শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় পর্ব- ০৪

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়
#পর্ব_৪
#Sadia_afrin_nishi

“আপনি এখানে?”

অস্থিরতা নিয়ে কথাটা বললাম আমি।আমার এই উক্তিটি যার জন্য করা সে আর কেউ নয়, “রোবটম্যান”।ওনাকে এভাবে এখানে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরেছি আমি।নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও প্রশ্ন করলাম,

_কী হলো বলুন আপনি এখানে কী করছেন।

রোবটম্যান আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলল,,

_এ্যানসার দিতে বাধ্য নই

ওনার এহেন জবাবে আমি একটু অপমানবোধ করলাম। মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলেই ওনার রাশভারি কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই আবার ঘুরে দাড়ালাম।

_”যেতে বলেছি কী”

ওনার কথার জবাবে কী বলা উচিত ঠিক বুঝতে পারছি না। লোকটা অতীব মাত্রায় ঘাড়ত্যাড়া। নিজেই সবসময় অধিকার ফলাতে আসে। আমি মৌনতা কাটিয়ে মিনমিনে স্বরে বললাম,,

_কলেজে দেড়ি হচ্ছে এখনই প্রস্থান করা আবশ্যক

উনি আমার কথায় হয়তো বিরক্তবোধ করলেন।চোঁখ মুখ কুঁচকে উত্তর দিলেন,,

_তো যাতে তাড়াতাড়ি যেতে পারো সেজন্যই তো এলাম

আমি প্রশ্নসূচক চাহনি নিক্ষেপ করে বললাম,,

_মানেটা বুঝলাম না, ক্লিয়ার করুন

উনি এবার চরম বিরক্তির আভা ফুটিয়ে বললেন,,

_তোমাকে অতো মানে বুঝতে হবে না। তুমি পিচ্চি আছো সেভাবেই থাকো।আর হ্যাঁ আমি বেশি কথা বলা পছন্দ করি না। চুপচাপ বাইকে উঠে বসো

আমি আরও কিছু বলতে নিলেই মাস্কের আড়ালে ওনার রক্তিম চোখ জোড়া দেখে দমে গেলাম। তারপর ধীরে ধীরে বাইকের দিকে অগ্রসর হলাম।

এই ঘটল এক বিপত্তি। বাইকে ওঠার এক্সপ্রেরিয়েন্স না থাকায় আমি একটু নার্ভাস হয়ে পরলাম। এতটাই টেনশন হচ্ছে যে বাইকের দিকে তাকিয়ে থম মেরে দাড়িয়ে থাকলাম। আমার এহেন অবস্থা মনে হয় উনি বুঝতে পারলেন তাই ঘাঁড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,,

_ভয়ের কোনো কারণ নেই, উঠে বসো

আমার ওনার কথায় একটু স্বস্তিবোধ তাই ধীরে ধীরে উঠে বসলাম বাইকে।আমি উঠে বসতেই উনি আমাকে বললেন,” পেছন থেকে ওনাকে ধরে বসতে”।ওনার এমন কথায় আমি আরও নার্ভাস হয়ে পরলাম। এটা কী করে সম্ভব। আমার পক্ষে ওনাকে ধরে বসা অসম্ভব।পরিস্থিতি আটকাতে আমি মিনমিনে স্বরে বললাম,,

_আমি ঠিক আছি আপনি বাইক স্টার্ট দিন আমার লেট হচ্ছে খুব

আমার কথাটা ওনার পছন্দ হলো কী না জানিনা তবে উনি আর কোনো কথা না বলেই বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল।

এ মা এটা কী হচ্ছে? আমার মনে হচ্ছে আমি শূন্যে ভাসছি।মুহূর্তেই চারদিক পেছনে চলে যাচ্ছে আর আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সামনে।প্রচন্ড ভয় করছে আমার।সারা শরীরের পশম কাঁটা দিয়ে উঠছে।পাঁয়ের তলা শিরশিরিয়ে উঠছে। আমি এবার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দু’হাতে শক্ত করে জাপটে ধরলাম আমার সামনে থাকা ছেলেটিকে।দুচোখ খিঁচে বন্ধ করে আছি।ভয়ের চোটে যে আমি রোবটম্যানকে জড়িয়ে ধরে আছি এটা আমার মাথাতেই নেই।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে আমার ললাটে, নাকের ডগায় কিন্তু সেগুলো মোছার সময় আমার নেই।আমি তো নিজেকে আড়াল করতেই ব্যস্ত।কিছুক্ষণ পরেই সবকিছু নিস্তেজ হয়ে গেল।কম্পন, হাওয়ার গতি ধীরে ধীরে কমতে কমতে একদম বন্ধ হয়ে গেল। আমি তখন বুঝতে পারলাম বাইক থেমেছে।ওনাকে জড়িয়ে থাকা হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো আমার।চোখ খুলতেই বাইকের মিররে দৃশ্যমান হলো আনন্দে উচ্ছ্বসিত রক্তিম বর্ণের দুটো চোখ।হয়তো তখন ওনার কথা না শোনার ফল ভোগ করায় উনি বেশ আনন্দ পেয়েছেন।এটা ওনার মুখ না দেখেও আমি বুঝতে পারছি ওই রক্তিম চোখের মনিকোঠা দিয়ে।

ধীরে ধীরে নিজেকে স্বাভাবিক করে বাইক থেকে চট করে নেমে পড়লাম আমি।নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে। মনে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত করে ফিরেছি।ওনার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে কাঁধের ব্যাগের ওপর এক হাত রেখে লম্বা লম্বা পা ফেলে ততক্ষণাত ওখান থেকে প্রস্থান করলাম আমি।উনিও আর আমাকে পেছন থেকে ডাকেননি।কলেজের বিশালাকার ক্যাম্পাস পেরিয়ে ক্লাসরুমের এরিয়ায় পাঁ রেখে গেটের দিকে চোখ নিবদ্ধ করতেই দেখলাম সেই বাইকওয়ালা এখনো ওখানেই আছে।আমি তাড়াতাড়ি করে চোখ ঘুড়িয়ে নিয়ে ক্লাসের দিকে অগ্রসর হলাম।

নতুন কলেজে এডমিট হওয়ায় তেমন কোনো ক্লোজ বন্ধু এখনো হয়নি আমার তবে আমার ক্লাসমেট মিতালির সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। মেয়েটা বেশ মিশুক প্রকৃতির। মিতালি হিন্দু ধর্মের। কিন্তু বন্ধুক্ত গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আমাদের দু’জনের ধর্ম বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি বরং আমরা দুজন দুজনের ধর্মকে শ্রদ্ধা করেই বন্ধুক্তটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

আর একটুর জন্য আজকের মতো বেঁচে গেলাম। এখনো ক্লাসে স্যার এসে পারেনি।মিতালির পাশের সিটটা এখনো ফাঁকা পরে আছে।এটা নতুন নয় প্রতিদিনই মিতালি ওর পাশে আমার জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখে।আমার মাঝে মাঝে খুব হাসি পায়।কলেজে উঠে ও কেমন প্রাইমারির স্টুডেন্টদের মতো বিহেভ করে মেয়েটা তবে আবার ভালোও লাগে আমার প্রতি ওর কানসাস দেখে।

আমার আজকে একটু লেট হওয়ায় মিতালি চিন্তিত স্বরে বলল,,

_কী রে এতো দেড়ি করলি কেন? শরীর ঠিক আছে তোর? তোকে কেমন জানি দেখাচ্ছে? কোনো প্রবলেমে পরেছিলি নাকি?

আমি মিতালির অবস্থা দেখে হা করে চেয়ে আছি ওর মুখপানে।আর মিতালি সে তো আমার উত্তরের অপেক্ষায় অধীর হয়ে চেয়ে আছে। আমি এবার খিলখিলিয়ে হেসে দিলাম। আমার হাসি দেখে মিতালি প্রচন্ড বিরক্ত হলো।কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিল আমাকে।আমি তারপর ওকে বললাম,,

_আচ্ছা তোরা সবাই কেন আমাকে বকিস বল তো?আমি তো কাউকেই বকতে পারিনা? সকাল সকাল ওই লো…….

“লোকটা” বলতে গিয়ে থেমে গেলাম আমি।ইস কী বড় ভুল করে ফেললাম। এখন যদি মিতালি জিজ্ঞেস করে তখন কী বলবো আমি?

আমার ভাবনা সত্যি প্রমাণ করে মিতালি বলে উঠল,,

_কী বলছিলি তুই? পরিষ্কার করে বল।সকাল সকাল কে তোকে কী বলেছে শুনি?

আমি আমতা আমতা করে বললাম,,

_ কই কে আবার কী বলবে আমাকে।কেউ কিছুই বলেনি। তুই অযথা টেনশন করছিস।

মিতালির হয়তো আমার কথা বিশ্বাস হলো না। সে আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ক্লাসে স্যার প্রবেশ করলেন।অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীর ন্যায় আমরাও তখন উঠে দাড়িয়ে স্যারকে ওয়েলকাম করলাম। তারপর দু’জনই এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ায় মন বসালাম।

_ _ _ _ _

কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরে বাবা আর আমি একসঙ্গে খাবার খেয়েছি। তারপর দু’জনে মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। বাবা-মেয়েতে অনেক দিন পর এভাবে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হলো।রাতে বাবার জন্য কিছু ছোট মাছের তচ্চরি করলাম। এই খাবারটা বাবার খুব পছন্দ। আমি আবার এসব খেতে পারিনা। ছোট মাছে কাঁটা বেশি থাকে যদি গলায় বিঁধে যায় সে ভয়তেই খাওয়া হয়না। আমি আবার একটু ভীতু প্রকৃতির।আমার জন্য কিছু শাকপাতা রান্নার আয়োজন করলাম।

রান্না প্রায় শেষের পথে এমন সময় বাবা দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে এলেন সাথে করে নিয়ে এলেন মেহমান। এই মেহমানও আর কেউ নয় “রোবটম্যান”।

ওনার আগমনে আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। কেন মনটা হচ্ছে জানি না তবে মনে হয় সকালের ঘটনাটি আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে যার দরুন ওনাকে এখন আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে।

বাবা হাতমুখ ধোঁয়ার উদ্দেশ্যে কলপাড়ে গেলেন।আমি আর রোবটম্যান ঘরে একা।এই একাকিত্ব সময়টা আমার মনে আরও বেশি অস্বস্তির সৃষ্টি করছে।আমি চুপচাপ ঘর থেকে কেঁটে পড়ার উদ্দেশ্যে এক পাঁ বাড়াতেই কেউ আমার হাতটা খুব শক্ত-পোক্তভাবে চেপে ধরল।আমি কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করলাম যার ফলে চোখে জল চিকচিক করে উঠল

চলবে,

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here