শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব -০১

শিশিরে ভেজা আলতা
(২য় খন্ড)
ফারহানা আক্তার রুপকথা

১.
“মেয়ে তার মায়ের বিয়ে দিয়েছে!
আলতা তো মহান কাজ করে ফেলেছে। এমন মেয়ে ক’জনের হয়?”

মায়ের বিয়ে দেওয়া সমাজের চোখে খুব বড় প্রশংসনীয় আর বাহবা’র কাজ। কিন্তু কিশোরী প্রায় বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকতেও মায়ের বিয়ে সমাজের চোখে কি পরিমাণ জঘন্য আর সমালোচনাতূল্য তা অজানা ছিলো আলতার। সে তো মায়ের বিয়ের রাতেই পাড়ি জমিয়েছিলো ঢাকার পথে৷ কিন্তু তারপরের দিন থেকে সমাজের মানুষগুলোর ছি ছি আর ধিক্কার তা যে তার মাকেই সইতে হচ্ছে। নকশির আর জহিরের বিয়েটা যতখানি চুপচাপে হয়েছিলো ততোটা নিশ্চুপ ছিলো না তার পরের সময়গুলো এখনো নেই। তাদের আড়ালে আবডালে পাড়া প্রতিবেশীরাই পরের দিন মুখরোচক গল্প বানিয়ে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দিলো। তাতেই আর শেষ হয়নি ঘটনা বরং দু দিনের মাথায় নকশি যখন স্কুলে গেল তখনি কানে এলো অনেকের ছি ছি।

“মাইয়া বিয়া দেওয়ার বয়সে নিজেই বিয়া বইছে। মনের ভিত্রে রস, রঙ্গ আছে বইলাই মাইয়ারে শহরে পাডাইছে পড়ার নাম কইরা। আহারে আতলাডার কপাল মন্দ!”

আবার কেউ কেউ তো বলে বসলো, “জহিরের লগে আগে থাইকাই কিছু আছিলো৷ তা না হইলে পোলাডা এত বছর বিয়া করলো না ক্যান। এই নকশিই কিছু করছে।”

এমনই কিছু সংলাপ মুখস্ত বাক্যের মত অনেকেই আওড়ায় নকশির সামনে। বুকের ভেতর তীব্র ঘৃণা জমে গেল নিজের প্রতি নকশির দু দিনেই। জহিরকে দেখলেই কেমন গা জ্বলে যায় তার। বারবার মনে হয় সব দোষ জহিরের। কে বলেছিলো তাকে এতগুলো বছর ধরে এভাবে তার পেছনে পড়ে থাকতে! আলতা তো জহিরের কথা জানতে পেরেই উতলা হয়েছে নিজের মাকে সংসারী করার জন্য। নইলে আগে তো সে এমন কোন ভাবনাই ভাবতে পারেনি৷ নাকি আওলাদের সাথে দেখা হওয়াটাই কাল হলো! তার কলিজার টুকরোটা তার বিয়ের পেছনে এমনি এমনিই পড়েনি। যে মেয়ে তাকে ছেড়ে এক রাত কাটাতে পারে না সে মেয়ে আজ মাস পেরিয়ে গেছে শহরে পড়ে আছে একা। হোস্টেলে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের সাথে কিভাবে থাকছে! যে মেয়ে কখনো ভাতটা বেড়ে খায়নি, নিজের কাপড় ধুয়ে দেখেনি সেই মেয়ে এখন কি করে নিজের ঘর গুছিয়ে, কাপড় ধুয়ে পড়াশোনা করছে! আবার নাকি মেয়েটা হোস্টেল থেকে অনেকটা দূরে কোচিংও করতে যায় সপ্তাহে তিনটা দিন। কালই তো শিশির জানালো আলতা নাকি একটা টিউশনি পেয়েছে। ছোট্ট আলতা নিজেই নাকি শিক্ষকতা শুরু করেছে। শিশিরই খুঁজে দিয়েছে টিউশনিটা। মাস শেষে চার হাজার টাকা ছোট্ট একটা বাচ্চার হাতেখড়ির জন্য৷ সপ্তাহে চারটা দিন একটা ঘন্টা করে পড়িয়ে আসে সে। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটোয় জল ছাপিয়ে গাল ভিজে গেলো। জহিরের সাথে বিয়েটা সে এখনো মানতে পারেনি অথচ চল্লিশ পেরোনো জহির একটা মাসের বেশি সময় হলো ধৈর্য্য ধরে আছে নকশির মনের পরিবর্তন হবে এই আশায়। একটা পুরুষ কতদিন অপেক্ষায় কাটাবে? নারীদেহের স্বাদ নিতে একটা পুরুষ কি পরিমান কামুক হয় তাতো নকশির অজানা নয়। বুকের ভেতর চাপা আর্তনাদ নিয়ে নকশি ডায়াল করলো আলতার নাম্বারটা। মেয়ে দূরে থাকবে বলে আওলাদই অনেকগুলো টাকা দিয়ে শিশিরকে বলেছে একটা ফোন কিনে দিতে। শিশিরও আওলাদকে সাথে নিয়েই ফোন কিনে সব সেটিংস বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলো আলতাকে। নকশিরও একটা দামী ফোন হয়েছে জহিরের বদৌলতে। জহির তার পুরনো ফোন নষ্ট হওয়ায় নতুন ফোনটা কিনেছিলো নিজের জন্য। হঠাৎই তার মনে হলো নকশির একটা দামী ফোন হলে সে নিশ্চয়ই আলতাকে ভিডিও কল করবে নকশির আগের ফোনটা তো বিয়ের দিনই ভেঙে ফেলেছিলো । বড় আনন্দে সে ফোনটা নকশিকে দিয়েছে৷ নকশি প্রথমে নিতে চায়নি তখন জহির বলল, “এখন তোমার আর আমার বলতে তো আলাদা কিছু নাই। যা আমার তাই তোমার। ফোনটা তোমার কাছে থাকুক।”

ভর দুপুর ; মাথার ওপর রোদের তীব্রতা মস্তিষ্ক গলিয়ে দেওয়ার মত৷ স্কুলের চাকরিটা ছাড়তে বলেছিলো অনেকেই নকশি ছাড়েনি। বিয়ে করায় তার দ্বায়িত্ব যতোই জহির নিতে চায় নেক কিন্তু সে একদম হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। তার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাকেই ভাবতে হবে। আওলাদ হয়ত তার মেয়ের জন্য কম করবে না তাতে কি নকশি নিজের দ্বায়িত্ব ভুলে যাবে! আরো কয়েকবার মেয়েকে ফোন করেও লাভ হলো না। কি করছে মেয়েটা এখন কে জানে! ঘামে ভেজা মুখ, গলা শাড়ির আঁচলে মুছে ফোন রেখে ক্লাসে ঢুকলো নকশি৷ নবম শ্রেণিতে এখন তার ক্লাস আছে। চিন্তাময় মনটা নিয়েই আপাতত নিজ কাজে ব্যস্ত হলো।

ডিপার্টমেন্ট হেড আজ শিশিরকে ডেকে কিছু কাজ দিয়েছেন। বলা চলে একদমই ব্যক্তিগত কাজ আর তাই কাজগুলো তাকে করতে হবে বিকেলে টিউশনিতে যাবার আগে। এখন দুপুর প্রায় মরে এসেছে। রোদের আলো কম থাকলেও তেজ মোটেই কম নয়। ডিপার্টমেন্ট হেড ইউসুফ স্যার মধ্যবয়স্ক লোক। বিয়ের পিড়িতে অনেকটা দেরিতে বসেছিলেন বলেই সন্তানাদিও বিলম্বের লিস্টে। তার দুটি ছেলে মেয়ে তারমধ্যে প্রথম সন্তানের বয়স চার আর দ্বিতীয় সন্তানটি গত মাসেই জন্ম নিয়েছে। আর আজ শিশিরের কাজ স্যারের শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বউ বাচ্চাকে স্যারের বাড়িতে নিয়ে আসা। চাইলেই আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমেই কাজটা করানো যেত। স্যারের নিজেরই ছোট ভাই, ভাইয়ের বউ আর মা-বাবাও আছেন৷ কিন্তু পারিবারিক কোন ঝামেলার কারণে নিজেও শ্বশুরবাড়ি যান না আর না বাড়ির কাউকে যেতে দেন৷ শিশির তার ডিপার্টমেন্টে বরাবরই প্রশংসনীয় আর সব প্রয়োজনে শিক্ষক ছাত্র প্রায় সবারই বিশ্বাসযোগ্য। সেকারণেই স্যার তাকে ডেকে খুবই স্বাভাবিক ভাবে বললেন কাজটা করতে। শিশিরও ঠিকানা নিয়ে রওনা দিলো মিরপুরের দিকে। শিশির যখন তার গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে যাচ্ছে তখনই তার ফোনটা বাজলো। স্ক্রীণে ভেসে ওঠা আলতার নাম।

– হ্যাঁ বল

-আমি একটু মার্কেটে যেতে চাচ্ছিলাম।

– আজ আমি একটু ব্যস্ত কাল নিয়ে যাব।

শিশির ঝটপট বলল কথাটা৷ আলতা ভয়ে ভয়ে বলল, “তোমার আসতে হবে না আমি রুমমেট শৈলি আপার সাথে যাচ্ছি।”

আলতার কথা শেষ হতেই চেঁচিয়ে উঠলো শিশির, “যাচ্ছি মানে কি হ্যা! সব প্রস্তুতি নিয়ে আমাকে কি ঢং করতে ফোন দিয়েছিস? এ্যাই তোর কলি’জা কতখানি বড় হয়েছে ঢাকায় এসে!”

শিশিরের এমন গর্জন করা আওয়াজ শুনে ট্যাক্সির ড্রাইভার একবার আয়নায় দেখলো তাকে। ওপাশে আলতাও ভয়ে চুপসে গেছে। ঢাকায় এসেছে মাস পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন সে একাই কলেজে যায়, কয়েক দিন ধরে টিউশনিতেও তবুও এমন আচরণ করার কি আছে! মার্কেটে কি সে একা যাচ্ছে! কিন্তু এই কথাটাই আর মুখ ফুটে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বলা যায় না। সে আবারও ধীর স্বরে বলল, “আমার খুব দরকার যাওয়াটা।”

“কি দরকারে যাবি বল আমি দরকার পূরণ করবো বল শিগ্রই।”
এবারও ঝাড়ি মেরে কথা। আলতার ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু কি করে বলবে তার দরকারটা কি। ওসব কথা কি ছেলেদের বলা যায়! বাড়ি ছেড়ে জীবনে কোথাও গিয়ে সে দশ বারো দিন কাটায়নি অন্তত মাসের সেসব দিনগুলোতে তো নয়ই। আর ঢাকায় আসার সময়ও মনের অবস্থা ঠিক ছিলো না কি গোছাতে কি গুছিয়েছে নিজেই জানে না। দরকারি জিনিস বলতে খাতাপত্র আর পোশাকটাই জরুরিভাবে গুছিয়েছিলো সে। আর ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো তো সব শিশির ভাই নিজেই জোগাড় করেছে কিছু অনলাইনে কিছু শরত ভাইয়ের মাধ্যমে। ফোনের ওপাশে অধৈর্য্য গলায় ধমকে ওঠে কল কাটলো শিশির। আলতা তার বিছানায় বসে মন খারাপ করে আছে। শৈলী আপু তার মুখ দেখেই বুঝলেন মেয়েটা অনুমতি পায়নি বাইরে যাওয়ার। বিগত দিনগুলোতে তিনি খেয়াল করেছেন আয়শা যাই করে সবটা তার মামাতো ভাই শিশিরকে জানিয়ে আর অনুমতি না মিললে তার সাধ্য নেই কিছু করার। আলতাকে হোস্টেল, কলেজ সবাই আয়শা আহমেদ নামেই চেনে। শৈলী আর যাওয়ার কথা বলল না আলতাকে বরং তার থেকে টাকা নিয়ে গেল নিজেই এনে দেবে সব।

সন্ধ্যার আকাশে আঁধার কতটুকু তা বোঝার উপায় নেই রাস্তাঘাটে জ্বলে ওঠা কৃত্রিম আলোয়। ইউসুফ স্যারের শ্বশুর বাড়ি থেকে মাত্রই বের হয়েছে শিশির স্যারের বউ বাচ্চা নিয়ে। আধঘন্টার মত বসেছিলো সে অথচ কেউ এক গ্লাস পানিও সাধেনি। শিশিরের মনে হলো এদের মধ্যে আন্তরিকতা নেই আর এ কারণেই বোধহয় স্যারের সাথে এদের দ্বন্দ্ব! কিন্তু তার এসব ভাবনার বিষয় নয় তার ভাবনা হলো আজ দুটো টিউশনি মিস হয়ে গেছে। তার ওপর আলতার জন্যও খারাপ লাগছে। নিশ্চয়ই খুব জরুরি কিছুর জন্যই বের হতে চাচ্ছিলো সে!

সন্ধ্যের বাজার আজ খুব গরম। শরত, আহসানুল্লাহ দুজনের দোকানেই ক্রেতার ভীড়। হাঁটের দিনগুলোতে এমনই হয়। আজও দম ফেলার উপায় নেই এরই মাঝে শরতের ফোনটা বেজে চলছে অনবরত। কয়েকবার ফোন রেখেই কাস্টমারে মনযোগ দিলেও বারবার কল আসায় নতুন কর্মচারীটিকে সামলাতে বলে ফোন রিসিভ করলো। স্বভাবসুলভ ভাবেই শরত প্রথমে সালাম দিলো। কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটি বুঝি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। নিজের মতোই বলে গেল, “কি অবস্থা শরত? আমি অনু বলছি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here