শেষ পেইজ পর্ব -০৩

#শেষ_পেইজ
#পর্ব_3

– যেদিন আবীর আর বন্যা পালিয়েছিলো সেদিন ছিলো ওর বোনের বিয়ে। মানে আমার বিয়ে ছিলো৷ সেদিন বন্যার ও বিয়ে ছিলো৷
বন্যাও তার বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিলো।

আবীর পালিয়ে যাওয়ার কারণে আমার বিয়ে ভেঙে যায়। আর বাবা সেদিন রাতে হার্ট অ্যাটাক করে৷ সাত দিনের মতো হাসপাতালে যুদ্ধ করে৷ আবীর মোবাইল অফ করে সব ছেড়ে ছুড়ে পালিয়েছিল। যখন ওর ফ্যামিলি ওকে সব চেয়ে বেশি দরকার ছিলো।
দিনে রাতে পরিশ্রম করে আবীর কে পড়িয়েছিল আমার মা বাবা।
ছয় বছরে একটা শাড়ি কিনে নি মা। বাবা এক জোড়া জুতা। ছোট বেলা থেকে পড়াশোনায় ভালো থাকায় আর স্কলারশীপে পড়াশোনা করার সবাই আশায় বুক বেধেছিল আবীর ভালো চাকরি করবে সবার জীবন শুধুরে যাবে। আমাদের সবার আশার ভরসা ছিলো একমাত্র আবীর৷ বাবা তার সরকারী চাকরী দিয়ে ভালো ভাবেই মানুষ করেছিলো আমাদের।

বাবা মারা যাওয়া একদিন আগে আবীর কে মোবাইলে পাওয়া যায়। যখন আমি ওকে জানাই বাবার এই অবস্থা সে তখন ছুটে আসতে চায়। কিন্তু বন্যা আসতে চায় না।

তখন আমরা বলেছিলাম, ও যেন বন্যাকে সহ নিয়ে আসে। বাবা যেন ওকে একবার দেখতে পায়।

কিন্তু বন্যা আসতে রাজি ছিলো না। হয়ত ওর মা বাবার ভয়ে। তখন আবীর বলেছিল তাহলে তুমি এখানে থাকো৷ আমি গিয়ে ফিরে আসছি। বন্যা ভেবেছে আবীর ওকে ফেলে চলে যাচ্ছে। সেদিন থেকেই শুরু হয় বন্যা আর আবীরের ঝামেলা। বন্যার অভিযোগ। এতদিন এত ভালোবাসতে এখন সব পালালো তাই না?এই সেই। ওর জন্য কত ভালো ছেলে সে ফেলে এসেছে।

আবীর বন্যাকে ফেলেও আসতে পারছিল না। না পারছিল বন্যাকে নিয়েও।

তারপরও আবীর বন্যাকে ঘুমের মধ্যে রেখে বাবাকে দেখতে আসে।

আবীর আসার কয়েক ঘন্টা আগেই বাবা মারা যায়।
শেষ বারের জন্যেও বাবা আবীর কে দেখতে পায় নি।
মারা যাওয়ার আগেও বাবা একবার চোখ খুলেছিলো। আমরা সবাই থাকার পর ও বাবা পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে এক রাজ্য হতাশা নিয়ে চোখ বন্ধ করল। সে বন্ধ ছিল একেবারের জন্য বন্ধ।
বাবার চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি লেগে ছিলো মরার পর ও। কতটা কষ্টে। সে শুধু আমরা জানি আর বাবা জানে। শুধু আবীরের জন্য।

আবীর এসে দেখলো না বাবাকে৷ কিন্তু তারপর ও আমরা সব ভুলে গিয়ে ওকে বুকে টেনে নিলাম।
যখন বাবাকে কবরে নামানো হচ্ছিলো।

ঠিক তখন পুলিশ আসলো আবীর কে ধরার জন্য। বন্যার মা বাবা ওকে তাদের মেয়েকে কিডন্যাফের জন্য কেইস করেছে।গুম, হত্যার চেষ্টা। আরো কত কি?

আবীর বন্যার বাবার পায়ে পড়েছিলো। বলেছিলো,

-আমাকে আমার বাবার কবরে দেওয়ার কাজ টা শেষ করতে দেন। বন্যা ভালো আছে। আমি ওকে নিয়ে আসবো।
শুনে নি কেউ।
ওরা টেনে হিজড়ে নিয়ে গেল আবীর কে। বাবার করব দেওয়া তখনো শেষ হয় নি। মাত্র নামানো হয়েছিলো৷ মাটিও দেওয়া হয় নি। সাথে আমাকে আর মাকেও। আমরা সবাই আসামী।

যে মেয়ে সদ্য তার স্বামী হারিয়েছে৷ আর মেয়েটার সদ্য বিয়ে ভেঙেছে। তাদের কাটাতে হলো জেলে৷
তুমি কি মনে কর এইসব কোন সাধারণ ব্যাপার ছিলো?
যে মানুষ টা একটা জীবন এই সংসারের উৎসর্গ করে গেলো সে মানুষ টা ঠিক মতো যেতেও পারলো না। এক মুটো মাটিও পেল না সে ছেলের হাতে।

কীভাবে কেটেছিল তিন দিন দুই রাত আমি জানি না আমরা কেউ জানি না। আমাদের জন্য বা কে লড়বে তখন বাইরে। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। দুঃস্বপ্ন যেন৷ আর সে দুঃস্বপ্ন যে শুরু হয়েছিলো এখনো চলছে তা। আবীরের কয়েক জন বন্ধু মিলে বন্যাকে নিয়ে এলো। বন্যা অনেক বলার পর ও ওরা আমাদের ছাড়ে নি।

ওর মা বাবা শর্ত দিলো, যদি বন্যা ওদের কাছে ফিরে যায় তাহলে ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে।
বন্যা আর কোন উপায় না দেখে হয়ত রাজি হয়েছিলো। আবীর কে বাঁচাতে।

আমাদের ছেড়ে দিলো। কিন্তু আমরা আর স্বাভাবিক মানুষে জীবনে রইলাম না।
আমাদের ছা-পোষা জীবন যেন এক নরকে পরিণত হয়েছিলো।

জেল থেকে ফিরে মা কেও আমরা আর স্বাভাবিক ভাবে পাই নি। মা আর কথা বলত না। একদিকে তাকিয়ে থাকতো। কিছুই করত না। যেখানে বসিয়ে রাখা হতো সেখানেই রাত দিন কাটিয়ে দিতো বিনা বাক্যে।

আমার সহজ সরল মধ্যবিত্ত দুই বেলা রান্না করে, অল্প টাকায় সংসার চালিয়ে নেওয়া অতি সাধারণ মা টা, –

বাকি কথা বলার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন আবীর ভাইয়ার বোন অর্পিতা।

আমার গলাও শত বছরের ক্লেশ জমেছে যেন। আমি পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিলাম উনার দিকে।

উনি আমার দিকে তাকিয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে জোরে চেপে নিশ্বাস নিলেন। চোখের পানি মুছে বললেন-

– আর আমার জীবন নরক হওয়ার গল্প না হয় নাই বললাম। কিন্তু বলতে হবে৷ সেদিন গুলো আমি আর কল্পনাতেও আনতে চাই না। কিছু তা যে পিছু ছাড়ে না৷ আমার পড়াশোনা, আমার বাইরে যাওয়া, আমার স্বাভাবিক জীবন। এমন কি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়াও যেন আগুনের উপর হেঁটে যাওয়ার সামিল হয়ে গেল। বিশ্রী বাজে কথা গুলো এখনো কানে লাগে আমার৷

এইদিকে মায়ের চিকিৎসা, বাবার কাজ। আবীরের বেকার জীবন। জেলে যাওয়ার কারণে কেউ একটা দোকানে সেলস ম্যান হিসেবেও রাখছিল না ওকে। তখন আবীর সব বন্ধু বান্ধব হারিয়ে ফেলল। ধার নিতে নিতে আবীর যেন মাথা তুলে কারো সাথে কথাও বলতে পারতো না।

এইদিকে বন্যা ফিরে আসতে চাইছে। ওর মা বাবা আটকে রেখেছে। যোগাযোগের কোন পথ রাখে নি৷
তারপর ও বন্যা যখন কয়েক বার আত্মহত্যা করতে গেল তখন আবীর কে ওরা শর্ত দিলো। হয় বন্যাকে ডির্ভোস দিয়ে দাও।
না হয় ভালো চাকরী করে স্টাবিলিস হও।

নইলে সবাইকে ছেড়ে বন্যাকে নিয়ে ওদের কাছে চলে যাক।

আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ সে রাখতে পারবে না।

আর যদি আবীর না যায়, বন্যা যদি সুইসাইড করে সব দোষ পড়বে আবীরের উপর। সারাজীবনে ও ওকে কেউ জেল থেকে বের করতে পারবে না।

উনি থেমে গেলেন। মাথা নিচু করে সমানে হা করে নিঃশ্বাস নিয়ে যাচ্ছেন। আমিও যেন তার সেসব যন্ত্রনার তীব্র জ্বলুনি অনুভব করছিলো। ছাই করে দিচ্ছে যেন সব। থানায় বসা প্রতিটা মানুষ যেন তাকিয়ে আছে অর্পিতার দিকে। সবাই অপেক্ষায় আছে শোনার জন্য। কি সিদ্ধান্ত নিলো আবীর?

উনি নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার বলতে শুরু করলেন৷

– আবীরের কাছে অপশন হয়ত আর ছিলো না।
কিংবা ছিলো,

কথাটা বলে থামলেন উনি। অনবরত চোখের পলক ফেলে যাচ্ছেন। কান্না আটকাতে চাইছেন। কান্না জড়ানো স্বরে বললেন-

– যদি সে আর অপশন নেই মনে করে সে পথে পা না বাড়াতো, হয়ত আজ আমার আবীর হাত পা কেটে এমন মাংস স্তুপ হয়ে পড়ে থাকতো না।

এইবার উনি আর আটকাতে পারলেন না নিজেকে। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন।
আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। সবাই নিঃশব্দে কাঁদছে।
কাঁদছে যেন থানার ডেস্ক, টেবিল, বেঞ্চ আর স্তুপ হয়ে সাক্ষী থাকা হাজার হাজার ফাইল। সবাই যেন নিজেদের কাজ ভুলে শুনছে অর্পিতার কথা। আর কোন কাজ নেই আজ।

আমিও একটু পানি খেয়ে নিলাম। আমিও যেন আর নিতে পারছিলাম না।

অর্পিতা কান্না শেষ করে হিচকি তুলতে লাগলো। আমি কিছু করলাম না। মনে হচ্ছিলো মেয়েটা কারো সামনে কান্নাও করতে পারে নি এতদিন।
অনেক ক্ষণ পর বলল-

-আবীর আমাকে আর মাকে ফেলে চলে যেতে বাধ্য হলো। কিন্তু আমি বলব আমাদের ছেড়ে পালিয়ে গেল ও৷ পালিয়ে গেল আবারো আমাদের জীবন নরক বানিয়ে। আমার জীবন নরক বানিয়ে। আমাকে একা এই নোংরা পৃথিবীতে ছেড়ে৷

আমি ভার্সিটির ছাত্রী হয়েও চাকরি নিলাম গার্মেন্টসে৷ বাবার গোছানো কোয়ার্টার ছেড়ে, এত বছরে মায়ার ঘর, মায়ের তিলে তিলে গড়ে তোলার ঘর। খাট, পড়ার টেবিল, চিটচিটে বালিশের কভার, ধেবে যাওয়া সোফা, মা বাবার সাদা কালো বাধানো ছবি। সব ছেড়ে আমি উঠলাম এক রুমের এক বস্তিতে। সারাদিন হা ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ঘরে এসে দেখতাম মা তখনো বাথরুমে করে ওখানে বসে আছে। কিছুই খায় নি৷

মাঝেমধ্যে আমি চাইতাম আকাশ বাতাস ফাটিয়ে কান্না করতে।
শফিকের সাথে বিয়ে করে আমার এতদিন লন্ডনে চলে যাওয়ার কথা ছিলো।
আর আমি কিনা বস্তির ঘরে, গার্মেন্টসে কাজ করছি।

আবীর কে আমি ঠিকানা দিই নি। কোথায় আছি আমরা৷ আমি আবীর আর বন্যাকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারি নি। আজো না। ওরা আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। সব চেয়ে মূল্যবান আমার মা বাবা। আমার স্বাভাবিক জীবন। আমার এত বছরের ভালোবাসার মানুষ। সব সব। এরপর ও আমি যত বার সুখী হতে চেয়েছি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়েছি আবীর আর বন্যার জন্য বলি হতাম আমি।

তারপর ও আবীর কীভাবে যেন খোঁজ নিয়ে বস্তিতে চলে গেল। কিছু টাকা দিতে চাইলো। মা ওকে চিনতেই পারছে না। বা চিনলেও যেন চিনছে না। মা আবীরের দিকে ফিরেও তাকায় নি। আবীর মায়ের পায়ে পড়ে গড়িয়ে কেঁদেছিলো। বাচ্চাদের মতো। মা ফিরেও তাকায় নি। শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলো অন্য দিকে।

ততদিনে আমি অনেক শক্ত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমারো ইচ্ছে হচ্ছিলো আবীর কে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদি।

না আমি পারি নি। ওর পরিপাটি শার্ট টা যেন আমার কাছে সুইয়ের মতো ফুটছিলো।
বলতে ইচ্ছে করছিল, আমাকে তো তোরা ফুলের মতো মানুষ করেছিলি৷ বাবা কোন দিন একটা টিউশন ও করতে দেয় নি। এত আদরের ছিলাম আমি।
দেয় না আমাদের মাথা উপর ছাদ ফিরিয়ে। এই বস্তি এই গার্মেন্টস যে জীবন্ত নরক আমার কাছে। দেয় না আমার অলস সময় গুলো ফিরিয়ে। দেয় না আমার কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বিশাল ক্যাম্পাস ফিরিয়ে৷

কিন্তু ওর হাতের দামী ঘড়ি আমার সে আকুতি যেন পুইয়ের আগার মতো কেউ কেটে দিচ্ছিলো। আমার গলা থেকে তা মুখে আসছিল না। টুকরো টুকরো হয়ে ভেতরে পড়ে যাচ্ছিলো।

আবীরের টাকা আমি নিই নি। বলেছিলাম,
-যেদিন তুই ফিরে এসে আমাদের দায়িত্ব নিতে পারবি। বন্যাকে বলে আসতে পারবি। সেদিন আসবি। এইভাবে কাপুরুষের মতো আসবি না। একদম না। তোর মুখ ও আমরা দেখতে চাই না।

আবীর বসে ছিলো। ক্ষমা চাইছিলো।
আমি কাজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। তখন ওর ফোন বেজে উঠলো৷ স্কীনের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

আমি হেসে বলেছিলাম।

-আমি চাকরিতে যাচ্ছি আর হাজার গার্মেন্টসের মেয়ের মতো আমাকে 5 মিনিট দেরী হলে ঢুকতে দেবে না।আমি ফিরে আসা অবধি মায়ের পাশে বসে থাক। মার খেয়াল রাখ। পায়খানা পরিস্কার করে৷ খাইয়ে দেয়৷
শুধু একদিন। শুধু একদিন তা করতে পারলে আমি তোকে ক্ষমা করে দেব।

এই বলে আমি বের হয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখেছিলাম। সে নেই।
টাকা গুলো পড়েছিলো। মায়ের পায়ের কাছে।

আমার তখন টাকা কে পৃথিবীর সেরা দান মনে হলেও। সেই টাকা আমার হাতে ধরতেও ইচ্ছে করছিল না। আমি পায়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম সে টাকা৷ বস্তির নোংরা কাঁদা মাখা রাস্তায়৷

এই কথায় বলে অর্পিতা ওর চোয়াল শক্ত করলো৷
ফুলের মতো বড় হওয়া মেয়েটা কীভাবে এমন শক্ত মানুষের পরিণত হলো তা যেন আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। কত টা ঘৃণা জমলে কেউ টাকা পায়ে ঠেলে ফেলে৷

আবার বলল সে,

-তারপর একদিন সাদা শার্ট ভর্তি রক্ত নিয়ে মধ্যরাতে আমাদের বস্তির ঘরে এসেছিলো আবীর৷
দরজা খোলার পর ঘরে ঢুকে আমি কিছু বলার আগেই,

– আমাকে তুই বাঁচা।

এই বলে মায়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো আবীর।
মা প্রথম বারের জন্য কোন রিয়েক্ট করলো। ফিরে তাকালো আবীরের দিকে।

-চলবে।

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here