে বিরিয়ানী খায় না।বেশিরভাগ শুক্রবার তো তার বাইরের কেটে যায় এদিক সেদিক কাজে গিয়ে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল বেলকনির দিকে,ফুলের গাছগুলো যত্নের অভাবে শুকিয়ে গেছে।অথচ সে আর মা করত শখ করে গাছগুলো কিনে এনে লাগিয়েছিল।এখন আর গাছগুলোর যত্ন নেয়া হয়না।
ধীর পায়ে বেলকনিতে গেল আদনান।তার চোখ আজ স্হির হয়ে গেছে,ছোটবেলাটা চোখে ভাসছে।আগে কত সুন্দর দিন কাটাতো,তার সবটা সে ডায়েরীতে লিখে রাখত।অনেকবছর হয়ে গেছে সে আর ডায়েরী লিখে না,এখন তো কম্পিউার নিয়েই সারাদিন পড়ে থাকে।রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারের ভিতর হাত দিল।হাতড়ে হাতড়ে ডায়েরীটা খুঁজে বের করল।ধুলো জমে গেছে ইতিমধ্যে।ডায়েরীর উপরে লাগানো ডিজাইনগুলোর কোনটা কোনটা উঠে গেছে।একবার হাত বুলিয়ে ডায়েরীটা রেখে দিলো।
মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে।অজু করে নামাজ পড়তে গেলো সে।
🍁
শিল্পী খাতুন নামাজ শেষ করে বসে তসবি পড়ছিলেন।হুট করে আদনান এসে তার কোলে মাথা গুজে শুয়ে পড়াতে তার হুস ফিরে। শুনতে পায় আদনান ধীম স্বরে তাকে বলছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।ছলছল চোখে তাকিয়ে থেকে শিল্পী খাতুন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। তিনি আরো অবাক হয়ে যান যখন আদনান বলে উঠে,”বিয়ের কাজ শুরু করতে,সে বিয়েতে রাজি।”
শিল্পী খাতুন আদনানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে আরামে কিছুক্ষণের মধ্যেই আদনান ঘুমিয়ে যায়।মাহমুদ খান রুমে এসে তাদের এভাবে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মাহমুদ খানকে অবাক হতে দেখে শিল্পী খাতুন হাসতে হাসতে পুরো ঘটনা খুলে বলেন।এটাও বললেন যে আদনান বিয়েতে রাজি হয়েছে। মাহমুদ খান যেন এ কথা বিশ্বাসই করতে চান না,কি এমন ঘটলো যে তাদের একগুঁয়ে রাগী ছেলেটা বিয়ের জন্য মূহুর্তের মধ্যে রাজি হয়ে গেল।
মুখে মৃদু হাসি নিয়ে শিল্পী খাতুন বলে উঠলেন,
-“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে।ছেলের আবার হুট করে কখন না কখন মত পাল্টে যায় কে জানে!”
মাহমুদ খানও সায় দিয়ে বলেন,
-“হ্যাঁ,আমি এখনই মহুয়ার বাবার সাথে কথা বলছি।এই শুক্রবার বিয়ে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে।”
মাহমুদ খান ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যান। শিল্পী খাতুন আদনানের মাথায় আবারো হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। কতদিন পর ছেলেকে এভাবে পেয়েছেন তিনি।
আদনান চোখ বুজেই বাবা-মায়ের সব কথা শুনল।নিজের মনকে বারবার প্রশ্ন করছে, বিয়েটা সুখের হবে তো?
চলবে,,,কি?
{নতুন গল্প শুরু করে দিলাম।আপনাদের রেসপন্সের আশা করছি।}
#লাভ_জার্নি
#ফারিহা জান্নাত