শুধু আমারই পর্ব ১১

শুধু_আমারই
পর্ব_১১

ভোরের আলোটা আজ অনেক মিষ্টি লাগছে। পাখির কিচমিচ শব্দও যেন মধুর লাগছে। এতো সকালে সায়ানের সাধারনত ঘুম ভাঙ্গে না। মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে আসছে। নড়তে গিয়ে টের পায় পিয়া ওর বুকের কাছে শুয়ে আছে। ওর চুল থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে।
সায়ান হেসে ফেলে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্য যেন এটা। পিয়াকে জড়িয়ে ধরে কপালে গভীর চুমু খায়। কোনো দ্বিধা নেই, কোনো কিন্তু নেই, কেনো আড়ষ্টতা নেই। আজ মন, হৃদয়, অন্তর সব জানান দিচ্ছে পিয়াকে সে ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে। নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।
গতরাতে পিয়ার চুপ হয়ে শুয়ে থাকা, ওর নীরবতা সায়ানকে বুঝিয়ে দিয়েছে পিয়া বিহীন এ জীবন কেবলই শূন্যতায় ভরা। এই মেয়েটাকে ছাড়া সায়ান অচল প্রায়।

পিয়াকে পাশে রেখে আস্তে করে উঠে এসে সায়ান বারান্দায় বসে। আজ মন অনেক বেশি প্রসন্ন। কোনো দ্বিধা নেই কোনো দীর্ঘশ্বাস নেই! কেবলই ভালোলাগায় ভরপুর।

সানজানা আজ চিটাগাং গিয়েছে। ও ফিরলে ওকে সব জানাতে হবে। জীবনের এ সত্য সানজানার জানার অধিকার আছে।
সায়ানের প্রথম প্রেম সানজানা তা অস্বীকার করার নেই। সানজানা যখন সায়ানের হাতে হাত রেখে হঠাৎ বলে উঠেছিলো ভালোবাসি। তখন সায়ানের বুকে ঠিকই দক্ষিণা হাওয়া বইছিল। সে মুহুর্তের ভালোলাগা, জীবনে প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি সবই সত্যি ছিল।
কিন্তু পিয়ার উপস্থিতি সায়ানকে বুঝিয়ে দিয়েছে ভালোবাসা মানে শুধু ভালোলাগা বা মিষ্টি অনুভূতি নয়, এর মাঝে আছে অস্থিরতা, ব্যাকুলতা, হারানোর ভয়, নিজেকে হারিয়েও কিছু পেয়ে যাওয়ার আনন্দ।
সারাক্ষণ পাশে পাওয়ার পরও তাকে প্রচণ্ড পাওয়ার আকুলতা সেটা ব্যাখা দিয়ে বোঝানো কঠিন।

সানজানাকে কখনো মনে হয়নি প্রচন্ড ভালোবেসে বুকে চেঁপে ধরতে, দূরে থাকার পরও কখনো ওকে হারানোর ভয় কাজ করে নি।
অন্যদিকে পিয়া পাশে থাকার পরও বার বার বুকের মাঝে চেঁপে ধরতে ইচ্ছে করেছে যেন বুকের ফাঁকা অংশটা পূর্ণ করতে তাকে চাই-ই-চাই।

সানজানাকে সায়ান কতটুকু বুঝাতে পারবে জানে না। কিন্তু সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবে সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভূতি কি তা বোঝানোর!
সানজানা হয়তো কষ্ট পাবে। কিন্তু ক্ষণিকের কষ্ট নিশ্চয়ই সানজানা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

ভালোবাসার মানুষটাকেও জানান দিতে হবে -ভালোবাসি তোমায় পিয়া সোনা!
মনের অজান্তেই শ্বাস বেড়িয়ে আসে।
এ কাজটি মনে হয় এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ। এতো কাহিনী করে এখন কোন মুখে সায়ান ভালোবাসার কথা বলবে! পিয়া কি বুঝবে! ও কি বিশ্বাস করবে!
পিয়া যে যুক্তিতর্ক ধরে কথা বলে শেষে প্রশ্ন করে বসবে কাল পর্যন্ত তো সানজানা ছিল, আজ হঠাৎ আমি কেন?
পিয়াকে বুঝানোর মতো মেধা কি সায়ানের আছে?

কিন্তু যেভাবেই হোক পিয়াকে বিশ্বাস করাতেই হবে সায়ান তাকে কতটা ভালোবাসে!
না না থাক, ভালোবাসার কথা এতো তড়িঘড়ি বলার দরকার নাই, একটু সময় যাক। ততোদিনে পিয়াকে সে অনুভব করাবে “এই সায়ান শুধু পিয়াকেই ভালোবাসে”।

কিন্তু তারপরও শংকা রয়েই যায়। পিয়া যদি বলে তোমার মতো স্বার্থপর বোকার হদ্দকে ভালোবাসি না !
উফঃ না! এটা মানা সম্ভব না। বললেই হলো ভালোবাসি না!
পিয়ার মতো এতো ভালো মানুষ না সায়ান যে হাসি মুখে অন্যের হাতে পিয়াকে তুলে দিবে। পিয়া অন্য কারোও হবে তা হতেই পারে না। এটা স্বার্থপরতা হলে তাই হবে। যা সম্ভব না তার মিথ্যা উদারতা দেখিয়ে লাভ নাই।

সায়ানের ঠোঁটে হঠাৎ হাসি ফুটে উঠে। আগে কখনোও এ অনুভূতি হয়নি। আজ হচ্ছে!
জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া! পিয়া তার বউ, বিয়ে করা বউ।
সে বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে পিয়ার দিকে তাকায়। পিয়া বিছানায় জুবুথুবু হয়ে শুয়ে আছে। সায়ানের বুকে ভালোবাসার মিষ্টি ব্যাথা। বিড়বিড় করে বলে অনেক ভালিবাসি তোমায় আমার বউ ! তুমি শুধু আমারই!
তোমার ভালোবাসা আমি জিতে নিবোই!!

*****-

আমার ঘুম ভাঙ্গে ঝরঝরা শরীর নিয়ে। একটু ক্লান্তি লাগছে কিন্তু মাথা ব্যাথা বা জ্বর জ্বর ভাব নেই। উঠে দেখি সায়ান আমার সামনে বসে আছে, আমাকেই দেখছে।
—এখন কেমন শরীর তোমার পিয়া?
—- ভালো।
— ঘুম ভালো হয়েছে??
— হু!
— তোমার কিছু লাগবে? তুমি…
—-সায়ান গতকাল যা হয়েছে তা মনে করিয়ে দিয়ো না তো! আমি মনে রাখতে চাইছি না।
— আমি কি করলাম??
— তুমি আমাকে দেখেই মুখ অন্ধকার করে ফেললে। বার বার নিজেকে দোষ দেয়া বন্ধ কর। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমার নিজেরও দোষ ছিল। আমি তোমার সাথে জিদ করে ওতোটা গভীরে না গেলেও পারতাম। সো প্লিজ কে দোষী, কেন এমন হলো এসব চিন্তা বাদ দাও। এক কথায় পুরো প্রসঙ্গটাই বাদ দাও। প্লিজ!
তুমি নিশ্চয়ই বুঝছো ব্যাপারটা বার বার আমার মনে আসা মানে কতটা কষ্টকর!

—- ওকে ওকে। সরি সরি! সব বাদ!!
এবার বলো শরীরের কি অবস্থা? আমি কি আজ বাসায় থাকবো??
— একদম না, তুমি অবশ্যই অফিস যাবে। আমিও আজ বের হবো। আমার আজ ইন্টারভিউ আছে।

— তুমি পুরোপুরি সুস্হ তো! আমি নিয়ে যাবো তোমাকে??
— কোনো দরকার নেই। আমি একাই পারবো।

— পিয়া, আসলেই পারবে তুমি! না মানে, তুমি কাল যে কাঁপুনি দিলে! আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। এভাবে বুঝি কাঁপুনি জ্বর হয় তোমার??
— হু। তুমি কি করলে তখন? হাত পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু কর নি তো? যে ছিঁচকাঁদুনে তুমি!!
— উহু! তোমার আদেশ মান্য করেছি।
— আমি আবার কি আদেশ করলাম??
— তুমি বললে আমি যেন তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। আমি তাই করলাম।
— আমি তোমাকে এ কথা বলেছি??
— নয় তো কি? নইলে আমি কেন তোমাকে জড়িয়ে ধরবো!

আমি একেবারে থ হয়ে গেছি। সায়ানের কথা কি সত্যি? জ্বরের ঘোরে কিছু মনে করতেও পারছি না। আর ভোররাতে তো আমি জেনে শুনেই ওকে জড়িয়ে শুয়ে ছিলাম।

পিয়ার বিব্রত মুখ দেখে সায়ান মিটমিট করে হাসে।

*****

গত তিনদিন ধরে সায়ানের মাঝে আমি একটা পার্থক্য টের পাচ্ছি। ও কেমন জানি আগের মতো আলোথালো লাজুক ছেলেটি আর নেই, কেমন সরাসরি চোখে তাকায়। যদি পাশে বসে বা হাত ধরে তবে তাকে ধরা বলা যায় না সেটাকে বলে স্পর্শ করা।
যা ব্যাখ্যায় বুঝানো যাবে না শুধু অনুভব করা যায়। সায়ান আমার কাছে এলে আমাকে স্পর্শ করলে ওর চোখে আমি কেমন যেন মাদকতা দেখতে পাই। হুট করে কেমন জানি ওর বন্ধুসুলভ আচরণটা সরে গিয়ে অন্য একটা ভাব চলে এসেছে। আমাকে এমন এমন সব কথা বলে আমি লজ্জায় লাল হতে থাকি, আড়ষ্টতা আমায় ঘিরে ধরে।
আমার কেন জানি মনে হয় সায়ান আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে??

তিনশো ফিটের ঘটনার পর সায়ানের সাথে সানজানা বিষয়ক কোনো কথা আমি বলি নি। সায়ানও বলে নি। তার কারণ ঐদিন সায়ান অফিস গেলে আমি চূড়ির বক্সে চাঁপা একটা চিঠি পাই। তাতে লিখা ছিল—

অধিকার কিংবা অনুরোধ
তুমি রাখবে কি??.
….কোনো প্রশ্ন ছাড়া!

তোমার ক’টাদিন ধার চাই!
কিছু না শুধু যেমন বন্ধু ছিলাম সেরকম হয়েই না হয় থেকো। তবু পাশে থেকো!!

আমাকে বিশ্বাস করো, পিয়া?
যদি করো তবে সে বিশ্বাসের উপর ভরসা রেখো।
তোমার ড্রাকুলা!

সায়ানের চিঠির আগামাথা নাই। কাব্যিকতা দিয়ে শুরু করেছিলো মাঝে খেই হারিয়ে বিশ্বাসে ভরসা রাখতে বলছে। ছেলেটা যেমন গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না তেমন লিখতেও পারেনা।
পুরো জীবন ওর জন্য নিয়ে বসে থাকা এ আমি আর সে কিনা ক’টাদিন চায় আমার কাছে। থাক, সব জিদ দূরে রেখে না হয় ক’টা দিন দিলাম আমার বুদ্ধু ড্রাকুলাকে।। ক’টা দিনই তো!

********

আজ আমার মামা শশুরের বাসায় গেট টুগেদার পার্টি। সন্ধ্যায় পর যাবো। মা বলেছেন সুন্দর করে সাজতে। আত্মীয়রা নাকি সবাই ওখানে থাকবে। সায়ানের মামাতো ভাই রোহান -সায়ানের সমবয়সী, আমাদের বিয়ের এক মাস আগে ওর বিয়ে হয়েছে, এফেয়ার ম্যারেজ। বউটা নাকি বেশ ঠোঁট কাটা। অল্প দিনেই বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। মা পইপই করে বলে দিয়েছেন রোহানের বউ মাহিরা যদি কোনো কথা শুনায় আমি যেন সাথে সাথে উত্তর দিয়ে দেই। ভাল মানুষের মতো চুপ করে না থাকি।

সায়ান অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখে বলে এখনও রেডি হও নি?
— হয়েছিই তো! শাড়ি পরা বাকি।
— পিংক শাড়ি পরছো ?
— না ব্লু টা। পিংকটাই পরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওটার ব্লাউজের পিঠটা একটু বড়। আমার পিঠের আচড়ের দাগ দেখা যাবে।

সায়ানের মুখ সাথে সাথে অন্ধকার হয়ে যায়।
আমি পরিবেশ হাল্কা করতে হেসে বলি অবশ্য তুমি চাইলে আমি পিংকটাই পরতে পারি। খামচির দাগ দেখে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো তোমার দ্বারা ঘটিত।

— আমি?? মানে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স?? আমাকে জেলের ভাত খাওয়াবে???

আমি মুখ টিপে হেসে হুম বলি!

— এক মিনিট! তুমি কি মিন করছো?
না, না, না! তোমার মিচকামী আবার শুরু! যে কাজ আমি করলামই না তুমি আমাকে সে কাজের অপরাধী বানাচ্ছো, তুমি তো মারাত্মক!! বাপরে! তুমি ব্লু শাড়িই পরো।
আমি এবার জোরে হেসে উঠি। সায়ানও হেসে শাওয়ার নিতে ঢুকে।

ততোক্ষণে আমি শাড়ি বদলে আমার সাজ শেষ করি। ভারি ম্যাকআপ আমি কখনই করি না। হালকা সেজে চুল আঁচড়ে নেই।

সায়ান বের হয় মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পরে। আমার পিছনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগে। আমি এক পলকে ওকে দেখি। হায়রে মায়া ভরা চেহারা! আমি বার বারই ঘায়েল হই তাতে! অন্যমনস্ক হয়ে কানে দুল পরতে পরতে ওকে দেখতে থাকি।

সায়ান হঠাৎ বলে কি দেখছো??

আমি চমকে উঠি। মুখ বাঁকিয়ে বলি কি আর দেখবো! গজদাঁতের ড্রাকুলাকে দেখছি।

— এই গজদাঁতের ড্রাকুলাকে যে তুমি প্রায়ই মুগ্ধ হয়ে দেখো তা বুঝি আমি টের পাইনা! তুমি মেয়েমানুষ হয়ে এতো নিলজ্জের মতো চেয়ে থাকো কেন, বলো তো!

আমি দমে যাই। মিনমিন গলায় বলি আমার বয়েই গেছে ড্রাকুলাকে দেখতে!

আমার তিননম্বর চোখ দিয়ে আমি বুঝতে পারি সায়ানও আমাকে দেখছে মুগ্ধতা নিয়ে। আমি আর কি সাজবো ওর এমন চাহনী দেখে আমার হাত কাঁপতে লাগে।
খুব স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গিতে বলি এখন তুমি কি দেখছো? কাজ শেষ হলে যাও, নিচে যাও।

— তোমাকে দেখছি। ড্রাকুলা তো ডাইনীকেই দেখবে। জুটিটাই এমন!
—হুম নীল শাড়ির পরা ডাইনী!!
—না! নীল শাড়ি পরা পরি! খুব সুন্দর লাগছে।
— বাঃ বাহ! মিস্টার সায়ান সুনাম করতেও জানে নাকি!!

— সত্যিই তোমাকে অন্যান্য দিনের চেয়ে ভিন্ন লাগছে।
— ভিন্ন মানে?? মা তো সাজতে বলেছে। বেশী সেজে ফেললাম কি?? আমি ব্যস্ত হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখি।
— না না, মোটেও বেশি সাজো নি। বরং মনে হচ্ছে তোমাকে আড়াল করে রাখতে হবে সব ছেলেদের দৃষ্টি থেকে।

— এবার এটা বেশি বলে ফেললে! একেবারে সিনেমাটিক ডায়লগ!
— কারে কি বলি! পিয়া, রোমান্টিকতা কি জিনিস তা তো বুঝলেই না জীবনে। দাও অর্নামেন্টগুলো পরতে তোমাকে হেল্প করি।
— কোনো দরকার নেই। আজাইরা ঢং! তুমি যাও তো!

কে শুনে! সায়ান চু্ড়িগুলো হাতে নিয়ে একটা একটা করে আমাকে পরিয়ে দেয়। সায়ান যেভাবে আমার হাত ধরে আছে সেটাকে বলে স্পর্শ করা। ওর প্রতিটা আঙ্গুলের স্পর্শ আমি টের পাচ্ছি। ওর শ্বাস ঘন হয়ে আসছে, চোখে মাদকতা। সে মাদকতা আমার মাঝেও ছড়িয়ে যাচ্ছে। সায়ান পিছনে দাড়িয়ে মালা পরিয়ে দিয়ে আয়নায় তাকিয়ে বলে তুমি গালে এতো লাল রং মেখেছো কেন?
আমি চমকে আয়নায় তাকাই। কই না তো?

— তবে তোমার গাল এতো লাল হয়ে আছে কেন?
আমি মুখ নত করে রাখি। আমার গাল লজ্জায় লাল আভা ছড়াচ্ছে।

— তুমি তো দেখি লজ্জা পাচ্ছো পিয়া?
— হু! কিছুটা! হঠাৎ মনে হলো কি বললাম আমি! ঠোঁট বাঁকিয়ে বলি কিসের আবার লজ্জা! বরং তুমি ইদানীং কেমন হয়ে গেছো!
— কেমন??
— তোমার ঢং বেড়েছে।
সায়ান আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে আমি প্রেমিক পুরুষ হয়ে উঠেছি তাই না??
আমি আয়নায় ওর দিকে তাকালে দেখি সে মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ছে।

আমি সুখো অনুভূতিতে ভাসি। না চাইলেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে। সব কিছুই স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে !!

রোহানদের বাসাটা অনেক বড়। ড্রইং রুমটা যেন বড় হলঘর। সায়ানের সকল আত্মীয়ই বিত্তশালী।অনেকেই পরিচিত আবার অনেকেই নতুন পরিচিত হচ্ছে। চারিদিকে ঘষামাজা করা নারীরা ঝলমল করছে। মা মুরব্বিদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। সায়ান আমার আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে।
রোহান ভাই এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করলো। বেশ হাসিখুশি উচ্ছল মানুষ। কথায় কথায় হাসেন। আমাকে বললেন ভাবী আপনার শাড়ির কালার আর আমার পাঞ্জাবির কালার তো পুরোই মেচিং। কিরে সায়ান আমরা তো মেচিং মেচিং হয়ে গেলাম বলে হাসতে শুরু করলেন যেন কত না হাসির কথা।
সায়ান হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে অনেকটা টেনে অন্যদিকে নিয়ে গেলো ।
কানের কাছে মুখ এনে বলল তোমার মেরুন রঙের কোনো শাড়ি ছিলো না?
— সায়ান,কেমন ছেলেমানুষী কথা এটা??
—- হোক ছেলেমানুষী! বিড়বিড় করে বলল শালা তো বিয়ের আগে ভদ্রলোকই ছিল! এখন তো পুরোই গেছে! সুন্দরী মেয়ে দেখে ছোঁক ছোঁক করা শুরু করেছে ।
—সায়ান, রোহান ভাই তোমার মামাতো ভাই। তুমি কি যা- তা উনার নামে বলছো?
— তুমি বুঝবে না! সব শালা ফাজিল! আমার সুন্দরী বউ দেখে সবকটার মাথা নষ্ট।
— মাথা তোমার নষ্ট! ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো!
— না। তুমি আমার সাথেই থাকবে। আমি চাই না ছেলেপেলেরা তোমার পিছে ঘুরঘুর করুক।

সায়ানের এমন আচরণে আমি খুব অবাক হই কিন্তু কেন জানি মজাও পাই।

সায়ানের মোস্ট চার্মির ইয়াং বিচ্ছু বাহিনী হঠাৎ হাজির।
— ভাবী সেল্ফি টাইম!
সব আমাকে ঘিরে দাড়ায়। সায়ানের চাচাতো ভাই অর্ণব আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রাখে।

সায়ান সাথে সাথে ধমকে বলে কিরে, তোর ভাবী না! এতো ঘেষ্টে দাঁড়িয়েছিস কেন? সরে দাঁড়া!

জমজ বোন দুটো এক সাথে হাত নেড়ে ধোঁয়া উড়ানোর মতো করে বলে ও…. হো… পজেসিভ…. বলেই খিলখিলিয়ে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দেয়।
অর্নব বেশ বিরক্ত হয়ে বলে, ভাইয়া বুঝলাম তুমি ভাবীর প্রেমে লাট্টু হয়ে আছো তাই বলে ভাই বন্ধুকে শত্রু বানাচ্ছো কেন? সরো এখান থেকে বলে সায়ানকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। সায়ান পাত্তা না পেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।

পুরো পরিবেশটা আমার ভালোই লাগছে। কেউ না কেউ আমার সাথে এসে গল্প করে যাচ্ছে। সবাই বেশ আন্তরিক। মাকে সবাই এখানে বেশ সমিহ করে। উনি সবার কাছে আমার কি গল্প করছে কে জানে সবাই এসে এসে আমার খুব প্রশংসা করে যাচ্ছে। সায়ান এখন আর আমার কাছে ঘুরঘুর করছে না। তবে পাশেই দাঁড়িয়ে গল্প করছে। হয়তো আমার সাথে সব মহিলারা গল্প করছে বলে সে অনেকটা টেনশন মুক্ত।

রোহান ভাইয়ের বউ মাহিরা এতোক্ষণে আমার কাছে আসে।

—ভাবী, তুমি তো বেশ সুন্দরী! তবে এতো কম সেজেছো কেন? আর একটু সাজলে আরও ভালো লাগতো।
আমি হেসে বলি তোমাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে। একেবারে ডানাকাটা পরি।
মাহিরা হেসে বলে সবাই তাই বলছে!
কে কে ওর কত প্রশংসা করেছে, কে ওকে বলেছে ওর মতো সুন্দরী মেয়ে এ ঘরটা পুরো আলোকিত করেছে আরও কত কি কথা মাহিরা হাত নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে থাকে !
আমি হেসে হেসে ওর গল্প শুনি।
— জানো ভাবী, রোহান তো আমি বলতে পাগল! আমার জন্য কি না করে আর আমার শাশুড়ী মাও আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। একমাত্র ছেলের বউ তো! দেখো না, গলার এই ডাইমন্ডের নেকলেসটা আমাকে ঐদিন দিয়ে বলেছে আমার লক্ষী বউমার জন্য ছোট উপহার। হি হি….
— তো ভাবি! তুমিও তো রোকেয়া ফুপির একমাত্র ছেলের বউ! উনি তো তোমার খুব প্রশংসা করে বেড়াচ্ছে সবার কাছে। তোমাকে যে এতো ভালোবাসে তো কি উপহার দিলো তোমাকে??

আমি হেসে বললাম উনি তো উনার সবচেয়ে দামী উপহারই আমাকে দিয়ে দিয়েছে।
— মানে??
— মানে উনি উনার একমাত্র আদরের ধনকে আমার হাতে দিয়ে বলেছেন “আজ থেকে এর সকল অধিকার তোমার”। এতো বড় উপহার কজন মা দিতে পারে বলো! বেশির ভাগ একমাত্র ছেলের মায়েরা বউকে হীরা, পান্না যা-ই দেক না কেন ঘুড়ির নাটাই কিন্তু নিজের হাতেই রাখে। সেখানে আমার শাশুড়ী পরই ভিন্ন।

আমি হয়তো মাহিরার গোপন কোনো ক্ষতে ছুঁয়ে দিয়েছি সে আর কথা না বাড়িয়ে পালিয়ে গেল।

*****
সায়ানের পাশে রোহান দাঁড়িয়ে বলল কিরে তোর বউ তো সেরকম বুদ্ধিমতী। আমার বউয়ের মুখ তো পুরোই বন্ধ করে দিলো। আমি আছি মহা জ্বালায় বুঝলি! বউকে এতো কিছু দেই, এতো করি কিন্তু কিছুতেই খুশি করতে পারি না। তুই কিভাবে ম্যানেজ করিস রে? পিয়া ভাবী তো তোকে নিয়ে বেশ সুখী মনে হচ্ছে। কি ধীরস্থির প্রশান্তির হাসি মুখে! আমাকে বুদ্ধি দে তো বউকে কি দিলে শান্তি পাবো?

এমন সময় পিয়া পেছনে এসে দাড়ায়। গম্ভীর সুরে সায়ানকে বলে মা ডাকছে, চলো!

অনুষ্ঠানের বাকিটা সময় সায়ানের খুব মন খারাপ থাকে। রাতুল যে প্রশ্ন করেছে সেটার উত্তর সায়ান জানে না। সে জানে না পিয়াকে সে আজ পর্যন্ত কি দিয়েছে যে পিয়া তারপরও এতো হাসি খুশি। পিয়ার প্রাপ্তির খাতা তো কেবল শূন্য অন্যদিকে সায়ান শুধু পিয়ার কাছ থেকে নিয়েই গেছে। পিয়ারও কিছু পাবার আছে তা কখনো চিন্তাও করে নি। একটা গিফটও তো সায়ান পিয়াকে কখনও দেয় নি। কখনোও স্পেশাল ফিলই করায় নি।
আর মনে মনে ভাবছিলো পিয়াকে ভালোবাসা অনুভব করাবে, এই বুঝি তার নমুনা! ধ্যাত!
পিয়া নিশ্চয়ই রাতুলের কথা শুনছে। তাই তো গম্ভীর হয়ে ছিল। নাহ! পিয়াকে কিছু একটা গিফট করতেই হবে।

কিছুক্ষণ আগেও যেখানে সায়ান বুক ফুলিয়ে পিয়ার সাথে সাথে চলছিল এখন পিয়ার সামনে এলেই মনটা কেমন খচখচ করছে।
*******

রাতে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আমি শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নেই। সায়ান চেঞ্জ করে চুপচাপ ডিভানে বসলে আমি কাটকাট সুরে বলি সায়ান এদিকে বসো, কথা আছে।
—আজ তুমি এমন করলে কেন??

সায়ান নিশ্চুপ।

— তোমার কাজে আমার লজ্জা লাগা তো দূর রাগ হচ্ছিল।

— সরি। আমার মাথায় কখনোও আসে নি। আমি কাল তোমাকে নিয়ে যাবো সাথে।
— আমাকে সাথে নিবে??? কোথায়???

— জুয়েলারির দোকানে।
—কেন??
— তোমার জন্য গিফট কিনতে।
— আমার জন্য গিফট? আরে আমি বলি কি, আর আমার সারিন্দা বাজায় কি??

সায়ান মাথা তুলে বলে, মানে??

— আমি তোমাকে প্রশ্ন করছি তুমি আমাকে নিয়ে এতো প্রটেক্টটিভ আচরণ করছিলে কেন? প্রথমে রোহান ভাই পরে অর্ণব… তুমি অর্নবের সাথে এমন কথা বললে? ও না তোমার আদরের ছোট ভাই!
আমার এতো রাগ লাগছিলো তোমাকে… হঠাৎ তোমার কি হয়েছে বলো তো??
— জানি না।
— কি জানি না??
— জানি না, তোমার প্রতি কেউ আগ বাড়িয়ে আগ্রহ দেখালে আমার ভালো লাগে না। ব্যাস!

আমি সায়ানের সরল স্বীকারোক্তিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। প্রসঙ্গ পাল্টে বলি, কি বলছিলে জুয়েলারির দোকান, গিফট, কি কাহিনী বলো তো??

রোহান বলছিলো না তুমি এতো হাসিখুশি, আমি তোমাকে কি দিয়েছি?? আমি তো তোমাকে কিছুই দেয় নি, শুধু নিয়েই গেছি। প্রথমে আম্মুর জন্য তুমি এতো কিছু করলে তারপর আমার অনুরোধে তুমি বিয়ের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছো, সবকিছু আপন করে নিয়েছো আর আমি…

আমি কটমট করে বলি তার বিনিময়ে তুমি আমাকে জুয়েলারি দিয়ে খুশি করতে চাইছো???

সায়ান নিশ্চুপ। এই মুহূর্তে সে বুঝে গেছে সে যে একটা আস্তো গাধা! এবার পিয়ার ঝাড়ি খাওয়া থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না।

—সায়ান তুমি যে একটা আস্তো গাধা তুমি তা বুঝো??
— সরি! আমি আসলে…
— আসলে কি?? তুমি আমাকে কিছু দাও নি, তাই বুঝাচ্ছো তো!
— আসলেই তো কিছু দেই নি। আমি তোমার মতো কখনোই হতে পারবো না, পিয়া! আমার অনেক অপূর্ণতা আছে। আমি আসলে কোনোকিছুই ডিজার্ভ করি না।

—সায়ান একটা গিফট করতেই তো চাচ্ছো তাই না?? তাহলে আগে শোনো তারপর চিন্তা করো আমাকে কি দিবে।
আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম আমার মর্জিতে, খুশি খুশি। হ্যাঁ, বিয়ের পর তোমার এফেয়ারের কথা শুনে আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু রয়ে গিয়েছিলাম মায়ের কথা চিন্তা করে।
উনি চাইলেই তোমার জন্য কোনো বিত্তশালী পরিবারের মেয়েকে বউ করে আনতে পারতেন। কিন্তু উনি আমাকে বেঁছে নিয়েছেন, পরম মমতায় আমাকে আপন করেছিলেন। আমি মাত্র তিনদিনেই উনার মনে দুঃখ দিয়ে কিভাবে যেতাম বলো! তোমার অনুরোধে যে আমি যাই নি তা না, আমি তখন তোমার কথা ভাবিই নি কারণ তোমার সাথে আমার তখনও কোন সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। আস্তে আস্তে আমাদের বন্ধুত্ব হয়, আমি তোমার মাঝে একটা নির্মল, সুন্দর মনের মানুষের দেখা পাই। তুমি চাইলে আমার কাছে সানজানার ব্যাপার গোপন করে দিব্যি সংসার চালিয়ে যেতে পারতে কিন্তু তুমি তা করো নি।
তুমি আমাকে তোমার সততা গিফট করেছো, সায়ান!

সেদিন তিনশোফিটের রাস্তায় যে এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেটা দূর্ভাগ্যজনক ছিলো। কিন্তু তুমি যে বলিষ্ঠতা সেদিন দেখিয়েছো তা প্রতিটা মেয়েই তার স্বপ্নের পুরুষের কাছে আশা করে। তুমি সেদিন শুধু আমাকে নিয়েই ভাবো নি, সানজানা বার বার বলার পরও ওকে রাস্তায় না নামিয়ে বাসায় পৌছে দিয়েছো।
তোমার এরকম দায়িত্ববোধ আমার একটা বড় গিফট।

আমার অসুস্থতায় তুমি আমার খেয়াল রেখেছো। আমার পাশে সবসময় বন্ধুর মতো থেকেছো তুমি যদি সাপোর্টিভ না হতে তবে কি আমি এখানে থাকতে পারতাম?? এসব কিছুই আমার গিফট!

আর সবচেয়ে বড় গিফট তুমি আমি একই রুমে একই বিছানায় শুই। কিন্তু তুমি কখনোও তোমার লিমিট ক্রস করো নি। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে তোমার পাশে শুয়ে পড়ি। তোমার প্রতি আমার এ ভরসাটা তোমার একটা গিফট। এবার বলো তুমি আমাকে এতো এতো গিফট করেও বলছো কিছুই দাও নি!

সায়ান উজ্জ্বল মুখে হেসে বলে আমার এতো কোয়ালিটি আমি নিজেও জানতাম না।

—অবশ্যই তোমার অনেক কোয়ালিটি আছে সায়ান! তুমি তো মহান!!
আমি ঠোঁট টিপে দুষ্টুমী হাসি দেই।
সায়ান নিজের বন্দনায় বেশ গদগদ। আমাকে দেখে বলে কি ব্যাপার? তুমি এভাবে হাসছো কেন?

—হাসছি কারণ তোমার শেষের কোয়ালিটি- টা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তুমি কি আসলেই ভরসার যোগ্য নাকি কোনো সমস্যা তোমা….
.…….
কথা শেষ করার আগেই সায়ান আমার মুখ চেপে ধরে বলে কোনো বাজে কথা বলবে না খবরদার! এতো ভালো ভালো কথা বলে এখন কোনো পঁচা কথা শোনার মুড নেই আমার। সো গুড নাইট!!

সায়ান পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
আমিও বিছানায় শুয়ে ভাবি জীবনটা কি আসলেই এমন সুন্দর!

অন্যপাশে সায়ান বিছানায় চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে অনেক ভালোবাসি তোমায়, আমার মিচকা ডাইনী!!

চলবে।।
লেখকঃ ঝিনুক চৌধুরী।

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here