শাহজাহান তন্ময় পর্ব -০৬

শাহজাহান তন্ময় – ৬

আজ অরুর ষোলো-তম জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হবে। বার্থডে কেকের অর্ডার তন্ময় দিয়েছে। রেড-ভেলবেট চার তলা কেক। কেকের অর্ডার দিয়ে মাত্রই ছাঁদে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে কফি। কফি থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে। ইতোমধ্যে বাগানে আয়োজন শুরু। হৈচৈ, ছোটাছুটি, চেঁচামেচি চারিপাশে। হাতে থাকা কফির মগে চুমুক বসিয়ে অদূরে নজর দিল। শাবিহা লুকিয়ে-চুরিয়ে বাগানে এসছে ফুল তুলতে। খালি পায়ে ওদিকে যাবার কী মানে? মেয়েটার পায়ে কাঁটা না ঢুকে! তন্ময় গম্ভীর স্বরে চেঁচিয়ে ডাকে,

‘শাবিহা! কী সমস্যা? জুতো কই?’

শাবিহা থমকে যায়। জিহ্বা দাঁতে চেপে ধরে। বোকাবোকা ধাঁচের হাসে। বিড়বিড় করে বলে,

‘ভাই-এইত পড়ছি।’

এরপর ফুল না তুলেই দ্রুত বাড়ির ভেতর চলে যায়। তন্ময় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটু ঘুরেফিরে ফুলের টব গুলো দেখে। এ-সময় মেয়েলী গলার স্বর শুনতে পায়। ফুসুরফাসুর করছে। তন্ময় তাকায় না। পাশের বাড়িটায় ইতর দুটো মেয়ে থাকে। একটা পাঁচতলায় আরেকটা দু-তলায়। তন্ময়কে দেখলেই বারান্দায় ওঁৎ পেতে দাঁড়ায়। যেন মধু এসেছে এখন তারা একটু চেখে দেখবে। পাঁচ তলায় থাকা মেয়েটার নাম হৃদ৷ ওই ফুসুরফাসুর সুরে ডাকছে। তন্ময় পাত্তা দিচ্ছে না দেখে এবার একটু শব্দ করেই ডাকে, ‘এইযে, শুনছেন!’

তন্ময় এম্নিতেই বিরক্ত! এখন তার বিরক্ততা কয়েকগুণে বেড়ে গেল। এভাবেই আজ অফিস যেতে পারেনি বলে মহাবিরক্ত ছিল। অফিসে তার সবে নতুন জয়েনিং। অনেক কিছুই শেখার আছে, শিখছে। এসময় একদমই ছুটি কাটাতে চাচ্ছিল না। যতোই নিজেদের কোম্পানি হোক না কেন! কাজ, কাজই হয়। নিজের বা পরের! কিন্তু মোস্তফা সাহেব মানলে তো? তিনি কড়াকড়ি ভাবে বলেছেন আজ বাড়িতেই থাকতে। অগ্যত তন্ময় বাড়িতেই রয়ে গেল।

ছাঁদ থেকে নেমে বাগানের দিকে আসতেই ডেকোরেশন ম্যানেজমেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হলো। আলাপ-আলোচনা করছিল দুজন। সেসময় তন্ময়ের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে পশ্চিম দিকটায়। তাদের বাড়ির বড়ো এক অরু নামক আপদ চোরের মতো, হুড়মুড়িয়ে ছুটছে বাগানের দিক। ফর্সা উদোম পা-জোড়া জমিন ছুঁয়ে যাচ্ছে তাড়াহুড়ায়। হালকা কুকড়ানো চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে নিচে নেমেছে। বাতাসে সেগুলো দুলছে-উড়ছে। টইটই করে বাগানের ভেতরে ঢোকার জন্য তৈরি মেয়েটা। এখন যদি পায়ে কাঁটা বিঁধে, ও বাড়ি কাঁপিয়ে কান্না করবে। নাকের পানি চোখের পানি তার শার্টে মুছে বলবে,

‘তন্ময় ভাই, তন্ময় ভাই ব্যথা।’

তখন তন্ময়ের ইচ্ছে করবে চাটিয়ে একটা চড় মারতে। তবে সে সেটা কখনোই করবে না। অত্যন্ত না রাগলে তার দ্বারা এসব মারামারি অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার। অগোচরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তন্ময়। কপাল মধ্যিখানে ভাঁজ পড়েছে। বিরক্ত সুরে গলা উঁচিয়ে বলে,

‘এই! তোর ওখানে কী কাজ?’

অরু থতমত খেয়ে ওঠে। থমকে পড়ে। ফিরে তাকায় মাথা উঁচু করে। পরপরই দাঁত বের করে হাসে। ফুলের পাপড়ির ন্যায় সুন্দরতম ঝকঝকে নয়নের পাপড়ি ঝাপটে ঝাপটে জবাব দেয়,

‘ফুল নিব। চুলে গুজব। সুন্দর দেখাবে না বলুন?’

তন্ময় দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। আঁড়চোখে ফের তাকায়। অরুর চোখ ঝাপটানো তার অন্যতম পছন্দের দৃশ্য। ওই মায়াবী নয়নের লম্বা ঘন পাপড়ি যখন ঝাপটা খায়, দারুণ দেখতে দেখায়।
অবিশ্বাস্য রকমের টান লাগে মনে। ভীষণ আদুরে লাগে।

তন্ময় নিজেই এগোয়। শার্টের হাতা কনুইয়ের ওপর তুলতে তুলতে ফুলের বাগানে ঢোকে। যা যা ফুল লাগবে তুলে দেয়। অরু ফুলগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। সবগুলো ফুল ফ্রোকে নিল। একটা ফুল হাতে নিয়ে কানে গুঁজে নিল। তন্ময়ের দিক লাজুক হাসি নিক্ষেপ করে শুধায়,

‘তন্ময় ভাই সুন্দর না ফুলটা?’

তন্ময় অপলক তাকিয়ে থাকল। ঢোক গিলল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এলোমেলো ভঙ্গিতে চারিপাশে তাকাল, ‘হু।’

অরু জবাব পেয়ে ধেইধেই করে ছুটে চলে গেল। শুনতে পেল না তন্ময়ের বিড়বিড় করে বলা, ‘এই ফুলের থেকেও সুন্দরতম ফুল তুই।’

______

অনুষ্ঠান শেষ হলো রাত বারোটায়। তন্ময় এসেই হট সাওয়ার নিয়েছে। রাতে গোসল না করলে তার ভালো ঘুম হয়না। ব্যাড-হ্যাবিট বলা যায়। মাত্রই গোসল সেড়ে বিছানায় বসেছে। সে-সময় দরজা ঠেলে একটা মাথা ঢুকে পড়ল। উদোম তন্ময়কে দেখে মাথাটা দ্রুততম গতিতে চলে গেল। পরপর দরজায় করাঘাত। তন্ময় আনমনে সামান্য হাসে৷ গলার স্বর গম্ভীর করে বলে,

‘কে?’
‘আমি।’
‘কী লাগবে?’

অরু এবার বিড়বিড় করে জবাব দেয়,

‘আমার গিফট।’

তন্ময়ের ঠোঁট ঘেঁষে ছুটে দুষ্টু হাসি৷ উঠে দাঁড়ায়। একটা টি-শার্ট জড়িয়ে বলে, ‘আয়।’

অরু পারমিশন পেয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে। সাদা প্রিন্সেস গ্রাউন এখনো পড়ে। পরীর মতো মাথায় ক্রাউন। হাতে সাদা গ্লোভস। তাকে এক ছোটো পরী বলাই যায়। সে হাত বাড়িয়ে দেয়,

‘আমার গিফট।’
‘কী গিফট চাই!’
‘বাইসাইকেল।’
‘সাইকেল দিয়ে কী হবে?’
‘মারজি চালিয়ে স্কুল যায়। ওর সাথে মিলেমিশে আমিও যেতে চাই।’
‘আচ্ছা।’

অরু বাইসাইকেল পাবার খুশিতে ছুটে বেরোয়। তন্ময় সেলফোন হাতে নেয়। সে কয়েকটা বাইসেকেলের পেজ ঘুরে। বেশ কয়েকটা সাইকেল দেখেশুনে সে সাদা-লাল কম্বিনেশনের একটা সাইকেল পছন্দ করে। পরপর অগ্রীম পেমেন্ট করে, অর্ডার প্রেস করে ফেলে। কাল নাগাদ চলে আসবে হয়তো।
_____

তন্ময় বন্ধুমহলের সবথেকে গম্ভীর, নীরব ব্যাক্তি তন্ময়।
প্রয়োজন ব্যাতিত তার মুখ থেকে শব্দ বেরোয় না। নীরব দর্শকের মতো শুনে এবং দেখে। তাই বন্ধুমহলের সকলের ক্যারেক্টর সম্পর্কে তার অবিশ্বাস্য রকমের প্রেডিকশন রয়েছে। এবং তা সত্য হয়। খুব কম কথা বলা তন্ময় যখন কিছু বলে তা অনেকটাই স্বর্ন যেন! এবং তার স্বর্নযুক্ত কথাবার্তার মান রাখা হয় দারুণভাবে।

যেমন সেদিন রিহান আড্ডায় এসে পৌঁছাল মন খারাপ নিয়ে। মারাত্মক ধরণের ডিপ্রেসড সে। বন্ধুমহলের সকলেই প্রশ্ন করল,

‘কী হয়েছে।’

রিহান ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে খুলে বলে। সে শুহানিকে পছন্দ করতে চায় না। তাও কেন দিনদিন পছন্দের মাত্রা বাড়ছে? আশ্চর্যজনক ভাবে তন্ময় সেদিন মুখ খুলে। খুব সাবলীল গলায় বলে,

‘When you try not to fall for someone you will fall harder and stronger.’

রিহান অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। তন্ময় উপদেশ দেয়,

‘সমদ্রের স্রোত কী থামাতে পারব আমরা? কখনোই না। থামানোর প্রচেষ্টায় হয়তো ডুবে যাব নাহয় মরে। তবে সেই স্রোতের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারব। চলতে গিয়ে উপভোগ করব, আনন্দ পাব, বৈরাগী হব।’

রিহান তন্ময়ের সেই উক্তি আজ ও মনে রেখেছে। সেই উক্তি মনে গেঁথে নিয়ে মনের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এতদূর এসেছে। এখন পছন্দের ভীষণ গভীরে সে। সেখানটার নাম ভালোবাসা। এক নিদারুণ ভালোবাসার জন্ম হয়েছে। যার অন্ত নেই। যার কোনো সীমান্ত নেই। রিহান ভাবে, খুব করে ভাবে। তন্ময় বুঝি ভালোবাসা নামক স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকদূর চলে গিয়েছে। এতটাই দূর যেখান থেকে ফেরার রাস্তা নেই।

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here