লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পর্ব -৩৪+৩৫+৩৬

লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৩৪
সামিরা আক্তার

সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল কে চায়ের শহর বললেও ভুল হয় না। সারা বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক চা বাগান এখানে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ।
রাফসান এখন দাঁড়িয়ে আছে তার চা বাগানের মাঝে। এই বাগান টা যার ছিলো তিনি হঠাৎ করেই বিদেশে স্থায়ী হওয়ায় রাফসানের কাছে বেশ সুলভ মূল্যেই বিক্রি করে গেছে।
রাফসান আনমনে ভাবছিলো। এর মাঝে তার ম্যানেজার এসে বললো- স্যার আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। পাশেই একটা কটেজ পাওয়া গেছে।
– হুম চলো।
– স্যার বলছিলাম চা বাগানের আগের কর্মচারী থাকবে?? না কি নতুন নিয়োগ দেবো??
– বর্তমান কর্মচারীতে কোন সমস্যা??
– না স্যার।
– তাহলে ওনাদের পেটে লাথি মেরে লাভ কি?? এই অমানবিক কাজ রাফসান শিকদার করে না।

ম্যানেজার আর কথা বাড়ালো না। হঠাৎ রাফসান বললো- লাওয়াছড়া উদ্যান কত দূর এখান থেকে?
– বেশি দূর না স্যার। আপনি যাবেন??
– দেখি।

**রাফসান শ্রীমঙ্গল এসেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। সব কাজও গুছিয়ে নিয়েছে।
আজ সে এসেছে এখান কার স্থানীয় বাজারে। গতকালই তার ম্যানেজার তাকে বলেছে এই বাজারে নাকি সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যায়। কারণ এখানে পাশেই কিছু আদিবাসী পল্লী আছে ওরা ওদের তৈরী নানা রকম জিনিস এখানে বিক্রি করতে আনে।
রাফিয়ার জন্য আর মেয়ের জন্য কিছু কিনবে সে।

একমনে ঘুরে দেখছিলো সে। ম্যানেজার সাথে আসতে চাইছিলো। সে আনলো না। এখন মনে হচ্ছে এলেই ভালো হতো।
কি কিনবে সেটাই বুঝতেছে না। হঠাৎ বছর দেড়েকের একটা বাচ্চা তার সামনে ধপাস করে পরে গেলো।
বাচ্চাটার কাছে দৌড়ে গেল রাফসান। হয়তো ব্যাথা পেয়েছে।
রাফসান কে অবাক করে দিয়ে বাচ্চটা খিলখিল করে তার দাঁত বের করে হেঁসে উঠলো। রাফসান একটু কৌতুক বোধ করলো।
মনে তো হলো জোরেই পড়েছে অথচ হাঁসছে। আশে পাশে তাকিয়ে তেমন কাউকে দেখতে পেল না সে। এদিকটায় ভিরও কম।
কার বাচ্চা। চলে যেতেও বিবেকে বাধছে। সে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিতেই পিছন থেকে কারো হাঁপানো মেয়েলি কন্ঠস্বর কানে এলো।
– আদ্র!!
রাফসান ঘুরে পিছনে তাকাতেই জমে গেলো। গলা দিয়ে কথা বের হলো না। বিপরীতের মানুষটারও একই অবস্থা।
হঠাৎ সেখানে দৌড়ে এলো ২৭-২৮ বছরের এক সুদর্শন যুবক। রাফসানের কোল থেকে বাচ্চাটাকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বুকের সাথে জাপটে ধরে বললো- এখানে কেন এসেছিলে বাবা? আমি আর মা কত খুঁজছি তোমায়।

রাফসান এক দৃষ্টিতে সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। কতদিন পর দেখলো। আগের মতই আছে। বরং আগের চেয়ে সুন্দরী হয়েছে।
হঠাৎ লোকটা বলে উঠলো – আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলে আদ্র এত দুষ্টু ওর মা কোল থেকে নামাতেই এদিকে চলে আসছে। আমরা দুজনের কেউ খেয়াল করি নাই।
রাফসানের এবার টনক নড়লো। লোকটা কি বলছে??
লোকটার দিকে তাকাতেই লোকটা হাত হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো- আমি আরিফ।

কৌতুহল বশত হাত মেলালো রাফসান। আরিফ সাহেব কি হয় বাচ্চাটার?? বাচ্চার দিকে তাকিয়ে দেখলো বাচ্চা টা আরিফের মুখটা ধরে বা বা করছে।
বাবা??
হঠাৎ আরিফ বাচ্চা টাকে মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো- বাবা মায়ের কাছে যাও তো।

রাফসানের মনে হলো ও ভুল শুনেছে। বললো- এই বাচ্চার মা কে??
– এই তো ওর মা। বলেই আদ্রকে মেয়েটার কোলে দিলো।
মেয়েটি মাথা নিচু করে ছিল। রাফসান বিস্ফোরিত চোখে মেয়েটার দিকে তাকালো। মাথা টা ঘুরে উঠলো তার। এটা কিভাবে সম্ভব?? রাফসানের মনে হলো তার দম আটকে আসছে। এই কথা শোনার আগে যদি সে বধির হয়ে যেতো?? তার দুনিয়ার সব কিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। কো রকমে মাথা টা ধরে ওখানে বসে পড়লো সে।
আরিফ এগিয়ে আসলো। ব্যাস্ত গলায় বললো- কি হয়েছে ভাই? শরীর খারাপ লাগছে??
রাফসান কোনরকমে দু পাশে মাথা নাড়লো।

মেয়েটা এতহ্মণ চুপ ছিলো এবার আরিফের উদ্দেশ্য বললো- আমরা তাহলে যাই।
– হুম। বলে আরিফ যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাফসান পিছন থেকে ডাক দিলো – চৈতী।
চৈতালী দাঁড়িয়ে গেলো। আরিফ অবাক হয়ে বললো- আপনি চৈতালী কে চিনেন??
রাফসান তার কথার উত্তর না দিয়ে ধীর পায়ে চৈতালীর সামনে এসে বললো- ভালই আছিস তাহলে?

চৈতালী মুখ তুলে চাইলো। রাফসান বললো- ভাল আছিস বলছি কেন?? আমি তো দেখতেই পাচ্ছি ভাল আছিস। স্বামী সংসার নিয়ে আনন্দেই আছিস।
চৈতালী ভ্রু কুচকে রাফসানের দিকে চাইলো। আরিফ এগিয়ে আসছিলো কিছু বলার জন্য। চৈতালী তার হাত ধরে থামিয়ে দিলো।
আরিফ আর কথা বললো না।

রাফসান সে দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো। তার পর বললো- তুই স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছিস আর বাড়ির সবাই ভাবছে তুই মরে গেছিস। স্পেশালি তোর মা বাবা, তারা তো শয্যাশায়ী হয়ে গেছে।

চৈতালী টলমল চোখে রাফসানের দিকে চাইলো। রাফসান আবার বললো- আমাকে বললেই মুক্তি পেয়ে যেতি চৈতী। এত নাটক করলি কেন?? এই অল্পবয়সী ছেলে বিয়ে করার জন্য??

-তাহলে আগেই বলতে পারতি। আমার ইমোশন নিয়ে খেললি কেন?? আমি তো তোকে জোর করি নি। বরং তোরই আমার কাছে আসার জেদ বেশি ছিলো। রাফসান এবার চৈতালীর কাঁধ ঝাঁকিয়ে চিৎকার দিয়ে কথাটা বললো।

আশেপাশের মানুষ খেয়াল করে আরিফ বললো- দেখুন আমি জানি না আপনি চৈতালীর কি হন। তবে আমার মনে হয় আমাদের কোথাও বসে কথা বলা উচিত। সবাই দেখছে।

রাফসান রক্তচক্ষু নিয়ে আরিফের দিকে তাকালো। সব রাগ আরিফের উপর গিয়ে পড়লো। মনে হলো এই লোকই তার কাছ থেকে চৈতী কে কেড়ে নিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো- তার কোন দরকার নেই। আর আমি কে সেটা আপনার বউয়ের কাছ থেকে জেনে নিবেন।

বলেই গটগট পায়ে হেটে বেরিয়ে গেলো সে।

**বাড়িতে এসে আদ্রকে নামিয়ে দিয়ে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকলো চৈতালী। আরিফ সে দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। সে জানে মেয়েটা এখন কাঁদবে। আড়াই বছর আগে মেয়েটাকে যখন সুইসাইড করতে দেখেছিলো তখন সে ছাড়া আর কেউ ছিলো না আশে পাশে।
খুব কষ্টে তার নৌকায় তুলেছিল সেদিন চৈতালী কে। তারপর একটু একটু করে সুস্থ করেছিলো তাকে।
সে আর তার স্ত্রী শিউলি।

তারপর থেকে একা থাকলেই মেয়েটা কাঁদে। তবে আজ কি হলো? কে ছিলো লোকটা?? যে তাকে চৈতালীর স্বামী মনে করলেও চৈতালী প্রতিবাদ করলো না।
আবার তাকে ও বলতে দিলো না।
এটাই কি চৈতালীর স্বামী?? আদ্রর বাবা??

চৈতালী কে কাঁদতে দেখে শিউলি এগিয়ে এসে বললো- এই তো ভাল মানুষ আদ্রর জন্য কেনা কাটা করতে গেলো। এখন কি হলো??
আরিফ সংহ্মেপে বললো ঘটনা টা। তারপর বললো
– ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। ওর যখন মনে চায় ও বলবে।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৩৫
সামিরা আক্তার

সেদিন চৈতালী যখন ডুবে যাচ্ছিল তখন কোথা থেকে ছুটে এসেছিল আরিফ। খুব কষ্টে তাকে টেনে তুলেছিল তার নৌকায়। শখ করে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল সে।
তারপর চৈতালীর যখন জ্ঞান ফিরলো চৈতালী নিজেকে আবিষ্কার করলো আরিফ দের বাড়ি।
জ্ঞান ফিরতেই সে পাগলের মত করছিল। বার বার বলছিল আমার বাচ্চা। আরিফ সহ ওর পরিবারের সবাই ভেবেছিল চৈতালীর বুঝি একটা বাচ্চা আছে।
তার কথাই বলছে।

তারপর শান্ত হয়ে চৈতালী নিজেই বলেছিল সবটা। এরা কে, কেমন মানুষ, কিচ্ছু মাথায় আসে নি তার। শুধু বলে নিজের ভিতরটা হালকা করেছিল।
আরিফের নিজের বলতে ছিলো চাচা, চাচি, দাদি, আর চাচাতো বোন। যার সাথে আরিফের বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল।
তারা সানন্দেই চৈতালী কে আশ্রয় দিয়েছিল। এমন কি তারপর দিন হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট ও করে জেনেছে চৈতালীর বাবু ঠিক আছে।

চৈতালী নিজ ইচ্ছায় তার পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ করে নি। তখন ও চোখের সামনে রাফসান আর আফরিনের দৃশ্য ভাসতো। ফিরে গিয়ে রাফসানের সাথে আফরিন কে দেখার সাহস তার ছিলো না।
তার ধারণা ছিলো রাফসান আর আফরিনের মধ্যে হয়তো সব ঠিক হয়ে গেছে। রাফসান হয়তো ভাল আছে।
হাজার হোক আফরিন তার প্রথম ভালবাসা।
তাহলে আজ কেন রাফসান নিজের ক্রোধ লুকাতে পারলো না??

**ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে চৈতালী বুঝে নি। সত্যি কথা হলো আজ তার কান্না পাচ্ছে না।
এটা তো হওয়ারই ছিলো। সত্য থেকে কেউ পালাতে পারে না।
চৈতালীর ভাবনার মাঝেই দরজায় ধাক্কার শব্দ এলো। দরজা খুলে দেখলো শিউলি দারিয়ে আছে। কোলে আদ্র। শিউলি রাগ হবার ভান করে বললো- এসব কি চৈতালী? তোর যে মাঝে মাঝে কি হয় বুঝি না। ছেলেটার কথা তো ভাববি না কি?? ওকে খাওয়া।

চৈতালী ছেলেকে কোলে নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলের মুখে হাসি। চৈতালী মৃদু হাসলো। যার বাবাকে কালে ভাদ্রে হাসতে দেখেছে তার ছেলের মুখ থেকে হাঁসি সরে না।
আচ্ছা আজ যখন রাফসান ওকে কোলে নিয়ে ছিল তখন রাফসানের কিছু মনে হয় নি??
নিজের ভাবনাতে নিজেরই হাঁসি পেলো ওর। এটা কি সিনেমা না কি?? যে ছেলেকে ছুলেই কেমন কেমন ফিল হবে।
তবে ছেলেটা যে অন্তত একবার বাবার কোল পেলো এর চেয়ে খুশির কি হতে পারে।
আদ্র দেখতে পুরোটাই তার মত। গায়ের রং থেকে শুরু করে নাক, কান, সবকিছু।
তাই রাফসান দেখলেও বুঝবে না। তবে বাবার মত তারও ডান ভুরুতে একটা তিল আছে। রাফসানের যে তিলটায় চৈতালী চুমু খেতো সেরকম।

আচমকা ভয় পেলো চৈতালী। এই তিল দেখে রাফসান যদি কিছু বুঝে? ও এই এলাকায় কেন?? ওর হোটেল তো সিলেটে। শ্রীমঙ্গলে কেন এসেছে??
ওদের যদি খুজে বের করে??
চৈতালী যতই ভাবুক চিনবে না চিনবে না। রক্তের টান যাবে কোথায়??
না না আদ্রকে সাবধানে রাখতে হবে। যদি তার ছেলেকে নিয়ে যায়?? তার ছেলে সৎ মায়ের কাছে বড় হবে??

চৈতালী আর ভাবতে পারে না। ছেলের মুখের দিকে চায় সে। ছেলেটা ইদানিং দু একটা কথা বলতে শুরু করছে। মা মা, বা, বা, এই রকম। এইজন্যই বোধহয় রাফসান আজকে আরিফ কে ওর বাবা ভেবেছে।
চৈতালী একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো।
তার পর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো- অভ্যাস বসত বাবার সামনে আজকে মামা কে যে বা, বা করেছেন। আর আপনার বাবা উল্টো বুঝেছে। অবশ্য এটাই ভালো হয়েছে।
আদ্র মায়ের কথার কি মানে বুঝলো কে জানে?? চৈতালীর দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসলো সে।

** ডাইনিংয়ের সমস্ত জিনিস ভাঙছে রাফসান। তখন চৈতালীর সামনে থেকে আসার পর ইমারজেন্সি বিমানের টিকিট কেটে ঢাকা চলে এসেছে। এরপর বাড়িতে।
আর বাড়িতে এসেই ভাঙচুর করছে। ভয়ে সিটিয়ে আছে আয়শা আর রাফিয়া। রাফসানের এই রাগ তাদের কাছে নতুন।
এই ভাবে কখনও ভাঙচুর করে না সে। জুনায়েদ অবশ্য রাফসান কে আটকাতে চেষ্টা করছে তবে ফলাফল শূন্য।
উল্টো কয়েক বার ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়েছে রাফসান।
ভাঙচুর শেষ হলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয় রাফসান। ওখান থেকে ভেসে আসে আরেক দফা ভাঙার শব্দ।

* রাতে খাবার সময় আরিফ বললো- আদ্র কি ঘুমিয়ে গেছে??
-হ্যাঁ। ছোট করে জবাব দিলো চৈতালী। তারপর একটু থেমে বললো- আজকের পুরো ব্যাপারটার জন্য আমি দুঃখিত ভাইয়া।
– লোকটা…
– আদ্রর বাবা৷ আরিফ কথাটা বলতেই চৈতালী বলে উঠলো।
আরিফ এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চৈতালীর দিকে তাকিয়ে বললো- তাহলে তো ব্যাপারটা খুলে বলা উচিত ছিলো।
– না ভাইয়া। ও জানতো না আদ্রর ব্যাপারটা। যেটা জানতো না সেটা না জানাই থাক। বরং যেটা ভেবে নিয়েছে ওটাই জানুক।

আরিফ অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলো। আড়াই বছর আগে যখন চৈতালী ওদের সাথে থাকতে শুরু করলো তখন এলাকার লোকজন ওর সাথে চৈতালীকে জরিয়ে নানা রকম বাজে কথা বলতে শুরু করে।
একটা অবিবাহিত যুবকের ঘরে এরকম যুবতী তারা মেনে নিতে পারে নি।
আবার সেও চৈতালী কে তারিয়েও দিতে পারে নি। মেয়েটা কি সু্ন্দর ভাইয়া বলে ডাকতো।
গ্রামবাসী পারলে এক প্রকার ওর সাথে ধরে চৈতালী কে বিয়ে দিয়ে দেয়।
উপায় না পেয়ে সে রাতে তার চাচা -চাচি কাজি ডেকে তার আর শিউলির বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপর রাতের অন্ধকারে শিউলির হাত ধরে চৈতালী কে সাথে নিয়ে সিলেট ছেড়ে তারা মৌলভীবাজার চলে আসে।
আরিফ একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো। তার বললো- তোর যেমন ইচ্ছা।

* রাফসান রুমের মধ্যে হাত- পা ছড়িয়ে বসে আছে। হাতে চৈতালীর একটা ছবি। ঝাপসা দৃষ্টিতে সে দিকে চেয়ে আছে রাফসান। তার চৈতালী অন্য কারো বাচ্চার মা!?? এটা সে ভাবতেই পারছে না।
বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক।
রাফসান উঠে আয়নার সামনে দাড়ালো। তাকে কি খুব বেশি বয়স্ক লাগে??
চৈতী কি এই কারণে তার কাছ থেকে চলে গেছে??
আচ্ছা চৈতালী কি আদেও কখনো তাকে ভালবেসেছিলো?? না কি দয়া করেছিলো??

আর ভাবতে পারে না রাফসান। ভেতরের কান্না গুলো দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসে। কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদে না?
চার দেয়ালের মাঝখানে রাফসান গুমরে গুমরে কাঁদে। যাকে হন্যি হয়ে খুজছিলো তাকে আজ অন্য কারো স্ত্রী, অন্য কারো বাচ্চার মা হিসাবে দেখে এসেছে সে।
অথচ এই মানুষটা একদিন শুধু তার ছিলো।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৩৬
সামিরা আক্তার

আদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে চৈতালী। তার বেঁচে থাকার মূল কারণ তার ছেলেটা। এই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে তার এই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
কিন্তু রাফসান?? তার সাথে আবার কেন দেখা হলো??
যদি বুঝে যায়??
তার ছেলেকে নিয়ে কি ওই আফরিনের হাতে তুলে দেবে??
চৈতালী ভাবতে পারে না। আদ্রকে বুকের সাথে চেপে ফিসফিস করে বলে আপনাকে আমি কাউকে দেবো না আব্বা। কাউকে না।

চৈতালী যখন আদ্রকে হারানোর ভয়ে সিটিয়ে রাফসান তখন চৈতালীর একটা ছবি বুকে জরিয়ে বসে আছে।
মনে মনে বলছে এমন কেন করলি চৈতী??
আমার অগোছালো জীবন টা গোছাতে এসে তুই যে আমায় উল্টো ভেঙেচুরে দিলি।
ওই ছেলেটা কি আমার চেয়ে বেশী ভালবাসে তোকে?? তুই কি ওই ছেলেটাকেও জরিয়ে ধরে ঘুমাস??
ওই ছেলেটার স্পর্শে ও কি কেঁপে উঠিস??

রাফসানের মাথার ভিতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। তার চৈতী কে অন্য কেউ ছোয় ভাবতেই শরীরের ভিতর রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে।
রাগে এক ধাক্কায় সামনে থাকা টেবিল ফেলে দিলো সে। তারপর আস্তে আস্তে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো সে।
তার এত কষ্ট কেন হচ্ছে?? এই কষ্টের শেষ কোথায়??

** সকাল বেলা পুরো ডাইনিং জুরে পায়চারী করছে আয়শা বেগম। মাঝে মাঝে রাফসানের রুমের দিকে তাকাচ্ছে। পাশেই সোফায় জুনায়েদ, রাফিয়া, আর আসমাত শিকদার বসা। সবাই চিন্তিত।
তবে কেউই রাফসানের দরজায় নক করার সাহস পাচ্ছে না।
কাল কি হয়েছিল কেউ জানে না। কেনই বা রাফসান এরকম করলো??
রাফসান কে আজকাল এমনি তেই বুঝতে পারে না তারা।
নিজ থেকে কিছু না বললেও তো জানা যাবে না।

এমন সময় দরজা খুলে রাফসান বের হলো বেশ স্বাভাবিক ভাবে। জুনায়েদ রাফসানের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাফসানের চোখ দুটো অসম্ভব লাল। বোঝাই যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি। কিন্তু কেন??
রাফসান হঠাৎ বলে উঠলো – মেঝো চাচা- চাচী আর ছোট চাচা চাচী কে ডেকে আন রাফু।

রাফিয়া কৌতুহলী দৃষ্টিতে রাফসানের দিকে তাকালো। তারপর জুনায়েদের দিকে তাকাতেই জুনায়েদ যেতে ইশারা করলো।
রাফিয়া যাওয়ার পর রাফসান বললো- আমাকে নাস্তা দাও মা।
আয়শা নাস্তা দেবার জন্য গেলো। জুনায়েদ রাফসান কে পর্যবেহ্মণ করছিলো। রাফসান স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে বটে তবে সফল হচ্ছে না।
অন্তত জুনায়েদের চোখে তা ধরা পরে যাচ্ছে। রাফসানও বোধ হয় জানে তার এই বন্ধুটি তাকে পড়তে পারে তাই ওর দিকে তাকাচ্ছে না।
যাই হোক জুনায়েদ রাফসান কে ঘাটালো না। তার ধারনা একটু পরেই সব জানা যাবে।

রাফসানের ছোট চাচা ছোট চাচী চলে এলেও চৈতালীর বাবা মার আসতে দেরি হলো। রাফসানের ততহ্মণে খাওয়া হয়ে গেছে।
আসলাম শিকদার আর রেবেকা এলেন চৈতালীর নানী গুলনাহার বেগম কে সাথে নিয়ে।
তিনি মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তাকে সাথে নিয়ে আসতেই দেরি হয়েছে তাদের।

সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে গুলনাহার বেগম রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললেন – নাতজামাই কেমন আছো??
– নাতজামাই!!?? বলে রাফসান তাচ্ছিল্যের একটা হাঁসি দিলো
রাফসানের কথার ধরণে সবাই একটু অবাক হলো। রাফিয়া আমতাআমতা করে বললো- এভাবে কথা বলছো কেন ভাইয়া??
বাকিরাও জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকালো।

রাফসান রেবেকার দিকে এগিয়ে এসে বললো- তোমার মেয়ে, মেয়ে জামাই, নাতিকে দেখে এলাম কাল মেজোমা। বেশ আনন্দে শপিং করছে। তুমি শুধু শুধু মরে গেছে ভেবে বছরের বার মাসের নয় মাস অসুস্থ হয়ে যাও।

রাফসান কথাটা বললো অতি স্বাভাবিক ভাবে। শান্ত গলায়। কিন্তু তার কথায় ঘরের মধ্যে একটা বড় সর বজ্রপাত হলো। সবাই যেন বোবা হয়ে গেলো।
আরমান শিকদার কোনরকমে বললেন- কি বলছিস কি তুই?? চৈতালী বেঁচে আছে?

রাফসান মৃদু হাসলো। তারপর বললো- তুমি বোধহয় আমার কথা পুরোটা শোন নি ছোট চাচ্চু। তোমার ভাতিজির একটা ছেলে আছে। কাল তার হাজবেন্ডের সাথে আমি হ্যান্ডশেক করে এসেছি।

তারপর একটু থেমে বললো- আসলে বেচারির কি দোষ?? তোমরা ধরে বেধে একটা আধবুড়ো লোকের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিলে। ওর ও তো জীবনে খুশি বলে কিছু আছে না কি??
তোমাদের কথার অবাধ্য হতে পারে নি আবার নিজের খুশিও বিসর্জন দিতে পারে নি। তাই এত নাটক।
শেষের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেঁপে বললো রাফসান।

– তোর কোথাও ভুল হচ্ছে না তো রাফসান?? এতহ্মণে মুখ খুললো জুনায়েদ।
রাফসান এবার উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। অনেকটা অসুস্থ লোকের মত হাসি। তারপর জুনায়েদের কাছে গিয়ে বললো- চৈতীর শরীরের এ টু জেড আমার জানা। আর তাকে আধাঘন্টা সামনে দেখেও ভুল হবে??

তার পর সবার দিকে তাকিয়ে বললো- আমি শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। চা বাগান টা বিক্রি করে দেবো। সিলেটে থাকার দরকার আমার ফুরিয়েছে। তবে এর মাঝে যদি আবার চৈতীর দেখা পাই তোমাদের খবর দেবো। তোমার দেখা করে এসো।
বলেই বেরিয়ে গেলো সে।

রাফসান যেতেই সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আয়শা বেগম। তিনি এখনও হজম করতে পারছেন না বিষয়টা। চৈতালী এরকমটা করলো?
সেই আবার তার ছেলেটা কষ্ট পেলো। আর কেউ না বুঝুক তিনি তো বুঝতে পারছেন তার ছেলেটা ভেতরে ভেতরে শেষ।
রেবেকা আর আসলাম শিকদার যেন কথা বলতে ভুলে গেছেন। মেয়ে বেঁচে আছে এটা যেমন খুশির তেমন মেয়ে আবার বিয়ে করেছে এটাও মানতে পারছেন না তারা।
চুপ করে আছেন শুধু আসমাত শিকদার। বুকে ব্যাথা অনুভব করছেন তিনি। তার চৈতালী এমন করেছে কেন জানি মনটা বিশ্বাস করছে না। এটা হতে পারে না।
আর রাফিয়া তো ভাইয়ের জন্য জুনায়েদ কে জরিয়ে ধরে কাঁদছে।
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here