শেষ_বিকেলের_মায়া (৯)

#শেষ_বিকেলের_মায়া (৯)

ছেলেটা মেয়েটার খুব নিকটে অবস্থান করছে। তাদের দুজনের দূরত্ব একেবারেই নেই। হুট করেই তাদের ভালোবাসা একে অপরের অধরে মিশে গেল। পুরো দৃশ্যটা চোখের সামনে ঘটে গেল। ফারিহা বিষয়টা দেখতে চায় নি তবু চোখে পড়ে গিয়েছে। অন্যের গোপনীয়তা নষ্ট হওয়ায় নিজের কাছেই খারাপ লাগল। নীরবে নত মুখে বেরিয়ে পড়ল সে। খাবার খেতে খেতে এক চামচ স্যুপ পড়ে গিয়েছিল শাড়িতে। সেটা পরিষ্কার করতেই ওয়াশরুমে এসেছিল। মাঝে এই অনাকাঙ্খিত দৃশ্যটি নজরে এল। রিহান বেশ অনেকক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে। ফারিহা কে দেখতে পেয়ে সে বলল,”মম তোমাকে কিছু বলেছে?”

“কোন ব্যাপারে?”

“বিয়ের ডেট নিয়ে?”

“না।”

“অহ। যদি বলে তো সোজা বলবে এখন না।”

“আচ্ছা।”

সময়টা অতি দ্রুত পেরিয়ে গেল। রুনার বান্ধবীরা চলে যাবে। রিহান আর ফারিহাকে দেখে বলল,”হাউ কিউট দে লুক টুগেদার।”

রুনা হাসলেন। ছেলের পছন্দ নিয়ে সে নিজেও বেশ খুশি।
“এদিকে আসো রিহান। তোমার আন্টিরা চলে যাচ্ছে।”

রিহান এগিয়ে আসল। আন্টিরা তাকে নানান ধরনের কথা বলছে। এরই মধ্যে একজন বলল,”বিয়ে করছ কবে?”

বিয়ের কথা শুনে রিহান নিজেই ভরকে গেল। রুনা কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন। ওমন সময় ফারিহা বলল,”কিছু সময় নিতে চাচ্ছি আমরা। রিহান তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হলেও আমার কিছু গ্যাপ রয়েছে। আমি ভার্সিটির জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছি।”

দম ফেলল রিহান। ওর কথায় সায় দিতে বলল,”ইয়েস। মম ড্যাড যদিও আগেই বিয়ের আয়োজন শেষ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে আরেকটু সময় নিয়ে প্ল্যান করাটা বেটার। যেহেতু ওর ভার্সিটির প্রিপারেশন নেওয়া বাকি।”

এর পরের কথা গুলো রিহান ই বলল। ফারিহা শুধু লাইন ধরিয়ে দিয়েছে। রুনা এ বিষয়ে তখন কিছু না বললেও গাড়িতে এসে বললেন,”তোমরা এ ডিসিশন কখন নিলে?”

“আগেই তো বলেছিলাম মম।”

“তোমার ড্যাড মানবে না রিহান।”

“প্লিজ ম্যানেজ করো।”

“এভাবে ম্যানেজ হয় না বেটা।”

“প্লিজ মম। তুমি পারবে।”

রুনার মুখটা গুমোট হয়ে রইল। ফারিহা আগে থেকেই চুপ। হুট করেই গাড়ি থামিয়ে দিল রিহান। পেছন ফিরে বলল,”মম,আমরা হুট করেই বিয়ে করতে চাই না। আমরা সময় চাই।”

“এর মানে কি রিহান? ভবিষ্যৎ এ ডিসিশন বদলাতে পারে? তোমরা সম্পর্ক নিয়ে এখনো নিশ্চিত না?”

“নো মম। তেমন না।”

রিহান যেন মিইয়ে গেল। একটা উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,”ওকে ফাইন তোমরা চাইলে আজ ই বিয়ে করে নিব। গাড়ি ঘুরাচ্ছি আমি। হ্যাপি এবার?”

ছেলের আচরণে তৃপ্তি পেলেন না রুনা। একটা চিন্তায় ডুবে গেলেন। ফারিহা মা ছেলের কথা শুনছিল। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এদিকে দুঃখে কান্না পাচ্ছে রিহানের। কিয়া কেন বুঝল না তাকে?

ধীরে ঘরে প্রবেশ করল ফারিহা। সে ভেবেছিল মা হয়ত ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু না তিনি জেগেই আছেন। মেয়েকে আসতে দেখে ডেকে উঠলেন।
“ফারিহা, এসেছিস মা?”

“হ্যাঁ মা। তুমি ঘুমাও নি কেন?”

“তুই ঘরে নেই। ঘুম কি আসে রে মা?”

মায়ের কথায় কেমন একটা মন খারাপ হলো ফারিহার। এরই মধ্যে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,”তোর জামাটা পরিবর্তন লাগছে।”

হঠাৎ কথাটা তোলায় চমকে উঠল ফারিহা। রিহান তাকে ড্রপ করে দিলেও জামা বদলের সময় নি। এতটা মাথায় ও আসে নি। তবে বিষয়টা সে সামলে নিল। মায়ের পাশে বসে বলল,”স্যারের অফিসে পার্টি ছিল মা। তাই এই পোশাক টি পরতে হয়েছে।”

“অহ।”

“খাও নি নিশ্চয়ই?”

“ভালো লাগছিল না।”

“আচ্ছা। আমি রান্না বসাই।”

সকালে ভাত ফুটিয়েছিলেন ফাহিমা। ফারিহা তৎক্ষণাৎ চুলা ধরাল। আগে তাদের বাসায় ফ্রিজ ছিল না। এখন ছোট ফ্রিজ ও হয়েছে। সেখান থেকে চিংড়ি মাছ বের করে নিল। সেটা রান্না করতে করতে হঠাৎ নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকাল। রিহানের সাথে চুক্তিটা যদিও বড্ড অদ্ভুত তবু এখন তার কাছে টাকা আছে। যেই টাকা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে। ভালো খাবার জুটছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল মেয়েটি। লোকে বলে টাকায় নাকি সুখ নেই। যদিও কথাটি সত্য তবু বলতে হয় টাকা ছাড়াও সুখের নয় জীবন। জীবনযাত্রার জন্য সব কিছুই বড়ো প্রয়োজন। সেখানে টাকা যেন একটু বেশিই ভূমিকা রাখছে। মা কে নিজ হাতে খাবার খাওয়াচ্ছে ফারিহা। খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে ফাহিমা বলল‍েন,”তোর জন্য বড়ো মায়া হয় রে মা।”

ফারিহা কিছু বলল না। এমনটা প্রায়শই বলেন তিনি। মেয়ে চুপ থাকাতে ফাহিমাই বললেন,”এই রুগ্ন মায়ের জন্য কতটা করে যাচ্ছিস। বিনিময়ে কিছুই পেলি না। সুখের জীবন দিতে পারলাম না তোকে।”

“এসব বলতে নেই মা।”

“কখনো আপসোস কিংবা রাগ রাখিস না মা। দশ মাস পেটে ধরেছি এটা মনে করে মাফ করে দিছ।”

কেন যেন ফারিহার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। নিজের জীবন নিয়ে আক্ষেপ তার সত্যিই রয়েছে। তবে সেটা কতটা যৌক্তিক এটাও ভাবার বিষয়। যখন তার বয়সী অন্য মেয়ে নজরে আসে। যাদের জীবন সুন্দর। তখন মনে হয় কেন এত অগোছালো হলো তার জীবন?

রিহানের জন্য আলাদা একটি রুম রয়েছে। যে রুমটি রিডিং রুম নামে পরিচিত। ছাত্র জীবনের দশ বারো ঘন্টা সেই রুমে বসেই পড়াশোনা করেছে সে। পড়ার প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছিল। এক মাত্র ছেলে শুধু পড়ালেখায় সমস্ত ধ্যান দিয়ে বাইরের জগতের প্রতি অনীহা তৈরি হচ্ছে বুঝতে পেরে ইরফান জোয়ার্দার ঠিক করলেন ছেলেকে বক্সিং এ পাঠাবেন। রিহান শুরুতে নাকোচ করলেও ভদ্রলোক জোর করলেন। বক্সিং শিখতে লাগল রিহান। এতটাই ভালো বাসা হলো যে পরের বছর ই বক্সিং খেলায় নাম দিল সে। বেশ কিছু জায়গায় জয় পাওয়া ও হলো। খেলতে খেলতে ওর জাতীয় পর্যায়ে নাম উঠল। ওমন সময় গাড়ি অ্যাক’সিডে’ন্ট হওয়ায় হাতে চোট মিলল। তারপর থেকে ছাড়তে হলো বক্সিং। শুরুর দিকে সবাই বলেছিল ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হবে রিহান। তবে নিজের স্বপ্ন টা জেতা হলো না। অধরা রয়ে গেল বক্সিং শিরোপা। এরপর অনেকটা সময় গেল। পড়াশোনায় মনোযোগ এল। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল স্বপ্নের বিজনেস। তবে অধরা স্বপ্নটা কখনো কখনো যন্ত্রণা দেয়। যেমনটা এখন হচ্ছে। আকাশের ম্নিয়মান চাঁদের দিকে তাকিয়ে কিয়াকে কল করল সে। কিয়া রিসিভ করে বলল,”বিয়ে বাদে যে কোনো কিছু বলতে পারো।”

রিহান কিছু বলল না। কিয়া কি যেন বুঝে ডাকল।
“রিহান।”

“তোমার মনে হয় না তুমি পরিবর্তন হয়েছ কিয়া?”

“পরিবর্তন? তোমার এমন কেন মনে হলো?”

“জানি না। তবে মনে হচ্ছে। কোথাও একটা যন্ত্রণা হচ্ছে।”

“রিহান, বেবি একটা কথা মনে রেখো। ধৈর্য মানুষকে অনেক দূর নেয়।”

“এই ধৈর্য তোমাকে হারিয়ে দিবে না তো কিয়া?”

ওপাশে থাকা কিয়া কোনো কথাই বলল না। রিহান অধৈর্য হয়ে ডাকল।
“কিয়া, আমি পারছি না। তোমাকে ভীষণ ভাবে পাশে দরকার।”

“কানাডা চলে এসো।”

“আমি সব সময়ের জন্য তোমাকে চাই কিয়া।”

“সেটার জন্য একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে রিহান। আমাকে প্লিজ ফোর্স কোরো না।”

“ফোর্স করছি আমি?”

“তেমন নয় কি?”

“ওকে আই এম সরি। বাট স্টিল আই মিস ইউ।”

“আই অলসো মিস ইউ জান। একটু অপেক্ষা করো প্লিজ।”

ওপাশ থেকে কিয়াও যেন হতাশার শ্বাস ফেলল। রিহান ও চুপ। তাদের দুজনের অন্তরেই যেন ব্যথা। একে অপরকে হারিয়ে ফেলার শোক। তাদের দুজনের দূরত্ব কবে শেষ হবে কউ কি জানে?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

পর্ব (১০)
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/313361031224798/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here