লুকানো অনুরক্তি পর্ব -১৭ ও শেষ

#লুকানো_অনুরক্তি (১৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

পড়ন্ত বিকেল! সূর্যের তাপ কমে এসেছে। গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছে চারজন। বিকেলের শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে হাঁটতে বের হয়েছে ওরা। গ্রামের স্নিগ্ধ, নির্মল পবন। গা ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বাতাসের তালে তালে দুলছে পথের দু’ধারে থাকা কচি ধানগাছের সবুজ পাতাগুলো।

আবিদ তিরিং বিরিং করে হাঁটছে। কখনো লাফ দিয়ে এইদিকে যাচ্ছে তো কখনো ওইদিকে। দৌড়ঝাপের জন্য ঘেমেনেয়ে একাকার সে। অবনি হাত দিয়ে ধরে তাকে। তারপর ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে দিল।

‘এমন করে না। ব্যথা পাবে।’

কে শুনে কার কথা। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। আবারও দৌড়ঝাপ করতে করতে মাহফুজ পা জড়িয়ে ধরে। দাঁড়িয়ে পড়ে মাহফুজ।

আবিদকে এভাবে পা ধরে ঝুলতে দেখে হাসি ধরে রাখতে পারল না নাদিয়া। পেট চেপে হাসতে লাগল সে।

‘অবনি তোর এলিয়েন ভাইয়ের সাথে থাকলে কেউ মন খারাপ করে থাকতে পারবে না। ছোট ছোট হাত পায়ে কি করে না করে নিজেও জানে না।’

মাহফুজ আবিদের দিকে তাকায়।

‘আপনি আমার শা*লা। ভাবলেও নিজেকে পা*গল পা*গল মনে হয়।’

অবনি সূঁচালো চোখে তাকায় মাহফুজের দিকে। মাহফুজ আরো কিছু বলবে তার আগে অবনির চাহনি দেখে চুপ হয়ে যায়।

মিনিট দুয়েক ঝুলে থেকে পা ছেড়ে দেয় আবিদ। অবনির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,

‘অবন কোলে।’

অবনি হাত বাড়ানোর আগেই নাদিয়া হাত বাড়ায়। নাদিয়াকে দেখে চোখেমুখে খামচি দেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় আবিদ। তবে খামচি দেওয়ার আগেই দূরে সরে এলো।

‘তোর ভাইয়ের সাথে আমার কোন কালের শ*ত্রুতা বলতো? আমাকে দেখলে তেড়ে আসে। ভাইয়ার কাছে তো ঠিকই যায়।’

আবিদকে কোলে নিয়ে অবনি বলে,

‘আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওকেই জিজ্ঞেস কর।’

‘এই ছেলের এখনই এতো ঝাঝ। বড় হলে তো যেই পথে যাবে সেই পথের একশো মিটারেও কোনো মেয়েকে আসতে দিবে না।’

অবনি মাহফুজের দিকে তাকায়। দৃষ্টি স্থির রেখে রগড় গলায় বলে,

‘আমরা হচ্ছি আগুন। আমাদের আশেপাশে এলেও তোরা ভস্ম হয়ে যাবি। অঙ্গার হয়ে যাবে পুরো দেহ।’

সামনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই হাসে মাহফুজ। মনে মনে বলে,

‘এই যে আমি অঙ্গার হয়ে বসে আছি। তারপরও আরো পুড়তে চাই। কি অদ্ভুত? এভাবে একটু একটু করে পুড়ে যাওয়ার মাঝেও এতো সুখ?’

_______________________

অবনিরা ফিরেছে আজ দুই দিন হলো। বিয়ের ঝামেলায় পড়াশোনা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে সে। তাই নোটস কালেক্ট করে সন্ধ্যার পর থেকে সেগুলো নিজের খাতায় নোট করতে ব্যস্ত সে। তার বইখাতা গুলো নাদিয়ার রুমেই আছে। তাই নাদিয়ার রুমে বসেই সে সব নোট করছে। এই রুম থেকে ওই রুমে টেনে নেওয়া মানে তারজন্য বিশাল ঝামেলা।

দু’টো বিষয় কমপ্লিট হতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পার করে ফেলেছে। এলোমেলো চুল গুলো কাঠি দিয়ে উঁচু করে বেঁধে রোজকার মতো নাদিয়ার পাশেই শুয়ে পড়ল সে। নাদিয়া তখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। পিঠ বিছানার সঙ্গ পেতেই তার চোখেও নামল ঘোর নিদ্রা।

অবনির অপেক্ষা করতে করতে মাহফুজ নিজেও অফিসের কাজ করার জন্য ল্যাপটপ নিয়ে বসে। কাজ শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘন্টার কাঁটা প্রায় একটার ঘর ছুঁই ছুঁই। কপালে ভাঁজ পড়ে তার। তপ্ত শ্বাস ফেলে নাদিয়ার রুমের দিকে গেল। রুমের লাইট বন্ধ দেখে ভ্রুকুটি হলো তার। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। হালকা চাপানো ছিল দরজা। আলো জ্বালায় সে। দুজন গভীর ঘুমে এতোটাই নিমজ্জিত যে আলোর প্রভাবে নড়ল না পর্যন্ত।

পাখার গতি কমিয়ে নাদিয়া গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিলো সে। মাথায় বুলিয়ে অবনির কাছে এলো। পাঁজা কোলে তুলে নিলো। কোনো খবর নেই অবনির। কি হচ্ছে না হচ্ছে এসবে। বিড়বিড় করে মাহফুজ।

‘এভাবে কেউ ঘুমায়? তুলে নিয়ে গেলেও তো টের পাবে না। শেষে আমায় বউ হারা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে।’

অবনিকে বিছানায় শুইয়ে আবারও মাহফুজ নাদিয়ার রুমে আসে। আলো নিভিয়ে দরজা চাপিয়ে গিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে অবনির পাশে।

_________________________

গরম লাগতেই ঘুম হালকা হয়ে এলো অবনির। হাসফাস করতে লাগল সে। যেন কিছু একটা শক্ত করে বেঁধে রেখেছে তাকে। ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল।

‘বিরক্ত করিস না। একটু আগেই শুয়েছি। ঘুমোতে দে আমায়।’

মাহফুজের কন্ঠস্বরের আধ্বান কানে বাজতেই চোখ মেলে তাকায় সে। হাতরে হাত উপরে তুলতে মাহফুজ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আঙুলে অনুভব হয়। জমে যায় অবনি। গলা শুকিয়ে এলো তার। মাহফুজের বাঁধন হতে মুক্ত হতে চাইল। ছিটকে দূরে সরে যায় সে। মাহফুজের এতোটা কাছে নিজেকে দেখে শরীর থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। মাহফুজের নিদ্রাও উবে গেল। তাড়াতাড়ি করে রুমের আলো জ্বালায় সে। অবনি তখনও কাঁপছে। চোখ জোড়ায় ভয়।

মাহফুজ আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘কি হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?’

অবনির কাছে যেতেই সে ভয়ে আরো দু’কদম পিছিয়ে গেল।

‘তুমি এই রুমে কি করছো? আর আমি তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমোচ্ছিলাম? ফুফু জানলে কি ভাববে? নিশ্চয়ই মনে করবে আমি খারাপ?’

অবনির এমন আবোলতাবোল কথা মাহফুজের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। নাক উঁচু করে সে বলে,

‘মা কি ভাববে মানে? তোর জ্বর টর উঠলো নাকি?’

‘তুমি রুম থেকে যাও। কেউ টের পেলে আমার মান সম্মান যাবে। যাও না প্লিজ!’

আহাম্মক হয়ে গেল মাহফুজ। মাঝরাতে অবনির কর্মকাণ্ড কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। মাথা চুলকাতে লাগল সে। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। আরো দু’কদম তার দিকে এগুলে অবনি পুনরায় ভয়ার্ত গলায় বলল,

‘ কাছে আসবে না একদম। আমি জানি তুমি এখন সেন্সে নেই। উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলবে।’

এবার নিজেকে সত্যিই পা*গল পা*গল মনে হচ্ছে মাহফুজের।

‘তোর মাথার কয়টা তার ছিঁড়ল? কিসব ভাট বকছিস। কিসের সেন্স? কিসের উল্টো পাল্টা কাজ?’

‘একটা অবিবাহিত মেয়ে আর অবিবাহিত ছেলে এক রুমে থাকলে সমাজ ভালো চোখে দেখে না। তার উপর তুমি আমায়,,,,,,

অবিবাহিত শব্দটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল মাহফুজ। মাঝ রাতে ইচ্ছে করছে দেয়ালে নিজের মা*থা ঠু*কে দিতে। মাথার চুল টেনে ধরলো। চাপা আর্তনাদ করে বলে,


‘তুই অবিবাহিত? তাহলে সেদিন কবুল বলে কাকে বিয়ে করলাম?’

এতোক্ষণে ঘোর কাটে অবনির। সম্বিত ফিরে পেল সে। জিভে কামড় দিয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখল। ভয় কমল। শরীরের কাঁপন থামল।সেইদিনের রাতের ব্যপারটা স্বপ্নে দেখছিল সে। আর তার রেশ ধরে এতো কিছু বলা। মাহফুজের দিকে তাকানোর সাহস হলো না তার। বাধ্য মেয়ের মতো সোজা গিয়ে আবার নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল গুটিসুটি হয়ে। আর বিড়বিড় করে নিজেই নিজের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল।

দাঁত কিড়মিড় করে অবনির দিকে তাকিয়ে থাকে মাহফুজ। এক মুহূর্তের জন্য সত্যিই মনে হচ্ছিল সবটা তার কল্পনা ছিল।

অবনির দিকে সরোষ চোখে চেয়ে মাহফুজ বলে,

‘এইজন্যই কারনে অকারণে বউকে চুমু খেতে হয়। সময়ে অসময়ে আদর করতে হয়। মোটকথা সামনে আসলেই শুধু আদর। বউয়ের যেন কোনোভাবে মনে না হয় সে অবিবাহিত। একটুর জন্য হার্ট অ্যা*টাক হয়ে যাচ্ছিল আমার । শুধু শুধু আধ পা*গল বলি। কোনদিন যে নিজে পুরা পা*গল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি আল্লাহ জানে। যেখানে পূর্ণ অধিকার থাকার পরও জোরজবরদস্তি করলাম না। সেখানে বউ আমায় বলছে আমি নাকি সেন্সে নাই। উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলবো। এসব শুনার জন্য এতো পা*গলামি করে বিয়ে করছিলাম আমি? আল্লাহ্!’

টু শব্দও করে না অবনি। নিবোর্ধের মতো করা নিজের কাজে নিজেই আহাম্মক হয়ে বসে আছে। কি লজ্জা! কি লজ্জা!

আলো নিভায় মাহফুজ। বিছানায় শুয়ে একটানে অবনির মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে দু’হাতে।

‘দু’হাত দূরত্বে গিয়ে ঘুমাবি বলে তো আমি কবুল বলে বিয়ে করিনি। ইঞ্চি পরিমাণ দূরত্বও থাকবে না দু’জনের মাঝে। না মনের আর না,,,,,,’

নৈঃশব্দ্যে হাসে অবনি। মাহফুজের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে রইল। বিয়ের পর একটা জিনিস খুব করে অনুভব করে সে। মানুষটার এইখানটায় মাথা রাখলে সুখ সুখ লাগে। শান্তি লাগে মনে। শীতলতায় ছেয়ে যায় সর্বাঙ্গ।

_____________________

সময় গড়ায় চোখের পলকে। কতগুলো দিন চলে গেল জীবন থেকে। অবনি এখন পাকা গিন্নি হয়ে ওঠেছে। পড়াশোনা এবং সংসার দু’টোই সামলাচ্ছে। যদিও আফসানা খানম অনেক সাহায্য করেন। মেয়েদের সব পারতে হয়। সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের এক অদ্ভুত শক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। এরা ঘর বাহির দু’টোই সমানতালে সামলাতে পারে। কথায় আছে যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।

চুলগুলো খোঁপা করে কোমড়ে আঁচল গুঁজে আলমারি থেকে মাহফুজের অব্যবহৃত শার্ট খুঁজে খুঁজে বের করছে অবনি।

অফিস থেকে ফিরেছে মাহফুজ। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ তার। ব্যাগ টা রেখে গলায় বেঁধে রাখা টাই ঢিলে করে অবনির পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। অবনি খোঁপা করে রাখা চুলগুলো ছেড়ে দিলো সে। মুখ ডুবায় অবনির ঘনকালো চুলে।

বিরক্ত হয় অবনি। বিরক্তির সুরে বলে,

‘কি করছো টা কি? দরজা খুলা রেখে।’

মাহফুজের ঘোরলাগা কন্ঠস্বর।

‘কাঁচা খেলোয়াড় না মাহফুজ। যে দরজা খুলে বউয়ের সাথে রোমান্স করবে।’

‘ছাড়ো তো গরম লাগছে আমার। এমনিতেই ঘেমেনেয়ে অবস্থা খারাপ আমার। আর তোমার বাসায় এলেই শুরু হয়ে যায়।’

অবনির কানে ঠোঁট ছুঁয়ায় মাহফুজ।

‘বউয়ের মনে থাকে না সে বিবাহিত। তাই আদরের উপর রাখি যেন আবার ভুলে না যায়।’

কনুই দিয়ে মাহফুজের পেটে গুঁতো দিল অবনি। মাহফুজ ‘আহ্’ বলে পেট চেপে ধরে।

‘কোন কালে ঘুমের ঘোরে কি বলেছি না বলেছি ওটা নিয়ে এখনো বসে আছে। যাও তো ফ্রেশ হয়ে আসো। মানুষ অফিস থেকে ফিরলে আগে ফ্রেশ হয়। তারপর খাবার খায়। এরপরে অন্য কাজ করে। আর জনাবের ফিরতে না ফিরতে শুরু হয়ে যায়।’

অবনির কটি চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো মাহফুজ। চুল সরিয়ে থুতনি ঠেকায় অবনির কাঁধে।

‘এগুলো তো তোমার রুটিন। আমার রুটিন হলো, আগে অফিস থেকে আসা। তারপরও বউকে জড়িয়ে ধরা। সারাদিনের ক্ষয় হওয়া এনার্জি যেন রিলোডেড হয়। ক্লান্তি যেন দূর হয় তার জন্য। তারপর ফ্রেশ হওয়া। সবশেষে খাওয়া।’

মাহফুজের দিকে ফিরে অবনি। কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘ওমা তাই? শরীর নিশ্চয়ই চার্জ হয়েছে? এবার গোসলে যাও। তোমার গা থেকে গন্ধ আসছে।’

‘তাহলে চল একসাথে গোসলে যাই।’

চোখ গরম করে চাইল অবনি। হাসে মাহফুজ। কোমড়ে হাত রাখে।

‘আমার পরে বিয়ে করেও সাইফুল বাবা হয়ে যাচ্ছে। আর আমি? জীবনযুদ্ধে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলাম সাইফুলের থেকে।’

অবনি ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় মাহফুজের দিকে। অবনির কপালের চুলগুলো সযত্নে কানের পিছনে গুঁজে দেয় মাহফুজ।

‘শুন না আমারও না ভীষণ বাবা বাবা পাচ্ছে। পুঁচকে টাকে পৃথিবীতে আনার আয়োজন শুরু করে দেই?’

‘তুমি বরং আগে ঠিক করো আমায় তুই বলবে নাকি তুমি। তারপর না হয় বাবা হবে। না হলে দেখা যাবে সে হয় তোমাকে মামা ডাকছে। নয়ত আমার পেট থেকে বের হয়ে আমাকে ফুপি ডাকছে।’

মাহফুজ কে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বলে,

‘আপাতত গোসলে যাও। পরের টা পরে দেখা যাবে।’

মাহফুজ তোয়ালে হাতে নিয়ে বলে,

‘তাহলে ম্যাডামেরও ইচ্ছে আছে মা হওয়ার?’

কিছু বলে না অবনি। আলমারি থেকে বের করে রাখা শার্ট গুলো নিয়ে মুচকি হেসে ড্রয়িংরুমে চলে গেল।

___________________________

গোসল সেরে ড্রয়িংরুমে আসে মাহফুজ। অবনি সবার অব্যবহৃত কাপড় নিয়ে বসেছে। আর বকাঝকা করছে।

‘শুধু শুধু কাপড় কিনে আলমারির তাক পূর্ণ করে। যে কাপড় গুলো বের করছি ওগুলোর টাকা দিয়ে গুলশানে দু’টো ফ্ল্যাট কিনা যাবে।’

শহিদুল হক মুখ খুলেন।

‘দু’টো ফ্ল্যাট না। পুরো একটা এপার্টমেন্ট।’

‘আপনি চুপ থাকেন। আজ থেকে আপনার একটা পাঞ্জাবি ছিঁড়লে আরেকটা পাঞ্জাবি কিনে দেওয়া হবে।’

‘সবাইকে ছেড়ে আমার পিছনে পড়লে কেন?’

‘কারণ অব্যবহৃত জামা কাপড় আপনার বেশি।’

তিনি আর কথা বাড়ালেন না। এখন কথা বাড়ালেই মেয়েটা উনাকে আরো কথা শুনাবে। এর চেয়ে ভালো চুপ থাকা।

‘এগুলো কি করবে?’

মাহফুজ প্রশ্ন করে অবনিকে।

‘দান করে দিবো। শুধু শুধু বাসায় ফেলে রাখলে তো হবে না। বরং কাউকে দিয়ে দিলে উনারা দোয়া করবেন।’

মাহফুজ ‘ওহ্’ বলে টেবিলে গিয়ে বসে। পুনরায় বলে,

‘খেতে দাও। খিদে পেয়েছে।’

ঘড়ির দিকে তাকায় অবনি। প্রায় ন’টা বাজে।

‘বাবা, মা টেবিলে যাও। এখন খাওয়ার সময়।’

‘আর একটু পরে খাই?’ শহিদুল হকের অসহায় গলা।

‘পরে টরে না। এখনই খেতে হবে। ডাক্তার বলেছে ন’টার মধ্যে ডিনার কমপ্লিট করতে। তারপর ঔষধ খেয়ে সোজা ঘুম।’

বলেই নাদিয়ার রুমে গেল সে।

অবনি যেতেই শহিদুল হক বলেন,

‘মেয়েটার সবদিকে নজর। যেদিন থেকে আমার সবকিছু তদারকি করা শুরু করেছে। সেদিন থেকে বাজে অভ্যাস ছাড়তে পেরেছি। এখন আর সুগার বেড়ে যায় না।’

‘ মেয়েটার আসলেই সবদিকে নজর। হিসেব করে চলে করে যেন অযথা টাকা খরচ না হয়। সংসারের কথা চিন্তা করে। মিতব্যয়ী মানুষ জীবনে উন্নতি করতে পারে।’

‘নাদু খাবি চল।’

‘এতো তাড়াতাড়ি খাবো না আমি।’

‘এখন না খেলে পরেও খেতে পারবি না। আমি সব ফ্রিজে রেখে ফ্রিজ তালা মে’রে রাখবো।

শোয়া থেকে উঠে বসে নাদিয়া।

‘তুই না বান্ধবী হিসেবে ভালো ছিলি। ভাবি হিসেবে ভালো না। তোর জন্য এখন সময় মেইনটেইন করে চলতে হয়। সময়ের খাবার সময়ে খেতে হয়। রাত জাগতে পারি না।’

নাদিয়া পাশে বসে সে। নরম স্বরে বলে,

‘তখন তো আর বউ ছিলাম না। আর না ছিল একটা পরিবার সামলানোর দায়িত্ব। বরং তখন তোদের দায়িত্ব ছিল আমার দেখাশোনা করার। তোরা এখন আমার পরিবার। অনিয়মে চলে, অনিয়ম করে খাবার খেয়ে আমার পরিবারের কেউ অসুস্থ হউক আমি চাই না। রোগে ভুগুক সেটাও চাই না। শারীরিক যন্ত্রণায় কাতরানোর চেয়ে নিয়ম মেনে সুস্থ ভাবে বাঁচা আমার কাছে ভালো মনে হয়। অন্তত আমার পরিবারটা তো সুস্থ থাকবে। খাবি এখন। তাড়াতাড়ি আয়।’

অবনি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তার হাতটা নাদিয়া ধরে ফেলে।

‘গিন্নি হয়ে গেছিস তাই না?’

‘সময় প্রবাহের সাথে সাথে মেয়ে থেকে গিন্নি হতে হয়। পরিবারের সবার কথা চিন্তা করতে হয়। গোটা একটা সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। মেয়েদের জীবনটাই এমন।’

পরিশিষ্টঃ

দু’হাতে অবনির বমি পরিষ্কার করছে মাহফুজ। সে না নাক সিটকাচ্ছে আর না তার ঘৃনা লাগছে। সম্পূর্ণ মেঝে পরিষ্কার করে সে অবনি প্রশ্ন করে,

‘আর খারাপ লাগছে? বমি হবে আর?’

এতোক্ষণ দূর্বল চোখে মাহফুজকে দেখছিল অবনি। প্রশ্ন শুনে না বোধক মাথা দুলায়।

মাহফুজ নিজে পরিষ্কার হয়ে বিছানায় বসল। অবনি দূর্বল গলায় জানতে চায়,

‘ইদানিং আমি তোমায় খুব জ্বালাচ্ছি তাই না? আমার জন্য ঠিকমতো ঘুমোতেও পারছো না।’

অবনির মুখটা হাতের আঁজলে নেয় সে। ঠোঁট ছোঁয়ায় দু-চোখের পাতায়।

‘এই যে জ্বালাচ্ছিস এটাই আমার সুখ। এটাই আমার শান্তি। ছেলে থেকে কেমন করে স্বামী হয়ে গেলাম। আর এখন বাবা। এই অনুভূতি আমি কাউকে ব্যক্ত করতে পারবো না।’

‘তোমার মনে আছে? বাসে বলেছিলে প্রেক্টিস করছো রাত বিরাতে আমার বমি পরিষ্কার করার। কেমন করে মিলে গেল সবটা তাই না?’

অধর প্রশস্ত হয় মাহফুজের।

‘তার জন্যই তো আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারি না। তবে তোমার জন্য মাঝে মাঝে কষ্ট হয়।’

ভ্রুকুটি হলো অবনির।

‘আমার জন্য?’

‘হ্যা, কারণ তুমি কখনো বাবা হতে পারবে না। আর না আমার অনুভূতি বুঝতে পারবে।’

ফিক করে হেসে উঠলো অবনি।

‘তাহলে তো তুমিও কখনো মা হতে পারবে না।’

বুকের বা পাশে হাত রাখে মাহফুজ।

‘হেসো না সুন্দরী। তোমার হাসির উত্তাপে আমার ভেতর জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়।’

মাহফুজের বাহুতে চিমটি কাটে সে।

‘এই আগুন, উত্তাপ, জ্বলেপুড়ে যাই তোমার এসব কথা কবে যাবে বলো তো?’

‘যাবে না। যাবে না। কারণ তুমি উত্তাপ ছড়াচ্ছো প্রতিনিয়ত।’

চাহনি সূঁচালো হয় অবনির। মাহফুজ হাসে অবনিকে দেখে।

‘গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে আগুন পোহালে কেমন লাগবে? কষ্ট হবে। শরীর জ্বালাপোড়া করবে। হাড়কাঁপানো শীতে যদি আগুন পোহায়? তখন আরাম বোধ করে। একটুখানি উষ্ণতার জন্য আগুনের কাছে হাত পা মেলে ধরে। আগুন কিন্তু ঠিকই নিজ জায়গায় আছে তবে কালের পরিবর্তনে তার ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটেছে। বিয়ের আগে তুমি আমায় গ্রীষ্মের দাবদাহের মতো পুড়িয়েছো। আর বিয়ের পর আমায় শীতকালের মতো উষ্ণতা দিচ্ছো। উম দিচ্ছো। মানুষ বলে তার জীবনের বসন্ত শেষ না হউক। আর আমি বলি আমার জীবনের শীত শেষ না হউক। কারন আমাকে উষ্ণতা দেওয়ার জন্য একটা ব্যক্তিগত মানুষ আছে। তবে মনের কোণে একটাই কষ্ট। সে আজও আমায় ভালোবাসি বলল না৷ যতবারই তার কাছে উত্তর জানতে চেয়েছি ততবারই হয় তার খিদে পেয়েছে। নয় তার ঘুম পেয়েছে। আর নয়তো হাত পায়ের ব্যথা শুরু হয়েছে।’

মাহফুজের বুকে মাথা রাখে অবনি। একেবারে লেপ্টে গেল বুকের সাথে। মৃদুস্বরে বলে,

‘মনের অনুরক্তি কি জানা বেশি জরুরি?’

অবনির চুলের ভাঁজে চুমু এঁকে দিল সে।

‘একটা সময় মনে হতো জানাটা জরুরি। কিন্তু এখন মনে হয় না। কেননা আমি জানি তোমার সবটা জুড়ে কেবল আমি। চোখে যেহেতু সবটা ভাসমান। তাই মুখ কি বলল না বলল জেনে কি করবো। তুমি মনের লুকানো অনুরক্তি বলবে বলবে এমন ফিল যখন মনে আসে। তখন বুকের ভেতরে কেমন উদ্দীপনা কাজ করে। শিহরণ বয়ে যায়। বলে ফেললে কি আর এমন অনুভূতি হবে আমার? তার চেয়ে বরং থাকুক অপ্রকাশিত। তোমার মনের সমস্ত অনুভূতি, অনুরক্তি, আবেগ অপ্রকাশিত হয়েও প্রকাশিত। তুমি আমার কাছে খোলা বইয়ের মতো। মনের অনুরক্তি বুঝানোর জন্য আলাদা করে বলতে হয় না। আমি দেখলে বুঝে যাই। তোমার অনুরক্তি না হয় লুকায়িত থাকুক।’

কিছু বলতে ইচ্ছে করে না অবনির। তার ব্যক্তিগত মানুষটার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানির নিনাদ শুনতে ব্যস্ত সে। তারও লুকানো অনুরক্তি মুখে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় ‘ভালোবাসি’ শব্দটা মুখে বললেই বুঝি সমস্ত ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে।

____________________সমাপ্ত__________________

সমাপ্তি ঘটলো লুকানো অনুরক্তির। অনেকেই বলবেন কেন শেষ করেছি। আমার মনে হয়, গল্পটা টেনে বড় করছে এটা শুনার থেকে ইশ! গল্পটা শেষ হয়ে গেল এটা শুনা অনেক ভালো। আর আমি গল্পটা এতটুকুই ভেবেছিলাম। এর থেকে বড় করা সম্ভব না। বেশি বড় করতে গেলে সৌন্দর্য হারাবে। এই গল্পটাকে যেভাবে ভালোবেসেছেন আশা করবো পরবর্তী গল্পকেও সমানভাবে ভালোবাসবেন। আজ নাইস নেক্সট না বলে দু’চার লাইন লিখবেন গল্পটা সম্পর্কে। আর আমার ভুলত্রুটিও দেখিয়ে দিবেন। যেন ভবিষ্যতে সংশোধন করতে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here