লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পর্ব -৩১+৩২+৩৩

লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৩১
সামিরা আক্তার

-দেখুন আমি এখনই রাফসানের সাথে দেখা করবো। কোন পরে টরে না। আর আপনি যদি এই মুহুর্তে আমাকে রুম নাম্বার না বলেন তাহলে আপনার এই চাকরির আজই শেষ দিন।
রাগে গজগজ করতে করতে বললো চৈতালী।

রিসিপশনের মেয়েটা একটু ভয় পেলো। আমতা আমতা করতে করতে বললো- ম্যাম আমি আপনাকে রুম নাম্বার দিচ্ছি। তবে ব্যাক্তিগত ভাবে অনুরোধ করছি একটু পরে যান। আমিই আপনাকে বলে দেবো কখন যাবেন। আপনি স্যারের কে হন আমি জানি না। তবে হুট করে না শুনে পাঠালে যদি স্যার রাগ করে?? আমার প্রবলেম হয়ে যাবে।

চৈতালীর এবার একটু খটকা লাগলো। এই মেয়ে বার বার তাকে পরে যেতে বলছে কেন?? এটা ঠিক সে
পরিচয় দেয় নি।
– কি ব্যাপার বলুন তো?? বার বার পরে যেতে বলছেন কেন??
একটু ইতস্তত করে মেয়েটি বললো- আসলে ম্যাম রুমে স্যারের সাথে ওনার ওয়াইফ আছে।

চৈতালীর মনে হলো ও ভুল শুনেছে। বৌ মানে?? সে তো এখানে। তাই আবার বললো- কে আছে??
– ম্যাম সারের ওয়াইফ। এইতো কিছুহ্মণ হলো এসেছেন। তাইতো আপনাকে পরে যেতে বলছি।

মেয়েটা আরও কিছু বলছিলো হয়তো। কিন্তু চৈতালীর আর কোন কথা কানে গেলো না। তার মাথায় একটাই কথা বাজছে রুমে স্যারের ওয়াইফ আছে। নিজেকে কোন রকম সামলে নিয়ে বললো- রুম নাম্বার প্লিজ।
মেয়েটা রুম নাম্বার বলতেই সে কোন রকম টলতে টলতে রাফসানের রুম দিকে যেতে লাগলো।

এদিকে আফরিন যখন রাফসানের পা ছাড়ছিলোই না তখন রাফসান বললো- পা ছাড়ো আমি তোমাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। কারণ তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে বলেই আজ আমি সুখী। আমার স্ত্রীর মত চমৎকার একজন মানুষ আমার জীবনে এসেছে।
না হলে তো তোমার মত বেঈমানের সাথে জীবন কাটাতে হতো।
আফরিন উঠে দাড়িয়ে অবাক কন্ঠে বললো- তুমি বিয়ে করেছো??
– তো কি ভাবছো তোমার জন্য দেবদাস হয়ে আছি?? হাউ ফানি! তাচ্ছিল্যের একটা হাঁসি দিলো রাফসান

আফরিন আর কথা বাড়ালো না। শুধু বললো – আসি।
আসি বলেই বললো- আমি তোমাকে একটু জরিয়ে ধরতে চাই রাফসান। শেষবারের মত।
– একদম চেষ্টা করো না। দাঁতে দাঁত চেপে বললো রাফসান। অনেকহ্মণ যাবত তোমাকে সহ্য করছি। এবার বের হও। আমি তোমার চেহারা আর দেখতে চাই না। বলেই ঘুরে দাঁড়ালো রাফসান।
কিন্তু তার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই তাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো আফরিন।

অনেকটা নাটকীয় ভাবেই সেই মুহূর্তে রাফসানের রুমের সামনে এলো চৈতালী। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো দরজা ভেজানো। দরজায় ধাক্কা দেবার আগে সে শুধু এটাই প্রার্থনা করলো যেন রিসিপশনের মেযেটার কথা মিথ্যা হয়।
তারপর অনেক কষ্টে মুখে হাঁসি এনে আস্তে করে দরজা ধাক্কা দিতেই চোখে পড়লো রাফসানকে জরিয়ে ধরে থাকা আফরিন কে।

নাহ্ চৈতালীর আফরিন কে চিনতে একটু ভুল হলো না। মুহূর্তেই তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেলো। তার রাফসান!!?? মাথাটা ঘুরে উঠলো। পড়তে গিয়ে কোনরকমে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলালো সে। দেয়ালের সাথে হাত লেগে হাতের কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে হাতে বিধে গেলো। সেদিকে নজর না দিয়ে আর একবার রুমের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে কান্না আটকিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো সে।
হাতের মোবাইলটা পরে গেল সেটাও চেয়ে দেখলো না। এক দৌড়ে হোটেলের বাইরে চলে এলো।

রাফসান এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে আফরিন কে সরালো। এই জঘন্য মেয়েকে টাস করার ইচ্ছেই ছিলো না তার। কিন্তু জরিয়ে ধরার কারণে পারলো ও না। ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে নিলো সে। না চাইতেও এই মেয়েকে ধরতে হয়েছে তার।
এবার রাগ গিয়ে পড়লো রিসিপশনের উপর। ওখান থেকে রুম নাম্বার না দিলে তো আসতো না।
ঝট করে রিসিপশনে ফোন দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো- এই ফালতু মেয়েকে আমার রুম নাম্বার কেন দেওয়া হয়েছে??

মেয়েটি এমনিতে রাফসানের রাগী গলা শুনে ভয়ে সিটিয়ে ছিলো। রাফসানের পরের কথা শুনে ভাবলো চৈতালীর কথা বলছে। কোনরকমভাবে বললো- আমি না করেছিলাম স্যার। কিন্তু উনি বললেন না দিলে চাকরি থাকবে না।
– তোমার চাকরি কে দিয়েছে?? ওই মেয়ে না আমি?? ফারদার আমাকে জিজ্ঞেস না করে আমার কোন ইনফরমেশন কাউকে দিলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
বলেই ফোনটা রেখে দিলো সে।

রাফসান ফোন রাখার কিছুহ্মণ পরেই তার ফোনে ফোন দিলো আসমাত শিকদার। ফোন ধরতেই তিনি হাসিমুখে বললেন – কিরে কেমন লাগলো সারপ্রাইজ??
– সারপ্রাইজ মানে? রাফসানের ভ্রু দুটো আপনা আপনি কুচকে গেলো।
আসমাত শিকদার একটু অবাক হলেন। চৈতালী এখনও পৌঁছায় নি?? কিন্তু হিসাব মত তো চৈতালীর আরও ১ ঘন্টা আগে পৌঁছে যাওয়ার কথা। এবার তার চিন্তা হতে লাগলো। চৈতালী ফোন তোলেনি বলে তিনি ভেবেছেন ও পৌঁছে গেছে। বললেন – আমি তোকে পরে ফোন করছি। বলেই রাফসান কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলেন।
রাফসান অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি বললো তার বাবা সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো।

আসমাত শিকদার একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছেন চৈতালী কে। কিন্তু কোন রেসপন্স নেই। এবার চিন্তায় তিনি ঘামতে শুরু করলেন। মেয়েটার কোন বিপদ হলো না তো?
তাড়াতাড়ি রাফসান কে ফোন করলেন আবার। কেউ জানতেও পারলো না চৈতালীর ফোনটা রাফসানের হোটেলের গার্ডেনে বেজে চলেছে।

রাফসান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো তার বাবা আবার ফোন করেছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যাস্ত গলায় আসমাত শিকদার বললেন- চৈতালী এখনও পৌছায় নি??
রাফসান অবাক হলো। বললো- চৈতালী পৌছাবে মানে??
– চৈতালী আজ সিলেট গেছে তোকে সারপ্রাইজ দিতে। ২টার সময় ওর ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। তারপর সিএনজি তে উঠে আমার সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু এখন ফোনে পাচ্ছি না।
রাফসানের মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। গলায় কথা আটকে গেলো। অজানা ভয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। একট শুকনো ঢোক গিলে কোন রকমে বললো- কয়টায় ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে বললে??
-২ টায়।
রাফসান কথা বলতে ভুলে গেলো। এখন প্রায় চারটা বাজে। এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসতে লাগে বড়জোর ৩৫ মিনিট। তাহলে কই গেলো চৈতী??
কোন বিপদ হলো না তো??
রাফসান ধপ করে খাটে বসে পড়লো। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রুমের ড্রেসআপেই সে বাইরে বেরিয়ে এলো।
দরজার কাছে আসতেই পায়ে কিছু বিধলো তার। তখনই মনে হলো জুতা পরে নি। বিষয়টা কে পাত্তা না দিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে পৃথিবী দুলে উঠলো তার।

ভাঙা লাল কাঁচের চুড়ি। চৈতীর চুড়ি। এই চুড়িই তো রাফসান প্রথম বিবাহবার্ষিকীর দিন পড়িয়ে দিয়েছিলো। এই চুড়ি এখানে?? তার মানে চৈতী এখানে এসেছিল?? তাহলে তার কাছে গেলো না কেন??
এক দৌড়ে রিসিপশনে গেলো রাফসান। রিসিপশনের মেয়েটা রাফসান কে এরকম টাউজার আর গেন্জিতে দেখে হকচকিয়ে গেলো।
রাফসান ফোন থেকে চৈতালীর একট ছবি বের করে এগিয়ে দিয়ে বললো-ও এসেছিল??
মেয়েটা একবার ছবির দিকে আর একবার রাফসানের দিকে তাকালো। রাফসান কে কেমন উদ্ভট দেখাচ্ছে।
– কি হলো বলছো না কেন? এক চিৎকার দিয়ে বললো সে।
রাফসানের চিৎকারে সবাই কেঁপে উঠলো। মেয়েটা কোনরকম কাপতে কাপতে বললো- ওনার কথাই তো আপনাকে ফোনে বলেছিলাম স্যার।
– ওর কথা বলেছিলে মানে??
– স্যার উনি এসে আপনার রুম নাম্বার জানতে চাইলো। আমি প্রথমে দিতে চাই নি। কিন্তু যখন চাকরির ভয় দেখালেন তখন দিয়েছিলাম। কিন্তু রুমে পরে যেতে বলেছিলাম। কারন রুমে তখন আপনি আর আপনার ওয়াইফ ছিলেন।
রাফসান যেন এবার আকাশ থেকে পড়লো। বললো – ওয়াইফ মানে?? তুমি যাকে কথাটা বলেছো সেই আমার ওয়াইফ।
মেয়েটা যেন এবার কথা বলতে ভুলে গেলো। তো তো করতে করতে বললো- তাহলে ওই সবুজ ড্রেস পরা মেডাম?? উনি যে বললেন উনি আপনার ওয়াইফ।
রাফসান এবার মেয়েটার দিকে তেড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো- আমি ফোনে ওই মেয়েটার কথাই তোমাকে বলছি।
পরহ্মণেই আবার বললো- চেতীর যদি কিছু হয় তোমাকে সহ তোমার ওই সবুজ ড্রেস পরা মেডাম কে আমি দেখে নেবো।
বলেই চৈতালীর নাম্বারে ফোন দিলো সে। এরই মাঝে একজন গার্ড এসে তার দিকে একটা ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো- স্যার এই ফোনটা গার্ডেনে পরে ছিলো।

রাফসান না চাইতেও ফোনের দিকে তাকালো। আর তাকিয়েই বুকটা কেঁপে উঠলো তার। কারণ ফোনটা চৈতালীর।
কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে দেখলো স্কিনে রাফসানের নাম্বার ভাসছে। তিনটা লাভ ইমুজি দিয়ে সেভ করা নাম্বার।
( ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৩২
সামিরা আক্তার

হোটেলের সব কয়টা সিসিটিভি ফুটেজ দেখার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ফুটেজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চৈতালী হাসিমুখে হোটেল ঢুকছে। তার পরনে লাল পাঁড়ের সেই সাদা শাড়ি।
রিসিপশনে কথোপকথনের পরই তার হাঁসি মুখটা আঁধার হয়ে গেল।
রাফসানের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কষ্ট পেয়েছে।
রাফসানের ইচ্ছে হলো পুরো দুনিয়া উল্টে ফেলতে।

– স্যার থানায় খবর দেওয়া হয়েছে। চারিদিকে লোক লাগানো হয়েছে। ইনশাআল্লাহ তাড়াতাড়ি ম্যাডামের খবর পাব আমরা।
ম্যানেজারের কথা শুনে একটু তাকালো রাফসান। তার অসহ্য কষ্ট হচ্ছে। চৈতী কে না পাওয়া পর্যন্ত এই কষ্ট কমবে না।
হঠাৎ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল সে। ফুটেজ টা তার রুমের সামনের। যেখানে চৈতালী আরও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তার মানে রুমে আফরিন কে দেখেছিলো চৈতী। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা আগেই ক্লিয়ার হয়ে গেছিলো।
এবার একদম পানির মত হয়ে গেলো ব্যাপারটা।
রাফসানের হাত আপনা আপনি মুঠ হয়ে এলো। সব ঝামেলা এই মেয়ের জন্য। এত বছর পরে আবার তার জীবন ওলট-পালট করার জন্য এসেছে
এই মেয়েকে তো সে দেখে নেবে আগে চৈতীকে পাক।

রাফসানের চৈতালীর প্রতি অভিমান হলো। এই মেয়ে এই চিনেছে তাকে। এতটা অবিশ্বাস। এক
বার পেয়ে নিক রাফসান কথাই বলবে না।

**দু পায়ে মাথা গুজে বসে আছে চৈতালী। জায়গা টা কোথায় সে জানে না। তেমন একটা লোকজন ও নেই
না থেকে বেশ ভালো হয়েছে চৈতালী ইচ্ছে রকম কান্না করতে পেরেছে।
নিজের ভাগ্যের উপর হাঁসি পেলো তার। দিনশেষে তাকেই কেন ঠকতে হলো? যার সাথে বিয়ে হবার কথা ছিল সে ঠকালো, বাবা মা তাকে বোঝা মনে করে দ্বিগুন বয়সী একজনের সাথে বিয়ে দিলো।
সবশেষে চৈতালী যখন সেই মানুষটাকে পাগলের মত ভালবাসলো তখন সেই মানুষটা ও তাকে ধোকা দিয়ে প্রথম স্ত্রীর সাথে হোটেল রুমে….
চৈতালী আর ভাবতে পারলো না। তার চোখে শুধু আফরিনের রাফসানকে জরিয়ে ধরার দৃশ্য টাই ভাসতে লাগলো।
কিন্তু চৈতালী জানতেও পারলো না সে যাকে ভুল বুঝেছে সে তাকে না পেয়ে পাগলের মত অবস্থায় আছে।

আসমাত শিকদার কে রাফসান কেবল এতটুকুই বলতে পেরেছিল যে বাবা চৈতী হারিয়ে গেছে। আর কিছু বলতে পারে নি।
তাতেই আসমাত শিকদার বুঝে গিয়েছেন ছেলের মনের অবস্থা। পুরো শিকদার পরিবার তাই ছুটেছে সিলেটের উদ্দেশ্য।
সবার মনে একটাই কথা যেন তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় চৈতালী কে।

রাফসান পাগলের মত খুঁজে চলেছে চৈতালী কে। মনটা তার বড্ড কু গাইছে। চৈতালীর কোন বিপদ হলো না তো? কোথায় আছে মেয়েটা? এই শহরের কিছু তো চিনে ও না।
একটু পর তো সন্ধ্যা নামবে। রাফসান আর ভাবতে পারে না। তার কলিজাটা কোথায় আছে??
কেন ভুল বুঝলো তাকে??
না ভালবাসে নি। একদম ভালবাসে নি চৈতী তাকে। না হলে তাকে অবিশ্বাস করতে পারতো না।
চৈতী কি জানে না তাকে ছাড়া মরে যাবে রাফসান। একদম মরে যাবে।

** সবাই যখন চৈতালী কে খুঁজতে ব্যাস্ত চৈতালী তখন নিজের জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা নামতে চললো।
চৈতালীর সামনে একটা নদী। এই নদী কি তার সব যন্ত্রনা নিভিয়ে দিতে সহ্মম?
কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে পায়ের জুতাটা খুলে একপাশে রাখলো সে। তারপর একটা হাত আপনাআপনি চলে গেল পেটে।
মনে মনে বললো -কেউ জানলো না তোর কথা। টেস্ট করা ৫টা কিট ময়লার ঝু্ড়িতে ফেলে এসেছি আমি। তোর বাবাও কোনদিন জানতে পারবে না।
বলেই এক পা দুই পা করে নদীর দিকে এগিয়ে গেলো সে।

**রাত দশটা বাজার পরও যখন চৈতালী কে খুঁজে পাওয়া গেলো না তখন পাগলের মত করতে শুরু করলো রাফসান৷
ছেলের অবস্থা দেখে মুখে কাপড় চেপে কাঁদতে শুরু করলো আয়শা বেগম। কেন তার ছেলেটার কপালে সুখ সহ্য হয় না।
আসলাম শিকদারের অবস্থা ও শোচনীয়। রেবেকা বেগম কে ঘুমের ইন্জেকশন দেওয়া হয়েছে। মেয়েকে হারিয়ে তিনি পাগলামি করছিলেন।

**এই পুরো বিষয়টার জন্য আসমাত শিকদার নিজেকে দায়ী মনে করছেন। তিনি যদি চৈতালীর পাগলামিতে সায় না দিতেন তাহলে এত কিছু হতোই না।
দুই ভাই, ভাতিজা সবাই কে একা হাতে সামলাচ্ছে চৈতালীর ছোট চাচা আরমান শিকদার। ভাতিজির জন্য তার কষ্ট হলেও সেটা দেখানোর সময় নেই তার।

পুরো হোটেল জুরে নিস্তব্ধতা। কেউ কেউ রাফসানের জন্য আফসোস করছে। আবার কেউ কেউ পিন ফুটাতে ছাড়ছে না।
নিশ্চয়ই তাদের স্যার ওই ম্যাডামের সাথে এমন কিছু করছিলেন যা তার বৌ দেখে নিয়েছে। যার জন্য এই অবস্থা।

** পুরো একদিন একরাত চৈতালীর কোন খবর পাওয়া গেলো না। শিকদার পরিবারের অবস্থা পাগল প্রায়।
দ্বিতীয় দিন হোটেলের ম্যানেজার এসে বললো – স্যার এই পাশে একটা নদী আছে আমাদের একটু সেখানে যেতে হবে।
– চৈতী কে পাওয়া গেছে?? ম্যানেজারের দিকে এক প্রকার দৌড়ে এলো রাফসান।
ম্যানেজার মাথা নিচু করে রইলো।
– কি হলো বলছো না কেন? চিৎকার দিয়ে উঠলো রাফসান।
ম্যানেজার কেঁপে উঠলো। ভয়ে ভয়ে বললো- স্যার ওখানে কিছু জিনিস পাওয়া গেছে। সম্ভবত সেগুলো ম্যামের। মানে সিসিটিভি ফুটেজে যেরকম দেখেছিলাম।

নদীটা ছোট তবে খরস্রোতা। পাহাড়ি নদী। পাশেই চৈতালীর ব্যাগ আর জুতা পরে আছে। চিনতে কারো ভুল হলো না।
কয়েকটা ভাঙা চুড়ি ও দেখা গেলো। নদীর তীরে কতগুলো পায়ের ছাপ যা নদীতে নেমে গেছে।

জুনিয়র পুলিশ অফিসার ওসির দিকে তাকিয়ে বললেন
– স্যার মনে হচ্ছে তো সুইসাইড কেস।
– হু আমারও তাই মনে হচ্ছে।
– স্যার খরস্রোতা নদী। জাল ফেললেও তো কিছু পাওয়া যাবে না। লাশ মেবি স্রোতে ভেসে গেছে।
রাফসান বিধ্বস্ত অবস্থায় চৈতালীর জিনিসগুলো বুকে জরিয়ে বসে ছিলো। পুলিশ অফিসারের কথা শোনা মাত্র তার গলা চেপে ধরলো।
– লাশ মানে?? কি বলতে চাইছেন আপনি??
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৩৩
সামিরা আক্তার

হাসপাতালে চিন্তিত মুখে বসে আছে শিকদার বাড়ির লোক। তখন পুলিশের সাথে ঝামেলা করতে করতে রাফসান হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়।
এখন পর্যন্ত তার জ্ঞান ফিরে নাই। তাছাড়া চৈতালীর বাবা মা কাউকে সামলানো যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে একটা বাজে পরিবেশ।

আসমাত শিকদারের মনে হচ্ছে এই সব ওনার জন্যই হয়েছে। যদি তিনি চৈতালীর সাথে তাল না মিলাতেন। তাহলে এসব কিচ্ছু হতো না। তাছাড়া চৈতালীর বাবা মাকেই কি বলবেন তারা? আসলাম তো তার এক কথায তার মেয়েকে দিয়েছিল। অথচ সে মেয়েটাকে সুরহ্মিত রাখতে পারলো না।
এর মধ্যেই রাফসান কে চিকিৎসারত ডাক্তার দেখে আয়শা বেগম এক প্রকার দৌড়ে গেলেন ওনার কাছে।
– ডাক্তার আমার ছেলে??
– দেখুন ওনার মেজর একটা হার্ট এট্যাকে হয়ে গেছে। এখন আপাতত ঠিক আছেন। বাকি টা জ্ঞান ফিরলে বলা যাবে। তবে আমার মনে হলো সুস্থ হওয়ার ইচ্ছা ওনার নিজের মধ্যেই নেই। শরীরটা কে রেসপন্স করাতে চাইছেন না।
ডাক্তার যেতেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন আয়শা। কি থেকে কি হয়ে গেলো তিনি বুঝতে পারছেন না। চৈতালী কেন ভুল বুঝলো তার ছেলেকে?? চৈতালী কি জানে না এই আড়াই বছরে সে রাফসানের অক্সিজেন হয়ে গেছে। এখন চৈতালী নেই তাই নিজেও বাঁচতে চাইছে না।সুস্থ হতে চাইছে না।

রাতের দিকে রাফসানের অবস্থার হঠাৎ করে অবনতি হলো। জরুরি ভাবে তাকে ঢাকার একটা বড় হাসপাতালে শিপট্ করা হলো।

আসলাম শিকদার রেবেকা কে সামলাতে পারছেন না। তার উপর রাফসানের এই অবস্থা। সে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিলো। তার অবস্থা কেউ জানলো না। সেও তো বাবা। তার ও তো মেয়ে গেছে। তার বুকের মধ্যেও তো ভেঙেচুরে যাচ্ছে।
এ কি হ্মত করে দিয়ে গেলো চৈতালী তাদের? এই হ্মত নিয়ে বাঁচতে হবে বাকিটা জীবন? কেন সবটা বুঝলো না??
সব ভুলে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। রেবেকা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে নিজেও কেঁদে উঠলেন।
একটাই মেয়ে তাদের। বিয়ের কত বছর পর আল্লাহ দিয়েছিল। তাহলে কেন আবার কেড়ে নিলো??
রাফসান কেও তো দোষ দেওয়া যায় না।
তার বাস্তব বুঝতে পারা মেয়েটা কেন ছেলে মানুষি করলো। ভালবাসার কাছে বোধহয় সবাই ছেলেমানুষ।

** রাফসান সুস্থ হলো। দিন গেলো। মাস গেলো। বছরও পেরিয়ে গেলো। একসময় শিকদার বাড়ির সবাই বিশ্বাস করে নিলো চৈতালী আর নেই।
এভাবেই কেঁটে গেলো প্রায় আড়াই বছর। সবাই প্রায় স্বাভাবিক হলো। শুধু বদলে গলো রাফসান।
প্রথম একবছর সে এক প্রকার ঘরবন্দী জীবন কাটিয়েছে। চৈতালীর ছবির দিকে তাকিয়ে নানা রকম অভিযোগ করেছে। তার সাথে একা একা কথা বলেছে। সবাই ধরে নিয়েছিলো বোধ পাগল হয়ে গেছে।

তারপর একদিন একাই বের হলো। নিজের ব্যবসা পত্র শিপট্ করলো সিলেটে। এখন বেশির ভাগ সময় সেখানেই কাটায়।
আসমাত শিকদার আর আয়শা বেগম বুঝতে পারেন ছেলে সেখানে চৈতালী কে খোঁজে। কিন্তু পায় না। কিন্ত তারা এটা জানেন না সিলেটের এক কোনা থেকে চৈতালী কে খুঁজতে শুরু করেছে রাফসান।
পাগলের মত গত দেড় বছর ধরে খুঁজছে। তার বিশ্বাস তার চৈতী আছে। ওকে থাকতেই হবে।

**আজ রাতের ফ্লাইটে বাংলাদেশ আসছে রাফিয়া আর জুনায়েদে। রাফসানও সিলেট থেকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। চৈতালী নিখোঁজ হওয়ার সময় রাফিয়া এসেছিল। তারপর আর আসে নি।
আজ অনেক দিন পর আবার সবাই একসাথে। ভাইকে দেখে চাপা কষ্ট অনুভব হয় রাফিয়ার। তার ভাই কেন সুখী হতে পারে না? চৈতালীর মত শক্ত মেয়ে কেন এমন করলো??
এত গুলো প্রশ্ন যার কোন জবাব নেই।

রাতে খাবার টেবিলে সবাই আলাপ করছিল আর রাফিয়ার মেয়ের পাকা পাকা কথা শুনে হাসছিলো। ওর বয়স চার চলছে। সামনেই স্কুলে দিতে হবে।
আসমাত শিকদার দীর্ঘ শ্বাস নিলেন। চৈতালী থাকলে রাফসানের ও বোধহয় একটা বাচ্চা থাকতো।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই বললেন- রাফসানের ব্যবসার কি অবস্থা??
– ভালো। ছোট করে জবাব দেয় রাফসান।
আসমাত শিকদার দমে গেলেন। এত কম কথা বলছে ছেলেটা আজকাল। যেন না বলতে পারলেই বাঁচে।
জুনায়েদ যেন শ্বশুরের মন পড়তে পারলো। বললো- এত সিলেটে পড়ে থাকিস কেন?? এদিকে কি হবে??
– তুই বাংলাদেশ থেকে যা। এদিকে তুই সামলা।
শান্ত গলায় বললো রাফসান।
পরহ্মণেই আবার বললো- আমি শ্রীমঙ্গলে একটা চা বাগান কিনতে চলেছি সামনে। কিছুদিন পরই যাব।

আসমাত শিকদার ইতস্তত করে বললো- গুলশানের ব্যবসার কি হবে?? কতদিন লোকজন দিয়ে করাবো?
রাফসান খাওয়া থামিয়ে দিলো। তারপর আগের চেয়ে শান্ত গলায় বললো- যা ইচ্ছা করো। না আমি গুলশান যাব। না গুলশানের বাড়িতে। ওইখানে গেলে দম বন্ধ হয়ে আমি মারা যাব।
বলেই উঠে দাঁড়ালো সে।

জুনায়েদ ব্যাথিত চোখে চেয়ে রইলো। তাদের ব্যাচের সবথেকে ভালো ছেলে ছিল রাফসান। অথচ তার কপালেই বিধাতা সুখ লিখলো না।

রুমে এসে দেয়ালে টাঙানো চৈতালীর ছবির দিকে তাকালো রাফসান। তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল।
রাফসান ছবিতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো- তুই কোনদিন আমাকে ভালবাসিস নাই চৈতী।
বাসলে ভুল বুঝতি না। আমিই বোকার মত তোকে ভালবেসে যাচ্ছি।
তোকে যেদিন খুজে পাবো না সেদিন আগে দু গালে দুটো থাপ্পড় মারবো। এই আড়াই বছর ধরে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি পাবি তুই। মনে রাখিস।

কয়েক দিন গেলো ব্যাস্ততায়। সবাইকে নিয়ে হই হুল্লোড় চললো।
অবশেষে আজ রাফসান শ্রীমঙ্গলে যাত্রা করলো। জানে না কি হবে সেখানে।
রাফসান তো শুধু এটা জানে সে কাজের মাধ্যমেই চৈতী কে খোঁজে।
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here