শুকনো বকুলের মালা গাঁথিব পর্ব -০৬

#শুকনো_বকুলের_মালা_গাঁথিব
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_৬

ভার্সিটি, টিউশন এসব করতে করতে বেশ ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে নুর। বাবার সাথে ও কথা বলা হয় না অনেক দিন হলো। প্রথম দিকে রশিদ সাহেব প্রতিদিন রাতে এসে একবার হলেও দেখা করে যেতেন মেয়ের সাথে। ইদানিং খুব একটা আসেন না। কেমন যেন হয়ে গেছেন। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলেন না। দেখতেও যেন অনেক দুর্বল লাগে। বাবার হঠাৎ কি হলো বুজতে পারে না নুর। মনে মনে ঠিক করে একবার ডক্টর এর কাছে নিয়ে চেক আপ করিয়ে আনবে।কিন্তু সামনে সেমিস্টার ফাইনাল সেই চাপে হয়ে ওঠেনি আর। একদিন সন্ধ্যার পড়ে অ্যাসাইনমেন্ট করতে ছিল নুর। তখন সাইডে রাখা ফোনের নোটিফিকেশনে সেদিকে ঘুরে তাকায় নুর। কিন্তু সেখানে এমন কিছু লেখা ছিল যা দেখে নুরের অন্তরাত্মা কেপে ওঠে। ফোনে মেসেজ আর কেউ করেনি বরং নুরের বাবাই করেছিল। সেখানে লেখাগুলো ছিল এমন

Amake khoma kore dis ma. Ami je vhul korechi ta khomar ojoggo tobuo khoma kore dish. Je vhul korechi tar khesarot ami dicchi. Amar kora vhul i aj amake sesh kore dilo. hate hoyto beshi somoy nei. Toke khub dekhte icche korse akbar aktu ei basay ay.

হাতে সময় বেশি নেই বলল কেন বাবা। কি বোঝাতে চাইলেন তিনি। তার মানে বাবা কি অসুস্থ ছিল নাকি। বাবার করা ভুলের জন্য কি একটু বেশিই কেয়ারলেস হয়ে গিয়েছিল বাবার উপর। আর ভাবতে পারছে না। প্রচন্ড গিল্টি ফিল হচ্ছে।
অ্যাসাইনমেন্ট যেভাবে করতে ছিল সেভাবেই ফেলে রেখে রুম থেকে বের হয়। বের হতে হতে নবনীকে ডাকতে থাকে।

– নবু, নবু কোথায় তুই।

নবনী হয়ত ওর মায়ের রুমে ছিল। নুর এর ডাক শুনতে পেয়ে ছুটে আসে। সাথে আসে খালিদা বেগম ও। তিনিই প্রথম জানতে চান

– কি হয়েছে নুর। এভাবে নবুকে ডাকছ কেন।

– বড়মা একটু ওই বাসায় যাব।

ওই বাসায় যাওয়ার কথা শুনে খালিদা বেগম চোখ ছোট ছোট করে তাকান নুরের দিকে। আসার পর থেকে কখনো ও বাসায় যেতে চায়নি নুর। যত সম্ভব নিজের মতো ব্যাস্ত থেকেছে। তেমন একটা কারো সাথে কথাও বলেনি। তবে আজ হঠাৎ নবুকে এত জোরে জোরে ডাকছে আবার ওই বাসায় যেতে চাচ্ছে। হলোটা কি।

খালিদা বেগমের ভাবনার মাঝেই নুর বলে

– বড়মা বাবার শরীর হয়ত ভালো নেই। কিসব উল্টা পাল্টা বকছিল। হাতে বেশি সময় নেই। কি না কি বলল। আমাকে দেখতে চাচ্ছি। এখনই যেন ওই বাসায় একবার যাই।

– এখন না গেলে হয় না। কাল যাস।

– না বড়মা। তুমি না যেতে চাইলে বল আমি নবুকে নিয়ে যাই।

দুটো মেয়ে একা একা যাবে। তাও রাত হয়ে গেছে। মনটা সায় দিল না খালিদা বেগমের। তিনি বলল তিনিও আসতে চান। এরপর তিনজন বেরিয়ে পড়েন। বেশি সময় লাগল না। এমনি যতটুকু সময় লাগে তার থেকেও কম সময় লাগল আজ এমনটাই মনে হলো।

নুররা পৌছাতেই দরজা খুলে দিল ঝর্না বেগম। নির কাল বিলম্ব না করে দৌড়ে চলে গেল বাবার রুমে। রশিদ সাহেব এর শরীর বেশ খারাপ করায় তিনি বেডে শুয়ে রয়েছেন। চোখগুলো কেমন ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। দেখতে কেমন ভয়ংকর লাগছে।
বাবার এই অবস্থা দেখে মনটা অনেক খারাপ হয়ে যায় নুরের। হুহু করে কাদতে মন চায়৷ তবুও নিজেকে সামলে নেয়। কারন বাবার সামনে কাদলে বাবা কষ্ট পাবে।

নুরকে আসতে দেখে ঝর্না বেগম কাদতে কাদতে রুমে ঢুকলেন। বললেন নুররে তোর বাবা বোধ হয় আর বাচবে না।

নুরের মনে হলো বাবাকে জরুরি ভিত্তিতে হসপিটাল নেয়া উচিত। ঝর্না বেগম তা তো করেনই নি এমনকি নুর দের একবার ফোন করার ও প্রয়োজন বোধ করেন নি। এখন যে কান্না টা করছে এটাও কেন যেন নুরের কাছে ফেইক ফেইক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে লোক দেখানোর জন্য করছে এসব। এই মুহুর্তে এসব নিয়ে কথা বাড়াতে চাইল না নুর। দ্রুত বড় চাচ্চু রায়হানকে ফোন করলেন।

নুর এর ফোন পেয়ে তিনিও চমকেছেন। নুর তো কখনো ফোন করে না। হঠাৎ। তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করলেন। নুুর ফোন রিসিভ করে আর কিছু বলল না শুধু বলল

– চাচ্চু তুমি এখনই চলে আস। আমাদের বাসায় আস। বাবা অনেক অসুস্থ। চাচ্চু রাগ অভিমান সব পড়ে হবে। হসপিটালে নিতে হবে তাকে।ইট’স ইমারজেন্সি চাচ্চু। প্লিজ কাম ফাস্ট।

নুরকে এভাবে অস্থির হতে দেখে সত্যি সত্যি টাগ অভিমান ভুলে গেলেন। সেদিন এর পর থেকে আর কখনো রশিদ এর সাথে কথা বলেনি রায়হান সিকদার। তার আত্মসম্মান বোধ প্রবল। ছোট ভাই তার মুখে মুখে তর্ক করেছে এটা তিনি মানতে পারছেন না। সেই ক্ষোভে এতদিন কোন যোগাযোগ রাখেন নি। কিন্তু আজ ভাতিজির এভাবে অস্থির হয়ে যাওয়ায় রায়হান সিকদারকেও ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। তিনি অফিস থেকে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে পড়লেন। ড্রাইভার এর অপেক্ষা করলেন না নিজেই ড্রাইভ করে চলে আসলেন।

বাড়িতে এসে ভাইয়ের এই করুন অবস্থা দেখে রায়হান সাহেব ও বেশ কষ্ট পেলেন। এ অবস্থা তো একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরেই হয়েছে। কি এমন ঘটল যে তার সুস্থ সবল ভাইটা এমন হাড্ডিসার হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে ভাইয়ের মাথায় হাত রাখলেন তিনি। সামনে নিজের পিতৃতুল্য বড় ভাইকে দেখে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন রশিদ সাহেব। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে রায়হান সাহেবেরও বুক চিড়ে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইল। কান্নাগুলো কেমন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল। চোখ পানিতে ভিজে উঠল। অন্য দিক মুখ ঘুড়িয়ে শার্ট এর হাতায় পানিটুকু মুছে ফেললেন। রশিদ তার কাপা কাপা হাত উঠিয়ে বড় ভাইয়ের ডান হাতটা আকড়ে ধরল। তারপর আস্তে আস্তে ভাইয়ের কাছে নিজের করা কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলেন। ভাই যখন বলল তোর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই তখন এত কষ্টের মাঝেও যেন এক টুকরো হাসির দেখা মিলল রশিদ সাহেব এর ঠোঁটের কোনে। তারপর তিনি ভাইয়ের কাছে বললেন

– সবাইকে একটু বাহিরে যেতে বলেন আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।

– সব পরে হবে। আগে ডক্টর দেখিয়ে আসি।

– বেচে ফিরি নাকি না তার গ্যারান্টি নেই ভাইজান এখনি বলতে হবে। আরজেন্ট..

ভাইয়ের এমন কথায় চোখ পাকিয়ে তাকান রায়হান। তারপর বলেন এসব কি কথা রশিদ। তুই ঠিক সুস্থ হয়ে ফিরবি দেখিস।

ভাইয়ের কথায় মনে মনে হাসে রশিদ সিকদার। তিনি তো জানেন তার সাথে কি হয়েছে। তাই তো সব কিছুর বন্দোবস্ত করে গেছেন তিনি। ভাইকে বলেন তার মাথার নিচের বালিশটা একটু তুলতে।

ছোট ভাইয়ের কথামতো রায়হান সিকদার ও তাই করেন। বালিশ টা একটু জাগালেই তার নিচে বেশ কিছু কাগজ পত্র দেখতে পান। রায়হান সিকদার বের করে দেখতে গেলে রশিদ সাহেব তখন ভাইয়ের হাত চেপে ধরেন। ভাইয়ের দিকে তাকালে বলে

– ভাইজান পরে দেখ।

– আচ্ছা ঠিক আছে। তবে এখন হসপিটাল যাওয়াটা জরুরি।

রশিদ সাহেব হসপিটাল যেতে রাজি না। তাই তিনি বারবার এটা ওটা বলে আটকাতে চাচ্ছিলেন। এর মধ্যে ঝর্না বেগম এসে বলেন

– ভাইজান তার বোধ হয় তেমন কিছু হয়নি। হসপিটাল না নিলেও চলবে। আমি ঠিকঠাক মতো সেবা যত্ন করলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

ঝর্না বেগম ও হসপিটাল নিতে নারাজ। ঝর্না বেগমকে বাধা দিতে দেখে মনে মনে একটু হাসলেন রশিদ। তিনি ঝর্না বেগমের মনের অবস্থা বেশ বুজতে পারছেন। যে যাই বলুক নুর আর ওর বড় চাচ্চু মিলে হসপিটাল নিয়ে গেল রশিদকে। নিয়ে যাওয়ার ডক্টররা কন্ডিশন খারাপ দেখে ইমিডিয়েটলি ভর্তি করার জন্য বললেন। ডক্টর দেখে বেশ কিছু টেস্ট করতে দিলেন। সব টেস্ট করানো হলো। রিপোর্ট দিতে একটু লেইট হবে বললে রায়হান সাহেব ঝর্নাকে আর খালিদা বেগমকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আর নুর হসপিটালেই রয়ে গেলেন।

রিপোর্ট আসল পরদিন বিকেলে। ততক্ষণে রশিদ এর অবস্থা আরো অবনতি হয়েছে। রিপোর্টে কি এসেছে জানতে চাইলে ডক্টর কেমন আমতা আমতা করলেন৷ এভাবে সরাসরি বলতে কেমন একটা লাগছে৷

নুর বলল ডক্টর আপনি বলুন। আমরা যেকোনো ফলাফল শুনতে প্রস্তুত আছি৷

নুরের কথায় ডক্টর ও আর কাল বিলম্ব করলেন না। তিনি বললেন রশিদ সাহেব এর কোন রোগ হয়নি। একচুয়ালি এটা মা’র্ডার এর চেষ্টা। মা’র্ডার অর সু’ই’সা’ইড এর চেষ্টা সেটা কনফার্ম বলা যাচ্ছে না তবে নীরবঘাতক বি’ষ ধীরে ধীরে ভিতর থেকে বিকল করে দিয়েছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here