#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-৭||
★
“-আমি ফারহিন কে বিয়ে করতে পারবো না মা! তোমার কথায় আমি রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে আজীবন একসাথে থাকার মত সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারছি না। আর আমি ফারহিন কে ভালোবাসি না। পারলে আমাকে ক্ষমা করো। আমি আসবো না আজ বিয়েতে। খালামনি, বাবাইকে আমার তরফ থেকে সরি বলে দিও।
ফারহিন ধীর গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে আছে। চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা পানি। ফারহিন জানতো তীব্র কখনো ফারহিনের ভালোবাসা বুঝবেনা। যদি এমনই হওয়ার ছিলো বিয়ে নামক এই নাটকের কি প্রয়োজন ছিলো। মাঝখানে এত গুলো দিন কেন তীব্র ফারহিনকে এটা বোঝানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো যে, যে ফারহিনকে ভালোবাসে। ফারহিনের চোখ নোনাপানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে। পলক ফেলতেই চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ভরা মজলিসে, এত মানুষের সামনে ফারহিন আবার অপমানিত হলো তীব্রের কাছে। এবার শুধু ফারহিন না ফারহিনের পুরো পরিবারই হেনস্তা শিকার হলো। তীব্র বিয়েতে আসতে লেট করছিলো বলে রফিক চৌধুরী বার বার ফোন করছিলো। তীব্র ফোনের রেসপন্স করেনি। হোয়াটসঅ্যাপের ভয়েস নোট এর মাধ্যমে জানিয়ে দিলো সে আসবেনা। সে বিয়ে করবেনা, ফারহিনকে তার পছন্দ না। নিজের ছেলের উপর প্রচন্ড রাগ হলো রাশেদার। রফিক সাহেব লজ্জায় মাথা হাত দিয়ে বসে পড়লো৷ দিদার হাসান রাগে গজগজ করতে বলল –
“-এসব কি ছেলে মানুষী আপা? তীব্র এসব কি বলছে?
“-আমি বুঝতে পারছিনা। ও তো ঠিকই ছিলো..
“-এক্ষুনি ওকে ফোন করো, আমি এমন ঠাট্টা একটুও পছন্দ করি না।
দিদার হাসানের কথায় রফিক সাহেব আবারো ফোন করলো। তীব্রের ফোন বন্ধ আসছে। সালমা ফারহিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রাণহীন এর মত শক্ত হয়ে আছে ফারহিন। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। দিদার হাসান এগিয়ে গিয়ে রফিক সাহেবের কলার ধরে ফেলল, বলল-
“-নিজের ছেলের মতামত না নিয়ে আমার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে কে বলেছিলো? আমি আমার মেয়ের বেইজ্জতি মেনে নেব না। আত্মীয় বলে আমি তোমাদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম এখন ভরা মজলিসে আমার মেয়েকে এভাবে হেনস্তা করার সাহস কি করে হলো?
কাদের শিকদার পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে গেল। দিদার হাসানের কাছ থেকে রফিক চৌধুরী কে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“-এখন এসব করে লোক হাসাবি নাকি? পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে আমাদের।
“-কি সামাল দেব আমি? আমার মেয়ে এখানে অপেক্ষা করছে আর ওই বদমাইশের বাচ্চা কি না নিজের মতামত এখন জানাতে এসেছে? একটা মাস ওর হাতে সময় ছিলো ও কেন তখন জানালো না? আমি ওকে মেরেই ফেলবো। কোনো সম্পর্কের গন্ডি আমি আর মানবো না।
“-দিদার শান্ত হ! কি করছিস? দেখ আমি বুঝতে পারছি তোর অবস্থা কিন্তু ফারহিনের দিকে তাকা। মেয়েটা শকে আছে তুইও এভাবে পাগলামী করলে হবেনা।
“-আমি এই মুহুর্তে কি করবো? আমি নিজেকে এত অসহায় কখনো পাইনি যতটা আজ পেয়েছি।
“-দিদার! তুই যদি রাজি থাকিস আমি ফারহিনকে আরশের জন্য নিয়ে যেতে পারি।
দিদার হাসান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।
“-দয়া দেখাচ্ছিস? লাগবেনা তোর দয়া।
“-তুই ভুল বুঝছিস। ফারহিনকে আমি অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম আরশের জন্য, কিন্তু আমি বলার আগেই তুই ওর বিয়ে অন্যত্র ঠিক করে দিয়েছিলি বলে বলা হয়নি।
ভ্রু কুঁচকে তাকালো দিদার হাসান। কাদের শিকদার ইশারায় সম্মতি প্রদান করলো৷
“-কিন্তু আরশ?
“-আরশের কথা চিন্তা করিস না! আমি তোকে পরে সব বলবো আপাতত পরিস্থিতি সামাল দে ভাই।
আরশের গাড়ি এসে গেইটে থামতেই কাদের শিকদার তাকালো। আরশ গাড়ি থেকে নেমে হাতে লাল গোলাপের ফুলের তোড়া নিলো। কালো রঙের স্যুট পরেছে সে। মার্জিত পোশাকে বেশ মানিয়েছে। ফুলের তোড়া হাতে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো।
“-হাই বাবা!
কাদের শিকদার দিদার হাসানের দিকে তাকালো। দিদার হাসান অন্য দিকে তাকালো। চরম লজ্জার মুখে পরেছে সে। কাদের শিকদার বুঝতে পারলো, তিনি কঠিন কন্ঠে সরাসরি ভাবেই প্রশ্ন করলেন-
“-ফারহিন কে বিয়ে করবে?
আরশ থতমত খেল।
“-এসব কি ধরনের মজা করছো বাবা?
“-আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার হ্যাঁ বা না তে উত্তর দাও। মনে রেখো, আজ তোমার উত্তরের উপর আমার আর তোমার আঙ্কেলের মান সম্মান নির্ভর করছে।
আরশ দিদার হাসানের দিকে তাকালো। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল-
“-বাবা!
“-আরশ..! হ্যাঁ বা না..
আরশ ফারহিনের দিকে তাকালো। ফারহিনের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আরশ বলল-
“-হ্যাঁ করবো।
★সমস্ত ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে বিয়ে সম্পন্ন হলো আরশ আর ফারহিনের। কবুল বলার সময় ফারহিন আরশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আরশের চোখাচোখি হওয়ার পরও ফারহিন চোখ সরালো না। চোখ ভর্তি পানি, লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগা। আরশকে বার বার বিব্রত করছিলো। এই চেহারায় এই রুপ দেখতে সে অভ্যস্ত নয়। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর বিদায় হওয়ার সময় ও চুপ ছিলো ফারহিন। তীব্রের করা আঘাত, অপমান ফারহিনকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিলো। ফারহিন শক্ত প্রাণহীন পাথরের মত ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলো।
আরশের গাড়ি বাড়ির সামনে থামলো। আরশ গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে দিলো৷ ফারহিন তখনও অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলো। আরশ বুঝতে পেরে ডাকলো-
“-ফারহিন! বাড়ি এসে গেছি..
আরশের ডাকে ফারহিনের ঘোর কাটলো। আরশের দিকে তাকাতেই দেখলো আরশ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফারহিন হাত দিলো না। নিজে নিজে নামার চেষ্টা চালালো। কিন্তু ভারী লেহেঙ্গায় ফারহিন পেরে উঠলো না। লেহেঙ্গা পায়ের সাথে আটকে পড়ে যেতে নিলেই আরশ ধরে নিলো। দুজনে মুখোমুখি হলো। আরশ বলল-
“-এই কারণে বলেছিলাম আমার কথা শোনো। আমার কথা শুনলে এমন হতো না।
ফারহিন নেমে দাঁড়ালো। আরশের হাত থেকে হাত সরিয়ে নিলো।
আরশের বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই আরশ ফারহিনের দিকে তাকালো। ফারহিনের হাত ধরে নিলো। ফারহিন তাকাতেই হালকা হেসে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। ফারহিন কে ড্রয়িংরুমে বসালো। কাদের শিকদার এসে বসলো।
“-তোমার কোনো অসুবিধে হলে আমাকে বলবে। আমি তোমার বাবার মতই। আর একদম লজ্জা পাবেনা কিছুতে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। ওখানে তো কিছু খাওয়া হয়নি, আমি রুমে খাবার পাঠিয়ে দেব কারো হাতে।
“-লাগবে না। আমার খিদে নেই।
“-ফারহিন! বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে। আমি তোমার জন্য বেশি কিছু করতে পারিনি, আমার বাড়িতে কোনো মেয়ে মানুষ ও নেই, তবে আমি তোমার যত্নের ক্রুটি রাখবোনা। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। এখন যাও মা ফ্রেশ হয়ে নাও। আর কিছু মনে ধরে রেখো না। এটা তোমারই বাড়ি। আমরা কাল সকালে কথা বলবো, আজ তো অনেক রাত হয়ে গেছে তোমার রেস্টের প্রয়োজন।
“-আচ্ছা।
“-আরশ! ওকে নিয়ে যাও।
আরশের দিকে তাকিয়ে বলল কাদের শিকদার। কথা শেষ করে কাদের শিকদার চলে গেলেন। আরশ হাত বাড়িয়ে দিলো। ফারহিন সেটা এড়িয়ে উঠে দাঁড়াতেই আরশ মুখোমুখি দাঁড়ালো। বলল-
“-এখন থেকে এই হাত ধরেই চলতে হবে। তাই অভ্যাস করো আস্তে আস্তে। কাম অন।
আরশ হাত আবারও বাড়িয়ে দিলো। ফারহিন হাতের দিকে তাকিয়ে আরশের দিকে তাকালো। তারপর কঠিন কন্ঠে বলল-
“-কারো উপর ভরসা করতে নেই। সুযোগ পেলে ধোকা সবাই দেয়।
“-আমার উপর করো, বিশ্বাস রাখো। পুরো দুনিয়া বেইমানি করলেও আরশ শিকদার তোমার সাথে বেইমানি করবেনা।
তোমাকে আরশ কখনো ধোকা দেবেনা।
“-সান্ত্বনা দিচ্ছেন?
“-আমার সান্ত্বনা দেওয়ার অভ্যাস নেই।
“-তাহলে..?
“-আস্তে আস্তে তুমি সব বুঝে যাবে। এবার রুমে যাওয়া যাক?
ফারহিন আরশকে এড়িয়ে সামনে পা বাড়ালো। আরশ পিছু পিছু গেল। দোতালায় উঠে ফারহিন দাঁড়ালো। কোনটা আরশের রুম তা ফারহিন তো চেনেই না। ফারহিন কে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে আরশ হাসলো, বলল-
“-আগেই বলেছিলাম শুনলে না।
আরশ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ফারহিন রুমের দরজায় পা বাড়াতেই আরশ থামিয়ে দিলো। বলল-
“-কোথায় যাচ্ছো?
“-রুমে..
“-ইউ নো! আমার ইচ্ছে ছিলো আমার বউ এই রুমে আমার হাত ধরেই আসবে। নাও ধরো..
আরশ আবারও হাত বাড়িয়ে দিলো। ফারহিন মুখ ফিরিয়ে নিতেই আরিশ খপ করে ফারহিনের হাত ধরলো। ফারহিন আচমকা এমন হওয়ায় চমকালো। আরশ হাত ধরে রুমে প্রবেশ করালো। বলল-
“-ওখানে কাবার্ড আছে, বাথরোব, টাওয়েল সব পাবে। ফ্রেশ হয়ে যাও।
“-আমার জামা কাপড়?
“-নিয়ে আসোনি?
“-না। আমিতো..
“-বুঝতে পেরেছি। ভালো করেছো নিয়ে আসোনি। এখানে রাখা আছে যেটা ইচ্ছে পরে নিও। আর হ্যাঁ রঙ নিয়ে কথা বলবেনা। সব আমার পছন্দের রঙেই কেনা।
কাবার্ডের দিকে ইশারা করে বলল আরশ। ফারহিন ভ্রু কুঁচকালো। বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে বলল-
“-আপনার মানে? কার জন্য কিনেছেন।
“-তোমার জন্য। বলেই আরশ ওয়াশরুমের দিকে হাটা দিলো। ফারহিন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“-আমার জন্য মানে?
ফারহিন কাবার্ড খুলতেই দেখলো কাবার্ড ভর্তি শাড়ি। ফারহিনের মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেল। এত শাড়ি? কালো, অ্যাশ, খয়েরী, ব্লু। এই চারটা রঙের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আরশ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো কাবার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফারহিন। মাথা মুছতে মুছতে বলল-
“-দেখা শেষ হলে যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
“- এত শাড়ি..
“-তোমার জন্য বললাম না? যাও..
“-আপনি একটু বাহিরে যাবেন?
“-কেন? ভ্রু কুঁচকালো আরশ।
“-ওয়াশরুমে শাড়ি পরা যাবেনা।
“-ওখানে নিচের তাকে কিছু সালোয়ার স্যুট আছে রাতে পরার জন্য। তুমি রাতেও শাড়ি পরে থাকবে নাকি? যাও ওখান থেকে পরো। আশাকরি ফিট হবে।
“-আপনি তারপরও বাহিরে যান। আমি কমফোর্ট ফিল করছিনা।
“-অভ্যাস করে নাও। আজ যাচ্ছি প্রথম ও শেষ বারের মত।
বলেই আরশ বেরিয়ে গেল। আরশের আচরণ, কথাবার্তা সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ফারহিনের। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় মাথার প্রেশার পড়েনি তো?
★সিগারেট মুখের কাছে এনে টান দিলো আরশ। সিগারের ছাই ঝেড়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে ছাদে থাকা চেয়ারে বসে পড়লো। সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলল-
“-জীবন কত অদ্ভুত! মানুষ নিজের জন্য কতকিছু করে। আমিও তাই করেছি। এক জীবনের একটা চাওয়া যদি পূরণ না হয় তাহলে কি লাভ জীবন রেখে? আমি জানতাম ফারহিন তুমি আমারই হবে। মাঝখানে পড়ে তোমাকে একটু কষ্ট দিতে হলো, কিন্তু কি করতাম বলো, তোমার সাথে তীব্রের বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। যখন থেকে জানলাম তীব্রের সাথে তোমার বিয়ে হবে তখন থেকেই আমার মেজাজ আগুনের লাভার মত বুদবুদ করছিলো। আমি এতটা মহান নই যে নিজের বন্ধুত্বের জন্য ভালোবাসা কোরবানি দিবো। আমি সেসব মানুষের কাতারে পড়িই না যারা অন্যের কথা ভাবে। আমি প্রচুর স্বার্থপর। তোমার জন্য, তোমার ক্ষেত্রে আমি কোনো কম্প্রমাইজ করবো না। তাই নিজের এই অস্থির ব্রেইন টাকে সামান্য কাজে লাগালাম। তোমার জন্য আমি তীব্রের মত বন্ধু কেন হাজারটা মানুষ কে ত্যাগ দিতে পারি। আমি তীব্রের মত এত মহান মোটেও নই ফারহিন, যে বন্ধুর জন্য নিজের ভালোবাসা ত্যাগ দেব। এমন ভালোবেসে কি লাভ যে ভালোবাসা ত্যাগ দিতে দুবার ভাবে না মানুষ? ওটাকে আমি ভালোবাসা মনেই করিনা। ভালোবাসা হতে হবে শ্বাসরুদ্ধকর, ভালোবাসা হওয়া চাই বিনাস্বার্থ, সব সম্পর্কের উর্ধে। তুমি আমার সব কিছুর উর্ধে ফারহিন। তোমার আগে আমার জীবনে কেউ না, আমি নিজেও না। অবশেষে, তুমি আমার। তোমার উপর শুধু আমার অধিকার, আমার হক, আমার সব।
বলেই হাসলো আরশ। সিগারেট শেষ করে মাথা এলিয়ে দিলো। ঘনকালো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে।
#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-৮||
★ফ্ল্যাশব্যাক..
এই প্রথম আরশ বাবার সাথে কারো ইনভাইটেশনে যাচ্ছে। নিজেই ড্রাইভ করলো। কাদের শিকদার পুরো রাস্তা শুধু আরশকেই দেখছিলো। গুনগুনিয়ে গান করতে করতে প্রফুল্লচিত্তে সে ড্রাইভ করছে। কাদের শিকদার বুঝতে পারছেনা কিসের এত আনন্দ। ফারহিনের বিয়ে কিছুদিন পর, যদি আরশ ফারহিন কে পছন্দ করেই থাকে তাহলে কেন তার এত আনন্দ? ছেলের ভাবসাব ভালো ঠেকলো না। হর্ণ দিতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিলো। আরশ গাড়ি পার্কিং করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। পরনের স্যুট ঠিক করে ঘুরে দাঁড়ালো। পুরো বাড়ি ডেকোরেশন করা। জমকালো সাজ বাড়ির। বাবার ইশারায় আরশ সামনে পা বাড়ালো। বাবা ছেলে একসাথেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রবেশের সময় আরশ এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। হয়তো তার দৃষ্টি ফারহিন কে খুঁজছে। এদিক ওদিক তাকানোর খেয়ালে আরশের পা কার্পেটে আটকে গেল। আরশ উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ একজন হাত টেনে ধরলো। আরশ দ্রুত পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো ফারহিন। আরশের দেওয়া ব্রাউন রঙের গাউনটাই পরেছে। আরশ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফারহিনের দিকে। ফারহিন হালকা হাসলো, বলল-
“-কোনদিকে তাকিয়ে হাটছিলেন?
“-কোনোদিকেই না।
“-দেখে শুনে চলুন। ভরা মজলিসে নাহলে বেইজ্জতি হয়ে যাবে।
“-আচ্ছা।
ফারহিন চলে গেল। আরশ ফারহিনের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলো। কাদের শিকদার ধীর গতিতে এসে দাঁড়ালো পাশে। আরশের চোখ যেন কথা বলে। হয়তো সে চেয়েছিলো ফারহিন থাকুক চলে না যাক। কাদের শিকদার এই প্রথম আরশের চোখের ভাষা বুঝলো। ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বলল-
“-এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি আলাপ ও করবে?
“-চলো। আরশ পা বাড়াতেই আরশের ফোন বেজে উঠলো। আরশ বলল-
‘-তুমি যাও আমি আসছি।
আরশ বাড়ির বাহিরে চলে এলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ম্যানেজার বলল-
“-স্যার আমি এহমাদ।
“-জি বলো?
“-স্যার মিটিংয়ের ডিটেইলস আর পেপারস মেইল করেছি আপনি চেক করে নিয়েন।
“-ওকে..
ফোন রেখে ফিরতেই ফারহানার মুখোমুখি হলো আরশ।
“-হাই ভাইয়া!
“-হাই!! কেমন আছো?
“-অনেক ভালো। আপনি?
“-এইতো ভালো।
“-ভাইয়া আপনাকে দারুণ লাগছে।
“-থ্যাংক ইউ। তুমি কি আজ রাত এখানেই থাকবে?
“-হ্যাঁ। ফারহিনের বিয়ে তো সামনে তো আমি কয়েকদিন এখানেই থাকবো।
আরশের মুখ মলিন হয়ে গেল। তবুও মুখে হাসি রাখার চেষ্টা চালালো বলল-
“-ওহ্! তা তোমার ফ্রেন্ডের হবু হাসবেন্ড এর ছবি নেই?
“-আছে তো ওয়েট দেখাচ্ছি।
বলেই ফারহানা ফোনের লক খুলল। হঠাৎ গাড়ির হর্ণ শুনে ফারহানা তাকালো। গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে তীব্র নেমে এলো। তীব্র কে দেখে ফারহানা বলল-
“-ছবি দেখতে হবেনা সরাসরিই দেখে নিন। ওইযে ওটা ফারহিনের উডবি।
আরশ ফারহানার হাত অনুসরণ করে তাকাতেই চরম বিস্ময়ে পৌঁছে গেল। অস্ফুটস্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো-
“-তীব্র!!
★তীব্র কে দেখার পরপরই আরশ চলে এসেছে। তীব্র কে দেখা দেয়নি। তীব্র ফারহিনকে পছন্দ করে, ফারহিনের সাথেই ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে এই একটা ব্যাপার আরশ মেনে নিতে পারছে না। দ্রুত গাড়ির ব্রেক করলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালো। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে। নির্জন রাস্তায় আরশ গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিলো। গাড়ির গ্লাসেই প্রচন্ড জোরে ঘুষি বসালো। একের পর এক আঘাতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কাঁচের টুকরো আরশের হাতে বিধে গেছে। আরশ ঘুরে দাঁড়িয়ে গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে রাস্তায় বসে পড়লো। হাত থেকে অঝোর ঝারায় রক্ত ঝরছে। ডান হাতটা চোখের সামনে ধরতেই হাতের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে আরশ রক্তে মাখা হাতেই নিজের মাথার দুপাশ চেপে ধরলো। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। এই মুহুর্তে সে কিছুতেই ড্রাইভ করতে পারবেনা। এমন উত্তপ্ত মেজাজে সে কিছুতেই ড্রাইভ করতে পারবেনা বলেই রাস্তাতেই বসে রইলো৷ রক্ত যেন বাধা মানছে না। নিজ গতিতে গড়িয়ে পড়ছে। রাস্তায় রক্তের দাগ, কোর্ট শার্ট রক্তে ভিজে একাকার। চোখে ঝাপসা দেখছে আরশ। চারপাশ ঘোলা লাগছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। চোখের সামনে আবারো হাতটি তুলে ধরলো। হাতের করুন দশা দেখে আরশ হেসে উঠলো, বলল-
“-আমি কিছু চাইনি। এই প্রথম কিছু চাইলাম তাও কিনা অন্যের হয়ে যাবে? আমার ভাগ্য এতটা খালি করে আমাকে কেন দুনিয়াতে পাঠালে আল্লাহ? আমার তো কেউ নেই। বাবা থেকেও ছিলো না। আর মা তাকে তো আমি দেখিও নি। তাহলে কেন আজ এই দিন দেখালে? কেন এমন একটা পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করালে? আমার জিনিস, আমার সুখ তুমি অন্যকে দিয়ে কি শান্তি পাও? আমার কথাটা কখনো ভাবলে না তুমি? আমি কি নিয়ে থাকবো, কিভাবে আমার জীবন চলবে আমায় নিয়ে ভাবোনি? কেন আমার প্রতি তুমি এত উদাসীন? কেন?
আরশ থামলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে বলল-
“-ইম্পসিবল। তীব্রের কাছে সব আছে। মা, বাবা সব। আমার কাছে নেই। আমি কখনোই আমার কাছ থেকে ফারহিনকে দূরে যেতে দেব না। তাতে যদি আমায় তীব্রের কাছ থেকে ওকে কেড়ে নিতে হয় আমি তাই করবো। আমি এতটা দয়ালু না। আমি আমার জিনিস, আমার জায়গা কখনো অন্য কারো জন্য ছেড়ে দেব না। ফারহিন শুধু আমার। ফারহিন আমার! আমি কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেব না। এতে যা করার প্রয়োজন আমি করবো। আমি অনেকদিন তোমার উপর ভরসা করে ছিলাম, আর না। তুমি কখনো আমার সঙ্গ দাওনি, তুমি সবসময় আমাকে এক পাশে সরিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে ভেবেছো। কিন্তু এবার তা হবেনা। এবার আমি আমাকে নিয়েই ভাববো। ফারহিনের জন্য যদি সবাইকে ত্যাগ দিতে হয় আমি তাই দেব। আমার ওকেই লাগবে, পুরোপুরিভাবেই। তীব্রকে সরে যেতেই হবে। হয় নিজ ইচ্ছায়, নাহলে সরানোর মাধ্যম আমার জানা আছে।
আরশ উঠে দাঁড়ালো। গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়লো। রক্তাক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরতেই হাতে চাপ পড়লো। রক্ত আরো জোরে ছিটকে বেরিয়ে এলো। আরশ স্টিয়ারিং এ শক্ত করে চাপ দিতেই রক্ত প্রচন্ড ধারায় বইছে। স্টিয়ারিং চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আরশ গাড়ি স্টার্ট দিলো, খুব স্পীডে।
★কাদের শিকদার এর ফোন বেজে উঠলো। দিদার হাসানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে ফোনটা রিসিভ করলো৷ ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“-হ্যালো কে বলছেন?
“-কে বলছি মানে? এটা তো আমার ছেলের ফোন আপনি কোথায় পেলেন?
“-স্যার এখানে একটা গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি ট্রাফিকে ডিউটিরত পুলিশ বলছি। আপনার ছেলের খুবই বাজে অবস্থা দ্রুত চলে আসুন। তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
“-আমি আসছি। আপনি এড্রেস আমায় মেসেজ করে দিন।
কাদের শিকদার হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। দিদার হাসান এমন অস্থিরতা দেখে প্রশ্ন করলো-
“-কি হলো? আপসেট দেখাচ্ছে কেন এত?
“-আরশের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমায় যেতে হবে।
“-গড! চল আমিও সাথে যাবো।
“-পার্টি ছেড়ে?
“-পার্টি পরেও পাওয়া যাবে কিন্তু ছেলে পাওয়া যাবেনা। চল!
দুজনেই বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্য। কাদের শিকদার বুঝলো না আরশের কি হলো। এখানে আসার সময় তো ভালোই হাসিখুশি ছিলো, হুট করে কি এমন হলো যে আরশ না বলে চলে গেল। আর এমন অঘটন ঘটলো কীভাবে? দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কাদের শিকদারের অস্থিরতা কমাতে দিদার হাসান বললেন-
“-কিছু হবে না আরশের।
কাদের শিকদার তাকালো। নিজেকে অসহায় লাগে তার খুব। ছেলের বেহাল দশা, এমন বার বার আঘাত মেনে নিতে পারে বা তিনি।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আরশ ড্রাইভ করতে করতেই সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো৷ গাড়ি ব্রেইক ফেল করে এক্সিডেন্ট হতে হতে বাঁচলো। কেবিনের বাহির থেকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল কাদের শিকদার। সেন্স এখনো ফেরেনি তার। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, এক হাতে ব্যান্ডেজ, স্যালাইন, ব্লাড চলছে। হাতে ক্যানুলা লাগানো। চোখ থেকে নিজের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়লো কাদের শিকদার এর। নিজেকে সবচেয়ে বড় অপরাধী মনে হয় তার। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে কখনো আরশ কেমন আছে সে জানতেই চায়নি। আর আজ তার একমাত্র ছেলের জীবন এমন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দিদার হাসান ডাকলো-
“-সুস্থ হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।
“-নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবোনা। ওর আর আমার মধ্যে অনেক বড় দেওয়াল দিদার। যা আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। আমি কখনো ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করিনি৷ কখনো ওকে বোঝার নুন্যতম আগ্রহ দেখাই নি। আমার ছেলেকে আমিই আজীবন একাকিত্বের অতলে ঠেলে দিলাম।
“-কাদের! এসব ভেবে লাভ নেই। ওর খেয়াল রাখ তুই। ওকে এভাবেই ছেড়ে দিস না। আগে পারিস নি। এখন তো পারবি, এখন সময় দে।
“-কিছু কিছু দূরত্বের অবসান হয়না।
★ছাদের এক পাশে রেলিং নেই। সেখানে পা ঝুলিয়ে বসে আছে ফারহিন আর ফারহানা। তীব্র ছাদে গিয়ে ফারহিন কে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। দুজনের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল-
“-আমি একটু বসতে পারি?
ফারহানা দ্রুত উঠে দাঁড়ালো৷
“-আরে ভাইয়া কেন নয়? বসুন না প্লিজ।
তীব্রকে বসতে দিয়ে ফারহানা চলে গেল। ফারহিন কিছু বলার সুযোগ ও পেল না। ফারহানা চকে যাওয়ার পর ফারহিন উঠে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যত হলে তীব্র আটকালো।
“-একটু থাকো? যেও না।
“-কেন? বেইজ্জতি বাকি আছে?
“-আমি তোমাকে কোনো বেইজ্জতি করতে চাইনি ফারহিন। আমি সেদিন তোমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করিনি রিজেক্ট করেছি আমি জানি। তোমার এসএসসি পরীক্ষা চলছিলো। শুধু তাই না আমি সত্যিই সেদিন ভেবেছিলাম বয়সের প্রভাবে, আবেগে এসব হয়েছে।
ফারহিন ঘুরে তাকালো দ্রুত। তীব্র আবারও বলল-
“-সেদিন তোমার ওই কান্না ভেজা চোখ আমার চোখের ঘুম হারাম করে নিয়েছিলো, আমি চুপচাপ সহ্য করেছি সেই অস্থিরতা। নিজের ভেতর কেন এত অস্থিরতা হচ্ছিলো আমি বুঝতে পারিনি। আমি কোনো মেয়ের সাথে নিজের জীবন জড়াইনি। নিজেকে আলাদা রেখেছি। কেন তাও জানিনা। কারো মাঝে আগ্রহ পাইনি কেন তাও জানিনা। পরে বুঝতে পারলাম আমি তাকে ভালোবাসি যাকে আমি দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। আমি তোমার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম নিজ অজান্তে। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি..
“-আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না তীব্র। কারণ আপনিই বলেছিলেন আপনার মুড চেঞ্জ হয়। মনে আছে? জানিনা এই মুড টা কখন আবার চেঞ্জ হয়ে যাবে। কখন আবার মনে হবে ফারহিন আপনার জন্য যোগ্য না।
তীব্র ফারহিনের ঠোঁটে আঙুল ঠেকালো। আর বলতে দিলো না। এক হাতের এক আঙুল ঠেকিয়ে অন্য হাত উচু করে একটা লকেট দেখালো। ফারহিন লকেটের দিকে তাকালো। লকেটে গোলাকার একটা আয়না আছে। সেই আয়নাটা বক্স সিস্টেম। তীব্র সেটা সরাতেই দেখলো ওখানে দুটি এলফাবেট। একটা ‘T’ অন্যটা ”F’। ফারহিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তীব্র লকেট টা ফারহিনের গলায় পরাতে পরাতে বলল-
“-এটা কেন আড়ালে দিয়েছি জানো? কারণ আমিও এতদিন আড়ালে থেকেই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।
কথাটা তীব্র একদম ফারহিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল। ফারহিন সরে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তীব্র ফারহিনের অনেকটা কাছেই চলে এসেছে। হঠাৎ তীব্রের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। তীব্র স্তম্ভিত ফিরে পেল। দ্রুত সরে গেল। ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কি বলল ফারহিন শুনতে পেল না। তীব্র ফোন রেখে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ফারহিন কে বলল-
“-আমার বেস্টফ্রেন্ড হসপিটালে এডমিট, আজ আসি! অন্যদিন কথা হবে।
ফারহিন কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তীব্র স্থান ত্যাগ করলো। ফারহিন ছাদ থেকে তীব্রের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। বার বার লকেটটা নিজ হাতে স্পর্শ করছে। গাড়ি দ্রুত বেগে বের হয়ে গেল।
চলমান….
||!||