শেষ বিকেলের আলো পর্ব ৬

শেষ বিকেলের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব 6

“কে আপনি “গলার স্বর শুনে অবাক হয়ে গেল রুমাইসা ।

চট করে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল এ তো ওর অভি নয় এ তো অন্য কেউ। এমন ধাক্কা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলনা রুমাইসা। একদম অপ্রস্তুত হয়ে দূরে সরে গেল।রুমাইসার মেয়েটা কান্নাকাটি করেই যাচ্ছে তীব্র জোরে। রুমাইসা থামাতেই পারছে না।সামনে দাঁড়ানো লোকটা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কারণ তার কাছে ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত।তবুও নিজের কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করল –

“এক্সকিউজ মি আমি কি আপনাকে চিনি আর আপনি আমাকে অভি বলে ডাকছিলেন কেন?”
ভ্রু কুচকে প্রশ্ন টা করে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে রুমাইসার দিকে।

রুমাইসা নিজেও জানেনা তখন কি হয়েছিল। অভির ভূত ওর মাথায় যেন শক্ত করে চেপে আছে। আগে যা কে না তা কেই অভির মত লাগত। কিন্তু মাঝে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। অথচ আজ কি এক কেলেঙ্কারি বাধিয়ে বসল রুমাইসা। রুমাইসা কিছু বলার আগেই দারোয়ান ছুটে আসলো। রুমাইসা কে বড় স্যারের সাথে কথা বলতে দেখেই তাকে ধমক দিয়ে বলল “তুমি এখানে কেন? বড় সাহেবকে কি বলছ তুমি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমাকে না বললাম এক কোনায় দাঁড়াতে।”

একরকম ধমক দিয়ে রুমাইসা কে এখান থেকে সরে যেতে বলল দারোয়ান।।

কিন্তু বড় সাহেব নামের লোকটা দারোয়ান কে হাত দিয়ে থামিয়ে দিল। “তুমি এখন যেতে পারো এখান থেকে মোবারক ভাই। ” দারোয়ান একবার রুমাইসা একবার বড় সাহেব এর দিকে তাকাল। উত্তর দেওয়ার সাহস করল না আর।দারোয়ান কথা না বাড়িয়ে চলে গেল মুহুর্তের মাঝে। রুমাইসার ভয় করতে লাগল। কোন ভুল তো করে বসল না আবার। আজ বোধ হয় লোকটার হাতে চরম ভাবে অপমান হবে। চাকরি টা হওয়ার চান্স থাকলেও হবে না এবার।মেয়েটা খুব মোচরা মুচরি করছিল ক্ষুধায়। লোকটা বুঝি বুঝতে পারল ।

রুমাইসা কে বলল “এক্সকিউজ মি শুনছেন? ”

রুমাইসা চোখ তুলে ভয়ার্ত মুখে বলল “জ্বি? ”

“বাচ্চা কান্না করছে খুব সম্ভবত ক্ষুধার জন্য।আপনি কি এই অফিসে চাকরি করেন? করলে ভেতরে যেয়ে খাইয়ে নিন বাচ্চাকে। এত কান্না করলে সে অসুস্থ হবে। ”

রুমাইসা শুকনা গলায় জবাব দিল “সে এখানে চাকরি খুজতে এসেছে একজনের সাথে। কিন্তু তার ভেতরে ঢোকার অনুমতি একদম নেই। ”

বড় সাহেব মুচকি হেসে বলল “সমস্যা নেই।আমার সাথে চলুন ভেতরে। আমি সাহায্য করছি।”

রুমাইসা যেন নিজের কান কেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। এখানেও আন্তরিকতা। আল্লাহ কি তার নসীব এত ই ভালো রেখেছে যে পদে পদে সে এত ভালো মানুষের দেখা পাচ্ছে। এসব ভাবনার খেয়ালে যখন ব্যস্ত তখন লোকটা রুমাইসার মুখের সামলে আঙুলের তুড়ি বাজিয়ে ধ্যান ভেঙে দিল। চিন্তার জগত থেকে হুট করে ছাড়া পেয়ে রুমাইসার মুখ টা একটু অন্যরকম হয়ে গেল।

“চলুন, দাড়িয়ে না থেকে । আপনার বেবি টা খুব কান্না করছে। আচ্ছা মেয়ে বেবি না ছেলে বেবি? ”

রুমাইসা কোমল স্বরে জবাব দিল “মেয়ে।”

“ওহ আই সি। তা নাম কি রেখেছেন?বয়স কত? বাই দ্যা ওয়ে আপনার মেয়েটা খুব কিউট। ”

রুমাইসার মনে হল এত পেরেশানির মাঝে মেয়ের নাম রাখে নি। কিন্তু কিভাবে যেন মুখ ফসকে বলে দিল “ইহিতা।”

“ওয়াও নাম টা তো সুন্দর। আর বয়স? ”

“বেশি না।আজ ৫ দিন চলছে। ”

“ওহ মাই গড, এত ছোট বাচ্চাকে নিয়ে কাজে বের হয়েছেন? ”

রুমাইসা শুধু হাসল আর কিছু বলল না।

লোকটার সাথে লোকটার কেবিনে যাওয়ার সময় আশেপাশের অনেকে ওদের দিকে চেয়ে রইল। কয়েকজন বলেই ফেলল দেখ দেখ স্যারের বউ আর বাচ্চা। বউ টাও কি সুন্দর বাবারে।
আল্লাহ স্যার বিয়ে করে ফেলছে। আমি আরো ভাবতাম স্যারের বিয়ে হয় নি।ইশ আজকা মন ভাইঙা গেল, স্যারের বউ রে দেইখা।

কথা গুলো রুমাইসার কান পর্যন্ত গেল আর সাথে সাথে সাথে কান আর মাথা লজ্জায় গরম হয়ে যাচ্ছিল। এমন কিছু শুনার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না। যদিও খুব একটা মানুষ ছিল না। তবুও যেই কয়জন আলোচনা করছিল তারাই রুমাইসা কে এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিল।

রুমাইসা পেছন পেছন ভেতরে ঢুকে গেল লোকটার। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত একটা সুন্দর রুম এ এসে ঢুকল দুজন। লোকটা রুমাইসা কে বলল “আপনি ওই যে কোনায় যেয়ে বেবি কে খাইয়ে দেন। আমি এদিক টায় আছি। ভয় পাবেন না আমি কিছু করব না। ইউ আর সেফ হেয়ার। ”

শেষ এর ইংরেজি টা বলে লোকটা একটু অস্বস্তি তে পড়ল। মেয়েটাকি ওর ইংরেজি বুঝতে পারল নাকি কোন ভুল মানে বের করল আবার। পরক্ষনেই রুমাইসার মুখ থেকে খুব সুন্দর ভাবে থ্যাংকস কথা টা বেরিয়ে আসল। লোকটার এবার একটু স্বস্তি মিলল। কারণ মেয়েটা মূর্খ নয় এইটুক কথাই ই প্রমান।

রুমাইসা এক কোনায় আড়াল করে বসে গেল। বাচ্চা কে খাওয়াতে খাওয়াতে একটু আগের ঘটনা মনে করছে। কি লজ্জাজনক অবস্থা ছিল। ভাবতেই কেমন লাগছে। যদিও অভি কে নিজের হাজবেন্ড ভাবে কিন্তু ওদের তো বিয়ে হয় নি। কে জানে আর এ সত্য ওদের মাঝে।

“হ্যালো, হ্যা, আমি বলছি। ছবি পাঠাচ্ছি কনফার্ম কর আমাকে। ”

এমন সময় রুমাইসা এসে সামনে দাড়ালো। কৃতজ্ঞতা হিসাবে ধন্যবাদ জানালো। লোকটা রুমাইসা কে বসতে বলল। রুমাইসা আড় চোখে টেবিলের উপর রাখা নাম খোদাই করা কাঠ টা দেখল। “ইহান তালুকদার। চ্যায়ারম্যান অফ সাহিল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি। ”

রুমাইসা ঢোক গিলল একটা । ইহান সাহেবের দিকে আড়চোখে তাকাল রুমাইসা। বয়স যে কত ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না। চেহারায় একটা গম্ভীর ভাব আছে। তবে হাসিমুখে কথা বলতে পারে এইতো কিছুক্ষন আগেই কয়েকবার সেটা চোখে পড়েছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, হয়তো নিয়মিত জিমে যায়।হাত আর বুকের চওড়া দেখে আন্দাজ করতে পারছে ও। এক কথায় লোকটা কে বেশ স্মার্ট লাগছে আর সুদর্শন। এজন্য ই বোধ হয় সবার মাঝে ওনার চাহিদা এত। সবচেয়ে বড় কথা কিভাবে যেন অভির সাথেও ওনার চেহারা খানিকটা মিলে।এজন্য ই বোধ হয় এতবড় ভুল হয়ে গেল।

রুমাইসা কে এভাবে তাকিয়ে দেখে ইহান সাহেব একটু হাসি টানার চেষ্টা করল মুখে। রুমাইসার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল “আগে কি কোথাও জব করেছেন? ”

“জ্বি না। এটাই আমার প্রথম জব। ”

“আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে যদি বলতেন।”

রুমাইসা ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে ইহান কে বের করে দিল। ইহান কিছুক্ষন মনোযোগ দিয়ে ফাইল গুলো দেখল। যত ই ফাইল দেখছিল তত ই যেন মুখের রং পাল্টে যাচ্ছিল। মুখের গাম্ভীর্য আরো বাড়ছিল। রুমাইসার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। জব টা কি পাবে ও এখানে।

ইহান ফাইল গুলো দেখা শেষ করে রুমাইসার দিকে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হল। কিন্তু রুমাইসা চোখ নামিয়ে নিল। ইহান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল “জব না হয় আমি দিলাম। কিন্তু বেবি নিয়ে কিভাবে কি করবেন আপনি? ”

রুমাইসা সহসা কোন উত্তর দিতে পারল না। ইহান পুনরায় প্রশ্ন করল “তখন যে অভি বলে চিৎকার দিলেন অভি টা কে? ”

রুমাইসা আবার করুন চোখে তাকাল ইহানের দিকে। ইহান উত্তরের আশায় চেয়ে রইল। রুমাইসার গলা টা ভারী হয়ে গেল। ও উত্তর দিল “আসলে তিন মাস আগে এক্সিডেন্টে এ ওর বাবা মারা গেছে। ওর নাম ছিল অভি। আপনার চেহারা অনেকটাই অভির মত। তাই আমিও ভুল ভেবে বসেছি। ক্ষমা করবেন প্লিজ। ”

ইহান বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল। “সমস্যা নাই আমি বুঝতে পারছি।” এমন সময় ইহানের ফোন টা বেজে উঠল। ইহান রুমাইসার দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে এক মিনিট সময় চেয়ে নিল।

“হুম তুমি কনফার্ম এটাই? ”
“আচ্ছা ওকে। ”

ফোন রেখে ইহান বলল “সব ই বুঝলাম। আপনার ঘটনা শুনে আমি খুব মর্মাহত। কিন্তু বেবি কে নিয়ে কি আপনার পক্ষে কাজ করা সম্ভব এখানে ৮ ঘন্টা? ”

রুমাইসা আত্মবিশ্বাস এর স্বরে বলল “হ্যা পারব। আমার মেয়ের জন্য আমাকে পারতেই হবে। ”

“আই লাইক দিজ কনফিডেন্স। তবে আমাদের তো এখন খালি নেই কাজের জন্য পজিশন। আপনাকে ম্যানেজার সাহেব দেখে একটা প্লেস দিয়ে দিবে। কাল সকালে ৮ টায় এসে ম্যানেজার এর সাথে দেখা করবেন। আমি বলে দিব। ”

রুমাইসার খু্শিতে কান্না চলে আসল। অবশেষে কিছু করার জন্য পেল তাহলে।

বাসায় যখন ফিরল তখন বাকিরা জেনে গেল রুমাইসার সেখানে চাকরি হয়েছে। কিন্তু কিভাবে হয়েছে সেই ঘটনা টা এই বস্তিবাসীদের মাঝে বর্ননা করার সুযোগ পায় নি। সাথের মেয়ে দুটোকে বলেছে দারোয়ান সাহায্য করেছে। মেয়েগুলো ও তেমন পাত্তা দেয় নি।রুমাইসা ব্যাগ এ করে চাল ডাল আর সব্জি কিনে এনেছে। প্রতিদিন এভাবে না খেয়ে থাকা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে জুই এর মা কে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেছে একজনের কাছ থেকে ধার করেছে। পুরো সত্য টা বলার সাহস পায় নি। কারণ এরাও রুমাইসার মত ই গরীব। টাকার ভাগ অবশ্যই কেউ ছাড়বে না।তাই কাউকে জানিয়ে বিপত্তি বাধাতে চাই নি।

রাতে রান্না শেষ করে সব খাবার নিয়ে নিজের ঘর আটকে বসল। গত রাতের ঘটনায় বেশ ভয় পেয়েছে ও।আজ রিস্ক নিতে চায় না নতুন করে। মেয়ে একা একা হাত পা নেড়ে খেলছে। কাল থেকে মেয়েটা অনেকটা সময় ওর থেকে দূরে থাকবে। ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। মেয়ের দিকে ঝুকে মেয়ের কপালে চুমু দিল। এ এক জীবনযুদ্ধ নিজেদের বেচে থাকার জন্য। রুমাইসা জানে না কাল থেকে ওর সাথে কি হতে যাচ্ছে।

ওর জীবনের গল্প টা হুট করেই ঘুরে যেতে পারে। হয়ত নতুন কোন কিছু ওর অপেক্ষায় আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here