লুকানো অনুরক্তি পর্ব -০৫

#লুকানো_অনুরক্তি (০৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

হাত জ্বলছে মাহফুজের। অসহনীয় ভাবে। তবে বুক জ্বলছে এর থেকে তীব্র হারে। হাতের থেকে অন্তঃস্থলের জ্বলন অনুভব হচ্ছে একটু বেশি। তবে এই সামান্য ব্যপারটায় এতটা খারাপ কেন লাগছে নিজেও বুঝতে পারছে না সে। চেয়েও নিজের মনকে শান্ত করতে পারছে না।

‘আশেপাশে কোনো ফার্মেসি থাকলে চল বাবা। মলম লাগাতে হবে হাতে।’

‘ছেড়ে দাও মা। এমনি সেরে যাবে।’ গা ছাড়া ভাব মাহফুজের।

‘আমাদের হলে এমনি সেরে যেতো। আমরা এসবের সাথে অভ্যস্থ।’

অতঃপর ছেলেকে টেনেটুনে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রেস্টুরেন্ট থেকে। রাস্তার বিপরীত দিকে একটা ফার্মেসি সন্ধান পেয়েই ছুটলেন সেদিকে।

সোহেল নামক ছেলেটাকে বিদায় দিয়ে অবনিও গেল পিছু পিছু ।

আফসানা খানম যত্নসহকারে ছেলের হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন।

নাদিয়া ফিসফিস করে অবনিকে বলে,

‘ মা খেয়াল না করলেও আমি দেখেছি ভাইয়া ইচ্ছে করে নিজের হাতে কফিটা ফেলেছে। আমার মনে হচ্ছে তুই যে ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছিস সেজন্য ভাইয়া জেলাস।’

গম্ভীর মুখে নাদিয়ার দিকে তাকাতেই ঠোঁটে আঙুল দেয় সে। ক্ষণকাল বাদে ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে পুনরায় বলে,

‘ভাইয়া কিন্তু সত্যি জেলাস। বিশ্বাস কর আমি কলিজা পুড়া গন্ধ পাচ্ছি।’

_____________________

‘অফিস গেলে তোকে শুধু একবার পাই? তোর বুদ্ধি দেওয়া আমি বার করছি।’

ফোনের ওপাশ থেকে বাগাড়ম্বরপূর্ন হাসল সাইফুল।

‘তুই যে মেয়েটার প্রেমে একেবারে উন্মাদ বুঝতে পারছিস? এই যৎসামান্য ব্যপারটায় এইভাবে রিয়েক্ট করার কিছু নেই, মাহফুজ। এটা স্বাভাবিক।’

মাহফুজের গলার স্বর নরম হয়ে এলো।

‘আমি জানি ব্যপারটা স্বাভাবিক। কিন্তু মনটা খচখচ করছে। ছেলেটা কিভাবে যেন অবনিকে দেখছিল। আমার একটুও ভালো লাগেনি। আমার অবনিকে ও দেখবে কেন? আমার অবনিকে কেবল আমিই দেখবো।’

তপ্ত শ্বাস ফেলে সাইফুল।

‘ব্যপারটা স্বাভাবিক বলে আবার তো অস্বাভাবিক কথা বলছিস।’

মাহফুজ বিবশ গলায় বলে,

‘অবনি ছেলেটার সাথে হাসছিল।’

‘তো কি কাঁদবে?’

জবাব দেয় না মাহফুজ। সাইফুল পুনরায় বলে,

‘ছোটবেলায় সমবয়সী ভাইবোনকে মা কিছু একটা বেশি দিলে আমরা অভিমান করে বলতাম না, আমায় একটুও ভালোবাসো না তুমি মা। তোর মাঝে এই ছোটবেলার ভাবটা ফুটে উঠেছে। সামান্য ব্যপারে এভাবে রিয়েক্ট করবি না। এতে করে ভবিষ্যতে তোর প্রতি কিন্তু বিরূপ ধারণা জন্মাবে ওর। জোর করে কারো মনে জায়গা করে নেওয়া যায় না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহফুজ। মাহফুজ কে একটু জ্বালানোর জন্য সাইফুল উপহাস করে বলে,

‘সব কাজের জন্য আমি যার কাছ থেকে পরামর্শ নেই। আজ আমি তাকে প্রেমে পরামর্শ দিচ্ছি। নিজেকে প্রেম কুমার আর তোকে অবুঝ মনে হচ্ছে। প্রেমে পড়লে মানুষ অবুঝও হয় জানা ছিলো না।’

_______________________

‘কি করছো মা?’ অবনির অসহায় কন্ঠস্বর।

ফোনের ওপাশ থেকে ফাতেমা আমিন জবাব দিলেন,

‘মাসিক পরীক্ষার খাতা দেখছি। বাঁদরগুলো যে কি লিখেছে ওরাই ভালো জানে।’ বলে হাসলেন তিনি।

ফাতেমা আমিন একজন প্রাইমারি শিক্ষিকা। স্থানীয় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা, বিজ্ঞান এবং সমাজ পড়ান।

‘আবিদ কি করছে?’

তিনবছর বয়সী আবিদের দিকে তাকালেন তিনি । কলম মুঠ করে এলোমেলো, অনভ্যস্থ হাতে নিজের মতো আঁকিবুঁকি করছে সে। বিস্তর হেসে জবাব দিলেন,

‘সাহেব এখন পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বিরক্ত করলে সারা বাড়ি মাথায় তুলবে।’

‘বাবা এখনো ফিরেনি?’

‘মাছের পোনা কিনতে গেল বিকেলে। এখনো ফিরেনি।’

কয়েক মুহুর্ত চুপ রইলো অবনি। সহসা মেঘমেদুর, মলিন স্বরে বলে,

‘তোমায় বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে মা।’

হাতটা থেমে গেল উনার। মনটা কেঁদে উঠে মেয়ের জন্য। এইচএসসি দেওয়ার পর মেয়েকে শহরে পাঠিয়েছেন। দেড় বছর যাবৎ দুইদিনের জন্য আসে আবার চলে যায়। চলে যাওয়ার সময় কলিজাটা ছিঁড়ে। তিনি বিবশ গলায় বলেন,

‘ক্যামেরাটা অন কর।’

অবনি কাঁপা গলায় বলে, ‘এভাবে না মা। তোমায় এভাবে দেখে আমার তৃপ্তি মিটে না।’

ফাতেমা আমিনের মুখটা পাংশুটে হয়ে গেলো।

‘দুই দিনের জন্য এসে থেকে যা বাড়িতে। তোর পিও আবার বাচ্চা দিয়েছে।’

‘ভার্সিটি তো অফ দিচ্ছে না।’

‘শুক্রবার দেখে চলে আয়।’

কিছু না বলে কল কে’টে দিলো অবনি।

_____________________

ড্রয়িংরুমে বসে খবর দেখছে মাহফুজ। কাঁথায় ফুল তুলছেন আফসানা খানম।

‘ফুফু?’

‘বলে ফেল।’

‘কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাবো।’

‘কেন ভার্সিটি কি অফ?’

বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে চট করে অবনির দিকে দৃষ্টিপাত করে মাহফুজ। ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো কি জবাব দেয় তা শুনার জন্য।

‘ভার্সিটি বন্ধ না।’

আফসানা খানম পুনরায় জানতে চাইলেন,

‘তবে?’

অবনি অসহায়, কাতর কন্ঠে বলে,

‘মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। কতদিন বাড়িতে যাই না।’

সেলাই থামিয়ে অবনির দিকে রইলেন তিনি।

‘মায়ের জন্য বেশি খারাপ লাগছে?’

টলমলে চোখে মাথা ঝাকায় সে। তিনিও মায়াভরা কন্ঠে বলেন,

‘কবে যাবি?’

‘কাল সকাল সাড়ে ছয়টার বাসে।’

‘ওমা এতো সকাল সকাল কেন?’

‘তাহলে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে পারবো।’

অবনির বাচ্চাদের মতো কথা শুনে হেসে ফেলেন তিনি।

___________________

বাস ছাড়ার অপেক্ষা করছে অবনি। অবনিকে বাসে তুলে দেওয়ার জন্য এসেছে মাহফুজ।

‘একা একা যেতে পারবি তো?’

নিচের দিকে তাকিয়ে অবনি জবাব দেয়, ‘হুম।’

‘বমি হয় বাসে?’

‘না।’

তারপরও মাহফুজ কতগুলো আচারের প্যাকেট কিনে দিলো।

‘বেশি খারাপ লাগলে খাবি।’

বাস ছাড়বে। একে একে সব যাত্রী বাসে উঠছে। অবনিকে তার সীটে বসিয়ে দিলো মাহফুজ।

‘সাবধানে যাবি আর বাস থেকে নেমে সবার আগে আমাকে ফোন দিবি। আমি মামুকে বলে দিবো থাকার জন্য।’

অবনি চট করে বলে, ‘না না বাবাকে বলো না। ওরা জানে না আমি যে বাড়ি যাচ্ছি।’

মাহফুজ আচ্ছা বলে নেমে গেলো।

বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বাস ছাড়ার। স্টাফরা চেক দিতে লাগে সব যাত্রী উঠেছে কিনা। অবনির পাশের সীট ফাঁকা দেখে প্রশ্ন করলেন,

‘পাশের সীট কি আপনার?’

না বোধক মাথা নাড়ায় অবনি। তিনি হাঁক ছেড়ে ড্রাইভার বলেন,

‘আরো একজন যাত্রী উঠবো।’

মিনিট তিনেক অপেক্ষা করেও যখন কোনো যাত্রী এলো না তখন ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলেন। এর থেকে বেশি অপেক্ষা করতে পারবে না তারা।
বাস চলতে শুরু করলো। ড্রাইভার ফ্রন্ট গ্লাসে তাকাতেই দেখতে পেল একজন যুবক দৌড়ে আসছে আর হাতের ইশারা বাস থামানোর কথা বলছে। বাস থামালেন তিনি।

মাহফুজ দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বাসে উঠে। ধপ করে অবনির পাশের সীটে এসে বসে পড়ল। এতোক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো অবনি। শব্দশুনে তাকাল সে। পাশের সীটে মাহফুজকে দেখে মুখ হা হয়ে গেল তার।

‘তুমি?’

মাহফুজ ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,

‘পানি দে।’

ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে তার হাতে দিল সে।

মাহফুজ এক নিঃশ্বাস বোতলের অর্ধেকটা পানি শেষ করে ফেলল। অর্ধপূর্ণ বোতল অবনির হাতে দিলো।

অবনি কৌতূহলী নয়নে তাকিয়ে আছে।

‘প্রাণভোমরাকে একা ছেড়ে একদন্ডও শান্তি পাবো না আমি।’

মাহফুজের অকপটে বলা কথায় অস্বস্তি বাড়ল অবনির। আর কথা বাড়ায় সে। দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বাইরের দিকে।

ছেলেটার সাথে যত দূরত্ব তৈরী করছে ছেলেটা ততই এক কদম এক কদম করে দূরত্ব মিটিয়ে নিচ্ছে।বাসস্টপেজেও আফসানা খানমের সাথে আসতে চেয়েছিল সে। ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে নিজে এসেছে।
দূরত্ব কমুক অবনি সেটা চায় না। সে চায় দূরত্ব বাড়ুক। মধ্যেখানে একটা প্রাচীর তৈরী হউক। দূরে সরে যাক মানুষটা।

জ্যামে আটকা পড়েছে বাস। অবনি নড়েচড়ে বসল। মাথা ঘুরছে ভীষন। নাড়ীভুঁড়ি উলটে আসছে তার। মাহফুজের একটা হাত খামচে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।

মাহফুজ ধড়ফড়িয়ে উঠে। সকালে ঘুম পূর্ণ না হওয়ায় চোখ লেগে এসেছিল তার। অবনির কঠিন চোখমুখ দেখে আঁতকে ওঠে সে। তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করে,

‘বেশি খারাপ লাগছে? বমি হবে?’

জবাব দিতে পারে না অবনি। দাঁতে দাঁত পিষে রইলো।যেন কথা বললেই সব পেট থেকে বেরিয়ে আসবে।

মাহফুজ স্টাফ কে ডাকে। পলি থাকলে দেওয়ার জন্য। পলি আনতে আনতে আর ধৈর্য্য ধরতে পারে না সে । তার আগেই হর হর করে মাহফুজের হাতের উপর বমি করে দিলো।

আড়চোখে একবার মাহফুজের দিকে তাকাতেই সে বলে,

‘বমি কর তুই সমস্যা নেই।’

স্টাফ পলি দিতেই মাহফুজ পুনরায় বলে,

‘টিস্যু থাকলে দিয়েন প্লিজ।’

সীটে গা এলিয়ে দিয়েছে অবনি। বমি করে ক্লান্ত সে। শরীরে বিন্দুমাত্র বল নেই।

বমি পরিষ্কার করে অবনিকে ডাকে মাহফুজ।

‘অবনি? একটু কুলকুচি করে নে।’

অবনি নড়েচড়ে উঠে। গাইগুই করে বলে, ‘ভালো লাগছে না।’

মুখের কথা মুখেই রইলো তার আগে আবারও বমি করে দিল সে।

‘এইজন্যই বলেছিলাম ট্রেনে আসার জন্য। ট্রেনে আসলে আর এতটা ধকল যেত না। আমি যদি না আসতাম কি হতো?’

মাহফুজের একটা কথাও কর্ণগোচর হলো না। সে রইলো তার মতো।

বাস আবারও চলতে শুরু করেছে। মাহফুজ পর্দা ভালো করে ফাঁক করে দেয় বাতাস যেন অবনির গায়ে লাগে। দূর্বলতায় মুদে আসছে অবনির দুই চোখ। ঘুমের মাঝেই হাসফাস করে সে। মাহফুজ দেরি করল না। নিজের বুকের সাথে অচেতন অবনির মাথা ঠেকালো। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ঘুমো তুই। তোর যতক্ষণ মন চায়।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here