#শুধু_তুই
—(সিজন২)
#পর্বঃ১৭
#Rifat_Amin
ঘড়িতে এখন রাত ১১ টা ০৯। প্রহর ভিলায় চলছে তীব্র মন খারাপের মহুর্ত। বাসার সব মানুষগুলো চিন্তায় আর কান্নায় মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পরেছে। বাড়িতে সারাটাদিন ছোটাছুটি করা ছোট মেয়েটা নিখোঁজ। পুরো একটা দিন কেটে গিয়ে আজকের দিনটাও কেটে গেলো। তবুও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি পুলিশও কোনো হদিস দিতে পারছে না। ড্রইং রুমে প্রেম, ফারহান আর মিল্লাত মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না তারা। চিটাগং থেকে এসেই বা কি লাভ হলো? এমন সময় প্রহরের ফোন আসায় পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করলো প্রেম,
‘ শোন, ঘন্টা দুই আগে সারাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছি। সারা জানিয়েছে তোকে? ‘ (প্রহর)
‘ হ্যাঁ। তখন তো আমার সাথে আসতেই পারতো। আর রশ্নি আসলো না কেন? ‘ (প্রেম)
‘ ওর কথা মুখে আনবি না প্লিজ। তোর বোন এমন কেন ভাই? এতটা জেদ কারো হয়? ‘ (প্রহর)
প্রেম মন খারাপেও সামান্য হাসলো। অতঃপর ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘ প্রেয়সীর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো? ‘ (প্রেম)
‘ হ্যাঁ। তুই একটা কাজ কর’তো, ফারহান আর মিল্লাতকে নিয়ে আবার চিটাগং ব্যাক কর। প্রেয়সীকে মাহিম কিডন্যাপ করছে। তুই আয়। ‘ (প্রহর)
চমকে উঠলো প্রেম। ড্রইংরুমে বসা সবাই এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পরেছিলো। অতঃপর প্রহরের থেকে সুসংবাদ পেয়ে ঝটপট মাথা তুলে তাকালো তারা। প্রেম চঞ্চল স্বরে বললো,
‘ আমরা এক্ষুনি রওনা দিচ্ছি। (প্রেম)
‘ এতরাতে গাড়ি চালাতে সমস্যা হবে না তো? আচ্ছা, আরেকটা কাজ কর, আম্মু আব্বুকে বল প্রেয়সী এখন আমার কাছে আছে। আর যেনো টেনশন না করে। ‘ (প্রহর)
প্রহর মুচকি হেসে বললো,
‘ কোনো সমস্যা হবে না৷ আমি এক্ষুনি বল দিচ্ছি। ‘ (প্রেম)
প্রেম ফোন কেটে বাসার সবাইকে জানিয়ে দিলো বিষয়টা। যাতে কেউ টেনশন না করে তাই একটু বাড়িয়েও বলতে হলো যে, ‘প্রেয়সী এখন সারার কাছে আছে। ‘ সংবাদটা পেয়ে বাসার সবার দেহে যেনো প্রাণ ফিরে এলো। প্রেম আর দেরী না করে চিটাগং যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
—
প্রেয়সী প্রহরভাইয়ের কাছে নিরাপদে আছে শুনে মন খারাপ আস্তে আস্তে কেটে গেলো ঐশীর৷ এতক্ষণ সে অন্ধকার রুমে চুপটি করে বসেছিলো। দুদিন ধরে আম্মুও কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পরেছে, তাই সকালে বাসায় ডক্টর এসে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়েছে। আব্বু তো পুলিশ পুলিশ করে দৌড়াদৌড়ি করছে। ফোন দিয়ে কি প্রেয়সীর কথা জানিয়ে দিবো এখন? মনে মনে কথাটা ভাবতেই ঐশী ফোন করলো আব্বুকে। প্রেয়সী নিরাপদে আছে জানিয়ে ফোনটা রেখে একটু চোখ বুঝবে একটু রেস্ট করবে, অমনি ফোনটা বেজে উঠলো ওর৷ স্ক্রিনে পুলক নামটা দেখে মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করে বললো,
‘ প্রেয়সীকে পাওয়া গেছে। ‘ (ঐশী)
ওপাশ থেকে পুলকের তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস শুনলো ঐশী। অতঃপর পুলক বললো,
‘ আলহামদুলিল্লাহ, বাঁচা গেলো বাবা। পিচ্চিটা এখন কই? আর কিভাবেই বা হারিয়ে গিয়েছিল? ‘ (পুলক)
‘ সেসব কথা পরে হবে। প্রেয়সী এখন ভাইয়ার কাছ আছে। ‘ (ঐশী)
‘ তাহলে তো নিশ্চিন্ত। এখন একটু ছাদে আসো তো। ‘ (পুলক)
‘ আশ্চর্য! এতরাতে আমি ছাদে যাবো কেনো? আমি আবার ভূতে ভয় করি বাবা!’ (ঐশী)
খানিকটা মন খারাপের স্বরে বললো ঐশী। পুলক কথা শুনতেই খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,
‘ চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আপনার হবু বর আপনার ছাদে দাঁড়িয়ে আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কি আসবেন তো? ‘ (পুলক)
ঐশী খানিকটা লজ্জা পেলেও রাগি স্বরে বললো,
‘ আপনি কি পাগল? এতরাতে আমার বাসার ছাদে আসলেন কিভাবে? ভাইয়া জানতে পারলে কিন্তু আস্ত রাখবে না আপনাকে। ‘ (ঐশী)
পুলক খানিকটা বিরক্ত স্বরে বললো,
‘ তোমার বাসার মশাগুলো এত খারাপ কেনো? আত্মীয় এসেছে। অথচ সম্মান না করে উল্টো রক্ত খেয়ে নিচ্ছে। তারাতারি কয়েল জ্বালিয়ে ছাদে আসো। ‘ (পুলক)
ঐশী শব্দ করে হেসে বললো,
‘ আরো কামরাক। আচ্ছা যাচ্ছি ছাদে। আজকের পর থেকে ভূলেও ছাদে আসার চেষ্টা করবেন না। আমার ভাইয়ের কিন্তু ঈগল দৃষ্টি। ‘ (ঐশী)
ঐশী ফোনটা কেটে একটা কয়েল জ্বালিয়ে নিলো। রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়ালঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটার কাছাকাছি এখন। আম্মু তো অসুস্থ, নিশ্চয়ই রুমে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু আব্বু তো বাসায় ফেরেনি। হয়তো এখন ফিরবে। ছাদে গেলে যদি ধরা খাই?
কি পাগল মানুষরে বাবা! এতরাতে লুকিয়ে ছাদে আসলো কিভাবে কে জানে! ঐশী ঝটপট রুমের দরজা অফ করে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। সম্পর্কটা তাঁদের অনলাইন জগৎ ফেসবুক থেকেই হয়েছে। আগে নাকি নারায়নগঞ্জে জব ছিলো। আমার জন্য ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় সিফট হয়েছে। পাঁচমাস সম্পর্কের পর প্রথম মিট হয়। দ্বিতীয়বার দেখা করতে গিয়েই তো রশ্নিকে সাথে নিয়েছিলাম। ভাগ্যিস একটুর জন্য ধরা খাইনি৷ ধরা খেলে প্রহরভাই আস্ত রাখতো বলে মনে হয় না। এখন তো নিয়মিত কলেজের সামনে বাইক নিয়ে দেখা করতে আসে৷ এখানেই প্রধান সমস্যা। প্রহরভাই যে ধুর্ত মানুষ! ঐশী চাবি দিয়ে দরজা খুলে ছাদে পা রাখতেই পেছন থেকে মুখ চেপে ধরলো কেউ! অতঃপর দরজাটা অফ করে লোকটা সামনের দোলনার দিকে এগিয়ে চললো। এতক্ষণে বুঝলো এটা পুলক। এমন ভয় দেখানোর মানে আছে? এক্ষুণি হার্ট অ্যাটাক করতাম বাপু। মুখ থেকে হাত ছেড়ে দিতেই ঐশী মারতে লাগলো পুলককে। পুলক মাইর খেয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বললো,
‘ বিয়ের আগেই বউয়ের মা’ইর খাওয়ার সৌভাগ্য হচ্ছে! না জানি বিয়ের পর নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়! ‘ (পুলক)
‘ আস্তে হাসেন। এভাবে কেউ ভয় দেখায়! ‘ (ঐশী)
পুলক জবাব না দিয়ে বললো,
‘ একটা খুশির সংবাদ আছে। শুনবা? ‘(পুলক)
‘ না। আপনার খুশির খবর আপনি রাখেন! ‘ (ঐশী)
‘ ওকে৷ বললাম না। ‘ (পুলক)
খানিকটা ভাব নিয়ে কথাটা বললো পুলক৷ ঐশী সেটা দেখে আরো মেজাজ গরম করে বললো,
‘ কি হলো এখন? বলেন না কেন? একটু জোর করার ক্ষমতা নেই নাকি! ‘ (ঐশী)
পুলক আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে মন জুরিয়ে গেলো ঐশীর। এই মধ্যরাতে কনক্রিটের ছাদ একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার দুষ্টামি নির্লজ্জের মতো উপভোগ করছে। বিষয়টা ভাবতেই শরীর শিরশির করে উঠলো ঐশীর। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, ঘোর নিস্তব্ধতা। কেউ কথা আর কোনো কথা বলছে না। আকাশে শুল্ক পক্ষের চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সেই চাঁদের আলোয় গা ভাসিয়ে দুজন দুজনার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিরবতা কাটিয়ে পুলক বললো,
‘ খুশির খবরটা হলো, আমি বিসিএসে টিকে গেছি। ‘ (ঐশী)
ঐশী তো ভূলেই গিয়েছিলো আজ রেজাল্টের দিন। এই প্রেয়সীর টেনশনে মাথা থেকে সব বেড়িয়ে গিয়েছিলো একেবারে। খুশির সংবাদটা শুনে এই মধ্যরাতে নাঁচতে ইচ্ছে করলো ঐশীর। নিজের উত্তেজনা দমিয়ে রেখে বললো,
‘ আমার গিফ্ট দাও তাহলে’ (ঐশী)
‘ কি জানি চেয়েছিলে? ‘ (পুলক)
মহুর্তেই মন খারাপে তলিয়ে গেলো ঐশী। এটা কোনো কথা। এত তারাতারি ভুলে বসলো? এ জন্যেই বলে, পুরুষমানুষকে বিশ্বাস করতে নাই। বলেছিলো বিসিএসে টিকে গেলে একটা কিছু গিফ্ট পাবো। আমি তো সামান্য একটা শাড়িই চেয়েছিলাম। ধুর! আর কোনো কথা বললো না ঐশী। পুলক বিষয়টা লক্ষ করে বললো,
‘ খুব তারাতারি তোমার বাসায় বিয়ের প্রোপোজাল আসছে। মন খারাপ?’ (পুলক)
এখনকার এই সুন্দর মহুর্তে আর মন খারাপ করে থাকা যাচ্ছে না। ঐশী বললো,
‘ আমি রুমে যাবো। আপনি ফিরে যান প্লিজ। আল্লাহ হাফেজ। ‘ (ঐশী)
ঐশী কোনো কথা না বলে হাঁটা ধরলেই হাতটা চেপে ধরলো পুলক। অতঃপর আরেক হাতে থাকা একটা মোমবাতি জ্বালালো সে। মহুর্তেই কিছুটা আলোকিত হলো জায়গায়টা। চন্দ্র কিরণ আর সোডিয়াম আলোর মিশ্রণে স্থানটা একটুকরো স্বর্গের বাগান মনে হলো। ঐশী জেদ ধরে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে থাকতেই হঠাৎ পুলক মিষ্টি কন্ঠে বললো,
‘ Will you marry me? ‘ (পুলক)
ঐশী পিছনে ফিরে তাকালো না। কিন্তু না তাকিয়েও তো আর থাকা যাচ্ছে না। সেকেন্ড কয়েক পর ঐশী ফিরে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। হাতে থাকা পুরো এক ডজন শাড়ির প্যাকেটের পিছনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে পুলক। ঐশীর চোখে পানি এলো। না চাইতেও তখন অশ্রুবিসর্জন দিতে বাধ্য হলো সে।
সেই শাড়ির প্যাকেটে শুধু শাড়িই ছিলো না। ছিলো চুড়ি, ফিতা, কাজল আরো অনেক কিছু। পুলক কিছুক্ষণ ঐশীর চোখের পানির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর বললো,
‘ একটা সত্য কথা বলি? ‘ প্রশ্নটা করে জবাবের আশায় বসে রইলো না পুলক। অতঃপর দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম। তোমার বেস্টফ্রেন্ড মেহরুনুরের কাজিন আমি। একদিন ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে তোমাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করে ফেলি। মেহনুরকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়েও তোমার নাম্বারটা পাইনি। ও বলেছিলো তোমায় আমার বিষয়টা জানাবে। কিন্তু তুমি তো এসব পছন্দই করতা না। আস্তে আস্তে তোমার ফেসবুক আইডি ম্যানেজ করে নক করেছিলাম ছয়মাস আগে। ভাগ্যিস সেদিন রিপ্লাই দিয়েছো। আমার সম্পর্কে তুমি সবকিছু জানো। শুধু এটাই ছিলো অজানা। আমার ভয় ছিলো যে আমি যদি এইটা বলি তাহলে হয়তো আগের মতো আমায় ভুল বুঝবা। আর এখন ভুল বুঝলেও সমস্যা নেই। তোমার বাবার সাথে একটু সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। তুমি বিয়ে না করলেও জোর করে বিয়ে করবো আমি। হিহিহি। ‘(পুলক)
ঐশী এখনো কাঁদছে। মনে মনে ভাবছে একটা মানুষ এত ভালো হয় কিভাবে? এখন শুধ শেষটা ভালো হলেই হয়।
#শুধু_তুই
—(সিজন২)
#পর্বঃ১৮
#Rifat_Amin
নিশুতি রাত। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। ক্ষণকাল পূর্বে মাথার উপর যে দীপ্তমান চন্দ্র অবলোকন করা গিয়েছিলো, সেটা এখন মেঘের অন্তরালে নিজের লাজুকতা প্রকাশ করতে ব্যস্ত। গাড়ি চলছে পরিত্যক্ত কোনো জঙ্গলের মাঝামাঝি সরু রাস্তা দিয়ে। চারপাশে ঘন জঙ্গল। সাথে মাথার উপর প্রকান্ড জঙ্গলের আচ্ছাদন। হেডলাইটের আলোয় পথ খুঁজছেন প্রহরভাই। আমি পাশে বসে উনার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছি। তিনি কোথায় যাচ্ছেন আমি জানি না। তবে আমার জোরাজুরিতেই যে উনি এখানে আমাকে নিয়ে এসেছেন, এতে তিনি বিরক্তবোধ করছেন। হঠাৎ উনি আমার দিকে দৃষ্টি ফেলতেই আমি চোখ সড়িয়ে নিলাম। আমার দিকে সামান্য তাকিয়েই নিজের ফোনে লোকেশনটা আবার দেখে নিলেন উনি। আমি নিজের ফোনটা অন করে দেখলাম রাত দুটো পার হয়ে গেছে। আমি যে এতরাতে জেগে আছি, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হলো যেনো। আকাশ ক্রমশ খারাপের দিকে পা বাড়াচ্ছে। একটু আগে ঘনীভূত হওয়া কালো মেঘগুলো একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিদ্যুৎের ঝলকানি আর প্রচন্ড শব্দ সৃষ্টি করছে। হঠাৎ প্রহরভাই আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরকন্ঠে বললেন,
‘ প্রেমকে ফোন করে দেখতো ওরা এখন কোথায়? ‘ (প্রহর)
আদেশ শুনে প্রেমের নাম্বারে কল করার আগেই দেখলাম নেটওয়ার্ক নেই। একদম এমারজেন্সি কল হয়ে আছে। তবুও একবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ হলো না। আরেকবার চেষ্টা করতেই দেখলাম এমারজেন্সি কল তো দূরের কথা, নেটওয়ার্কের কোনো খুটিই শো করছে না । একদম সিমলেস ফোন মনে হলো। উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। ‘ (আমি)
সাথে সাথেই ব্রেক কষলেন উনি। ভাগ্যিস সিটবেল্ট বাঁধা ছিলো। নাহলে এতক্ষণে মাথাটাই ফেটে যেতো। উনি নিজের ফোন চেক করে দেখো বললেন,
‘ ওহ, শিটটট! লোকেশন কাজ করছে না। এ আমরা কোথায় এলাম? ‘ (প্রহর)
‘ আপনিই জানেন কোথায় এসেছেন। জোর করে আসতে চেয়েছি বলে আমাকে মে’রে ফেলার প্লান করেননি তো? ‘ (আমি)
আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলতেই উনি সরু চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,
‘ তখন গলা টি’পে তোকে মে’রে ফেলাই উচিৎ ছিলো। বাঁচিয়ে রেখে ভূল করেছি। এখন চুপচাপ থাক। ‘ (প্রহর)
আমি লম্বা একটা হাই তুলে মাথাটা সিটে আরাম করে দেয়ার আগেই বিকট আওয়াজে গর্জন করলো আকাশ। সাথে সাথেই চমকে উঠলাম। ভয় ভয় দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতেই উনার চিন্তিত মুখশ্রী পরিলক্ষিত হলো। উনি ঝটপট গাড়ি স্টার্ট করে বললেন,
‘ এটা সেভজোন না রশ্নি! লোকেশনও তো কাজ করছে না! কোথায় যে যাবো তাও বুঝতেছি না। কি করি! ‘ (প্রহর)
‘প্রহরভাই! এখন মধ্যরাত। তার উপর ঘন জঙ্গল! হঠাৎ সাদা পোষাক পরা কোনো প্রেতাত্মা যদি সামনে আসে! তখন? ‘(আমি)
আমি চোরা চাহনিতে ভয় ভয় কন্ঠে কথাটা বলতেই উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ তোর বাচ্চামো অফ করবি। প্রহর খান মানুষ তো দূরের কথা। কোনো ভূতপ্রেত থাকলেও তাকে ভয় পায় না। ‘ (প্রহর)
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। মাথার উপর গাছগাছালির আচ্ছাদন থাকায় বোঝা যায়নি কতটা আকাশ খারাপ। কিন্তু যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন প্রহরভাই আর দেরী না করে গাড়ি চালানো শুরু করলেন। এখন তিনি কোথায় যাবেন তা অজানা!
‘ আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি? (আমি)
‘ এখন কোথায় যাচ্ছি জানি না। তবে আমরা এখন খাগড়াছড়ির কাছাকাছি আছি ‘ (প্রহর)
‘ ওয়াও! সাজেক যাচ্ছি! কিন্তু আপনি না বললেন প্রেয়সীকে আনতে যাচ্ছেন’ (আমি)
‘ অবশ্যই সাজেক যাচ্ছি না ময়না! আমি প্রেয়সীকেই আনতে এসেছি। মাহিম নামক ছেলেটা তোকে বিয়ে করতে চায়। তাহলে নাকি সে আমার বোনকে ফিরিয়ে দিবে। তো তোকে সাথে নিয়েছি এই কারণেই। বুঝলি কিছু? ‘ (প্রহর)
উনার কথা শুনে অন্তর-আত্মা শুকিয়ে গেলো আমার। কি ভূলে যে উনার সাথে আসার জেদ ধরলাম, কে জানে! উনি কি মজা করছেন! আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলেন। আকাশের অবস্থা ভালো না। হালকা বজ্রপাতের আওয়াজ আসছে। তাছাড়া এই অবস্থায় গাড়ি চালানোও রিস্কি। হঠাৎ বিকট শব্দে বিদ্যুৎের ঝলকানি আসতেই ভয় জেঁকে বসলো আমায়৷ আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,
‘ ভ-ভয় লাগছে ভ-ভাইয়া। ‘ (আমি)
উনি বারবার ফোনে লক্ষ্য রাখছেন নেটওয়ার্ক আছে কি না। এটা কি গভীর জঙ্গলে ঢুকে পরলাম!
‘ চুপচাপ থাক। দেখি কোথাও কোনো আশ্রয় পাওয়া যায় কি না! ‘ (প্রহর)
হঠাৎ আমার মনে হলো জঙ্গলটা ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। আর আকাশের ভয়াবহ অবস্থা আরো দৃশ্যমান হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর জঙ্গলটা পেরিয়ে যেতেই একটি ছোট গ্রাম দেখা গেলো। গুটিকয়েক বাড়ি, টিনের চালার মাঝে বিল্ডিংও আছে। মনে হচ্ছে এখানকান মানুষ যথেষ্ট শিক্ষিত। হেডলাইটের আলোয় তার কিছুটা সামনে গ্রাম্য বাজার পরিলক্ষিত হতেই উনি গাড়ি থামালেন। আমরা ঝটপট নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। গাড়িটা রাস্তায় রেখে একটা দোকানের বারান্দার নিচে আশ্রয় নিলাম। মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ জঙ্গলে থাকাকালীন এমনটা বোঝায় যায়নি৷ কি গুমোট অন্ধকার চারদিকে! মধ্যরাতের এমন নিস্তব্ধতা আর টিনের চালায় বৃষ্টির শব্দে চারপাশটা কেমন ভূতরে মন হলো। আমি ফোনের ফ্লাশলাইট জালিয়ে প্রহরভাইয়ের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। উনি বিষয়টা বুঝতেই আবার গাড়ির ভীতর ছুটে গিয়ে একটা জ্যাকেট আনলেন৷ একটু আগে দোকানে উঠতে যতটুকু ভিজেছিলেন। এবার আরো অনেকটা ভিজলেন! একদম গোসল অবস্থা!
আমরা দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ খুব খারাপভাবে ফেঁসে গেছি রশ্নি। আকাশটা এত খারাপ হবে জানতাম না। নে, এটা পরে নে। ঠান্ডা লেগে যাবে! ‘ (প্রহর)
‘ আপনার ঠান্ডা লাগছে না? ‘ (আমি)
উমি জবাব দিলেন না। আসলেই আমার ভীষণ শীত করছে। আমি উনার থেকে জ্যাকেট নিয়ে গায়ে জড়াতেই হঠাৎ বারান্দার আলো জ্বলে উঠলো। সোলার প্যানেলের আলো। এসময় দুনিয়া উল্টে গেলেও কারেন্ট থাকবে না নিশ্চিত। তাঁর সাথে সাথেই দোকানের দরজা খুলে একজন মধ্যবয়স্ক লোক বেড়িয়ে এলেন। হঠাৎ উনার আগমনে কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম আমরা। প্রহরভাই উনাকে সালাম দিলেন। উনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
‘ আপনেরা কারা বাবা। ‘ (লোকটা)
প্রহরভাই বললেন,
‘ আমার নাম প্রহর খান। আসলে আমরা এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। আকাশটা ভীষণ খারাপ হওয়ায় আপনার এখানে আশ্রয় নিয়েছি। ‘ (প্রহর)
লোকটা ভীষণ খুশি হলেন বলেই মনে হলো। আমাদের ভীতরে আসতে বললেন উনি। আমি ভীতরে পা রেখে বুঝলাম এটা মুদি দোকান। উনি বললেন,
‘ আল্লার কি কাম দেখছেন বাবা! আমিও দোকানে টিভির জ্যাক আর ফ্রিজের লাইন খুলতে আসছিলাম। এহন তো ঠাডা পরলেই কাম সারা। সব কিছু নষ্ট হই যায়। আচমকা মনে হলো দোকানের বাইরে কেউ কথা বলছে। তাই দরজা খুলে দেখলাম। এটাই নসিব বাবা। আহেন, ভীতরে আসেন। তোমরা আজ আমার অতিথি। ‘ (লোকটা)
বোঝা গেলো খুব একটা শিক্ষিত না উনি। তাই গ্রাম্যভাষা আর চলিত ভাষা গুলিয়ে ফেলেছেন। উনার ব্যবহারে খুব খুশি হলাম। উনাকে দেখে নামাজি বলেই মনে হলো। মাথায় টুপি না থাকলেও শরীরে পান্জাবী আছে। প্রহরভাই আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় ভীতরে ঢুকতে বললেন। এখন একমাত্র অবলম্বন এনাদের আশ্রয় গ্রহণ করা। নাহলে বারান্দাটাও নিরাপদ ছিলো না। রুমের ভীতর ঢুকার পর উনি বললেন,
‘ তোমরা কি জামাই-বউ? ‘ (লোকটা)
প্রহরভাই খানিকটা ভরকে গেলো। এই অবস্থায় ফুফাতো বোন বলা উচিৎ নাকি বউ? উনি চুপ থাকতেই লোকটার ভাবমূর্তি কিছুটা চেন্জ হওয়া শুরু করলো। সন্দেহ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। প্রহরভাই আর কোনো কথা না বলেই বললেন,
‘ জি আমরা স্বামী-স্ত্রী। ‘ (প্রহর)
কথাটা শুনেই শরীর শিরশির করে উঠলো আমার। কেনো এই অনুভূতি হলো বোঝা গেলো না। লোকটা বিশ্বাস করলেন না৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না তুমিব বিবাহিত ‘ (লোকটা)
লোকটা হঠাৎ এই কথা বলতেই আমি মুখ ফসকে বললাম,
‘ আমার তো বিয়ে হয়নি। তাই মনে হওয়ারও কারণ নেই। (আমি)
কথাটা বলেই ঠোঁট চেপে ধরলাম। প্রহরভাই স্তব্ধ-দৃষ্টিতে আমার তাকালেন। জীবনের সব থেকে বড় ভূলটা যে এখানেই করলাম তা হয়তো আগে বুঝিনি। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তেই লোকটা উনার ছেলেকে ডাক দিলেন। আকাশ খারাপ হওয়ায় সবাই জেগে ছিলো। ছেলেটা উপস্থিত হতেই ওর দিকে আড়চোখে তাকালাম। অল্পবয়সী ছেলে। বয়স ষোল-সতেরো হবে বোধহয়। লোকটা ছেলেকে কিছু বলবে তার আগেই ছেলেটা বললো,
‘ আরে আপনি প্রহর না? আজ সন্ধ্যায় যে চট্টগ্রামে কনসার্ট করলেন? আমরা তো টিভিতে আপনাকে দেখেছি। ‘ (ছেলেটা)
প্রহরভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুখটা অন্ধকার করে রেখেছেন। সামনে কি হতে চলেছে ভালো করেই বুঝতে পারলেন। নিজের ছেলে এমন কথা বলায় লোকটা বললেন,
‘ তুই হেরে চিনস? আচ্ছা বলতো হেয় কি বিবাহিত ? ‘ (লোকটা)
প্রহরভাই ওকে থামাতে যাবে তার আগেই ছেলেটা বললো,
‘ আরে না । উনি তো সপ্তাহখানেক হয় দেশে ফিরেছেন। ‘ (ছেলেটা)
অতঃপর যা হওয়ার তা হলো। লোকটা বললেন,
‘ দেহো বাবা, এই গ্রামে এসব চলে না। তোমরা শহরের মানুষজন। ভালো কথা। তাই বলে গ্রামে আইসে এইসব ফষ্টিনষ্টি চলে না। গ্রামে কাজি হিসেবে আমার যথেষ্ট মান আছে। সব বিয়ে আমিই পরাই। তোমাদের বিয়ে পড়াইতেও কষ্ট হবে না। আল্লা তোমাদের এহানে পাঠাইছে হয়তো এই কারণেই। একটা পবিত্র বন্ধন তোমাদের দরকার। আমি তো নিজ চক্ষে এমন পাপ দেখতে পারুম না’ (লোকটা)
লোকটার কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেনো। স্তব্ধ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি স্বাভাবিক। টু শব্দ করছে না। উনার যে এত ক্ষমতা! পাওয়ার দেখিয়ে অন্তত এখান থেকে কি পালিয়ে যাওয়া যায়না! লোকটা ছেলেকে বললেন,
‘ তোর চাচা-চাচিরে ডাক দে। আর কাগজপাতি রেডি কর। ‘ (লোকটা)
ছেলেটা অবাকদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
—-
রাত তখন তিনটার কাছকাছি। বাইরে এখনো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালার বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার যোগার। ঠিক তেমনি বৃষ্টি ঝরছে আমার চোখে। থেমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। একটু আগে প্রহরভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। অথচ এটা আমার বিশ্বাস করতেও যেনো কষ্ট হলো। কখনো ভাবতে পারিনি এভাবে আমার বিয়ে হবে। তাও আবার এমন একটা মানুষের সাথে। যে কিনা আমাকে সহ্য করতেও পারে না। প্রেম আর আমার বিয়েটা হলো আকষ্মিক! প্রেমের বিয়ের মুল হোতা ছিলো প্রহরভাই। অথচ আমাদের বিয়ের মুল কারিগর এই অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। নিজের ভাগ্যটাকে এভাবে চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম আমি। মামা মামি কি আমাকে মেনে নিবেন? যে মামিকে সবসময় আম্মি ডেকে এসেছি। তিনি কি নিজের পুত্রবধূ হিসেবে আমায় গ্রহণ করবেন? আমি কোনো সাইড দিয়েই উনার যোগ্য না। উনি বড় গায়ক। কত উচ্চবিত্ত ফ্যামিলি থেকে বিয়ের প্রপোজাল আসে। কিন্তু রিজেক্ট করে দেয় প্রহরভাই। সেখানে আমি তো ডালভাত। এতদিন পরিবারে যে স্নেহের ভাগিদার ছিলাম সেটা আর জুটবে বলে মনে হলো না। বিয়ে হতে না হতেই অনুভবে নিজেকে এমন বড় বড় প্রশ্নের সম্মুখীন করতেই অন্তর-আত্মা ফেটে যাচ্ছে আমার। বাজ পড়ার শব্দে কল্পনা থেকে বেড়িয়ে প্রহরভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি নেটওয়ার্ক খোঁজার চেষ্টা করছেন। হাফ বিল্ডিং এই রুমটার ছাদ সম্পূর্ণ টিনের। সেখানে সোলারের মৃদু আলো আর টেবিলে রাখা মোমবাতির আলোয় রুমটা মোটেও স্বস্তি দিলো না আমায়।
‘ মনে হচ্ছে কেঁদেই বন্যা হয়ে যাবে। তুই থামবি? ‘ (প্রহর)
উমার কথায় সচকিত দৃষ্টিতে তাকালাম। জবাব দিলাম না। উনি বিছানায় শুয়ে মোবাইলে কি জানি করছেন। আমার কাছাকাছি এসে বললেন,
‘ তোর না ঘুম পাচ্ছিল তখন। এখানে ঘুমা। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ‘ (প্রহর)
এখনো কি সেই ঘুম আছে! উনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার চোখে আমার চোখ পড়তেই চোখ সড়িয়ে নিলাম। নিভূ নিভূ স্বরে বললাম,
‘আপনি একটু কষ্ট করে ডিবোর্স পেপার ম্যানেজ করবেন ভাইয়া। আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যতে কখনো আমার ছায়া থাকবে না। টেনশন করবেন না, আমি বিয়ের কথা কাউকে জানাবো না’ (আমি)
উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ ডিবোর্স পেপার দিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। যা হয়েছে হয়েছে। এসব নিয়ে আমি ভাবছি না। আমার বোনটা এখন কেমন আছে, সেটা নিয়েই আমার ঘুম আসছে না। আমি জানি মাহিম ওরে কিছুই করবে না। শুধু একটাই ভয়, তা হলো ওর মানসিক অবস্থাটা কেমন। ‘
চলবে?
চলবে?
(কাল প্রহর-রশ্নির পর্ব পাবেন)