দীর্ঘ রজনী পর্ব -০১

,,কাউকে ভালোবাসেন সাদ ভাই?

নির্ধারিত কক্ষে বসে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে মুখ গুজে আছে সাদ বিন সাদাফ। কাজের চাপ এতো বেড়েছে যে কোনো দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। হুট করে কারো কাঁপা কন্ঠের এহেন প্রশ্নে চমকালো। তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে তাকলো সাদ।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে সদ্য উনিশে পা দেওয়া চির চেনা সেই মেয়েটা। যাকে দেখলে সাদ একটু বাঁকা চোখেই তাকায়।ঘামে জবজব করছে মুখ । দুধে আলতা গায়ের রংয়ের মেয়েটা টুকটুকে লাল হয়ে আছে। চুল গুলো বড্ডো বেশি অগোছালো।পরনে কলেজ ইউনিফর্ম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।

সাঁজির কলেজের পাশেই সাদের অফিস।
তাও সাজিকে দেখে মনে হচ্ছে মাইলের পর মাইল হেঁটে এসেছে। পরক্ষনেই সাদের মাথায় আসলো ,এই মেয়ে এলিভেটরে করে উপরে আসেনি বরং সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় এসেছে। সাঁজির ভ,য়ং,ক,র ক্লাস্ট্রোফোবিয়া আছে তাই সে এলিভেটরে উঠে না। দেখতে ক্লান্ত লাগলেও পুরো মুখের আদলে বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন এটে রেখেছে মেয়েটা।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা সাদের মামাতো বোন সাঁজি। যাকে সাদ সাঁজ বলেই ডাকে। সাদ ফাইলটা সাইডে রেখে সোজা হয়ে বসে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি ভঙ্গিতে বললো, তুই হঠাৎ আমার অফিসে টপকালি কেন? মামুনী জানে তুই কলেজে না গিয়ে আমার অফিসে এসে ফাউল প্রশ্ন করছিস? একপ্রকার বে*য়া*দবি করছিস!

সাদের কথায় সাজি খুব বেশি ভ*য় আর অ*প*মা*ন বোধ করলো।ভয়ে সাজি মুখ কাচুমাচু করে বললো, উঁহু জানে না। আসলে আমি ওই আরকি। ভয়ের চোটে কথা বের হচ্ছেনা মুখ থেকে। কি-ই বা বলবে! সামনে বসা লোকটা বাঘ থেকে কম কিসে? ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। জোসের সাথে এসে প্রশ্ন করে ফেললেও এতক্ষনে টের পাচ্ছে আসলে করেছেটা কি।

সাদ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বললো, আমতা আমতা না করে সোজাসুজি উত্তর দে ইডিয়েট!!

সাজি ভয়ে পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফটাফট বললো, স্যরি সাদ ভাই আসলে রিমি বলেছে আপনি কাউকে ভালোবেসেন কিনা তা জেনে নিতে।ও আপনাকে নাকি পছন্দ করে । আপনি কাউকে ভালো না বাসলে ওর রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। রিমি সোজা এনট্রি নিবে। বিশ্বাস করুন আমি এইখানে আসতে চাইনি । রিমি বলেছে না আসলে আমার সাথে কথা বলবে না। ও কথা না বললে আমার খুব কান্না পায় তাই এসেছি সত্যি!প্লিজ আম্মুকে কিছু বলবেন না। আম্মু উল্টো ঝুলিয়ে খুব পে*টা*বে।

এতক্ষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও এখন রাগ হচ্ছে।সাদ প্রচন্ড রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, এইটুকুন মেয়ে এই গুলো করে বেড়ায়? মেয়েটা না তোকেও বিগড়ে দেয়!আজকের পর থেকে তুই ওই মেয়েটার সাথে মিশবি না আর না কথা বলবি। কতো বড় সাহস। তোরও সাহস বেড়ে গেছে দেখছি! তা না হলে আমাকে এই প্রশ্ন করার সাহস পেতি না। চ*ড় থা*প্প*ড় ইদানিং পড়ে না দেখে তাই না? চা*প*কে সিধে করে দিবো বে*য়া*দব!সাঁজ আমি কিন্তু তোকে সাবধান করে দিচ্ছি। পরেরবার আর মুখে বলবো না।

এই ছেলেটার রাগ সম্পর্কে সাজি আগ থেকেই অবগত।আগে ভুল করলেই থা*প্প*ড় মা*র*তো কিন্তু বিগত এক বছর সেটা বন্ধ আছে।তবে ধমকানো আর অধিকার বোধ বেড়ে গেছে বৈকি। কিন্তু আজকের কথা শুনে মনে হচ্ছে খারাপ সময় আসতে দেরি নেই। সাজি ভয় পেয়ে ঠোট উল্টিয়ে কেঁদে দিলো। বকেছে ঠিক আছে তাই বলেকি বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলবে না?

সাজির কান্নায় সাদের ভ্রু জুগল সিথিল হয়ে এলো। মেয়েটা কাঁদলে সাদের মোটেও ভালো লাগে না। ভালো লাগেনা বললে ভুল হবে। কাঁদলেই গালের দুপাশ ,নাক লাল হয়ে উঠে এতে সম্মোহিত হয়ে পড়ে সে। সাজির কান্না দেখলে সাদের মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছে জন্মায়। সাদ মোটেও চায় না এই শুভ্র সুন্দর বেলী ফুলের প্রতি তার কোনো নিষিদ্ধ ইচ্ছে জন্মাক।সাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। টিস্যু বক্স হাতে নিয়ে সাজির সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে দিতে দিতে বললো, আর কাঁদতে হবে না। কান্না বন্ধ কর!

সাজি হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো, রিমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ওর সাথে কথা না বললে আমি ম*রে*ই যাবো। কালেজের কাউকে চিনি না রিমি ছাড়া। আর আপনি তার সাথে মিশতে মানা করে দিলেন?ও না হয় আপনাকে একটু পছন্দই করে। তাই বলে রিমি খারাপ হয়ে গেলো? বলে দিলেই হয় আপনার ভালোবাসার মানুষ আছে!

সাদ সাজির কথা গুলো মনযোগ সহকারে শুনলো। আসলেইতো সাঁজবাতি তো আর কারো সাথেই মেশে না। না এমন করলে ভারী অন্যায় হবে। তবে শেষের কথাটা শুনে উল্টো ঘুরে মুচকি হাসলো সাদ।

,,ঠিক আছে কথা বলিস। আর হ্যা বলবি,সাদ ভাই কাউকে প্রচন্ড পরিমানে ভালোবাসে। এখন বাসায় যা। মামুনী চিন্তা করছে।

সাঁজি সাদের কথায় ভিষন খুশি হলো।মনে মনে ভাবছে , সাদ ভাইকে যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ না। কিন্তু কাকে ভালোবাসে?কে সে মেয়ে? হুট করে কেন জানি সাঁজির কোথাও একটা খারাপ লাগছে। সাদ ভাই কাউকে ভালোবাসে তা যেন সাঁজির মন মানতে পারলো না।

সাদ যত্ন করে সাজির চুল গুলো আঙ্গুলের সাহায্যে গুছিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বললো, ড্রাইভারকে বলছি তোকে ড্রপ করে দিবে। সোজা গিয়ে গাড়িতে বসবি। তিরিং বিরিং করলে থা*প্প*ড় মিস যাবে না কিন্তু ।

সাজি ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল, ঠিক আছে আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। কিন্তু মাকে কিছু বলবেন না সাদ ভাই। বললে খুব মা*র*বে।

সাঁজির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।সাজি চলে যেতে নিলেই সাদ সাঁজির হাত ধরে আটকে দিয়ে বলে, একটু দাড়া!

সাঁজি বোকা বোকা চাহনিতে সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছে না দাড়াতে বললো কেন!
সাদ ডেস্কের উপর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে সাজির হাতে ধরিয়ে দেয়। সাজি প্যাকেটের ভেতর উঁকি দিয়ে একপ্রকার খুশিতে লাফিয়ে উঠে জোরে বললো,, চকলেট!

সাদ পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ালো। সাজি খুশিতে দুই হাত প্রসারিত করে এগিয়ে সাদের দিকে আসতে নিয়ে থেমে যায়। সাদ তা দেখে মনে মনে হাসছে। মেয়েটা বড্ডো বেশি পাগলাটে। অল্পতেই খুশি হয়ে অদ্ভুত কান্ড করে। এখন আবার নিজেই লজ্জা পাচ্ছে।

সাজি নিজেই নিজের বোকামোতে লজ্জা পেলো। পরক্ষনেই কাচের দরজাটা টেনে খুলে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। চোখ মুখ কুঁচকে “নির্লজ্জ” বলে কয়েকবার নিজেকে গালি দিলো।

সাদ তাকিয়ে আছে সাজির যাওয়ার দিকে। সাজি হেলেদুলে চলছে।হাতে পায়েই বড় হয়েছে শুধু তা না হলে বড্ডো বেশি বেখেয়ালি মেয়েটা। অফিসের স্টাফের মধ্যে কয়েকটা ছেলে মুগ্ধ হয়ে সাজির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দিকে সাদের নজর পড়তেই দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল।
উঁহু এর কিছু একটা ব্যবস্থা নিতেই হবে! কেন সবাই মুগ্ধ হয়ে সাঁজবাতিকে দেখবে! এই সাদ ব্যাতিতো কেউ সাঁজবাতিকে মুগ্ধ নয়নে দেখবে না। কেউ না।
এই একটা মেয়ে যার আশেপাশে কাউকে সাদ না পছন্দ করে, না বিশ্বাস করে। কেন তা জানতো না, তবে এখন ঠিকই জানে। বেখেয়ালি মেয়েটাকে সুধরাতে গিয়েই আটকা পড়েছে সাদ। এইটুকুন একটা মেয়ের মায়ায় এতো ক্ষমতা?ভেবে পায় না সাদ।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবার কাজে মন দিলো।

এইদিকে সাজির মা সেঁজুতি হাসান টেনশনে পায়চারি করছে। দু’টো বাজতে চললো সাজি এখনো ফেরেনি। সাজির বাবা জুবায়ের হাসান বাইরে থাকে। তিনি প্রতিদিন এই সময় মেয়ের সাথে কথা বলেন। কিন্তু আজ সাজি ফেরেনি দেখে টেনশনে পড়ে গেছেন।

সেঁজুতি জুবায়েরের কল কেটে দিয়ে সাদকে কল দেয়।

সাদ সবে মাত্র লাঞ্চ করতে বসেছে। মোবাইল বেজে ওঠায় হাতে নিয়ে দেখে ছোট মামুনীর কল। সাদের বুঝতে বাকি রইলো না তার ছোট মামুনী কেন এতো কল করছে।
সাদ কল রিসিভ করতেই সেঁজুতি হাসান ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,, আব্বু আমার সাঁজিতো এখনো এলো না! কোথায় গেলো মেয়েটা? এইদিকে তোর মামু কল দিতে দিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার কিছু হলে বিদেশে থাকা অবস্থায় আমার গলা টি*পে মে*রে ফেলবে। আব্বু একটু গিয়ে দেখে আয় না!

সাদ মুচকি হেসে বলল, মামুনি শান্ত হয়ে কথা শুনো। সাঁজকে একটু আগে আমি নিজেই গাড়িতে তুলে দিয়েছি। চিন্তা করোনা এখনই পৌঁছে যাবে।আর মামুকে আমি কল দিয়ে বলছি। তুমি টেনশন নিও না।

সেঁজুতি হাসান স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, আব্বুরে তুইতো জানিস না তোর কথায় কলিজার উপর থেকে কতবড় পা*থর নেমে গেছে। তুই তোর মামুকে কল দিয়ে একবার বল বাপ।তোর মামা তোর কথা ছাড়া কারো কথা বিশ্বাস করবে না। বুঝিয়ে বল একটু নয়তো আমাকেই দোষী করবে।

সাদ হেসে উঠে বললো, ওহো মামুনী টেনশন ফ্রী থাকো। আমি আছিতো টেনশন নেওয়ার জন্য! আমি থাকতে তুমি কেন টেনশন নিবে? ঠিক আছে এখন ফোন রাখো। এতক্ষণে সাঁজ হয়তো পৌঁছে গেছে।

~ আল্লাহ হাফেজ আব্বু রাখছি।

সেঁজুতি হাসান কল কাটতেই ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো সাদ। মামুনী নামক এই মমতাময়ী নারীটাকে বড্ডো বেশি পছন্দ করে সাদ। তার ভেতর একটা মা মা অধিকার বোধ আছে।মামী কিংবা মামুনী শব্দটা অনেকের কাছে তিক্ত হলেও সাদের কাছে বড্ডো প্রিয় তার এই ছোট মামুনী। তবে বড় মামুনীর ব্যাপারটা বরাবরই আলাদা। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে খাওয়া শুরু করে দিলো।

এইদিকে সেঁজুতি হাসান কল কেটে টেনে নিঃশ্বাস নিলো। সাদ ছেলেটাই একমাত্র ভরসা। জুবায়ের বাইরে যাওয়াতে এই ঘরের অভিভাবক হচ্ছে সাদ।সাদের ছোট মামা সাদকে নিজের ছেলের মতোই দেখে তাইতো তার হাতে সব দায়িত্ব সপে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজ করছে।
কলিং বেল বেজে উঠতেই সেঁজুতি হাসান মুচকি হেসে বললো , বড় আপার সোনার টুকরো ছেলে। কিভাবে যে ছেলেটা এতো ভালো হলো? অবশ্য যার মা নিজেই সোনা দিয়ে গড়া তার ছেলেতো এমন সোনার টুকরো হবেই!

দরজা খুলে দেখে সাঁজি দাঁড়িয়ে আছে। সেঁজুতি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললো, তোর টেনশনে আমি আর তোর বাবা শেষ। এতো দেরি হলো কেমনে? ভাগ্যিস সাদকে কল দিয়েছিলাম!নয়তো আমি তো ম*রেই যাচ্ছিলাম।

সাদের কথা শুনতেই সাঁজি ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকালো। সেঁজুতি হাসান দরজা আটকে সাদকে কল দিয়ে জানালো সাঁজি পৌঁছে গেছে। সাজির তো ভয়ে কাঁপা কাঁপি অবস্থা। এইরে সাদ ভাই কিছু বলে দিলো নাতো?

সাজির মা সাজিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর বাবা তোর সাথে কথা বলবে।

সাজি তাড়াতাড়ি রুমে চলে গেলো। ভাবতে লাগলো, মাকে দেখেতো মনে হচ্ছে না এমন কিছু বলেছে! অবশ্য সাদ ভাই এক কথার মানুষ। যখন বলেছে বলবে না তখন কিছুতেই বলবে না। হুম বলে নি হয়তো।
সাঁজি খুশিতে লাফালাফি করতে লাগলো। যাক বাবা শেষ দফায় বেঁচে গেলাম। সাদ ভাই সামনে থাকলে নিশ্চিত তাকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে চুমু দিয়ে দিতাম। ছিঃ ছিঃ কি ভাবছিস সাঁজি?তোর এতো অধঃপতন?সাদ ভাই জানলে থা*প্প*ড় মে*রে মে*রে গাল কে*টে খাল করে দিবে। ছিঃইই

অফিস ছুটির পর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সাদ। সোজা মলে গিয়ে ঘুরে ঘুরে লেডিস কর্নার গুলো দেখছে। কাঙ্খিত জিনিস পত্র আর পছন্দসই সব কিছু পেয়ে ফটাফট কিনে নিলো। অতঃপর গাড়িতে বসে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো সাদ। একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস গুলো গুছিয়ে আগলে রাখতে জানে সে।

চলবে,,,,,

(ভুল গুলো সুধরে দিবেন। )

গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here