শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব -১২+১৩

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১২.
ঝরঝরে পরিষ্কার দুপুর ; শীত শীত রাত-ভোর মাঝামাঝি এমন দুপুর বড্ড স্নিগ্ধ করে মনকে। আজকের দুপুরটা অনেক অনেক দিন পর আলতার কাছে বেশ আনন্দের, স্বতঃস্ফূর্ত লাগছে। সকালের সময়টা ভালো কেটেছে দুপুরটাও এখন বাবার সঙ্গে বসতে ভালো লাগছে খুব। শিশিরের সাথে একটু আগেই এসেছে সে বাবার সাথে দেখা করতে। প্রায় ত্রিশ মিনিট আগের ঘটনা, শিশির যখন জহিরের বাড়ি গেল তখন শরতও বাড়ি আসছিলো। আজ দোকান খোলেনি সকালেই সে দোকানের বিভিন্ন মাল কিনতে সদরে গিয়েছিলো। সবে মাল নিয়ে দোকানে ফিরেছিল অমনি নকশি কল করে বলল আজ তাদের বাড়ি যেতে। বাড়ির সকলে সেখানেই আছে। দোকানের কাজ গুছিয়ে দোকান বন্ধ করতে বেশি সময় লাগেনি। মনে মনে ঠিক করেছে আজ দিনটা ছুটিই থাক। তাই কর্মচারী ছেলেটিকে ছুটি দিয়ে নিজেও ফিরে এসেছে৷ বাড়ির গেইটে এসে ঢোকার পথে শিশিরকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ানো দেখে সে একবার ডাকলো কিন্তু শিশির বুঝি শুনতেই পায়নি। শরত পুনরায় ডাকতে উদ্যত হতেই দূর থেকে অনু চেঁচিয়ে বলল, “ওই শিশির স্ট্যাচু অফ শিশির ফোঁটা হইছিস ক্যান পিছনে তো শরৎচন্দ্র দাঁড়াইয়া আছে।”
কথাটা বলতে অনু লজ্জা না পেলেও তখন শরত, শিশির দু ভাই ঠিকই লজ্জা পেল। আলতা অবশ্য জোরে হাসতে গিয়েও হাসি আটকেছে। আর সোহা তার স্বভাবসুলভ নিঃশব্দ হাসি হেসেছিল। এরপর অনেকটা সময় অনুর দিকে একদমই তাকায়নি। শিশিরও নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চট করে বলে বসলো, “আওলাদ চাচা আসছে বাড়িতে চল” এটুকু বলেই আবার বলল, “তুই এগিয়ে যা আমি আম্মার থেকে বাড়ির চাবি নিয়ে আসি।”

আব্বা এসেছে শুনেই আলতা বেরিয়ে যাচ্ছিল পরে মনে হলো আম্মাকে বলে যাওয়া উচিত। সে নকশির ঘরের উত্তরের পেছন দিকটায় যেখানে রান্নাঘর সেদিকে যেতে পা বাড়ালে শিশির বাধ সাধলো, “তুই যা চাচা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমি বলে দিব ফুপুআম্মাকে।”

তারপরই আলতা এসেছে মিনিট খানেক পর শিশিরও চাবি নিয়ে হাজির। গেইট খুলে দিয়ে আওলাদের আনা ব্যাগভর্তি চাল, গুড়,নারকেল সব ঘরে নিয়ে রাখলো। তারপর আর সে কোথাও যায়নি উল্টো নিজের ঘরে ঢুকে নিজের কিছু জিনিসপত্র শরতের ঘরে রেখে এলো। যে কদিন এখানে আছে মেয়েগুলো যে তার ঘর দখলে রাখবে তাতো জানাই আছে।

আওলাদ মেয়েকে পাশে বসিয়ে তার খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নিলেন প্রথমেই পরে কিছুটা সংকোচের সাথেই জানতে চাইলেন দু একদিনের জন্য তার গ্রামে যাবে কিনা! সংকোচ তার মূলত তার স্ত্রীর করা পূর্ব ঘটনার জন্যই। প্রথমবারও তো কত আহ্লাদ করে জোর গলায় আবদার করে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। কি লাভ হলো! তার স্ত্রীর মেয়েটাকে চক্ষুশূল ভেবে কটুকথা শোনালো। সে চেয়েও কথার বাণ রুখতে পারেনি। এরপর স্ত্রীকে মা*রধো*রও কম করেননি কিন্তু তাতে কি কথাগুলো তো আর ফিরে আসবে না। মনে অনেক সাধ নিজের ছেলেদের যেমন সাথে রেখেছেন তেমনই করে মেয়েটাকেও রাখতে। চোখের সামনে থাকবে, ভালমন্দ নিজে যা খাবে তাই খাওয়াবেন কিন্তু এই সাধ তার আর পূরণ হবার নয়। তাই আজ আর জোর খাটিয়ে কিছু বললেন না। আলতাও বাবাকে কষ্ট না দিয়ে যতটুকু সম্ভব বুঝ দিলো সে অল্প সময়ের জন্য এসেছে আর শহরের দুজন বান্ধবী এসেছে তাদের সাথেই থাকবে। এ আর বলেনি বান্ধবী দুটো তার নয়। কথায় কথায় আওলাদ জানতে পারলো আলতা টিউশনি করে সেখানে তখনই তার মাথায় আসমান ভে*ঙে পড়লো যেন। সাথে সাথে বলল, “তোর ট্যাকা পয়সা যা লাগবে আমারে বলতে বলছিনা! তুই টিউশুনি নিলি ক্যান রে মা!”

আলতা ক্ষীণ হেসে জবাব দিল, “টিউশনি করলে সময়টা ভালো কাটে আব্বা। টাকার দরকার পড়লে আমি নিজেই আপনারে ফোন দিব।”

আওলাদ আশ্বস্ত হতে পারলো না। সে আজও আলতার জন্য হাজার দুয়েক টাকা এনেছে। কারে কাছে জেনেছে এই গ্রামের পাশের গ্রামে মেলা হচ্ছে সেই কথা মাথায় রেখেই এক হাজার টাকা আর টুকটাক প্রয়োজনের জন্য এক হাজার বাড়িয়ে এনেছে সে। এমনিতে মাস শেষে ফোন করে আলতাকে তার খরচের টাকা পাঠায় শিশিরের কাছে। আজকের টাকাটা দেখে আলতা নিতে চাইলো না আওলাদ জোর করেই মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ” কারো লগে যদি মেলায় যাওনের সুযোগ হয় যাইস। আমি নিয়া যাইতাম কিন্তু আমার তো ফারমের( খামার) তে বাইর হইতে সন্ধ্যা হেরপর বেলা গড়ায় তাত্তাড়ি। অহন দিন ছোট আইসা মেলায় নিয়া আবার তোরে দিয়া যাইতে অনেক রাইত হইব।”

আওলাদ কথা শেষ করার আগেই শিশির এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের সামনে। হাতে তার এক কাচের পিরিচে সকালের ভাপা পিঠা অন্যহাতে এক গ্লাস পানি। মা বাড়ি নেই ঘরে কোথায় কি আছে তা সে জানে না৷ আর আজ বাড়িতে ভাত রান্না হয়নি তাই এই ভর দুপুরে আওলাদকে সে ভাত খাওয়ার কথা বলতে পারলো না। কিন্তু এ সময় একটা মানুষকে একদম না খাইয়ে পাঠাতে ইচ্ছে করলো না বলেই ঘরে থাকা পিঠা এনে দিল। কিন্তু আওলাদের কথা শুনে বলল, “চাচা মেলায় যাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে না। মেহমান এসেছে ঢাকা থেকে তারাও যাবে আলতাও তাদের সাথেই যাবে।”

আওলাদ খুশি হলো শুনে। সে পিঠা খেতে চাইল না কিন্তু শিশিরের জোরাজুরিতে একটুখানি মুখে দিল। আলতার মুখে শুনলো আজ ও বাড়ি সবাই খাবে তাই আওলাদ ফিরে যাওয়ার জন্য উঠলো। শিশির আর আলতাও তার সাথেই বেরিয়ে পড়লো। আওলাদ বাজারের পথে চলে যেতেই বাড়ি উল্টো দিকে জহিরের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো তারা। মাথার ওপর রোদটা মোটামুটি তেজি আলতার গোলাপি মুখ আরও গোলাপি হলো সেই রোদে। পাশাপাশি হাটছে দুজন নিশ্চুপ, ক্লান্ত পথিকের মত। পৌষের বেলায় উষ্ণ ওম মাখা রোদে হাটতে হাঁটতে শিশিরের নজর নিবদ্ধ রইলো আলতার মুখে। তার দিকে না তাকিয়েও যেন সে বুঝতে পারছে শিশির ভাইয়ের এই চাহনি। অনুভব করছে ভেতর থেকে এক অবাধ্য কম্পন। ভয় নেই, ভীতি নেই যে মানুষটার পাশে থাকতে সে মানুষটার দৃষ্টিতেই সে আজ কাঁপছে কেন! আলতা ভেবে পায় না বছর কয়েক আগে যে মানুষটার অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পেয়ে সে গুটিয়ে গিয়েছিল ভেতর থেকে সেই মানুষটার জন্যই এখন তার ভেতরের উথাল-পাতাল ঢেউ বয়। এ কেমন আজাব শুরু হয়েছে তার ছোট্ট জীবনটাতে! মায়ের দূরত্ব যখন তাকে বিষন্নতার এক অকূল পাথারে ফেলে দেয় ঠিক তখনি আবার এই মানুষটার উপস্থিতি তাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে আনে মহাশূন্যে, হাওয়ায় ভাসিয়ে বিষাদের সাথে আড়ি করায় সেই মানুষটাতেই এখন আবার ভীত হয়ে উঠছে সে। এই আজব ভিন্ন অনুভূতিগুলো তার কিশোরী মনে বিস্তর প্রভাব ফেলছে দিনকে দিন। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে জহিরের বাড়ির সামনে এসে গেছে খেয়াল করেনি দুজনের কেউই। তারা ভেতরে ঢুকতেই সোহা ডেকে উঠলো, ” শিশির তোমাদের এদিকে নাকি পৌষমেলা বসেছে আমরা কি যেতে পারব?”

সোহার প্রশ্নটাতে কি যে মিষ্টতা ছিল জানে না আলতা। কিন্তু তার এই মিষ্টভাষিণী মেয়ের মিষ্টি প্রশ্নটা জঘন্যরকম তিক্ত লাগল৷ সোহা দেখতে ভীষণ সুন্দর তার মুখে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য দেখতে পায় আলতা। পুরো গ্রাম জুড়ে যেখানে কিশোরী আলতার রূপের কথা জনে জনে বলে, ঢাকায় পা দিতেই হোস্টেল ভর্তি নারী, মেয়েরা তার গায়ের রঙ, তীক্ষ্ণ নাসিকা আর টানা চোখদুটোতে হিংসায় জ্ব*লে সেখানে আলতা আজ সোহার উজ্জ্বল অথচ অল্প পর্সা মুখশ্রীতে হিং*সায় পোড়ে। ক্ষণে ক্ষণে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে শিশিরকে। শিশিরের দৃষ্টি ঠিক কেমন থাকে সোহার প্রতি! আর তার মনে বিদঘুটে যে সন্দেহ ঘুরপাক খায় তার আশি শতাংশ গাঢ় হয়েছে সোহা আর অনুর মধ্যে তফাৎ সম্মোধন। তার সন্দেহী মন যুক্তি খাটায় শিশির অনুকে ‘তুই’ বলে সম্মোধন করে তার কারণ একটাই তারা খুব ভাল বন্ধু। অথচ সোহাকে সর্বদা ‘তুমি’ আর ভিন্ন স্বরেই সম্মোধন করে৷ এটা হতে পারে তাদের মধ্যকার গভীর কোন অনুভূতির কারণে। তার ছোট্ট মনে যেটুকু পারে সেটুকুই ভাবে। অথচ তার জানাই হলো না কখনও শিশির ভাইয়ের মনটা তাকে কতোটা ভালোবাসায় আগলে নিয়েছে মনের কুঠুরিতে।

সোহার কথার জবাব শিশির দেওয়ার আগেই শিফা বলে উঠলো, “অবশ্যই যাবে তোমরা দরকার পড়লে শরত নিয়ে যাবে।”

চাচীর কথা শুনে চকিতে তাকালো শরত চাচীর দিকে। সে কেন যাবে তাদের নিয়ে! শিশির আলতা ততক্ষণে ঘরের বারান্দায় এসে বসেছে মাদুরে। সেই আসার পর এখানে মাদুর পেতেছে সোহা, অনু এখনো সেখানেই বসা সাথে যুক্ত হয়েছে শিফা আর জহিরও। জয়তুন অবশ্য রান্নাঘরে রুই মাছ ভাজছে। নকশির ক্লান্ত লাগছে বলে একটুর জন্য সে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। শিশির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই গেলে তো ভালো হয় নয়ত তিন তিনটা মেয়ে নিয়ে আমার মেলায় যেতে ভয় লাগত।”

শিশিরের কথাটাতে টিপ্পনী ছিল বুঝতে পেরে তেতে উঠলো অনু। সোহা শুধু নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে৷ কিন্তু তাদের দিকে পাত্তা না দিয়ে শরত বলল, “আমি যাব না কাকী শিশিরই পারবে তাদের নিয়ে যেতে। আর দূরে কোথাও তো না।”

অনু ফটাফট বলে বসলো, “আমাদের ভয় পাও নাকি শরৎচন্দ্র! নিশ্চিন্ত থাকো ব্রো আর যাইহোক আমরা তিনজন তোমার ইজ্জত লু*টবো না।”

অনুর হুটহাট লাগামহীন কথাবার্তায় এ নিয়ে প্রায় কয়েকবার লজ্জায় পড়লো শরত, শিশির আর তার চারপাশের মানুষজন। শিফা তো কথা শুনে জিভ কামড়ে ধরলো। জহিরও পাশেই ছিল তার ব্যপারটা পছন্দ হয়নি অন্তত আলতা সামনে আছে তাই৷ মেয়েটা এসব শুনে কি শিখবে এইটুকু বয়সে! সে নিজে বসা থেকে উঠে আলতাকে বলল, “আলতা মা তোর আম্মার খারাপ লাগছে একটু যা তো ঘরে। তুই পাশে থাকলে তার একটু ভাল লাগব।”

আলতা উঠে গেল, শিফা আর জহিরও চলে গেছে। শিশিরের চেহারা দেখে কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না সে কি রেগে আছে নাকি না! তবে শরত চোখ, মুখ শক্ত করে তাকিয়েছে অনুর দিকে। তা দেখে সোহা বেশ ঘাবড়ালো কিন্তু যার উদ্দেশ্যে শরতের মুখের ভাব পরিবর্তন হয়েছে তার এ ব্যাপারে কোন হেলদোল নেই। সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “তোমাদের একেকজনের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি কাউকে খু* ন করেছি। এমন রিয়াকশন দিচ্ছো যা দেখে জীবিত হয়েও মর*ণ মর*ণ ফিলিংস আসছে আমার।”

“এসব কি ধরণের কথাবার্তা তোর? এটা কি শহর পেয়েছিস অনু? এখানে সবাই কনজার্ভেটিভ মাইন্ডেড। কিছু জিনিসের লিমিটস আছে এখানে। তুই তো এতোটাও অবুঝ না।”

শিশিরের গলায় অপ্রকাশিত একটা শাষণ স্পষ্ট টের পেল অনু। তার এই প্রথম মনে হলো তার আচরণ ঠিক নেই। সে শরতের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যরি বুঝতে পারিনি।”

শরত সে কথা শুনলো না উঠে চলে গেল বাড়ির বাইরে। শিশির আর সোহা একদমই চুপচাপ বসে রইলো আগের জায়গায়।

“আম্মা তোমার কি কিছু লাগব?” মায়ের সিথান বরাবর বসে বড্ড আলতো স্বরে প্রশ্ন করল আলতা। নকশি শুয়ে ছিল চোখের ওপর হাত ফেলে। আলতার কথা কানে যেতেই সে উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “কেমন আছিস তুই? ”

আলতা মায়ের ডান হাতটা ধরে একটু হেসে বলল, আমি ভালো আছি আম্মা তুমি কেমন আছো? তোমার শরীরটা এমন লাগে ক্যান আম্মা! তুমি অনেক কালো হয়ে গেছো আর এই যে গলার হাড়গোড় সব দেখা যাইতেছে।”

ঘরের উত্তর দিকে একটা জানালা আছে। সেটা খোলা থাকায় ভর দুপুরের উজ্জ্বল রোদের আলোয় ঘরটা আলোকিত। নকশি মেয়ের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। তার হাত ধরে রাখা আলতার হাতটা তুলে গাঢ় এক চুমু খেয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখলো কিছু সময়। তারপরই হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো নকশি। অকস্মাৎ মায়ের এমন কান্নায় ভড়কে গেল আলতা। মাকে এবার এক হাতে জড়িয়ে ধরতেই মায়ের গলা শোনা গেল, “আমি খুব খা*রাপ মা তাই নারে! আমি তোকে একলা করে দিলাম এজন্যই তুই আমায় ছেড়ে গেলি। আমি স্বার্থপর হয়ে গেলাম আলতা মা আমার আমি তোকে এতিম করে দিলাম। আমার বুকটা খালি করে দিলাম আমি তোকে ঢাকায় যেতে দিয়ে।”

একের পর এক অস্পষ্ট উচ্চারণে নকশি কত কি বলে চলছে। কান্না আর আর্তনাদে ঘর জুড়ে এক শোকসভা তৈরি হয়ে গেল। আলতাও মায়ের আহাজারিতে কান্নাকাটি শুরু করলো আর এ সবটাই দরজার বাইরে থেকে শুনলো জহির, বারান্দা থেকে শুনলো শিশির, সোহা অনু আর শরত। রান্নাঘর থেকে শুনলো জয়তুন আর শিফাও। প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয় তাদের সেই কান্নার সাক্ষী হয়ে অনেকটা সময় বিষাদে জর্জরিত রইলো। দুপুর ঘন হয়েছে, খাওয়ার সময় হয়েছে অনেক আগেই। মা মেয়ের এই বেদনার সমবেশের সমাপ্তি টানতেই জয়তুন এলেন নকশির ঘরে। তার অতি পুরনো রাগী স্বরে ধমকে উঠলেন নকশিকে, “আক্কেল জ্ঞান কিছু হয় নাই তোর এহনও? এই যে কান্দাকাটি করতাছোস পেডেরটার (পেটেরটা) যে ক্ষতি হইবো সে খেয়াল আছে আর এই যে তোর বড় মাইয়াডাও তো দু দিন পরে শহরে যাইবো গা অর কি মন টিকবো পড়ালেহায়!”

নকশিকে কথাগুলো বলেই আবার আলতাকে ধমকে উঠলেন, “আর তুই কি বড় হইতাছোস না আলতা। তোর আম্মার এই শরীলে তুই একটু বুঝাবি না তারে! তুই এতিম হবি ক্যান তোর আব্বা, আম্মা মামা-মামী, জহির কাকা, শরত ভাই, শিশির ভাই আবার নতুন আরেকটা ভাই বোন হইবো। তুই একলা কেমনে আলতা তোর আম্মারে বুঝা তো। হেয় কি মই*রা যাইবো যে তোরে এতিম কইয়া ম*রা কান্দোন কানতাছে?”

জয়তুনের কথার ধাচ বরাবরই রুক্ষ অথচ তার মনটা ভীষণ কোমল। সে নকশি আর আলতাকে বকে ধমকেই কান্না থামালো যেন নরম সুরে কথা বলা তার স্বভাবে কিছুতেই যায় না। মা মেয়ের কান্নার পর্ব শেষ হতেই শিফা তাড়া দিলেন সবাইকে মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসতে। এ বাড়িতে ডাইনিংটেবিল আছে তবুও সবাই একসাথে নিচে বসে খেতে চাইলো। নকশি বলেছিলো, সোহা আর অনু টেবিলে দিতে অনু মুখের ওপর বলে দিলো তাকে মেহমানের মত ট্রিট করলে এখানেই থাকবে না আর। সোহা অবশ্য অনুর মত না বললেও নিচু স্বরে বলেছিলো, আমাদের সাথে এমন পর পর আচরণ করলে খুব কষ্ট পাবো।”

খুশি হয়েছে সবাই তাদের কথা শুনে। মেঝেতে মাদুর পেতে একে একে প্রত্যেকে পাশাপাশি বসে খাওয়ার পর্ব সেড়ে নিলো। তারপর কিছুটা সময় মহিলারা এ বাড়িতেই রেস্ট নিয়ে তবে বাড়ি ফিরলো। শিশির, আহসান আর শরত আগেই বাড়ি গিয়েছে তবে পরে শিফা, জয়তুন যাওয়ার সময় জহির বলে দিলো আলতা এ বাড়িই থাকুক দুটো দিন। আলতা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অস্বস্তিবোধ করছিলো। মনটা চাইছিলো মায়ের পাশে, মায়ের কাছেই থাকতে কিন্তু যতবার মনে পড়ে এ বাড়িটা তার বাবার নয়, তার আহসান মামারও নয় তখনি অন্তর জ্বলে ওঠে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে এই জ্বালাপোড়া কষ্ট নিয়েই মনস্থির করে এখানে আজ রাতটা থাকবে বলে। রোদ শেষের বিকেলটুকু রক্তিম হয়ে কুয়াশার আড়ালে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতেই নকশি একটা শাল নিয়ে আলতাকে ডাকলো। সবাই চলে যাওয়ার পরপরই নকশি তাকে খুব জোর করেই নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়েছে। আলতাও নিঃশব্দে মায়ের কোমর জড়িয়ে শুয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন সন্ধ্যে নামার মুখে বাইরের শীতের তীব্রতা আন্দাজ করে নকশি তাকে শাল দিয়ে ঢেকে আলতো স্পর্শে ডাকতে লাগল। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই তো শিফা ফোন করে বলল, আলতাকে পাঠিয়ে দে জলদি সন্ধ্যার পর সবাই মিলে মেলায় যাব। তোর এখন বাইরে বাইর হওয়া ঠিক না তা না হইলে তোকেও যাইতে বলতাম।”

নকশি জিজ্ঞেস করলো আর কে কে যাচ্ছে তখন নকশি হাসতে হাসতে বলল, শরতটা দিল ঝা*মেলা বাঁধিয়ে। হুট করেই বলছে আম্মা আর কাকীকেও নিয়া যাব। বুঝছিস তো ঘটনা ওই যে, মেয়ে গুলার সাথে যাইতে বলছি সে যাইব না এইজন্যই এমন বুদ্ধি বের করছে।”

নকশি আবারও হাসলো, “সত্যিই শরতটা একদম ভিন্ন৷ আজকালকার ছেলেরা যেখানে মেয়ে দেখলেই গা ঘেঁষে থাকতে চায়, সুযোগ খোঁজে কথা বলার সেখানে এই ছেলেটা মেয়েদের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। অলি মেয়েটা সত্যিই তাকে পায়ে ঠেলে ভুল করেছে।”

নকশির এ কথার পিঠে শিফা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।

ঘুমঘুম চোখে আলতা জামাকাপড় বদলেছে। চুল আঁচড়ানোর একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না বলে সে এমনিতেই ওড়না টেনে মাথায় দিচ্ছিলো তা দেখে নকশি ডেকে বলল, “আয়নার সামনে দ্যাখ চিরুনি আছে নিয়ে এখানে আয়।”

চলবে#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১৩.
সরিষা আর কলাই ক্ষেতের মাঝখানের আইল দিয়ে হেঁটে চলছে শিশিররা। প্রত্যেকেই শীতের তোপে গা কাঁপিয়ে কুয়শা সরিয়ে এগিয়ে চলছে মেলার দিকে। সারি বেঁধে চলতে চলতে নিজেদের মধ্যে আবার চলছে নানারকম কথাবার্তা। মেলায় যাওয়ার জন্য শুধু যুবক-যুবতী নয় শরতের চাপে পড়ে বড়দেরও আসতে হয়েছে। আহসানুল্লাহ অবশ্য শরতের একবার বলাতেই তৈরি হয়েছে জোর করতে হয়েছে জয়তুন আর শিফাকে। জহিরের বাড়ি থেকে ফিরেই সবাই একটু আধটু বিছানায় গড়িয়েছিল শুধু শিশির বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। সন্ধ্যাকালে বাড়ি ফিরে সোহা আর অনুকে তাড়া দিলে অনু বলল শরতকেও নিবে সাথে। শিশির ভেবেছিল ভাইকে বলবে তবে জোরাজুরি করবে না সে৷ কিন্তু তার আর কিছু করতে হয়নি অনু নিজেই গিয়ে জয়তুনকে বলল, চাচী শরৎ ভাইয়াকেও বলেন আমাদের সাথে যেতে। শিশিরের ওপর ভরসা নেই আমাদের খেয়াল রাখবে না সে।”

সোহা মিটিমিটি হেসেছে শুধু অনুর কথা শুনে। যে টোনে সে কথা বলছো তা অবিশ্বাস্য ছিলো। এত নরম আর বিনয়ী সুরে অনু এর আগে কখনো কথা বলেছে বলে মনে পড়লো না তার। শরত তখন ঘরেই ছিল মায়ের কাছের অনুর বলা কথা শুনে সে বিড়বিড় করে উঠলো, “আল্লাহ্! চরম নাটকবাজ মেয়ে তো এটা।”

জয়তুন এসে একবার বলাতেই শরত দ্বিরুক্তি করলো না তবে সেও বলে বসল, “আম্মা আপনি আর কাকীও তৈরি হোন। বাড়ির সবাই একসাথে যাব।”

মাগরিব শেষে একসাথে বেরিয়েছে সবাই। নকশি বাড়ি থেকে বের হবে না বলে জহিরকেও আর বলা হয়নি যাওয়ার কথা। বাড়ি থেকে বেশি দূর নয় বলেই সবাই রাস্তা ছেড়ে ক্ষেত পেরিয়ে যাচ্ছে। আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে আলো থাকলেও আজ চাঁদহীন আকাশ বলেই হয়ত চারদিকে অন্ধকারে ঢাকা। আইল দিয়ে চলার সময় সবার প্রথমে আহসান চলছে তার পেছনে শিফা তারপরই জয়তুন। তাদের থেকে দু কদম পেছনেই আছে শিশির আলোহীন পথে তার বা হাতের মুঠোয় আছে আলতার হাত। আলতা তার পেছন পেছন চলছে যার ফলে শিশিরকে একটু বাঁকা হয়েই আগাতে হচ্ছে সামনে। আলতার পেছনে অনু তার থেকেও পেছনে পরে আছে সোহা। বেচারি দু জোড়া জুতো এনেছে আসার সময় কিন্তু তার দুঃখ দু’জোড়া জুতোই উঁচু। সমান হিলের জুতো ছাড়া ক্ষেতের চিকন আইল দিয়ে চলতে সে হিমশিম খাচ্ছে খুব। কখনো এদিক তো কখনো ওদিক হেলে পড়ছে হাঁটতে হাঁটতে। শীতের রাতে এমনিতেই হাত পা জমে একাকার হয়ে আছে তারওপর আইল জুড়ে ঘাসে ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু পা ছুঁয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে তাকে। তার পেছনেই আছে শরত তার হাতেও আহসানুল্লাহর মত বড় টর্চবাতি। সে চলতে চলতে খেয়াল করেছে সোহার সেই নড়বড়ে চলন। মনে মনে একটুখানি হতাশ হলো সে। শহুরে মেয়েরা শহুরে ফ্যাশন সেন্স নিয়ে গ্রামে কেন আসে! বুঝে পায় না সে। চলতে চলতেই তার মনে হচ্ছিলো এই মেয়েটা যেকোন মুহূর্তে পড়ে গিয়ে একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটাবে। মন বলছিল একটু সতর্ক করতে পরমুহূর্তেই বাড়াবাড়ি ভেবে আর সে কিছু বলল না। মেলার প্রায় কাছাকাছিই চলে এসেছে তারা। সরিষার ক্ষেত ফেলে এসেছে পেছনে এখন তারা আছে কাঁচা মাটির রাস্তায়। দু’ধারে বাঁশঝাড় আর থেকে থেকে দু একটা বাড়ি। অথচ কোথাও আলোর রেশটুকু নেই সেদিকে। আহসানুল্লাহ চলতে চলতেই অনেক কথা বলে চলছিল শিফাকে। বলছিলো কথা তাদের শৈশবের কিছু স্মৃতি হুট করেই তার সামনে দিয়ে কিছু একটা দৌঁড়ে গেল। পা থেমে গেল আহসানের থামল বাকিরাও। জয়তুন চোখে আজকাল একটু কমই দেখে কিন্তু শিফা স্পষ্ট দেখলো কালো কোন এক চতুষ্পদ জন্তু ছুটে গেছে সামনে দিয়ে। সে কিছুটা আঁতকে উঠেই বলল, “ওটা কি গো!”

সবাই থমকে গেল ; সোহা ছিল একদম পেছনের দিকে সে শুনতেই ভয়ে শিউরে উঠলো। আহসানুল্লাহ হেসে বলল, শিয়াল ছিলো এত ভয় পাচ্ছো কেন আসো।”

আলতা মোটেও ভয় পায়নি। তার এসব কুকুর, শেয়ালে কখনোই ভয় হয়নি। ছোট থেকেই কতশত শেয়াল দেখেছে তার তো শেয়াল দৌঁড়ানোর অভিজ্ঞতাও আছে। তবুও শিশির একটু কেমন যেন চমকালো তাকে নিয়ে। মুঠোয় রাখা হাতটা আরেকটুখানি শক্ত করে ধরল, ফিসফিসিয়ে বলল, “ভয় পাস না”

আলতাও তেমনই ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি শেয়াল ভয় পাই না।”

“ওহহো আমিই ভুলে গেছি। তুই আবার শেয়াল ভয় পাবি কেন শেয়াল নিজেই তোকে দেখলে ভয়ে মা*রা যায়।”

অনু বিষ্মিত গলায় বলল, সত্যি!

জয়তুন এ কথা শুনে জোরে হেসে ফেলল। সেও শিশিরের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “হ এই কথা সত্যি। আলতায় তো আরো ছোট থাকতে একবার আমাগো বাড়ির পিছের ক্ষেতে শিয়ালরে পিডাইতে জিংলা(বাঁশের কঞ্চি) লইয়া দৌঁড়াইছে। হেই বার নকশির হাতে ওই জিংলার বারি হে নিজেই খাইছিল।”

হা হা করে হাসির শব্দ অন্ধকার পথে ঝংকার তুলল। প্রত্যেকেই হাসছে খুব আর আলতা লজ্জায় লাল হয়ে উঠছিল। ইশ, কেমন কথা বলছে তারা এখন সে বড় হয়েছে না। এভাবে তার মা*র খাওয়ার গল্প বললে সে লজ্জা পায় না বুঝি! হাসি, গল্পে পথ ফুরিয়ে এলো। এখন একটু সামনেই চোখে পড়ছে ছোট ছোট খন্ড আলো আর মাইকের উচু সাউন্ডে চলা বিভিন্ন এনাউন্সমেন্ট। আর মাত্র দু মিনিটের পথ আর ঠিক সে মুহূর্তেই ঝোপ থেকে কিছু একটা বেরিয়ে দৌঁড়ে গেল সোহার সামনে দিয়ে। সে ভয়ে চিৎকার করে পাশে থাকা শরতের কালো রঙের জ্যাকেটসহ শার্ট খামচে ধরলো। তার চিৎকারে সকলের পা থেমে গেল। আহসান পিছু ফিরে তার টর্চের আলো ফেলতেই অস্বস্তি বোধ করে আবার আলো অন্যদিকে ফেলল। ততক্ষণে প্রত্যেকেই ঘুরে তাকিয়েছে পেছনে। শরত অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে এক মুহূর্ত তারপরই নিজের হাতের টর্চের আলো পথের একপাশে ফেলে বলল, শেয়াল ছিল ওটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

সোহা তার হাত এখনো সরায়নি। সে আগের মতোই শরতের পেটের দিকের জ্যাকেটসহ শার্ট খামছে ধরে আছে। শরত টের পাচ্ছে মেয়েটা কাঁপছে খুব। বোঝাই যাচ্ছে ভয়টা সে বেশিই পেয়েছে। আহসানুল্লাহ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শিফাকে বলল, “তুমি আর ভাবী আমার সাথে আসো ওরা গিয়ে ঘুরে দেখুক মেলা। আমি তোমাদের মিষ্টির দোকানে ঘুরিয়ে আনি।”

অনু মিনিট খানেক সময় একদমই চুপ ছিল। সে ভীতু নয় তবুও এমন আঁধার ঘেরা পথে কোন জন্তুর উপস্থিতি তাকেও শিউড়ে দিয়েছে। তবে সে সামলে নিতে সক্ষম কিন্তু সোহা তা পারবে না সে জানে। মেয়েটার ভয় কাটাতেই সে মজা করে উঠলো, “শরৎচন্দ্রের শার্ট কি তোর নিজস্ব সম্পত্তি পাইছিস! যেভাবে ধরছিস বেচারার জ্যাকেটটা উপরে না থাকলে নিশ্চয়ই এটা ছিঁ*ড়ে যেত এখন।”

সোহা লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো। ছেড়ে দিল শরতের জ্যাকেটটা তবে এবার ভয়ের সাথে লজ্জায় পড়ে গেল ভীষণ। কি বাজে একটা ব্যাপার ঘটালো সে! শিশিরও অস্বস্তি কাটাতে বলল, ভয় পাস না আর চলে এসেছি মেলায়। যাওয়ার সময় আমরা মেইনরোডে গাড়ি দিয়ে যাব।”

সোহা নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় নিলো তারপর ক্ষীণ স্বরে শরতকে উদ্দেশ্য করে বলল, “স্যরি ভাইয়া আমি আসলে বুঝতে…”

“হু, বুঝতে পেরেছি সংকোচ করতে হবে না। চলো”

রাত যত বাড়ে মেলায় ভীড়ও তত বাড়তে থাকে। এজন্যই আহসানুল্লাহ মাগরিবের পর তাড়া দিয়েছিল বের হতে। কিন্তু মহিলাদের নিয়ে কি আর কোথাও সময় মেপে যাওয়া সম্ভব! যেখানে এশারের পর বাড়ি ফেরার কথা ছিল সেখানে এশারের আজান পড়লো মেলায় পৌঁছুতেই। জয়তুন মেলায় পা দিয়েই বলল, “চল ফিরা যাই। এত্তো মানুষের ভিতর ক্যামনে ঘুরমু শরীলে শরীল ঠেকে। তারচেয়ে ভালা ছিল বাড়িতে থাকা।”

শিফাও সহমত প্রকাশ করলো। বিয়ের প্রায় পঁচিশ ছর হতে চলল আর তার মেলায় শেষবার আসারও সময় হলো পঁচিশ। বিয়ের বছরেই সে এসেছিল আহসানের সাথে তারপর আর কখনো সাধও জাগেনি আর আসাও হয়নি। কিন্তু আজ এসে তার এত ভীড় আসলেই ভালো লাগছে না। আহসানুল্লাহ নিজের মত করে তাদের ঘুরিয়ে দেখাতে চাইলে দুজন মহিলাই ভীষণ আপত্তি তুলল৷ মনে মনে সে শরতকে ব*কলো কিছুক্ষণ, ফাজিল ছোকড়া মা-চাচীরে মেলা দেখাবি বলে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিলি। দুইজনের একজনও ঘুরবে না আর আমাকেও একটু ঘরে দেখতে দিবে না। এর চেয়ে ভালো ছিল বাড়িতে এখন লেপের তলায় শুয়ে আরাম করতাম।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহসান তার ভাবী আর স্ত্রীকে নিয়ে ময়রার দোকানে গেল। পছন্দসই কিছু মিষ্টি, নিমকি নিজেদের জন্য কিনে সে শরতকে ফোন দিল। শরত ফোন তুলে কিছু বলার আগেই আহসান বলল, “আমি তোর আম্মা আর চাচীরে নিয়া বাড়ি চলে যাচ্ছি। শিশিরে ভরসা নাই বাবা তুই একটু খেয়াল রাখিস মেয়েগুলোর। সাবধানে নিয়ে ফিরে আসিস পরের মেয়ে বুঝিসই তো!”

শরত বলল, “কাকা আপনারা এখনই চলে যাবেন মাত্রই না এলাম!”

“আর বলিস না তোর মা-চাচীরে এনেই তো দিলি ঝা*মেলা বাঁধিয়ে এরা কি ভীড়বাট্টায় থাকতে পারে?”

শরত বুঝলো ব্যাপারটা। তারই আসলে ভুল হয়েছে সে জানে আম্মা আর চাচী দুজনই এখানে এসে কমফোর্ট হবে না তবুও তখন মনে হচ্ছিলো শিশিরের বান্ধবীদের সাথে তার আসাটা অস্বস্তিকর হবে না বড়রা থাকলে। কিন্তু এখন তো সেই সমস্যায়ই পড়তে হবে দেখছি!

আহসান ফোনের ওপাশ থেকে আবার ডাকলেন, “কিরে আমার কথা শুনছিস তুই শরত?”

মাইকের আওয়াজ, গান-বাজনা আর লটারির গেম কথা কিছুর শোরগোলে হয়ত শরত কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ভাবছিলো আহসান। তখনই শরত জবাব দিলো, জ্বী কাকা শুনেছি।

“খেয়াল রাখিস কিন্তু ওদের। আর ফেরার সময় অটো দিয়ে ফিরিস।”

না চাইতেও দ্বায়িত্ব কাঁধে নিতেই হলো। সে ছোট্ট করে জবাব দিলো, জ্বী কাকা খেয়াল রাখব আমি সাথে সাথেই আছি তাদের।”

ফোন রেখে শরত তাকালো আলতাদের দিকে। আলতা আর অনু পাশাপাশি হাঁটছে শিশির তাদের দুজনের পেছনে৷ তার পেছনে সোহা আর সেখানে শরত নিজেও। আপনাআপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস ছিটকে এলো ভেতর থেকে তার। মনে পড়লো বছর দুই আগের এক রাতের ঘটনা। এখানটাতেই মেলা বসেছিল সেবারও। সে মেলায় আসা খুব একটা পছন্দ করে না অথচ অলি নাকি বের হওয়ার সুযোগ পায় না। তার জোরাজুরিতেই এক রাতে আসতে হয়েছিল এখানটায়। প্রেমিকা নিয়ে রাত বিরাতে ঘুরতে বের হওয়া, মেলায় যাওয়া এসব তার পছন্দের বিপরীত। তবুও সেদিন প্রেমিকার শখ পূরণ করতে আঁধার মাখা রাস্তায় হাঁটতে হয়েছিল। অলি বোরকা, নিকাবে নিজেকে ঢেকে শরতের বাহু চেপে হেঁটেছিল সেই পথে। শীতের তীব্রতায় প্রেমিকার স্পর্শের উষ্ণতা তাকে পাগল করেনি বরং করেছিলো লজ্জিত। মেয়েটাকে সে ভালোবাসলেও বিবাহ বহির্ভূত স্পর্শ তার মনকে কখনোই নাড়া দিত না বলেই সেদিন প্রেমিকার সেকি অভিযোগ! আজও মনে পড়ে যায় পুরনো সব স্মৃতি যা ছিল আকাঙ্ক্ষিত যা হয়ে গেছে আজ অযাচিত।

“আসুন না শরত ভাইয়া সবাই নাগরদোলায় চড়বো।”

সোহার আকস্মিক ডাকে ভাবনায় বিভোর থাকা শরত চমকে উঠেছে। চারপাশে ঝলমলে আলোয় শরতের চমকে ওঠা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সোহা। সে অবাক হলো ভীষণ তবে কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করলো না। নাগরদোলার প্রথম খোপে অনু বসেই চেঁচিয়ে বলল, আমি একা বসব প্লিজ আমি একা বসবো ইয়াহু ইটস এডভেঞ্চার টাইম।”

অনুর চেঁচানো দেখে শিশির বলল, “যা তুই একাই ম*র।”

পরবর্তী খাপে আলতা বসতেই শিশির বলল, “সোহা এবার তুমি বসো।”

আলতা আতঙ্কিত চোখে তাকালো সোহার দিকে। সোহারও একই অবস্থা মানে তারা দুজন দুজনকে ভরসা করে বসতে পারছে না। তাদের শখ থাকলেও একজন শক্ত মানুষ পাশে চাচ্ছে। তাদের মনের কথা যেন অনুর নখদর্পনে। অনুই আবার বলল, “আরররররেহ তোদের এই ঢং, কুয়ারাতে এখানেই রাত পেরিয়ে যাবে বাল। এ্যাই শিশির তুই বস আলতার সাথে শরৎচন্দ্র একটু কষ্ট করে সোহার সাথে বসো প্লিজ। এটা খুব ভী*তু মেয়ে পরে না আবার হার্ট অ্যাটাক করে বসে।”

অনুর কথা শুনে অন্যরা কিছু ভাবার আগেই সোহা বিড়বিড় করে উঠলো, নননাহ আমি শিশিরের সাথে বসবো।”

চলবে

(এত মন্তব্যহীনতা লেখার আগ্রহ শূণ্য করে দিচ্ছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here