#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সিজন_২
#Tahmina_Akhter
(৯)
রৌদ্রমুখর দিন, আকাশের বিশাল জায়গা জুড়ে কোথায়ও আজ কালো-ধূসর রঙা মেঘেদের আনাগোনা নেই৷ হালকা শীত শীত ভাব প্রকৃতির মাঝে। হালকা বাতাস গায়ে ছুঁয়ে দিলে গা কাটা দিয়ে
উঠে৷ গাছের পাতা হলুদ হতে শুরু করেছে হয়তো কিছুদিন পাড় হলে গাছের পাতাগুলো অচিরে ঝরে যাবে। গাছে দেখা দিবে নতুন পাতার কুড়ি।প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে রুপ বদলায়, সেখানে ভালোবাসার রঙ বদলাবে না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য বাক্য!
হয়তো না, কারণ ভালোবাসার রঙ বদলায় যেমন করে প্রকৃতি তার রুপ বদলায়৷ প্রতিটি ঋতুতে প্রকৃতি তার ভিন্ন রুপে রুপান্তরিত হয়।
এই যেমন আমার আর আদিলের সম্পর্কের রঙ বদলে গেলো এক নিমিষেই।
-আদিল ভাইয়ার কথা মনে পড়েছে, ভাবি?
রুশা তখন জানালা দিয়ে বাইরে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত সাথে ভালবাসার আর প্রকৃতি নিয়ে চলছিল ফলাফল শূন্য, গবেষণা। ভালোবাসা আর প্রকৃতিকে নিয়ে কেউ কখনো সঠিক বৃত্তান্ত দিতে পারেনি হয়তো পারবেও না৷
রুশা তার চেহারায় মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে কাজলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-হুম, তার কথা তো আমার প্রতিটা নিশ্বাস নেয়ার সময় মনে পড়ে।কিন্তু, আদিলের কি আমার কথা মনে পড়ে, আপু?
কাজল রুশার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর জানে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুশার দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ দু’মাস হতে চললো আদিলের সাথে রুশার কোনোপ্রকার যোগাযোগ নেই। কি কারনে ওদের দু’জনের মাঝে এতখানি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, ওরা দুজন কেউ মুখ খুলছে না,এই ব্যাপারে?
রুশার মুখের দিকে তাকালে বড্ড মায়া হয় কাজলের। ভাসা আঁখি যুগল দেবে গিয়েছে, চোখের নিচে যেন একঠাসা কালো রঙের প্রলেপ মাখানো, উষ্কখুষ্ক চুল।
এই তো মাস দুয়েক আগেও যখন রুশার অন্তঃসত্ত্বার খবর আদিল কল করে জানিয়েছিল, সেদিন আদিলের কন্ঠে ছিল, অন্যরকম আনন্দ।যখন আদিল কাজলকে তার অনাগত সন্তানের আগমনী বার্তা দিচ্ছিল, তখন ওর কন্ঠ থেক শব্দ ভেসে আসছিল কাঁপা স্বরে।
আর আজ দু’মাস সেই অনাগত সন্তানের কথা, তার মাধুর্যের কথা তার জানার প্রয়োজন বোধটুকুও যেন উধাও হয়ে গিয়েছে।
-ভাবি, চলো নিচে। তোমার সাথে কেউ দেখা করার জন্য এসেছে?
রুশা কাজলের দিকে তাকালো, কাজল রুশার তাকানো দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-আমার কথা বিশ্বাস না হলে, নিজে হেঁটে গিয়ে দেখে এসো৷
রুশা কাজলের কোনো কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে খাটের উপরে থাকা ওড়না নিয়ে মাথায় অনেক সুন্দর করে পেঁচিয়ে নিলো। এরপর, কাজলের সামনে এসে বললো,
-চলো, আপু দেখে আসি কে এলো আমার সাথে দেখা করতে?
রুশা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় অতি পরিচিত কন্ঠ শুনতে পেলো। ।
রুশা ড্রইংরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সর্বপ্রথম যাকে দেখলো সে ব্যক্তি হলো,আদিলের বাবা রায়হান সাহেব। বয়সের ভারে বেশ নেতিয়ে গিয়েছেন। রায়হান সাহেবকে এখানে দেখে রুশার অবচেতন মন বারংবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছিল, আদিল আজ নিশ্চয়ই এসেছে।
রুশাকে দেখতে পেয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রায়হান সাহেব এরপর ধীরপায়ে হেঁটে রুশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। রুশার মুখের দিকে তাকাতেই রায়হান সাহেবের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।কি অপরাধে আদিল এমন ফুলের মতো মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে?
রায়হান সাহেব উনার ডানহাত উঠিয়ে রুশার মাথার উপর রেখে বলেন,
-বুড়ো বাবাকে ফেলে এখানে পড়ে আছিস? একবার ভাবিস না তোর বাবা তোকে ছাড়া কেমন আছে?
রায়হান সাহেবকে একা দেখার পর থেকে রুশার চোখের পানিতে টইটম্বুর কিন্তু পিতৃ স্নেহের ছোঁয়া পেতেই রুশার চোখের বাঁধ ভেঙে গেলো। রায়হান সাহেবের ডানহাত নিজের মাথা থেকে সরিয়ে এনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রুশা কেঁদে উঠলো।
রায়হান সাহেব আর কাজল রুশার কান্না দেখে নিজেদের চোখ কখন ভিজে উঠছিল খেয়ালই করেনি।
-বাবা,যেই বাড়িতে আমার কথা কোনো দাম নেই, বিশ্বাস নেই। সেখানে আমি থাকি কি করে? বাবা,আপনার ছেলে অনেক নিষ্ঠুর কিভাবে সে পারলো আমার সাথে এমন একটি কাজ করতে? তার কি আমার উপর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই?
-মা রে,তুই চলে আসার পর থেকে আমার ছেলেটা ভালো নেই। প্রতিটা রাত আমার আদিল জেগে পাড় করে দেয়। একবেলা খেলে আর দু’বেলা না খেয়ে থাকে। প্রায়সই ওর চোখের কোণায় পানিরা ভিড় জমায় কিন্তু গড়িয়ে পড়ার আগে আড়াল করে রাখে।
মনে মনে কথাগুলো বললেন রায়হান সাহেব। চাইলেও তিনি পারতেন কথাগুলো সরাসরি রুশাকে জানাতে কিন্তু তিনি এই কাজ কখনো করবেন না। যেদিন তাদের রাগ-অভিমানের বাঁধ ভেঙে যাবে সেদিন এমনি এই পাগল দুটো এক হবে। কিন্তু সেই দিনের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই। কিন্তু, খুব বেশি যে দূরে নেই এটা পরিষ্কার।
-তুই যাবি আমার সাথে কুঞ্জ বাড়িতে?
রুশা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রায়হান সাহেবের দিকে। কুঞ্জ বাড়িতে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব যেখান থেকে শুধুমাত্র লাঞ্চিত হয়ে এই বাড়িতে এসে থাকছে আজ দু’মাস ধরে।
————————–
-মাধুর্য, তুমি শুধু আমাকে পোড়াতে জানো আর কিছুই জানো না। শক্ত হৃদয়ের নারী তুমি, হৃদয়হীনা তুমি। আমার রাগটাই দেখলে আমার কষ্টটা বুঝলে না তুমি৷ আমার করা ভুলের জন্য তোমার কাছে যে মাফ চাইব সে সুযোগ তুমি আমায় দিচ্ছো না। কেন এমন করো, পাখিটা? আ..মি মানছি আমি সেদিন তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই বলে তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে। আজ দু’টো মাস তোমার ওই আদর মাখা আদলটাই আমার কাছে থেকে আড়াল করে রেখেছো।তোমাকে ছাড়া আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে কিছু খেতে পারিনা, যখনি খেতে বসি তখনি মনে হয় তুমি আমার পাশের চেয়ারে বসে গালে হাত রেখে আমার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো, যে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাই ওমনি তুমি অদৃশ্য হয়ে যাও। তখন আমার চোখের পানি গড়িয়ে ভাতের প্লেটে পড়ে। ঝাপসা চোখে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। তোমার হাতে সাজানো রুমটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, ছুঁয়ে দেখি না কোনো আসবাবপত্র যদি তোমার হাতের স্পর্শ হারিয়ে যায়। আজ দু’টো মাস ধরে আমাদের ঘর ছেড়ে ড্রইংরুমে শুয়ে-বসে রাত কাটাই আমি।
মাধুর্য ফিরে এসো তোমার আদিলের কাছে।পাখি, তোমাকে হারানোর পর আমার হৃদয়ের মধ্যেভাগে যেই আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয়েছে,সেই আগ্নেয়গিরি একমাত্র কমবে তোমার মাথা যেদিন আমার প্রশ্বস্ত বুকে ঠাঁই পাবে।।
কান্নামাখা কন্ঠে কথাগুলো বলছিল আদিল রুশার হাসোজ্জল ছবির দিকে তাকিয়ে।
———————
সময় অতিক্রম করে পাড় হলো আরও একসপ্তাহ। দেড়মাস আগে রুশা তার চাকরি স্থানান্তরিত করে জয়েন করেছে সোহরাওয়ার্দী হসপিটালে।
আদিলের সাথে যেন তার দেখা না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা।
আদিল বেশ চটে গিয়েছিল রুশার এই সিদ্ধান্তে কিন্তু কিছু বলার সাহস পায়নি। পাছে তার মাধুর্য আরও রেগে যায়, অভিমানে কেঁদে দিন পার করে। সেও তো পাশে নেই যে বলবে,
-পাখি আমার বুকে গুঁজে কান্না করো তো, তোমার অনুভূতির ঢেউয়ে আমার শরীর সিক্ত না হোক অন্তত তোমার চোখের জলে আমার বুক সিক্ত হয়ে যাক।
-রুশা?
-জি, আয়াত ভাই।
-আজ হসপিটালে যেয়েও না। কল করে ছুটি মঞ্জুর করো।
-কিন্তু, কেন?
-কারণ, আজ আমার বাবা-মা কানাডা থেকে আসবে।
-আজকে আসবে?
-হ্যা। প্লিজ আজ কোথাও যেয়েও না। মা তোমাকে সামনাসামনি দেখলে ভীষণ খুশি হবে৷
-আচ্ছা, যাবো না।
আয়াত খুশি মনে চলে গেলো বাজার করতে। অনেকবছর পর তার বাবা-মা বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবে। কাজলের সাথে আয়াতের বিয়ে হবার পর গিয়েছিল আর এখন আসছে বাংলাদেশে।
আয়াতকে অনেকবার ওর বাবা-মা রিকুয়েষ্ট করেছিলো, কানাডায় শিফট হতে কিন্তু আয়াতের কেন যেন বাংলাদেশকে ছেড়ে যেতে হয় না।
ভালো চাকরি করছে,প্রিয়তমা স্ত্রী, আদরের কন্যা আছে আর কি চাই আয়াতের? স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে তার বেশ চলছে বিদেশ যাবার দরকার নেই দেশের মাটি ভালো।
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সিজন_২
#Tahmina_Akhter
(১০)
আমি তখন হসপিটালে কল করে ছুটির জন্য আবেদন করছিলাম এমন সময় হুট করে কে যেন পেছন থেকে আমার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
-কেমন আছো, রুশা?
আমি কল কেটে পিছু ঘুরে তাকিয়ে দেখি একজন মধ্যবয়স্কা নারী আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।
সেই নারীর পিছনে এবার আয়াত ভাইয়াকে হাসিমুখে দেখা গেলো, বুঝতে পারলাম উনিই আয়াত ভাইয়ের আম্মু।
-আন্টি আমি ভালো আছি। আপনি?
-আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। জানো, আয়াতকে দেখার চেয়ে আমি তোমাকে দেখার জন্য বেশি অস্থিরতাবোধ করছিলাম। এখন তোমাকে দেখার পর থেকে মনটা কেমন শীতল অনুভব করছি!
রুশা তাকিয়ে আছে আয়াতের আম্মুর দিকে,অপরিচিত কারো জন্য কেউ কি এমন করে? জানা নেই। আয়াত ভাই পুরোটা উনার আম্মুর কপি।এত সুন্দর মায়া মায়া কথা আর কাউকে শুনতে দেখি নি এই মা-ছেলেকে ছাড়া।
আয়াত ভাইয়ের আব্বু -আম্মু ফিরে আসার খবর পেয়ে বাবা চলে এলেন। আরশি তার দাদা-দাদুকে দেখে খুশিতে আত্মহারা। কাজল আপু তো শাড়ি পরে নতুন বৌ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর আমার সামনে এসে বলছে,
-ভাবী,আমার খুব টেনশন হচ্ছে। শ্বশুর -শ্বাশুড়ির সামনে গেলে বুঝি এমন নার্ভাস ফিল হয়? তুমি কিভাবে আব্বার সামনে এত হাসিখুশি থাকো?
রুশা হালকা হেসে কাজলের হাত ধরে বলে,
-তুমি এর আগে কখনোই তাদের সাথে কথা বলোনি, দেখা করোনি তাই তোমার এত নার্ভাস ফিল হচ্ছে। এখন যতটা নার্ভাস ফিল হচ্ছে দেখবে কাল সকালে অতটা নার্ভাস ফিল হচ্ছে না। তাছাড়া, আয়াত ভাইয়ের আম্মু যথেষ্ট মিশুক প্রকৃতির। তোমার সাথেও তো কত মিষ্টি করে কথা বললো।
কাজল রুশার কথায় কতটুকু যুক্তি খুঁজে পেলো বোঝা গেলো না। কিন্তু, কাজলের চেহারায় সেই নার্ভাসনেসটা আর দেখা যাচ্ছে না।
সকলেই একসাথে মিলে দুপুরের খাবার খেতে বসলো।কাজল আর রুশা মিলে সকলকে খাবার সার্ভ করে নিজেরাও খেতে বসে পড়লো।
এমনসময়,আরশি তার ছোট ছোট পা দিয়ে দৌঁড়ে এসে রুশার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। উপস্থিত সকলে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে।রুশা খাওয়া বন্ধ করে আরিশকে জিজ্ঞেস করলো,
-কিছু বলবে, আরশি?
আরশি রুশার কথার জবাব না দিয়ে মোবাইল এগিয়ে দিলো। রুশা, আরশির হাত থেকে নিজের মোবাইল নিয়ে দেখলো, কেউ কল করেছে প্রায় ১০মিনিট হবে,এইজন্যই হয়তো আরশি মোবাইল নিয়ে এসেছে।
কিন্তু, নাম্বারটা আননোন হতে পারে কোনো রোগীর স্বজন কল করেছে। রুশা মোবাইল কানে ধরে সালাম দিলো। কিন্তু, ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। রুশা কান থেকে মোবাইল সরিয়ে চেক করলো কল কেটে গিয়েছে কি না? কিন্তু না কল কাটেনি।
রুশা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এঁটো হাত নিয়ে।রায়হান সাহেব ডাক দিবে এমন সময় কাজল উনাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।
রুশা মোবাইল কানে ধরে বললো,
-হ্যালো, কে আপনি? কথা বলছেন না যে? হ্যালো?
-মাধুর্য?
আজ কতদিন পর সেই চিরচেনা ডাকে রুশার হৃদয় কেঁপে উঠলো। ধুকধুক করছে হৃদয়, স্বাভাবিক হতে পারছে না রুশা। সবই তার কাছে নিছক স্বপ্ন মনে হচ্ছে। চোখে খুলে তাকালে আদিলের মাধুর্য ডাক মূহুর্তে বিলিন হয়ে যাবে অদৃশ্যে।
-কথা বলবে না আমার সাথে?
এবার রুশার বিশ্বাস হলো এটি তার স্বপ্ন নয় সত্যি আজ তার আদিল তাকে ডাকছে। কান্নার বাঁধ ভেঙে গেলো রুশার। হিচকি তুলে কাঁদছিল তখন মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না,রুশার।
-আজ যদি তুমি আমার সাথে কথা না বলো, তবে আমি ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যাবো৷ তখন তুমি থেকো তোমার জিদ নিয়ে।
ভীষন রেগে এই কথাটি বলে আদিল কল কেটে দিলো।এদিকে, রুশা আদিলের কাছ থেকে এমন কথা শুনে আতংকে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। দিশেহারা বোধ করছে রুশা, কারণ আদিলের মোবাইলে কল যাচ্ছে না সুইচড অফ জানাচ্ছে।
রুশা কোনোমতে পায়ে হেঁটে ডাইনিং টেবিলের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। রায়হান সাহেব এগিয়ে এলেন রুশাকে এমন অবস্থায় দেখে।
-কি রে, কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
-বাবা, আপনার ছেলে আমার কাছে কল দিয়ে বলেছে, ও ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যাবে।
রায়হান সাহেব বিশ্বাস করতে পারছে না আদিল এই ধরনের কথা বলেছে! তবুও, উনারও এখন বেশ সন্দেহ হচ্ছে, যদি সত্যি আদিল সেরকম কিছু করে ফেলে! তিনি মোবাইল বের করে আদিলের নাম্বারে কল দিলেন, কিন্তু মোবাইল সুইচড অফ বলছে।
রায়হান সাহেব এবার ঘামতে লাগলেন, রুশা রায়হান সাহেবের মুখের অভিব্যক্তি দেখে কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছে।
খুব দ্রুতই ওর ঘরে গিয়ে বোরকা-নিকাব পড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হতে যাবে তার আগে রায়হান সাহেব বলেন,
-তুই কোথায় যাচ্ছিস?আমি আর আয়াত যাচ্ছি। তোর শরীরটা এমনিতেই ভালো নেই।
-বাবা,আমি যাই। আপনি আয়াত ভাইকে নিয়ে আসুন। আমি যেতে যেতে বড্ড দেরি না হয়ে যায়।
রুশা দ্রুতপায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। একটি সিএনজি ডাক দিয়ে উঠে পড়লো উদ্দেশ্য কুঞ্জ বাড়ি।
এদিকে,
-আয়াত, তুমি এভাবে বসে আছো কেন? রুশা এই অবস্থায় একা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আর আদিলই বা কি অবস্থায় আছে কে জানে?
রায়হান সাহেব কথাগুলো বলে আয়াতের মুখের দিকের তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায় কিন্তু আয়াত আয়েশ করে খেতেই লাগলো।
আয়াতের আব্বু বেশ চটে গেলেন ছেলের এহেন আচরণ দেখে।
-তোমাকে কি বলছে তুমি শুনতে পারছো না আয়াত?
-আসলে হয়েছে কি, বাবা?আদিল ভাইয়া নিজের কোনো ক্ষতি করবে না। শুধুমাত্র রুশাকে ভয় দেখিয়ে কুঞ্জবাড়িতে নেয়ার জন্য মিথ্যে সুইসাইডের কথা বলেছে আদিল ভাইয়া।রুশা তো কোনোভাবেই আদিল ভাইয়াকে সুযোগ দিচ্ছিলো না তাই উপায় না পেয়ে ?
-তাই মানে কি? আমি জানি এমন মাথা মোটা পরিকল্পনা শুধুমাত্র তোমার মাথায় থাকতে পারে৷
কাজল বেশ রেগে কথাগুলো বলে উঠলো। বাকি সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো একে-অপরের দিকে।
*************
রুশার যেন প্রাণ যায় যায় অবস্থা, যদি সত্যি সত্যি আদিল নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলে তবে রুশা বাঁচবে কি করে,
-আল্লাহ, আপনি আদিলকে শান্ত করুন। একবার শুধু উনাকে সহি সালামতে খুঁজে পাই তবে সারাজীবনেও আর কখনো উনার সাথে অভিমান করে থাকবো না।
নানান রকমের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কুঞ্জ বাড়িতে পৌঁছালো রুশা৷ ভাড়া মিটিয়ে একপ্রকার দৌঁড়ে মেইন গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
ভিতরে দারোয়ানকে দেখা যাচ্ছে। রুশা দারোয়ানকে ডাক দিতে দারোয়ান এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-ম্যাম, আপনে?
-হ্যা আমি। তোমাদের স্যার ভিতরে আছে?
-জি ম্যাম আছে। আপনি যান।
গেট খুলতেই রুশা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। সদর দরজা হালকা ধাক্কা দিতে খুলে গেলো।রুশা যেন মন কিছুটা শান্তি পেলো দরজা খোলা পেয়ে। হাতের ব্যাগটি ড্রইংরুমের সোফার উপরে রেখে সিঁড়ি বেয়ে ওদের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় এত দৌঁড়ঝাপের কারণে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে রুশা। তবুও, নিজেকে স্বাভাবিক করে ওদের রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো।
ঘর জুড়ে কোথাও আলোর ছিট ফোঁটা নেই। অথচ বাইরে তখনও বিকেল। জানালা বন্ধ, ঘরের বাতি নেভানো। রুশা এইবার রুমের লাইট অন করলো। দেখলো পুরো ঘর ফাঁকা কোথাও আদিল নেই।
রুশার এবার ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো। সত্যিই কি আদিল?
-আদিল, আপনি কোথায়? আপনি প্লিজ চলে আসুন। বিশ্বাস করুন আমি আর কখনো আপনার সাথে রাগ করবো না। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, আপনি শুনতে পারছেন আমি কি বলছি?
জোরে জোরে কান্না করছে রুশা। এমন সময় রুশাকে কেউ পরম আবেশে বুকের মাঝে টেনে নিলো। রুশার এই স্পর্শ বহু চেনা। এই স্পর্শ খানি পেয়ে যেন রুশার কান্নার গতি আরও বেড়ে গেলো।
-তলে তলে এতকিছু!তুমি আমার সাথে কথা বলবে না,আমার সাথে একই ছাঁদের নিচে বসবাস করবে না তবে, আজ কেন আমার কাছে ছুটে এলে?
রুশার কান্নার বেগ কমে এলো আদিলের খোঁচানো কথা শুনে।
রুশা চোখের পানি মুছে আদিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ঠোঁটের কোণায় দুষ্টহাসি ঝুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে।
রুশা এবার আদিলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,
-আপনি তাহলে আমার সাথে প্র্যাংক করেছেন?
আমি তাহলে শুধু শুধু আপনার জন্য চিন্তা করছিলাম!আপনি মিথ্যা কথা বলেছেন আমার সাথে।
-ভালোবাসার মানুষকে যখন কোনোভাবে নিজের করে নেয়া যায় না,তখন মিথ্যা বলে যদি তাকে কাছে পাওয়া যায়। তবে আমি মনে করি মিথ্যার আশ্রয় নেয়া শ্রেয়।
-আমি থাকবো না, চলে যাবো।
রুশা ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছিল আদিল পিছন থেকে রুশার হাত ধরে ফেললো।রুশা পিছন ফিরে আদিলকে বললো,
-হাত ছাড়ুন আমার। আমি থাকবো না এখানে।
-তুমি যেহেতু চলেই যাবে তবে যাওয়ার আগে এই ছুরিটা দিয়ে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলে যাও। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।রুশা, আমি মানছি সেদিন আমার ভুল ছিল। কিন্তু, এরপর থেকে আমি বারবার তোমার কাছে গিয়েছি ক্ষমা চাইতে, তোমাকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু, তুমি হৃদয়হীনা আমাকে বারবার খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছো।
রুশার দিকে একটি ছুরি এগিয়ে দিয়ে বললো আদিল। রুশা ছুরিটার দিকে তাকিয়ে আদিলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আর, আপনি কি করেছেন মি.আদিল?আমার কথা একটিবারের জন্য শুনতে চেয়েছেন? নাকি একবার বোঝার চেষ্টা করেছেন আমি কি বলতে চাই আপনাকে?
রুশার কান্নারত কন্ঠে বলা এক একটি শব্দ যেন আজ তীরের আঘাতের মতো বিঁধে যাচ্ছে, আদিলের পুরো শরীরে।
তার একটু ভুলের জন্য আজ তার মাধুর্যের চোখে পানি। অথচ, কথা ছিল কখনোই ওই চোখে পানি আসতে দিবে না আদিল। কিন্তু, সে কথা রাখতে পারলো কই?
#চলবে