শুচিস্মিতা পর্ব -০৯

#শুচিস্মিতা -৯
Tahrim Muntahana

~ আনতারা কেন আমার বউ হবে না, আম্মা? খুব বেশী ক্ষতি তো হবে না।

ছেলের করুণ কন্ঠটাও মিসেস সেলিনা কে টলাতে পারলো না। কোনো ভাবেই আনতারা কে তার ছেলের ব‌উ হিসেবে মানতে পারবে না। ওমন কালো মেয়ে তার ছেলের ব‌উ হবে? প্রতিবেশীর কাছে তার মান থাকবে? সেদিন ও না গলা উঁচিয়ে বললো, ‘আমার সোনামুখ পোলার জন্যে রূপসী মাইয়া আনমু, যেদিক যাইবো আলোকিত হ‌ইয়া যাইবো!’ এখন যদি ছেলের কথা শুনে ওমন কালো মেয়েকে ঘরে তুলে প্রতিবেশী রা ছি ছি করবে না?

~ চুপ যাও ফাতিন। আমি একবার না ক‌ইছি মানে না। দু দিনের মনে ধরছে, ঘরে নতুন ব‌উ আইলে ওই সবে মন যাইবো না। সবাই যখন ক‌ইবো সোনার মুখের সাথে কোন মুখ জোড়া লাগছে, তখন তোমার‌ও মন ভাইঙ্গা যাইবো। মাইয়া ডা কষ্ট পাইবো বেশী। সীমার মধ্যে থাকো, ভালো করে ব‌ইলা দিলাম‌। না হলে আম্মা’র কথা ভুইলা যাও, আমার ওমন ছেলের দরকার নাই, ওই দিকে আগাইলে আমার মরা মুখ দেখবা!

কেটে যায় ফোন, ফাতিন বিষাদ নজরে তাকিয়ে তাকে ফোনের দিকে। মা বুঝতে পারছে না, সে কৃষ্ণমায়ার প্রেমে পড়েছে, ভালোবেসেছে, মোহে পড়েনি। ওই মেয়েটা তার হলে প্রতিবেশী কেন পুরো পৃথিবীর সাথে লড়তে পারবে। তবে মা যে কসম দিয়ে দিল, কি করবে ফাতিন? কসমে সে বিশ্বাস করে না, কিন্তু মা তো! জন্ম দিয়েছে, বড় করেছে, মায়ের খুশির জন্য না হয় একটা মেয়েকে ছেড়েই দিলো, নাহয় সে দহনেই পুড়লো, পুড়ে একদম ছাই হয়ে গেল তবুও আর চাইবে না! আনতারা নামক মেয়েটিকে সে চাইবে না, তবে ভালোবাসবে। যে ভালোবাসার কথা একান্ত‌ই তার নিজের কাছে গচ্ছিত থাকবে, না কেউ শুনবে, না কেউ জানবে।
কয়েকটা ডায়েরী না হয় কলমের কালিতে ঠাসা থাকবে, লেখা থাকবে হাজারো অব্যক্ত কথাগুলো, ডায়েরীর প্রতিটা ভাজে তার গোপন ভালোবাসা মিশে থাকবে; কেউ জানবে না! জানতে দিবে না। চোখের কোণে তপ্ত জলের ছোঁয়া টের পায় ফাতিন, তাচ্ছিল্য হাসে! ছেলেরা নাকি কাঁদতে পারে না, কাঁদতে নেই! তাহলে সে কি করছে? ছেলেদের কাতারে পড়ে না নিশ্চয়‌ই! ওয়ালপেপারে থাকা ছবিটায় চোখ বুলায় সে, বিড়বিড় করে বলে,

~ আমি ঠকেছি কৃষ্ণমায়া, তুমি যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে!

সকালের রক্তিম সূর্য উদিত হয়েছে মাঠ ও বিলের অসংখ্য ধানের জমিতে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে। দূর্বাঘাসে শিশিরের ছোঁয়া। মনে হয় রূপালী মুক্তার বিন্দু! নীলাকাশে বিশাল সামিয়ানার মতো উড়ন্ত সাদা মেঘ। সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে যায় শালিক, ময়না, টিয়ার ঝাঁক। কলকাকলি তে মুখোরিত পরিবেশ এক অভূতপূর্ব আনন্দ-অনুভূতির সৃষ্টি করে। অপূর্ব ভালো লাগার দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়, মন‌ নেচে উঠে, ডানা ঝাপটানো পাখিদের মতোই উড়তে ইচ্ছে করে। আনতারা’র আজ কেন জানি উড়তে ইচ্ছে করছে, প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে, মনের ভেতর অস্থিরতা দোলা দিয়ে যাচ্ছে। কারণটা রাত তিনটেই আসা অটো, যে অটো তে ছিল রক্তে মাংসে গড়া এক অসম্ভব সুন্দর মনের মানুষ। যার মনকুঠিরে তার মতো অন্ধকারের রাজত্ব! পড়া শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় আনতারা, হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দে উঠে বসে, মন বলছিলো মানুষ টা বুঝি এসেছে। দোটানা নিয়েই বেলকনির পর্দায় নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ায়, কৃষ্ণ নয়ন যুগল মেলে বাইরে দৃষ্টি ফেলে আনতারা। আলো আঁধারি রাতে পরিচিত বলিষ্ঠ পুরুষালি অবয়ব দেখে ধক করে উঠে বুক! সেই সাথে হানা দেয় একরাশ খুশি, অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠে মায়াবি হাসি। এরপর ঘুমাতে পারেনি মেয়েটি, চরম উৎকণ্ঠায় হাঁসফাঁস করেছে। কখন সকাল হবে, কখন সে প্রকৃতি বিলাস করবে, কখন রাশিদ নামক পুরুষ টি তার পথ আগলে দাঁড়াবে! সময় টা হতেই ছুটে এসেছে বাইরে, তবে যার জন্য এত খুশি, এত তাড়াহুড়ো সেই তো আসছে না! ওইদিকে সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে, তাকে ফিরতে হবে! আরো কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে অপেক্ষায়, আসে না। বাড়ির পথে র‌ওনা দেয়, হাসি খুশি মুখটা আঁধারে ঢেকে গেছে। তালুকদার বাড়ির সামনে এসেই চিকচিক করে উঠে আনতারা’র চোখ, ওই যে দাঁড়িয়ে আছে। শিউলি তলায়! হাতের মুঠোয় কয়েকটা শিউলি ফুল! পায়ের গতি স্বাভাবিক করে হেঁটে আসে আনতারা, বুঝতে দেয় না রাশিদ কে। কাছাকাছি আসতেই হাতে থাকা ফুল গুলো ছুঁড়ে দেয় আনতারা’র দিকে, আনতারা কিছু বলে না। মনে হয় মুখ খুললেই সে ধরা পড়ে যাবে, যা কখনোই করা যাবে না।

~”তুমি আমার এমনি একজন, যারে
এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন!”

গানের লিরিক্স গুলো গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে চলে যায় রাশিদ! খানিক টা লজ্জা পায় আনতারা, ভেবেছিল রাশিদ এমনিই কথা বলবে। বাড়ির ভেতরে ঢুকার আগেই আনতারা টের পায় তার ছোটচাচা ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। আনতারা হেসে উঠে, লোকটা কিছু না বলেও, সবার আড়ালে গান দ্বারা কি সুন্দর বুঝিয়ে দিলো ভালোবাসার গভীরতা! এমন ভালোবাসা বারবার উপেক্ষা করা যায়? সে কি এতটা নিষ্ঠুর?

~”তোমার মনে পরলো বান্ধা
আমার আন্ধা মন
আদরে রাখিও বন্ধু
করিও যতন!”

ঘুমের ঘোরে ফোন হাতড়ে কানে ধরতেই গানের লিরিক্স শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে রনি। অচেনা নম্বর দেখে ভড়কে যায়। তবে কন্ঠটা বেশ চেনা চেনা লাগছে। আবার কানে তুলে কিছু বলবে অপাশ থেকে ভেসে আসে,

~ রনি ভাই, আন্ধা মন বান্ধা পড়েছে। ভালোবাসলে বলতে হয়!

ভ্রু কুঁচকে আসে রনির। সে আবার কাকে ভালোবাসলো‌। স্কুল কলেজ লাইফে অনেক মেয়ের সাথে প্রেম ছিলো, তা কেবল মজা করেই। মেয়ে রাও মজা নিতো, সেও এগিয়ে যেত। তখন সময় টাই মেয়েদের পেছনে ঘুরার ছিলো, বড় দের দেখে দেখে নিজেও ট্রাই করতো, চেহারা সুরত বেশ ভালো ছিলো বলে মেয়েরাও পাত্তা দিতো‌। ঝামেলা বাজতো তখন যখন নিব্বি গার্লফ্রেন্ড গিফট চেয়ে বসতো। কি দরকার? ব্রেকাপ, শেষ! তবে ভার্সিটি লাইফে তেমন কিছু করার সুযোগ হয়নি, পড়েছে মন দিয়ে, তাই তো আজ লেকচারার হতে পেরেছে। এত বছরে কাউকে ভালোবেসেছে বলে রনির মনে আসলো না, এই মেয়ের মাথা খারাপ? ধমকে উঠে,

~ এই মেয়ে কিসব যা তা বলছেন? কে ভালোবাসে, কাকে ভালোবাসে? কে আপনি?

~ রনি ভাই আমি ঝিনুক! তোমার হবু ব‌উ, যাকে তুমি ভালোবাসো। যাও তো প্রেম প্রেম মুড টাই নষ্ট করে দিলে।

খট করে কল কেটে যায়, অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে‌ রনি।‌ হবু ব‌উ ঠিকাছে, তবে সে কখন বললো ভালোবাসে? চিন্তায় ব্যস্ত রনির ঘোর কাটে কারো ঘর কাঁপানো হাসির শব্দে‌। রাশিদ কে এভাবে হাসতে দেখে কিছুই বুঝতে পারে না। মন মতো হেসে রাশিদ ভাইয়ের পাশে বসে,

~ ঝিনুক ফোন দিয়েছিল?

মাথা নাড়ে রনি। ঘটানা সব খুলে বলতেই রাশিদ আবার হেসে উঠে। হেসেই বলে,

~ ভালোবাসো না তুমি? ব‌উ তো! আগে ভালো না বাসলেই এখন থেকে বাসবে। সমস্যা‌ ক‌ই?

~ তুই এসবের পেছনে? কি বলেছিস ঝিনুক কে?

~ বেশী কিছু করি নি ভাইয়া, বলেছিল তোমার মতো লেকচারার কে বিয়ে করবে না, বলেছি তুমি ভালোবাসো ওরে অনেক দিন থেকে। কাজ হয়ে গেছে, একরাতেই আন্ধা মন বান্ধা পড়েছে!

আবার হাসে রাশিদ। রনির মাথায় কিছু ঢুকেনা। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে। রাশিদ দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে আয়েশ করে বিছানায় বসে। ফিসফিস করে বলে উঠে,

~ কি করতাম বলো? আম্মা আমার জন্য ঝিনুক কে ঠিক করেছিল, উপায় ছিল না। তুমি তো আমার বড় ভাই, তোমার দায়িত্ব ছিল এটা। তোমাকে বলেছি ঝিনুক ভালোবাসে, ঝিনুক কে বলেছি তুমি ভালোবাসো। আমার কাজ খতম! এখন তোমরা জামাই ব‌উ, আমি হবু ব‌উয়ের দেবর, আমার শুচিস্মিতা জা!

আহমেদ বাড়ি আজ নিরব, শান্ত! রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ ভেসে আসছে। আজ সকালের চিত্র টা ভিন্ন। তিন ব‌উ মিলে রান্না করছে। দেখে মনে হচ্ছে তিন জা এর মধ্যে কত মিল, অথচ মন পড়তে পারলেই মনের কথাগুলো হয়তো বেরিয়ে আসতো। কালকে এসে নিয়নের কাছে ঝামেলা’র কথা শুনে ফারাহ আর সাহস পায় না শাশুড়ির কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার। অপেক্ষা করতে থাকে সময়ের। আজ সকাল টা যেন সেই সময়, তবে সে আগে আগে কিছু বলবে না, কেউ তো কিছু জিজ্ঞেস করবেই। তখনি তার গলা দেখাবে সে! তার বোন কে অপমান করা বুঝিয়ে দিবে!

~ বড় ভাইয়া কি বেরিয়ে গেছেন, বড়ভাবী?

~ না গো, আজ তো শুক্রবার। নামাজের পর লাঞ্চ সেরে তারপর যাবে।

ফারাহ আর কিছু বলে না। রিনু শাশুড়ির জন্য চা নিয়ে শাশুড়ির ঘরে যায়। পারভিন হাসে। এই মেয়ের কুটনৈতিক ভাবনা কিছুতেই যাবে না। ফারাহ কে ফিসফিস করে বলে,

~ যাও তো উঁকি দিয়ে আসো আম্মা’র ঘরে। কুটনি কি কি বলে শুনে আসো।

ফারাহ বিচলিত হয়, যাবে কি যাবে না দোটানায় পড়ে যায়। কথা না শুনলে রাগ করবে ভেবে যেতে নিবে, পারভিন আটকায়।

~ যেতে হবে না রে পাগলি, আমি তো মজা করলাম‌। অন্যের ঘরে উঁকি দেওয়া অন্যায়।

ফারাহ’র বেশ ভালো লাগে‌। যৌথ পরিবার গুলো এমন‌ই। কারো মনোভাব ভালো, তো কারো ভালো না। মানুষ বলতেই ভালো খারাপ। হুট করেই পারভিন বললো,

~ প্রথম যে ভুল টা করেছো, বোন কে এই পরিবারে এনে আর ভুল করো না ফারাহ। বোন ভালো তবে জা নয়! কখনো যে ঝগড়া হবে না গ্যারান্টি আছে? আর আনতারা এই পরিবারে ভালো থাকবে না, বিশেষ করে নিবিড়ের কাছে। ছেলে ভালো তবে ভালো স্বামী হতে পারবে না নিবিড়।

ফারাহ মাথা নাড়ে, আবার অপরাধ বোধ ঘিরে ধরে তাকে। বোন যখন জা হয়, সম্পর্কে খুব একটা সখ্যতা থাকে না, হুট করেই ঝগড়া হলে, মিলবন্ধন টাও জটিল হবে! রাশিদের ভালোবাসা সম্পর্কে জানার পর তো আর কোনো প্রশ্ন‌ই আসে না। আনতারা নিজেই নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরাবে‌। সে দূর থেকেই সাপোর্ট করে যাবে‌। খাওয়ার সময় হয়, সবাই এসে উপস্থিত হয় ডাইনিংয়ে। মিসেস নাজমা’র মুখ থমথমে। পারভিনের বুঝতে অসুবিধা হয়না রিনু কিছু না‌ কিছু বলেছেই। আজ আর রিনু খেতে বসতে পারে না, পারভিনের মতোই খাবার পরিবেশন করে। নাহিদের মুখে সুক্ষ্ম হাসি, ব‌উয়ের দিকে তাকায়। আগের মতোই যত্ন করে সবাইকে পরিবেশন করছে, যেন কালকে কিছু ই হয়নি। খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষ তখন‌ই মিসেস নাজমা গমগম কন্ঠে বললো,

~ সেজ ব‌উ, তোমার বাপ কিছু বলছে?

~ কোন বিষয় আম্মা? যৌতুক?

আগুন চোখে তাকায় মিসেস নাজমা। মেয়ের সাহস দেখ! নাহিদ ফারাহ’র দিকে তাকায়। মেয়েটা কি বলছে? মধ্য থেকে রিনু মুখ বেঁকিয়ে বলে,

~ যৌতুক ক‌ও কেন? মেয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবো না?

~ আপনার বাবা কি কি দিয়েছিল মেজ ভাবী? বড়ভাবী তুমি কিছু নিয়ে এসেছিলে?

~ তোমার বোনের সাথে আমারে তুলনা করো তুমি?

ফারাহ মুচকি হেসে বললো,

~ তুলনা ক‌ই করলাম মেজ ভাবী? আমার বোনের সাথে তুলনা করলে আপনি ওর সমান হতে পারবেন? আমার বোন কি ফেলনা নাকি? আপনাদের কখনো বলেছিলাম আমার বোন কে বিয়ে দিতে পারছে না, বিয়ে আসে না? আমাকে না জানিয়ে এরকম একটা কাজ করলেন কি করে আম্মা? আমার বোন কে কেন অপমান করলেন? আমার বোন নিম, কালো তাতে তো আমাদের সমস্যা নেই‌। তাহলে?

নাহিদ চুপচাপ বসেই র‌ইলো। কেউ যেহেতু তাকে কিছু শুধায় নি সে চুপচাপ থাকায় ভালো‌। পারভিন বসে বসে মজা‌ নিচ্ছে, ফারাহ’র কথাগুলো মনে ধরেছে তার। নিয়ন নিজেও চুপচাপ‌। মায়ের উপরেও কথা বলতে পারবে না, ব‌উয়ের উপরেও কথা বলতে পারবে না। নিবিড় বললো,

~ যা দিবে সব তোমার বোনের‌ই থাকবে সেজভাবী। অপমান করেছে ক‌ই? সরাসরি কথা বলেছে।

~ আমার জানা মতে পড়ালেখা করছো এখনো! চাকরি আছে? তোমার কোনো যোগ্যতা আছে আমার বোন কে বিয়ে করার? কি খাওয়াবে? বাবার টাকাই ব‌উ কে খাওয়াবে? আচ্ছা এটা বাদ দিলাম, সব কিছু নিয়েই যেহেতু বিয়ে করবে এক কাজ করো। ঘর জামাই যাও, তালুকদারদের যা আছে তোমার মতো কয়েকটা নিবিড় বসে বসে খেতে পারবে। আরাম আয়েশে দিন চলে যাবে।

মিসেস নাজমা যেন রাগে কথায় বলতে পারছেন না। সেজ ব‌উয়ের মুখ যদি না ভাঙে তার মাথা ঠান্ডা হবে না। কেমন গুমোরের কথা দেখছো? ফারাহ আবার নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো,

~ বড়ভাইয়া আপনি জানেন না বিদেয় আপনাকে কিছু বললাম না। তবে আম্মা কে বুঝান এই ব্যাপারে যেন কোনো কথা নাহয়, বিয়ের কথা এখানেই বন্ধ। আমার বোন পড়ালেখা করবে। আমার বাবা’র বাড়ি থেকে লোক আসলে এসব যেন না উঠে। আমি শান্তিপূর্ণ সংসার চাই। যৌথ পরিবারে আমিও বড় হয়েছি, দু একটা ঝামেলা হয়‌ই। আবার ঠিক হয়, আমি আশা করবো আম্মা বুঝবে। আর আপনি মেজ ভাবী। নিজের কুটনামি কমান, হাতে নাতে ধরা পড়লে আপনাকে কিন্তু আমি ছাড়বো না। আমি বড়ভাবী নয়, মুখ বুঝে সব সহ্য করবো। সংসার সবার, দায় ও সবার, ভালোবাসাও সবার।

চুপ মেরে যায় ফারাহ। নাহিদ হেসে ফারাহ’র মাথা হাত বুলিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। একে একে সব পুরুষ ই নিজের ঘরে চলে যায়। নিবিড়ের রাগ হলেও সে শান্ত, একটা মেয়ের জন্য আধা জল খেয়ে পড়ার কোনো মানেই হয় না। হাজার মেয়ে আছে। তার জীবনে যে আসার সে আসবেই। ফারাহ খেয়ে কিছু কাজ গুছিয়ে নিজের রুমে যেতে ধরতেই এতক্ষণের চুপ করে থাকা মিসেস নাজমা মুখ খুলে,

~ যাও যাও দেখমু তোমার ওই কালি ব‌ইন পড়ালেখা ক‌ইরা কি হয়। মাইয়া মানুষের ঠিকানাই শশুরবাড়ি। হুহ!

~ তোমার না কাল বিকেলে আসার কথা ছিলো আঁখি।

কেয়ার কথায় পৃষ্ঠে বলার কিছু পায় না আঁখি। মুখে হাসি নিয়ে বসে থাকে। আলাপ জমাতে না পেরে কেয়া’ও চুপ মেরে যায়। দুজন‌ই আনতারা’র ঘরে বসে আছে‌। পড়বে! আনতারা আসতেই কেয়া মিষ্টি হেসে বসার জায়গা করে দেয়। আগেই পড়া শুরু করে না, আনতারা বলে উঠে,

~ আয়েশা আপু নাকি কাল একেবারে চলে এসেছে আঁখি?

~ শাশুড়ি খুব জ্বালায় গো আপু। বাড়ি থেকে টাকা নিতে বলে আপাকে। বাবার তো তেমন রোজগার নেই, ধার দেনা করে দু তিন বার দিয়েছে আবার টাকা চেয়েছে। আপা বলেনি বলে মেরেছে অনেক। আর কত সহ্য করবে বলো! কালো শরীর টাও কেমন মারের দাগে লাল হয়ে আছে‌।

মলিন মুখে কথাগুলো বলেই আঁখি মাথা নিচু করে নেয়। আনতারা চাপা শ্বাস ফেলে। এখন সমাজ এমন‌ই! কিন্তু কেয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,

~ কি বলো আঁখি, তোমার আপার না প্রেম করে বিয়ে হ‌ইছে।

~ এর জন্য‌ই তো শাশুড়ি জ্বালায় আপু। দুলাভাই আগে মায়ের কথা শুনতো না, ইদানিং নাকি তার আপা কে ভালো লাগে না। নতুন বিয়ে করবে। আপার যে কি হবে, আসার পর থেকে মা তো গালমন্দ করছেই।

ক’দিন বা বিয়ের সময়। বছর না ঘুরতেই এমন পরিবর্তন! আনতারা’র ভেতর টা যেন নাড়িয়ে দিলো। মেয়েরা এমনিই সকল জায়গায় হেনস্থার শিকার হয়, মেয়ে কালো হলে তো কথায় নেই। এমন ঘটনা যে অহরহ ঘটে। বিয়ের পর মেয়েটা পড়ালেখাও ছেড়ে দিয়েছিল। আনতারা বুঝানোর স্বরে বললো,

~ এসব দেখে শিখো আঁখি। দেখছো তো তোমার আপার কি হলো‌। তোমার বাবা’র কষ্ট তোমাকেই বুঝতে হবে। আরো দুটো ভাই-বোন রয়েছে। তোমাকে পড়তে হবে। অন্য পথে পা দিও না বনু। পাড়ার মোড়ে একটা ছেলের সাথে দেখেছিলাম তোমায়, সরাসরিই কথাগুলো বলছি। ওসব ছেলেরা মোড়ে বসেই থাকে মেয়েদের পেছনে লাগতে‌। ভালো ছেলেরা কখনোই নেশাখোরদের মতো হয় না, তারা পরিবারের চিন্তা করে। তোমার চোখে এখন রঙিন চশমা, যেদিকে তাকাবে সেদিক ই রঙিন লাগবে। এখন যদি আবেগের বশে এসবে জড়িয়ে পড়ো পড়ালেখায় মন বসবে না। তখন তোমার ধ্যান ই থাকবে সেদিকে। উঠতে বসতে ছেলের কথা ভাববে, হাজার চেষ্টা করেও তখন পিছুতে পারবে না। তাই একেবারের ঢোকার আগেই থেমে যাও। এইসব ছেলেদের কাজ কি জানো? তোমাকে প্রেম নিবেদন করবে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে, রাজি না হওয়া পর্যন্ত ঘুরতেই থাকবে। হঠাৎ করেই তোমার মনে হবে ছেলেটা তোমাকে কত্ত ভালোবাসে, তোমার ভালো লাগতে শুরু করবে, একসময় তুমিও রাজী হবে। কথা বলবে, দেখা করবে, পড়ালেখায় মন বসবে না। তুমি যখন একেবারে ছেলের প্রেমে ডুবে যাবে তখন হঠাৎ করেই দেখবে ছেলে পাল্টে যাচ্ছে, তোমাকে অবহেলা করছে, তুমি কান্নাকাটি করছো, তখন তোমার কষ্ট টা পৃথিবীর সকল কষ্টের থেকে বড় মনে হবে, একসময় দেখা যাবে তুমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে। জীবন কি এত সহজ?

থামে আনতারা। সামনে বসা দুটো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মনোযোগ সহকারে শুনছে। আনতারা আবার বললো,

~ জীবন কিন্তু সহজ নয়। তুমি এই বয়স টা, এই সময় টা যদি পেরিয়ে যেতে পারো পড়ালেখার মধ্য দিয়ে তখন তোমার জীবন এক নিমিষেই পাল্টে যাবে। তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে, তখন দেখবে পাড়ার মোড়ে বসে থাকা ছেলেরাই‌ নেশা করে পড়ে আছে এদিক ওদিক, বাড়িতে ঝামেলা করছে, মা কে মারছে, বাবাকে গাল মন্দ করছে, ঘরের ব‌উ থাকলে শশুড়ের কাছে যৌতুকের দাবি করছে। আর তুমি নিজের সুন্দর সুখী জীবন লিড করছো। তখন তোমার পেছনে এর থেকে হাজার গুণ ভালো ছেলে ঘুরবে, বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে থাকবে, তাদের থেকে যাকে ভালো লাগবে, সৎ, দায়িত্ববান দেখে একজন কে বিয়ে করবে। সুখের‌ সংসার সাজাবে।

জোরে শ্বাস নেয় আনতারা। একসাথে কতগুলো কথা বলে ফেললো। আজকের এই কথাগুলো ই কোনো একদিন তার ছোটচাচি তাকে বলেছে। কালো বলে যে প্রেমের প্রস্তাব পায় নি এমন না! মজা নিতে, টাইম পাস করতে অনেক ছেলেই আসতো, তখন ছোটচাচির কথাগুলো স্মরণে রেখেই এড়িয়ে চলতো সে।

~ আমার কথাগুলো শুনে এখন তোমার মনে হবে পড়ালেখা করবো, সেসবে কান দিবো না, কিন্তু হুট করেই আবার তোমার মনে রঙিনের ছোঁয়া লেগে যাবে। তখন কি করবে জানো? আমার কথাগুলো স্মরণ করবে, তোমার বাবা-মা’র কথা ভাববে, তোমার বোনের পরিণতির কথা ভাববে; দেখবে তথাকথিত রঙিন জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে না। বরং নিজের তৈরি করা রঙিন জীবন টাই বেছে নিবে। তোমার বিয়ের কথা হচ্ছিল জানো? আমি চাচা কে বলে এই যাত্রায় তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম। তবে এমন কিছু যদি আমি আবার দেখি বা শুনি; আমি নিজে দাঁড়িয়ে তোমার বিয়ে দিবো। একবার চাচার মানসম্মানে কাঁদা লেগেছে, সমাজের চোখে ছোট হয়েছে; আরেকবার এমন করো না বনু‌। তখন দেখবে তোমার বাবা’র মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। মস্ত বড় মানুষ হয়ে তোমার বাবা-মা কে ভালো রাখবে। কষ্ট করে মানুষ করছে, প্রতিদান দিও সুখী জীবন ফিরিয়ে দিয়ে। সর্বোপরি মাথায় রেখো একজন ছেলে হাজার দোষ করলেও তার গায়ে ক্ষনিকের আঁচ পড়ে, সময় পেরোতেই লোকে ভুলে যায় তবে একজন মেয়ে একটা ভুল করলে সেই ভুলের মাশুল তাকে সারা জীবন বয়ে নিয়ে যেতে হয়। যেমন টা তোমার বোন করবে এখন। ঘা শুকিয়ে গেলেও আঁচ থেকে যায়। এখনি সাবধান হয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হ‌ও।‌

আঁখি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রয়। ছেলের সাথে দেখেছে বিষয়টায় লজ্জা পাচ্ছে। আনতারা কথা যে সত্যি সে বুঝতে পেরেছে‌‌। একটুর জন্য সে ভুল পথেই যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস উপর ওয়ালা এই সুন্দর মনের মেয়েটির সাথে আজ আলাপ করালো। আঁখি নরম সুরে বললো,

~ তোমার কথাগুলো ই আমাকে লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে আপু। ভুল থেকে ফিরে এসে এখন মনে হচ্ছে আমি পারবো নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে‌।

আনতারা হাসে। মনে মনে চ্যালেঞ্জ নেয় দূরে গেলেও মেয়েটির মনে বারবার কথাগুলো জাগিয়ে দিবে‌। তার কথায় যদি একটা মেয়ে জীবনে সফল হয় জয় টা তো তার‌ই। আনতারা এবার নিজের বোনের দিকে তাকায়। শান্ত স্বরে বলে উঠে,

~ মুচকি মুচকি হাসি কিসের লক্ষণ আমাকে বলে দিতে হবে না। তুমি যেভাবে ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকে পড়েছো এখনি সাবধান হ‌ও‌। এখন শুধু বললাম এর পরিবর্তে বড়দের জানাতে বাধ্য হবো। সামনের মানুষ টার মনের খবর‌ই ঠিক ভাবে বোঝা যায় না, তুমি কিভাবে অনলাইনের অপরিচিত মানুষের মনের খবর টের পাবে? ওসব সব‌ই অন্ধকার! আলো তে ফিরে আসো!

কেয়া শক্ত করে বোন কে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণ এসব ই ভাবছিলো। তার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে সে সবথেকে সুখী কারণ আনতারা’র মতো একজন বড় বোন রয়েছে‌। হেসে বললো,

~ আমার ভাগ্য খুব ভালো আপায়, তোমার মতো একজন বড় বোন আছে!

আনতারা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। পরিবারের মানুষ গুলোর হাসিখুশি মুখ দেখলে শান্তি লাগে। ভাগ্যের কথা শুনে তাচ্ছিল্য আসে ভেতর থেকে। আনমনেই বলে উঠে,

~ পৃথিবীতে সবার ভাগ্য ভালো হয় না
নাহলে কোনো বাবা আমার মতো অন্ধকার মেয়ে জন্ম দেয়!

চলবে…?

(ফারাহ’র শশুড় বাড়ির ঘটনাটা সিনেমাটিক লাগতে পারে তবে আমি বাস্তবতা থেকেই নিয়েছি টপিকটা। গ্রামের ব‌উ ঝি রা টপাটপ এভাবেই কথা বলে, সম্মান দেওয়ার সময় ও যেমন কার্পণ্য করে না তেমনি কথা শুনাতেও তোয়াক্কা করে না।

রিয়েক্ট করার অনুরোধ র‌ইলো। অনেক অনেক শুকরিয়া)

Pic credit by মুগ্ধ তা আপু🌺🌺🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here