শেষ বিকেলের আলো পর্ব ৮

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ৮

রুমাইসা মোটেও এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না। এক রকম হা হয়ে চেয়ে রইল ইহানের দিকে। ইহানের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে যেন একদম গা ছাড়া। রুমাইসা অনেকক্ষন পর বলল “আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে ইহান সাহেব! ”

“হলে নিশ্চয়ই আপনার সাহায্য করতে ছুটে আসতাম না মাঝ রাস্তায়? ” ইহান কথা টা না তাকিয়েই বলল।

রুমাইসার একটু রাগ লাগল। উচ্চস্বরে চেচিয়ে বলল “প্রথমত আপনি আমার অফিসের বস। আমার অনেক হেল্প করেছেন আপনি যেটার জন্য আমি ঋনী আপনার কাছে। কিন্তু একটু আগেই জোর গলায় বলেছি আমি অভি কে ভালোবাসি তাহলে আপনি হুট করে কিভাবে এই প্রস্তাব দেন? তারচেয়ে বড় কথা আমরা কেউ কাউকে চিনিও না। তাহলে এইখানে বিয়ের কথা কেন আসবে!!”

“মিস রুমাইসা নিজেকে শান্ত করুন আগে। প্রথমত এত জেনে কি হবে? জানলেই কি আমাকে আপনার বিয়ে করার আগ্রহ বাড়বে এমন কিছু? ৪/৫ বছর রিলেশন করেও তো অভি কে বিয়ে করতে পারেন নি? নিয়তি যার যেখানে ভাগ্য রাখবে সেখানেই হবে। আর বিয়ের কারণ হিসাবে ইহিতা কে আমার প্রথম দিন দেখেই ভালো লেগেছে। আর তাই আমি ওর জন্য একটা বেটার লাইফ দেওয়ার জন্য এই বিয়েটা করতে চাইছি। আর আপনি জাস্ট নিজেকে সময় নিয়ে ভাবান যে, আজ আমি হয়ত এখানে কপাল গুনে চলে এসেছি৷ না আসলে তো আপনার আর আপনার মেয়ের পরিস্থিতি কি হত ভাবতে পারছেন? আপনি কোথায় থাকেন সেটা আমার অজানা নয়। আপনার সব ইনফো আমার জানা আছে। সারাদিন মেয়েকে বেবি কেয়ারে রেখে কাজ করে কত টুক ভালো লাইফ দিতে পারবেন চিন্তা করেছেন? আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্ট অন ইউ। বাট ইহিতার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট। আর আমি ওর বাবা হতে চাইছি। আশা করি ডিপলি চিন্তা করে ডিসিশন নিবেন। ”

রুমাইসা থমকে গেল এত গুলো যুক্তি শুনে। ইহানের বলা একটা কথাও ভুল ছিল না। বরং পাই টু পাই কথা সত্যি।কিন্তু ওর ই বা কি করার আছে।কিন্তু হুট করে অচেনা একটা লোকের সাথে কিভাবে সংসার শুরু করবে। তাছাড়া এটা সারাজীবন এর ডিসিশন। রুমাইসার একটা হ্যা না এর উপর ওদের ভবিষ্যত।আজ যদি না করে দেয় তাহলে হয়ত ইহান ও কে আর কাজেই রাখবে না। কোথায় ওর ঠিকানা হবে। কি করবে তারপর ? বাড়ি বাড়ি কাজ করবে? তখন মেয়েকে কোথায় রাখবে? আবার কাল আজকের পরিস্থিতি হবে না সেটার কি নিশ্চয়তা।

রুমাইসার মাথা ভো ভো করছে। চিন্তা করতেই পারছে না। আড়চোখে ইহানের দিকে তাকাল। লোকটা কে না করার মত কোন কারন নেই। তবে সবচেয়ে বড় কথা ইহানের পরিবার বা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ওর কিছু জানা নেই। কি বলবে এখন। ভাবছে না ই করে দিবে।কিন্তু ইহিতার দিকে তাকাতেই ভয় লাগছে আবার। একটু আগে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেচে ফিরল মা মেয়ে। রুমাইসা চুপচাপ বসে রইল। মুখে কথা ফুটছে না।জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। অন্ধকার শহরে ছুটে চলছে হাজারো গাড়ির মেলা। লাল হলুদ লাইটের আলোতে অন্ধকারের মাঝেও কিছুটা রঙিন লাগছে৷ এ শহরের মানুষ গুলো নিতান্তই ব্যস্ত। এই বিশাল শহরে আজ কাল কি কেউ স্বার্থ ছাড়া কারো দিকে হাত বাড়ায়। ওর নিয়তি কি এতটাই ভালো যে প্রতি পদে পদে ওই ভালো মানুষ গুলোই ওর জীবনে উকি মারছে।

ইহান আবার জিজ্ঞেস করল “মিস রুমাইসা আমরা কি কাজী অফিসে যাচ্ছি নাকি আপনি ফিরে যাচ্ছেন আজ? ”

রুমাইসা ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে রইল ইহানের দিকে। একটা ঢোক গিলল শুধু । কি উত্তর দিবে এখন। চোখ বুঝে হেলান দিল গাড়ির সিটে। সারাজীবন এতিম বলেই ফুপির কাছে কথা শুনেছে। শেষ বার তো বলেছে, এতিমের বাচ্চা এতিম। তোর মত অভাগীরে সংসারে আইনা আমি আমার বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করসি। নস্টা মেয়ে বের হ আমার বাড়ি থেকে। রুমাইসার গা শিরশির করে কেপে উঠল। চোখ খুলে হা করে শ্বাস নিল।

ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল “কাজী অফিসেই চলুন।”

ইহান বাহিরের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দিল। সেটা দৃষ্টি এড়ালো রুমাইসার। রুমাইসা তখন ভুল আর সঠিক টা যাচাই করতে ব্যস্ত।

তিন ঘন্টা পর রুমাইসা আর ইহান একটি বাড়ির সামনে এসে নামল। বাড়িটা খুব যে রাজকীয় তা না। একদম সাধারণ একটা পাচ তলা বিল্ডিং। ভারী লাল বেনারসি গায়ে রুমাইসা গাড়ি থেকে নামল। আর ইহান একদম সাধারণ একটা লাল রং এর পাঞ্জাবি গায়ে। ইহান রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে একটা শো রুম থেকে সব কিছু কিনে নিয়েছে। রুমাইসা প্রথমত না করেছিল। কিন্তু ইহান যেন বিয়ের আগেই এক রকম অধিকার দেখিয়ে দিয়েছে শাড়ি কেনার সময়। নিজে পছন্দ করে কিনেছে। সাথে ম্যাচিং গহনা। আবার ইহিতার জন্য লাল জামা কিনেছে। আর ওর জন্য লাল পাঞ্জাবি । রুমাইসা এক রকম ঘোরের মাঝে ছিল সারাটা সময়। শাড়ি পড়ে ইহানের সামনে যখন দাড়িয়েছে ইহান ৩০ সেকেন্ড এর জন্য বোধ হয় ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। তারপর বলল “পার্ফেক্ট। চলুন এখন। ”

রুমাইসা না করেছিল ইহিতার জামা কিনতে। কিন্তু ইহান একটা ধমক দিয়েছে ও কে সেখানেই। “আমার মেয়ের জন্য আমি জামা কিনব। সেটা আমার ব্যাপার । আশা করি এখানে আপনি কিছু বলতে আসবেন না। ” ধমক শুনে রুমাইসা চুপসে ছিল। আসতে আসতে ইহান কে জানছিল রুমাইসা।লোকটার মুখে এখনো হাসি দেখে নি একবারো।

বিয়ে করা শেষ এ এক মিনিট ও দাড়ায় নি। এই সোজা বাড়িতে চলে এসেছে। বেশ কিছু সময় হেটে বাড়িতে ঢুকল দুজন। এক তলায় খুব সম্ভবত ভাড়া দেওয়া। ভারী শাড়ি নিয়ে রুমাইসার সিড়ি বেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। বারবার শাড়ি পায়ের সাথে বেজে যাচ্ছে। কয় তলায় যেতে হবে সেটা ইহান বলে নি।ও সুন্দর করে হেটে হেটে উঠছে মেয়েকে নিয়ে। বিপত্তি বাধছে রুমাইসার, বলতেও পারছে না কিছু।বিয়েটা করা কি ঠিক হয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না একদম। খুব দ্বিধা লাগছে মনের মাঝে। কেমন যেন অস্বস্তি ও লাগছে। ইহানের পরিবার কি মেনে নিবে রুমাইসা আর ইহিতা কে।

এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছিল রুমাইসা। এমন সময় শাড়ির সাথে পায়ে বেজে রুমাইসা পড়েই যাচ্ছিল। ইহানের পাঞ্জাবি কে শক্ত করে আকড়ে ধরল। ইহান ও এক হাত দিয়ে রুমাইসার হাত শক্ত করে ধরল। রুমাইসা দাড়িয়ে গেল। বড্ড বাচা বেচে গেছে ও এ যাত্রায়।

“শাড়িটা উঠিয়ে নিন ভালো করে। চলে এসেছি আর কয়েকটা সিড়ি। তিন তলায় আমাদের ফ্লাট। ”

রুমাইসা লজ্জায় কেবল বলল “দুঃখিত।”

ইহান কথা না বাড়িয়ে আগে আগে উঠে গেল। রুমাইসা এবার শাড়িটা অনেকখানি উপরে তুলে এবার দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠল। পায়ের নুপুরের আওয়াজে রিনিঝিনি শব্দ হতে লাগল। ইহান আগে উঠলেও পেছনে ফিরে রুমাইসার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ কেমন যেন ঝলসে যাচ্ছে ইহানের। চোখ ফিরিয়ে নিলো সাথে সাথে।

ইহান এর পাশে এসে রুমাইসা দাড়াতেই ইহান কলিং বেল চাপল। রাত তখন ১২ টার বেশি বাজে তখন।বেশ রাজকীয় দরজা সেটা । বাহির এর দেয়ালের রং টাও সুন্দর। আবার ডিজাইন করা দেয়ালে। পুরো তৃতীয় তলা টাই ওদের। বেশ বড় ই হবে হয়ত ভেতরে।একটু পর ই দরজা খুলে দিল একজন মাঝারি বয়সের মহিলা। দরজা খুলেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে চিৎকার দিল “ও মাগো মা খালা খালু, সাহিল ভাইয়া, ভাবি দেইখা যান ইহান ভাই কারে লইয়া আইসে রে।

ইহান বিরক্ত হয়ে বলল “মিলি আপা থামো তো। এত চিৎকার দিচ্ছ কেন! ”

মিলির চিৎকার এ বাসার সবাই এসে জড় হল। ইহান ততক্ষনে মিলি কে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল রুমাইসার হাত ধরে। ভেতরে আসতেই রুমাইসা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল বিশাল বড় ড্রইং রুম এ এসে দাড়িয়েছে ওরা। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে আরামে ইহানের কোলে। মনে হচ্ছে সেই রকম একটা শান্তি পাচ্ছে।।

হুট করে “কি হয়েছে” বলে একটা হুংকার করা শব্দে রুমাইসা কেপে উঠল। সামনে তাকাতেই দেখল ৬০/৬২বছর বয়স হবে এমন বয়সের এক লোক এসে দাড়ালো ওদের সামনে। লোকটা কে দেখেই ওর ভয় লাগছে কেমন। ভয়ে গুটিশুটি মেরে ইহানের পাশে চেপে দাড়াল। একটু পরেই আরো দুইজন আসল। একজন মধ্য বয়সের মহিলা, খুব সম্ভবত ইহানের মা। আরেকজন রুমাইসার চাইতে ৩/৪ বছরের বড় হবে হয়ত। দুজনের গায়েই শাড়ি পড়া।

ইহান কে দেখে বয়স্ক লোক আর মহিলা একসাথে বলল “এ কে? আর বাচ্চা কার? ”

ইহান খুব শান্ত গলায় উত্তর দিল “আমার স্ত্রী আর সন্তান। ”

দুজনের মুখের রক্ত যেন সরে গেল। সেই ভদ্রলোক উচ্চস্বরে চেচিয়ে বলল “স্ত্রী মানে? বিয়ে করলে কখন তুমি? আর বাচ্চা ই বা আসল কই থেকে? ”

সেই বয়স্কা ভদ্রমহিলা বলল “বাবা তুই বিয়ে করেছিস কখন? আমাকে বলিস নাই কেন? ”

“আম্মু আব্বু , আমি বিয়ে করেছি ও কে। আর এটা আমাদের মেয়ে। বেসিক্যালি এটা রুমাইসার মেয়ে ইহিতা, তবুও যেহেতু মাত্র ই বিয়ে করেছি তাই এখন থেকে ইহিতা আমাদের মেয়ে। আর জানানোর প্রয়োজন মনে করি নি কারণ নিজের ডিসিশন নিজের নেওয়ার অধিকার আমার আছে। ”

রুমাইসার কান টা যেন এগুলো শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। এগুলো কি শুনছে ও। সবাই কি ভাবছে ও কে। আড়চোখে তাকাল একে একে সবার দিকে। ওর থেকে বড় বয়সের মেয়ে টা মুখে আঙুল দিয়ে নখ কাটছে আর আগ্রহ ভরে দেখছে। আর ওর বাবা মায়ের মুখ টা রাগে লাল হয়ে আছে। অথচ ইহানের মুখে চিন্তা বা ভয়েত ভাবলেশ ও নাই। হঠাৎ মনে পড়ল সাহিল ভাই বলে মিলি ডেকেছিল। সেই সাহিল ভাই এখানে অনুপস্থিত। হ্যা তার নামেই তো গার্মেন্টস টা আর সে হয়ত ইহানের বড় ভাই হবে।

ওর বাবা রেগে বলল “বিয়ে করেছ ভালো কথা। কিন্তু একটা বাচ্চাওয়ালা মেয়ে কে কেন? এটা কি তোমার বাচ্চা? ”

রুমাইসার মনে হলে এই মুহুর্ত দেখার আগে মরে যেত। না জানি আর কত প্রশ্ন করবে।

ইহান গম্ভীর গলায় বলল “যেহেতু আমি বিয়ে করেছি তাই এখন থেকে আমার মেয়ে। আগে কার ছিল সেটা ভেবে লাভ নেই। ”

ইহানের মা হুট করে ছুটে আসল রুমাইসার কাছে। রুমাইসার বাহু ধরে ধাক্কা দিয়ে বলল “এই যাদুগরনী শয়তান মেয়ে , আমার ছেলে কে কি জাদু করেছিস বল। আমার ছেলে আমার সাথে এভাবে কথা বলছে। ”

রুমাইসার মুখ টা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সারা মুখের রক্ত যেন চোখে এসে জমে গেল। ও কিছু বলতে পারছে না ঠোঁট কাপছে। কি বলবে এই অভিযোগ এর বিরুদ্ধে। ইহান ওর মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল “এটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ছিল। তাই রুমাইসা কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ”

সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ইহান হুট করে সেই মেয়েকে বলল “তৃষা ভাবী তোমার বর কে ডাকো একবার। আসবে না এখানে? আর কত কাজ করবে? ”

তৃষা সেখান থেকে ই জোরে জোরে ডাকতে লাগল “সাহিল সাহিলা, তাড়াতাড়ি এদিকে আসো দেখে যাও।”

ভেতর থেকে জোর গলায় শব্দ হল “কি হয়েছে কাজ করছি আমি। ”

তৃষা ভাবী আবার বলল “কাজ রাখো দেখ তোমার ভাই কি করেছে। ”

এবার আর শব্দ এল না। পায়ের শব্দ আসতে লাগল ক্রমশ কানে। দ্রুত পায়ে ধুপধাপ আওয়াজ করে ড্রয়িং রুমে এসে থামল একজন লোক। রুমাইসা তার ভাসুর কে দেখার সাহস করল না। যা অপমান হচ্ছে, এবার যেন কি শুনতে হয়।পাশ থেকে ইহান বলল “সাহিল ভাইয়া আমার স্ত্রী, পরিচিত হও। ”

“রুমাইসা মাথা তুলে তোমার ভাসুর কে সালাম দেও।” ইহান হাসতে হাসতে বলল।

রুমাইসা মাথা তুলে আসসালামু বলেই থেমে গেল। সামনের দাড়ানো লোকটার মুখের রং পাল্টে গেল।

রুমাইসা কাপা কাপা ঠোঁটে বলল “অভি তুমি।”

ওপাশ থেকে অভি জবাব দিল “রুমাইসা”।

পুরো রুমের সবাই অবাক চোখে চেয়ে রইল। একমাত্র ইহান এর ঠোঁটে রাজ্য জয়ের হাসি।

(তারপর কেমন লাগল আজকের টুইস্ট।কমেন্ট করবেন সবাই প্লিজ।লেট হয়ে গেল ডক্টর দেখাতে গিয়েছিলাম। আপনাদের রেস্পন্স এর উপর কাল আরেক পর্ব আসবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here