শেষ পেইজ পর্ব -০৪

#শেষ_পেইজ
#পর্ব_4

-আবীর কে সেদিন আমি ফেরাতে পারি নি। সেটা ছিলো আমার জীবনের আরেক টা ভুল।

আবীরের চিকিৎসার জন্য আমি অগ্রীম বেতন নিতে গিয়েছিলাম ম্যানেজারের কাছ থেকে। আর ছয়দিনের ছুটিও।

ম্যানেজার বলেছিলো, পাবে না ছুটি। চাকরি যাবে, এত দিন ছুটি নিলে।

আমি যখন অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলাম। তার বিচ্ছিরি গা গিন গিন করা হাতের স্পর্শ আমাকে বুঝিয়েছিলো, উপায় তো একটা আছে।

আমার নীরব সম্মতিতে সে ধরে নিয়েছে আমি ভীষণ বিপদে তার যেকোন টোপ আমি গিলবো।

সে হয়ত মিথ্যা ছিলো না। আমারও উপায় ছিলো না৷
কিছু দিন সময় চেয়েছিলাম।

চার দিন অজ্ঞান কাটালো আবীর, জ্বরের ঘোরে। কি এমন হয়েছিল আমি আজো জানি না সেদিন।

ওর গায়ে কোথায় ও কাটা ছিলো না। তবে রক্ত গুলো যে বন্যার ছিলো তা আমি বুঝলেও মানতে পারছিলাম না। এত কিছু পর ও যে ছেলে তার ভালোবাসাকে ছাড়ে নি সে বন্যাকে আঘাত করতে পারে।

-তখন না পারলেও, এখন কি পারে?

আমার কথা একটু থামলো অর্পিতা। বেশ খানিক টা বিরক্তি টেনে বলল,

– আপনার ওদের গল্প শোনার ইচ্ছে ছিলো। আমি আমার ভাইয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী বন্যার কোন কিছুই মনে রাখতে চাই না। ওদের প্রেম গল্প শোনানোর আগ্রহ আমার নেই। আমি বিচার চাইতে এসেছি। আপনি ফোন করেছেন, আমাকে আসতে বলেছেন।
আপনার ইচ্ছে ছিলো আপনার পরিচিত বন্যা আপু জীবন রূপকথার গল্প থেকে কীভাবে এমন থ্রিলার গল্প হলো। তা জানার? আমি আমার মেয়েকে স্কুল থেকে না নিয়ে গিয়ে আপনার এইখানে আটকে আছি। আপনি আটকে রেখেছেন।

বারো বছর সময় টা কম নয়। এইটা মনে রাখবেন। আজ ওরা যা হয়েছে তা একদিনে কেউ হয় নি। না একদিন আবীর এমন হয়েছে। না বন্যা এমন সাইকো হয়েছে।

– সাইকো?

– নয় তো কি? আপনি তো কত খুন দেখেন। পারবেন নিজের স্বামীকে এইভাবে কাটতে? কোন সুস্থ মানুষ পারে? যদি সব টা না শুনেন আপনি বুঝবেন না আসলে কে দোষী আর কে ভিক্টিম?

– আমার তো মনে হয় না আপনি কখনো বন্যা আপুকে ভিক্টিম মানতে চান। পুরো গল্পে বন্যা আপু ভিলেনেই।

আমার এইবারের কথা উনি এইবার কিছুটা চুপ হয়ে গেলেন।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল-

-আমি এক বিন্দুও মিথ্যা বলছি না। মানুষ যখন প্রেম করে তখন মনে করে এই জগত এই সংসার মানেই দুইটা মানুষ। সব সময় হ্যাপি এন্ডিং।
কোন মেয়ে যখন পালাই, বা কোন ছেলে যখন মা বাবার সব ভরসা শেষ করে পালাই তারা যদি একবার এইসব ভয়াবহতার কথা চিন্তা করতো তাহলে এই কাজ জীবনেও করত না। পালানো কে যত সহজ মনে করে এবং এরপর যা যত কষ্ট তা ঠিক করতে ফেইস করে। বিশ্বাস করুন যদি ঘরে থেকে বাবা মায়ের সাথে আলোচনা করে বুঝিয়ে যুদ্ধ করে সে সর্ম্পক করা সফল করা যায়, আরো অনেক সহজ।
এই সাধারণ ব্যাপার টা এই প্রেমে মাতোয়ারা বুঝে না।
তাই বিয়ের পর সবাই কল্পনার জগত থেকে ধুম করে মাটিতে পড়ে। অনেকে আবার মাটিটাও খুঁজে পায় না। আবীর আর বন্যার হয়েছে তাই। সাথে হারালাম আমিও। আপনি কি শুনবেন নাকি আমি যাবো? আমার মেয়ে অপেক্ষা করছে।

অঙ্কিতার ওখান থেকে কিছু রির্পোট এসেছে। কনেস্টেবল হেমা এসে তা আর টেবিলে রাখলো। বন্যা আপুর অবস্থাও খুব একটা ভালো না৷ এখনো সেন্সলেস।

আমি রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে থমকে গেলাম। তারপর অর্পিতার দিকে তাকালাম। বললাম, বলুন।

কারণ সত্য হোক বা মিথ্যা পুরো গল্প আমার জানা উচিত। কারণ মিথ্যা বলতেও যে সত্য লাগে। সত্য ঢাকতে যে মিথ্যা বলা হয় সে মিথ্যা গুলো খুব দূরের হয় না। ধরুন আপনার অংকের উত্তর সাত, আপনি মিথ্যা সাজাতে গেলে গোলমাল করতে গেলে বড়জোর লিখবেন আট। কারণ এতে পুরোটায় সত্য লাগবে৷
তাই ঠিক কোন জায়গায় সাত টা আট হয়েছে তা জানতে আমাকে পুরো গল্প জানতে হবে। উনি আবার বলতে শুরু করলেন।

-আবীর সুস্থ হয়ে উঠলো চার দিন পর। একবারের জন্য ও জিজ্ঞেস করল না আমি এখন বাড়িতে কেন?কীভাবে চিকিৎসা করালাম তার?
ও প্রথমে বলেছিলো, আমার মোবাইল কোথায়? বন্যা কি ফোন দিয়েছে?

রাগে দুঃখে অভিমানে আমার কান্নায় চলে আসলো। টিনে থালাটা সজোরে মাটিতে ফেলে উঠে গেলাম।

আবীর, সারাদিন বসেই রইলো। কোথায় ও গেল না। সেদিন বুঝলাম মানুষ আসলে কিছু সময় আপণ দের সজ্ঞানে সুস্থ দেখার চেয়ে অসুস্থতে বেশি টান অনুভব করে। আমার অবস্থা হচ্ছিলো তাই। মানুষ বড় অদ্ভুত৷ আমি আবীর কে এক মূহুর্তের জন্যেও সহ্য করতে পারছিলাম না।

এইদিকে সে ম্যানেজার ঘরে এসে টাকা দিয়ে গেল। সেগুলো বেতনের অগ্রিম ছিলো না। সে তার তৃতীয় বউ হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।

চিন্তা করতেই আমার সারা গায়ে আগুন জ্বলছিলো। সব হলো এই আবীরের জন্য। কিন্তু ওর কোন চিন্তাই নেই আমি বাঁচি না মরি। বাঁচলেও কিভাবে বাঁচি? মরলেও কীভাবে মরবো? গায়ে আগুণ দিয়ে নাকি বিষ খেয়ে?

আবারো থেমে গেল অর্পিতা।

– তারপর?

-তারপর সেদিন এক ঝাঁক পুলিশ এসে এলোপাতারি বস্তির ঘর গুলো ভাঙ্গতে লাগলো। যাকে পাচ্ছে তাকে ধরে মারতে লাগলো। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি এইসব আবীরের জন্য হচ্ছিলো। আবীরের ও না।
আবীর নিজে তখন ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন পুলিশ থেমে গেল। ওকে জামাই আদর করে তুলে নিয়ে গেল। সে একবার ও চিন্তা করলো না সে দুটো মানুষ কে কিসে ফেলে যাচ্ছে। কি হবে ও যাওয়ার পর? না সে চুপচাপ চলে গেল।

চারদিনের জন্য এসে সে আমার কি ক্ষতি না করে গেল।

বস্তির মানুষ জন আমাকে আর মাকে পাথর ছুড়ে মারলো। তখনিই যেন বের হয়ে যায় আমরা ।

আমি মাকে নিয়ে কোথায় যাবো? তখন আমার কাছে সে ম্যানেজারে তৃতীয় বউ হওয়ার চেয়ে বেটার কোন অপশন ছিলো না।

তার তিন রুমের ঘরে আমাকে নিয়ে গেল কোন পরিপূর্ণ নিয়মের বিয়ের ছাড়া। কলোনী হলেও বস্তির চেয়ে বেটার ছিলো। কাজের মেয়ে ছিলো। ঘর ভর্তি মানুষ ছিলো।।অনেক গুলো বাচ্চা কাচ্চা ছিলো। আমার কাছে ওটা কাদায় ঢাকা স্বর্গের চেয়ে কম ছিলো না।

রাত হলে মাকে বারান্দায় রেখে আসা হতো। মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। সকালে দেখতাম মায়ের চোখের পাশে গড়িয়ে পড়া পানির দাগ। কোন দিন মুছে দেওয়ার সাহস হয় নি আমার।

সে যখন দরজা বন্ধ করতো দুই রুম থেকে অন্য দুই বউ সমানে গালি দিতো। আমি জানি না আমি কিসের শাস্তি স্বরূপ এই জীবন কাটিয়েছি।

আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো অর্পিতা, টেবিলে মাথা রেখে কেঁদে যাচ্ছে। একবার ফুলে উঠছে ওর ফর্সা পিঠ টা। আমারো ইচ্ছে করছিলো অর্পিতার পিঠে হাত রেখে একটু বলি,
-তুমি অনেক স্ট্রং মেয়ে।

কিন্তু পরলাম না। চাকরির অভিজ্ঞতা যেন আমাকে এইটুকু সংযম এনে দিয়েছে।

আমি আবারো বলে উঠলাম,তারপর? কীভাবে মুক্তি পেলেন?

-আবীর আমাকে মুক্ত করেছে সে জীবন থেকে। তবে অনেক পরে। আমার জীবনের সব চেয়ে ভয়ংকর মূহুর্তটা আমি কাটিয়েছি তখন।
সে ম্যানেজার সাদেম, সে নাকি কোন মেয়ে এনে দুই মাসের বেশি রাখে না। এদের বাচ্চা হয়েছে তাই রয়ে গিয়েছে।
হয়ত আমার শিক্ষা, ব্যাক্তিত্বের কাছে সে থিতু ছিল। কারো কোন বদনাম নেই, নিম্ম পলেটিক্স আমার রুচিতে বাঁধতো। তাই সে ভালোবাসতে চেয়েছে আমাকে।আর আমি মানিয়ে নিতে। অনেক টা পানির নিচে অক্সিজেন দিয়ে মানিয়ে নেওয়ার মতো। কষ্ট হচ্ছে, স্বাভাবিক নয়। তবে জরুরী ছিল।

সে আর কারো কাছে যেত না। সাত মাস হয়ে গেল। আমি তখন চার মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলাম। সে বউ গুলো যখন আমার নামে বদনাম করতো সাদেম বলতো আমার নামে আরেক টা কথা বললে, সে সবাইকে বাচ্চা সহ বের করে দেবে।

যে কথাটা তাদের কারো পছন্দ হয় নি।
তার কল তলায় আমায় ধাক্কা মেরেছিলো। রক্তে আমি ভেসে যাচ্ছিলাম।তারা দুজনে আমাকে ডাইনী বলে সজোরে পেটে লাথি মেরেছিলো।

রক্তাক্ত আমি যখন কাতরাচ্ছি তখন মা মোবাইল টা এনে দিলো আবীর কে ফোন দেওয়ার জন্য। আমি আবীর কে ফোন দিয়েছিলাম আর বলেছিলাম কোথায় আছি।
এরপর আর কিছু আমার মনে নেই। জানি না কয় দিন পর জ্ঞান ফিরেছিলো। একটা দামী হাসপাতালে পেয়েছি নিজেকে। মা পাশের বেডে ঘুমাচ্ছিলো। আর আবীর আমার পায়ের উপর পড়ে ছিলো।
ভেজা কাপড় টা জানিয়ে দিচ্ছিলো আবীর কত টা কেঁদেছে।

আমি আনমনে বা হাত টা পেটের উপর দিয়ে তা সমান দেখে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম কেন আমি জানি না। জানি না কেন মা, আবীর, আমি, আমার জীবন ছাড়িয়ে আমি একটা অখন্ডিত মাংস পিন্ডের জন্য কষ্ট পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো সেই তো বোধহয় সবচেয়ে ইম্পটেন্ট ছিলো৷ কিন্তু সে বিশ্রী লোক টা কোন চিহ্ন নেই ভেবেও যেন স্বস্তি হচ্ছিলো। আমরা বড় অদ্ভুত। তাই না?

এরপর জীবন টা পাল্টে গেল। আবীর কে ফিরে পেলাম আমরা। আবীর ওর শ্বশুর বাড়ির চাকরি ফেলে বাবার অফিসে জয়েন করলো।

আমাদের সে কলোনীতে আবার ফিরে গেলাম আমরা। মাথার উপর নিশ্চিত একটা ছাদ আর দুই বেলা চিন্তা ছাড়া ভাতের চেয়ে এই দুনিয়ায় আর কিছু জরুরী লাগছিলো না৷
আমি ভেবে নিলাম কিছুতেই আর আবীরকে হারাবো না আমি। কারণ মা ও সুস্থ হয়ে উঠছিলো।

আমি কখনো জিজ্ঞেস করি নি সে বন্যার কাছ থেকে কীভাবে এসেছে। আমার জানার আগ্রহ ও হয় নি। আমি শুধু আবীরের ছায়াটা আর হারাতে চাইছিলাম না।

কিন্তু সেটাও বেশি দিন রইলো না।
এক রাতে ব্যাগ-পত্র নিয়ে হাজির হলো বন্যা।

আবীর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলো নিঃশব্দে, বন্যা বলেছিলো,

-তুমি যেখানে যেভাবে রাখবে সেভাবে থাকবো। প্লিজ আমাকে তোমার কাছে রাখো।

আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো তখনিই ওকে ধাক্কা দিতে। কিন্তু আবীর ওকে জড়িয়ে ধরে রুমে নিয়ে গেল। সেদিন মনে হলো আমি বন্যার চেয়ে বেশি আর কাউকে হিংসা করি না।

বন্যা আমাদের ঘরে এলেও আমাদের মানতে পারছিল না। আবীর কিছুক্ষণ আমাদের সাথে বসলে, কথা বললে, হাসলে, রাগারাগি করতো, জিনিস ভাঙ্গচোর করতো। অযথা পাগলামী করতো৷

দিন দিন তা সহ্যের সীমা পার করছিলো। এরপর আবীর আর বন্যার সর্ম্পক টা দিন দিন খারাপেই হচ্ছিলো। কিন্তু এক সময় গিয়ে আমার মনে হতো কি হতো সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে।
আমি আর ও তো বন্ধু হতে পারতাম। এক সাথে ঝালমুড়ি খেতাম। একে অন্যের ড্রেস পরতাম।

না সেসব হয় নি। সে দিন দিন সাইকো তে পরিণত হচ্ছিলো৷ এইসব নিতে না পেরে মা মারা গেল এক সকালে। সে রাতেই আমি সে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম।
আর আমার জীবন আমি গড়ে নিলাম। হলে থেকে পড়াশোনা শেষ করলাম আবীরের সাহায্যে । জব করলাম, ভালো একটা মানুষ কে বিয়ে করলাম। সংসার হলো। বাচ্চা হলো।
আমার সব হলো, শুধু কিছুই রইলো না আবীরের। কীভাবে যে ওরা দুজন এমন পশু হয়ে গেল।

উনার কথার শেষ মনে হতেই আমি বলে উঠলাম,
– তো আপনার এই গল্পে, বন্যা আপুর বাচ্চা গুলো কোথায়?

উনার এতক্ষনের কষ্টে মাখা চেহেরাটা মূহুর্তে যেন পাল্টে গেল৷
চোখের মণি গুলো দ্রুত নড়ছে। যেন কিছু এখনি বলতে হবে। কিন্তু পারছেন না। তীব্র স্রোতে উপরে উঠতে চাইছে যেন কিছু।

অঙ্কিতার পাঠানো রিপোর্ট গুলোতে চোখ বুলিয়ে বললাম-
-বন্যা আপুর দুই বার ডেলিভারি হয়েছে। একবার নরমাল,একবার সিজার। ক্রাইম সিনে, বাড়িতে বা আপনার গল্পে কোথায় ও তাদের পেলাম না।কোথায় বন্যা আপুর বাচ্চারা? আর কোথায় বন্যা আপুর মা বাবা? যারা মেয়ের জন্য এত কিছু করল, সে মেয়ে জেলে কোথায় তারা?

চোখ মুখ দৃঢ় করে সোজা হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে অর্পিতা বলে উঠলো,
– ওদের সবাইকে খুন করে বন্যা।

-চলবে।

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here