শ্রাবণ ধারা পর্ব -০১

প্রায় এক ঘন্টা যাবত ওয়াশরুমের দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে ধারা।ঝর্ণার পানিতে সে ভিজে একাকার। আজকে রাতে তার জ্বর আসবে নিশ্চিত তবে তাতে তার কোন হেলদোল নেই।ঝর্ণার পানির সাথে তাল মিলিয়ে তার পিঠ বেয়ে গড়িয়ে চলেছে টকটকে লাল রক্ত!
অবাক লাগলো তাই না?অবাক ধারাও হয়েছিল যখন তার নিজের মা তাকে বেধম পিটিয়েছিলো। তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল নিজের বাবার মুখে নিজের নামের পাশে পতিতা ট্যাগ শুনতে পেয়ে।
চলুন ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ঘুরে আসা যাক।

ধারা,পুরো নাম অধরা শেখ ধারা।ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাড়ি থেকে দূরের একটা কলেজে যে পড়াশুনা করে।কলেজ আর বাসার দূরত্ব কিছুটা বেশি হওয়ায় সে হোস্টেলে থাকে।দু সপ্তাহ পরপর বাসায় আসার সৌভাগ্য হয় তার।এই বার যেন তার সৌভাগ্য তার দূর্ভাগ্যকেও হার মানালো।বাড়িতে এলেই সে দেখতে পেতো তার মা-বাবার চকচকে হাসি মুখ।কিন্তু এবার বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা।এবার বাড়িতে আসতে না আসতেই তার উপর চলতে থাকে অজস্র গালির বর্ষণ।ধারা অবাক হয়।প্রচণ্ড অবাক হয়।যেই বাবা-মা তাকে কোনো দিন একটা ধমক অব্দি দেয়নি সেই বাবা-মা তাকে এইভাবে বলছে ভাবতেই ধারার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।এর আগে সে নিজের বাব-মা’র এমন রূপ দেখেনি কখনও।সবচেয়ে বেশি অবাক তো তখন হয়েছিল যখন তাকে রাস্তার মেয়ে বলা হয়েছিল। আচ্ছা সে কি আসলেই রাস্তার মেয়ে? সে কি আসলেই পতিতার সমতুল্য?কেন?কি করেছে সে?তার জানা মতে সে এমন কোনো কাজ করেনি যাতে করে তার বাবা-মায়ের সম্মানহানি হয়।তাহলে আজ কেন তাকে নিজের বাড়িতে এমন আক্রোশের শিকার হতে হচ্ছে?কি অপরাধ তার?কোন অপরাধের এমন নির্মম শাস্তি সে পাচ্ছে তা ধারার জানা নেই।

আরো কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধারা ওয়াশরুমের ঝর্ণা বন্ধ করে দেয়।শুকনো কাপড় পরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে আঁতকে উঠল সে।ধবধবে সাদা শরীরে আঘাতের দাগ স্পষ্ট! আবারও ধারার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। আলমারি থেকে ফুলহাতার কলার জামা পরে নেয় সে।মারের দাগ গুলো ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা। এগুলো দেখলে যদি বাব-মা’র কষ্ট হয় তখন!আসলেই কি তারা এই দাগ গুলো দেখে কষ্ট পাবেন?সত্যিই কি কষ্ট হবে তাদের?অবস্থাটা যদি কিছুদিন আগের হতো তাহলে উত্তর হতো “হ্যাঁ” তার বাবা-মা ভিষণ কষ্ট পেতেন।কিন্তু এখন?এখন বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা কারণ দাগগুলো যে তাদেরই দেওয়া উপহার!

ধারা বিছানায় আসন পেতে বসে আছে।তার সামনে ঝুলছে তাদের ফ্যামিলি ফটো।ছবিতে চারজন মানুষ।ধারা,তার বাবা-মা আর ধারার বড় ভাই আবির।সে একজন ইন্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট। পেট্রোলিয়াম ইন্জিনিয়ারিংয়ে চুয়েটে অধ্যায়নরত।ধারা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ছবিটির দিকে।ছবিতে ধারার বাব-মায়ের সামনে ঘাসের উপর বসে আছে ধারা আর আবির।আবির ধারার চুল টেনে আছে আর ধারা গাল ফুলিয়ে বসে আসে।ইশ! কি সুখী পরিবার তাদের।সকলে তাকে কতো ভালোবাসে। ওহ্ বাসে না বসতো।সবটাই যে এখন ধারার জন্য অতীত। হঠাৎ করেই তার পরিবারের সকল সদস্যের ভালোবাসা কর্পূরের ন্যায় যেন উবে গেলো।কেন এমন হলো?উত্তরটা ধারার অজানা।

বসার ঘর থেকে হালকা বাক-বিতন্ডার আওয়াজ আসছে।একটা কন্ঠস্বর তার ভাই আবিরের অপরটি তার বাবার।বাকিগুলো কার তা ধারা ঠিক ঠাহর করতে পারলো না।আওয়াজ শুনে সে দরজার কাছে যায়।দরজা টান দিতেই সে বুঝতে পারলো দরজা বাইরে থেকে আটকানো আছে।যার মানে তাকে ঘরে বন্দী করা হয়েছে।আবারো একটা দীর্ঘশ্বাসকে পুঁজি করে সে পুনরায় বিছানায় এসে বসে।খাটে হেলান দিতেই ক্লান্তিতে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসে ধারার।
মৃদু কম্পনে “ভুমিকম্প” বলে চেচিয়ে উঠে ধারা।
—আস্তে এতো চেচাচ্ছিস কেন বেহায়া মেয়ে?

প্রচন্ড রেগে কথাটা বললেন ধারার মা মিসেস আয়েশা।ধারা কিছুক্ষণ ঢুলুঢুলু চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে পুরো বিষয়টা বুঝতে পারলো।ধারার মা ধারার মুখের উপর একটা হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি ছুড়ে দিয়ে বললো,,
—যা এটা পরে আয়।

—হঠাৎ শাড়ি কেন?

—এখন তোর বিয়ে তাই।
মায়ের কথায় যেন ধারার মাথায় বাজ পড়লো।তার বিয়ে?মানে কি!

—বি..বিয়ে মানে?

—দেখ কোনো নাটক করবি না।এমনিতেই যা করেছিস তাই অনেক আর কোনো ড্রামা চাইছি না।

ধারা একটু সাহস করে বললো,
—কি করেছি কি আমি যাতে করে তোমাদের মান-সম্মান ডুবে গেলো?
ধারা কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার গালে পড়লো এক বিশাল থাপ্পড়। চড় খেয়ে ধারা গালে হাত দিয়ে রোবট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবার তার মা কিছুটা চেচিয়ে বললো,
—বাইরে রঙ্গলিলা করে ঘরে এসে জিজ্ঞেস করছিস কি করেছিস?এই তোর লজ্জা করে না তাই না?কোন পাপে যে তোকে আমি পেটে ধরেছিলাম। মরতেও তো পারিস তুই।বেঁচে আছিস কেন তুই।

ধারা তখনো রোবট হয়ে বসে আছে।তার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গরম অশ্রু। তার নিজের জন্মদাত্রী মা তার মৃত্যু কামনা করছে! সেই মা মৃত্যু কামনা করছে যে মা তার সামান্য জ্বরেও কেঁদে বুক ভাসাতো।

♣️
ধারা সামনে দশ মিনিট যাবত বসে আছে শ্রাবণ।শ্রাবণ ধারার প্রাইভেট টিউটর। হোস্টেলে যাওয়ার আগে শ্রাবণ ধারাকে প্রাইভেট পড়াতো।সে একজন এমবিবিএস স্টুডেন্ট। এবার তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সে।তার সাথেই বিয়ে হতে যাচ্ছে ধারার।ধারা নিজের বিয়ের কথা শুনে যতটা না অবাক হয়েছে তার চাইতেও দ্বিগুন তিনগুন বেশি অবাক হয়েছে বরের জায়গায় শ্রাবণকে দেখে।শ্রাবণের সাথে ধারার বিয়ে হচ্ছে ভাবতেই ধারার কান্নারা যেন ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে আসছে।ধারা শ্রাবণকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতো।কিন্তু কখনও নিজের আচরণে তা প্রকাশ করেনি।পরে যখন জানতে পেরেছিলো শ্রাবণ একটা মেয়েকে ভালোবাসে তখন সে খুব যত্নে নিজের অনুভূতি গুলোকে আগলে নেয়।অনুভূতি গুলোকে শ্রাবণের দিকে আর এক কদমও বাড়তে দেয় নি।শত কষ্টে আগলে রাখা অনুভূতি গুলোর কি হবে এখন?ধারার জীবনের ধারা কোথা থেকে যে কোথায় যাচ্ছে তাই সে বুঝতে পারছে না।নিরবতা ভেঙে শ্রাবণ এক পর্যায়ে ধারাকে বলে,,
—কি সমস্যা তোমার?বিয়ে কেন করতে চাইছো না?

শ্রাবণের এমন প্রশ্নে ধারা অবাক হয়।

—আপনি বিয়েটা করতে চান?

—বিয়ে করতে না চাইলে কি এখানে আসতাম নাকি? আজব।
বেশ বিরক্ত হয়ে কথাটা বলে শ্রাবণ।শ্রাবণের কথায় আবাকতা এক ধাপ বেড়ে গেলো ধারার।
—মানে?আপনি না মেহরিন আপুকে ভালোবাসেন?

—হ্যাঁ তো?কি হয়েছে এখন?

—কি হয়েছে মানে?মেহরিন আপুকে ভালোবাসার সত্ত্বেও আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইছেন?

—মেহরিনকে ভালোবাসলে কি তোমাকে বিয়ে করা যাবে না নাকি?

—যখন মেহরিন আপুকে ভালোবাসেন তখন বিয়েটাও তাকেই করা উচিত।তাই নয় কি?

শ্রাবণ এবার ভ্রু কুঁচকে বললো,,
—বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করতে বলছো?

—বিবাহিত মেয়ে মানে?

—ওই মেয়ের আরো দু’বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।গিয়ে দেখো স্বামীর সাথে সুখে সংসার করছে সে।

ধারার এবার মাথা ঘুরছে।এতো এতো চাপ সে নিতে পারছে না।আজকে সকাল থেকেই সবাই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে চলেছে।সন্ধ্যায় শুনতে পেলো আজ তার বিয়ে।তার কিছু সময় পর জানতে পারলো তারই প্রাইভেট টিচারের সাথে তার বিয়ে যে অন্য একজন মেয়েকে মনে প্রাণে ভালোবাসে।আর এখন জানতে পারেছে মেহরিন দু’বছর আগেই নিজের নামের পাশে বিবাহিত মহিলার তকমা লাগিয়ে বসে আসে।সারাদিনের না খাওয়া আর এতো প্রেশার সহ্য করতে না পেরে ধারা এক সময় জ্ঞান হারায়।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ।

#শ্রাবণ_ধারা
/সূচনা_পর্ব/
#সাদিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here