শেষটা সুন্দর পর্ব -০৮

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৮।

‘কিরে, না খেয়ে শুয়ে আছিস কেন?’

‘মা, আমি খেয়ে এসেছি।’

‘কোথা থেকে খেয়ে এসেছিস?’

‘তোমাদের জামাইয়ের সাথে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে এসেছি।’

রামিনা বেগমের চোখ মুখ পাল্টে গেল। তিনি খুশি হয়ে বললেন,

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ মা, সত্যি।’

রামিনা বেগম বেশ শান্তি পেলেন যেন। মেয়েটা আস্তে আস্তে সম্পর্কটা মেনে নিচ্ছে। তিনি বললেন,

‘আচ্ছা তাহলে, তুই এখন রেস্ট নে। আমি যাই।’

রামিনা বেগম বেরিয়ে যাওয়ার পর মেহুল রিতাকে কল করে। ওকে সব খুলে বলার পর রিতা বলল,

‘দেখেছিস, আমি বলেছি না ভাইয়া সব কিছু মেনে নিবেন।’

‘হ্যাঁ, এখন দোয়া কর, উনার মাও যেন মেনে নেন।’

‘নিবেন নিবেন। ভাইয়া একটু বুঝিয়ে বললেই উনি সব মেনে নিবেন।’

________

বৃদ্ধ লোকটা কাঁদতে কাঁদতে রাবীরের সামনে এসে বসল। রাবীর ফাইল সরিয়ে উনার দিকে চেয়ে বলল,

‘কী হয়েছে?’

‘বাবা, বাবা ঐ কালাম দোকানডা আমারে দিতাছে না। ওর মাল দোকান থেইকা এখনও বাইর করে নাই। আমি কেমনে দোকানে বসতাম কন? আপনি কিছু করেন না, বাবা।’

রাবীর রাগে গজগজ করতে থাকে। সে ইশারায় একজনকে ডাকে। বলে,

‘পুলিশকে কল দিয়ে আসতে বলো। বেটাকে আর এত সহজে ছাড়া যাবে না। যা শুরু করেছে, জেলে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই দেখছি।’

‘ঠিক আছে, স্যার। আমি এক্ষুনি পুলিশকে সব জানাচ্ছি।’

_________

মাগরিবের আজান হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। মেহুলের ঘুম এখনও ভাঙেনি। ঘড়িতে তখন সাতটা বেজে দশ মিনিট। তার ফোনটা তখন বেজে উঠে। ঘুমের ঘোরে ফোনের এই শব্দটা মারাত্মক রকমের বিকট লাগে তার কাছে। ফোনটা হাতরে বের করে রিসিভ করে। দেখেওনি কে কল দিয়েছে। সোজা কানে নিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলে,

‘হ্যালো!’

‘কেমন আছো, মেহুল মা?’

“মা” সম্বোধন শুনে খানিকটা ভড়কে যায় সে। তাকে এমন মা বলে কেবল তার বাবা’ই ডাকে। কিন্তু, এটা তো মহিলার কন্ঠস্বর। ইনি কে? মেহুল ঘুমের ঘোরেই বলল,

‘কে আপনি?’

‘ওমা, চিনতে পারোনি? আমি তোমার শাশুড়ি, রাবীরের মা।’

মেহুল এক লাফে উঠে বসে। অস্থির হয়ে বলে,

‘আসসালামু আলাইকুম, মা। আসলে আপনার নাম্বারটা সেইভ ছিল না তাই চিনতে পারিনি। কিছু মনে করবেন না, আমি আসলে..’

‘আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে, আমি বুঝতে পেরেছি। এত অস্থির হতে হবে না। তা মা, ভালো আছো তো?’

‘জি, আমি খুব ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ মা, আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। সকালে তোমার মা বাবার সাথে আমার কথা হয়েছিল, তুমি তখন ভার্সিটিতে ছিলে বলে আর কথা বলা হয়নি। তাই ভাবলাম, এখন একটু কল দিয়ে খোঁজ নেই।’

মেহুল হেসে হেসে বলে,

‘ওহ।’

‘আচ্ছা, তাহলে তুমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও। পরে আবার কথা হবে তাহলে। রাখছি এখন, কেমন?’

‘মা..’

‘হ্যাঁ, কিছু বলবে?’

মেহুল ইতস্তত স্বরে বলল,

‘আপনার ছেলের সাথে আপনার কথা হয়েছে?’

‘তা কী করে হবে বলো? সেই যে সকালে বেরিয়েছে এখনও বাসায় ফেরার কোনো নামই নেই। তোমাকেও বুঝি সময় দিতে পারছে না? আসলে বুঝোই তো, এই রাজনীতিতে কত চাপ। সারাক্ষণ একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। তুমি কিছু মনে করো না, আমি রাবীরকে বলে দিব তোমাকে যেন সময় দেয়। তোমার সাথে কথা বলে। তুমি মন খারাপ করো না, কেমন?’

মেহুল আলতো হেসে বলে,

‘না না, মা। আমি মন খারাপ করিনি। আমি বুঝি, উনি খুব ব্যস্ত মানুষ। সমস্যা নেই, যখন ফ্রি হবে তখন কথা বললেই চলবে।’

‘আচ্ছা, আমি ওকে বলে দিব। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। রাখছি মা, ভালো থেকো।’

‘আচ্ছা মা। আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’

ফোনটা রেখে মেহুল মনে মনে বলল,

‘কবে আপনার এত ব্যস্ততা শেষ হবে, নেতা সাহেব? আর কবেই বা আপনি আপনার মা’কে সবকিছু বলবেন? আমার যে আর এত ধৈর্য্য ধরতে ইচ্ছে করছে না।’

________

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেহুল গিটারে সুর তুলে। টুংটাং টুংটাং করে সেই সুর বাজছে। সে তখন চোখ বুজে মৃদু সরে গেয়ে উঠে,

‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল
বাতাসের আছে কিছু গন্ধ
রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি
তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ

আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল
বাতাসের আছে কিছু গন্ধ
রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি
তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ

আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল
বাতাসের আছে কিছু গন্ধ

আমার এ দু’হাত শুধু রিক্ত
আমার এ দু’চোখ জলে সিক্ত

আমার এ দু’হাত শুধু রিক্ত
আমার এ দু’চোখ জলে সিক্ত

বুকভরা নীরবতা নিয়ে অকারণ
বুকভরা নীরবতা নিয়ে অকারণ
আমার এ দুয়ার হলো বন্ধ।’

‘হয়েছে?’

মেহুল চমকে পেছনে তাকায়। বলে,

‘মা, তুমি?’

‘এই গিটার আর গানে সুর না ধরলে হয় না?’

‘কেন মা, কী হয়েছে?’

‘তোমার শাশুড়ি যে নিষেধ করেছেন, সেটা কি ভুলে গিয়েছ?’

মেহুল মৃদু হেসে বলল,

‘কিছুদিনের মধ্যে দেখবে আবার উনিই আমাকে গান গাওয়ার কথা বলছেন।’

‘আচ্ছা, আগে তেমনটা হোক। তার আগ অবধি এই গান আর গিটার থেকে দূরে থাকাটাই তোমার জন্য মঙ্গল।’

এই বলে রামিনা বেগম চলে গেলেন। মেহুলের মন খারাপ হয়ে গেল। তার চাচি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মেহুলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,

‘মা বকেছে?’

‘আচ্ছা চাচি, মা হঠাৎ এমন করে বদলে গেল কেন? মা তো কখনো এমন করেনি। আমি গান গাইলে মা বরং খুশি হতেন। অথচ এখন, কেমন রাগ দেখান। যেন গান গাওয়া উনি একদম সহ্যই করতে পারেন না। মা কেন এমন করছে, চাচি?’

চাচি মেহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

‘প্রত্যেক মা চায়, তার মেয়ের বিবাহিত জীবন যেন সুখের হয়। তোমার মা তো দুশ্চিন্তা করেন। ভাবেন, তোমার এই গান গাওয়া নিয়ে যদি তোমার শ্বশুর বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়। যদি তোমার সাথে উনারা খারাপ ব্যবহার করে ফেলেন। তাই তিনি তোমাকে আগে থেকেই নিষেধ করছেন, তোমার কথা ভেবেই করছেন। কেবল তুমিই সেটা বুঝতে পারছ না।’

‘চাচি, আমি গান গাইতে পারলেই সুখে থাকব। মাও সেটা জানে। উনারা আমাকে গান গাইতে না দিলে আমিও উনাদের মেনে নিব না। তুমি গিয়ে এটা মা’কে বলে দিও।’

‘হ্যাঁ, তারপর তোমার মা আমাদের দুজনকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে আসবেন। সেটাই চাও তুমি, তাই না?’

চাচির কথা শুনে মেহুল হেসে বলে,

‘সমস্যা নেই, তখন তোমার বিদেশী জামাই তোমাকে এসে বাঁচাবেন আর আমার নেতা সাহেব আমাকে এসে বাঁচাবেন।’

চাচি তখন ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

‘ওহহো! আমার নেতা সাহেব, তাই না..হু?’

চাচির কথার শুনে মেহুল যেন লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা নিচু করে বলে,

‘যাও তো চাচি, আমি এখন মজা করার মুডে নেই।’

চাচি হেসে বললেন,

‘তা মুড চেঞ্জ করার জন্য আপনার নেতা সাহেবকে ডাকব নাকি?’

মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘উফফ, চাচি!’

চাচি হেসে সেখান থেকে চলে যান। মেহুল জোরে নিশ্বাস ফেলে। অবাক হয় সে। সে কি আজকাল একটু বেশিই রাবীরের কথা ভাবছে? তবে কি সে এত তাড়াতাড়িই রাবীরের উপর ঈম্প্রেসড হয়ে গেল? না না, মোটেও এত তাড়াতাড়ি লোকটার উপর ইম্প্রেসড হওয়া যাবে না। লোকটাকে আরো ঘুরাতে হবে। আরো পরীক্ষা করতে হবে। তারপর সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই সে একেবারে ইম্প্রেসড হবে। এর আগে না।

________

খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেহুল রুম জুড়ে পায়চারি করছে আর বারবার তার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। রাবীর এখনও কেন কল দিচ্ছেন না। মায়ের সাথে তার কথা হয়েছে কিনা কে জানে? মেহুলের বেশ অস্থির লাগছে। মা যদি রাজি না হয়, সেই ভয়ও পাচ্ছে সে। এদিকে রাবীরও কল দিচ্ছে না। সবমিলিয়ে তার এখন পাগল পাগল অবস্থা।

অপেক্ষার প্রহর শেষ করে অবশেষে তার কল এল। সে সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে বলল,

‘এতক্ষণ লাগে একটা কল দিতে? আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম জানেন?’

রাবীর ভীষণ অবাক হয়। বলে,

‘আপনি আমার কলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন? আমি তো ভাবতেই পারছি না, মেহুল।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here