#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ❤’
#’লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
#’পর্বঃ ১২
.
রত্নমার দিকে ক্রমশই এগিয়ে আসছেন রুদ্র। একসময় একদম কাছে এসে দাঁড়িয়ে রত্নমার ছোট ছোট চুলগুলোতে হাত বোলালেন তিনি। বাঁকা হেসে বললেন,
—” যে যাই বলুক! তোমাকে কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেশে দারুণ লাগছে। কামড়াতে ইচ্ছে করছে।”
রত্নমা চমকায়। এত ভালোবাসা! রুদ্র তার প্রতি হঠাৎ এত প্রেমময় বার্তা গাইছে কেন? সন্দিহান দৃষ্টিতে রুদ্রের পানে তাকালো রত্নমা। একটু আগেও যে কিনা তার গুণ নেই বলে তাকে অপমান করছিল, সে এখন তার তারিফ করছে? ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না রত্নমার। তবে রুদ্রও রত্নমাকে ভাববার কোনো প্রহর দিলেন না। একটানে নিজের অনেকটা কাছে এনে দাঁড় করালেন তাকে। বলা বাহুল্য, রত্নমাকে নিজের একদম কাছে আনলেও তার হাত স্পর্শ করা ছাড়া এক বিন্দু জায়গাও স্পর্শ হয় নি দু’জনের মাঝে। এতে যদিও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই রত্নমার। সে তো রুদ্রের মতিগতি বুঝতে চাইছে। খুব করে চাইছে! তবে প্রতিবারের মতো সে এবারও ব্যর্থ। রুদ্রকে বোঝা যে খুব মুশকিল। রুদ্রের নেশাময় সেই চোখদু’টোর দিকে তাকাতেই রত্নমা অধিক আবেগী হয়ে উঠছে। সবকিছু যেন ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। রুদ্রের প্রতি দুর্বল হওয়া ছাড়া আর কোনো দিক-বেদিক চিন্তা করার সময় নেই তার। রুদ্র যা বলছে সব সঠিক। সব! বাকি সবাই মিথ্যুক। মিথ্যাচার করছে তার সঙ্গে। রত্নমার এ ভাবনাটাকেই কাজে লাগালেন রুদ্র। প্রতিবারের মতো রত্নমার গাল স্পর্শ করে আলতো হাতে বোলাতে লাগলেন। মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—” মাতার অগ্রে তোমাকে ওমন কটু কথা বলায় তুমি কি রাগ করেছ রত্নমা?”
রত্নমা মাথা নাড়ায়। সে রাগ করে নি। অথচ একটু আগেও রাগে, অপমানে, হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল সে। আলবাদ যাচ্ছিল। আর এখন! এখন সব শান্ত! রত্নমার মাথা নাড়ানো দেখে রুদ্র হাসলেন। অতীব শান্ত কণ্ঠে বললেন,
—” তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
—” বলুন।”
রুদ্র বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। রত্নমার একটু পাশে থাকা দর্পণে (আয়না) স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে তাদের পশ্চাতে। আর সে ‘কেউ’ আর কেউ নয় সয়ং চন্দ্রা। রুদ্র প্রথমে চমকে যান চন্দ্রাকে দেখে। কেননা চন্দ্রা নিজ কক্ষ থেকে কিভাবে বেরোলো? তাছাড়া যেভাবেই বেরিয়ে আসুক না কেন রত্নমার কক্ষে ঢোকার আগে তো দাসীদের তাদের জানান দেওয়ার কথা! পরক্ষণেই মনে হলো হয়তো কিরণের কাজ এটি। চন্দ্রার অতীব রুক্ষ আচরণের সঙ্গে না পেরে চন্দ্রাকে এখান অব্দি আনতে সাহায্য করেছে সে। এরুপ বেশ কয়েকবারই করতে চেয়েছে চন্দ্রা। রুদ্রের আদেশে কিরণ চন্দ্রাকে সাহায্য করে নি। শেষে রুদ্রই বলেছিল চন্দ্রা যদি অতি পাগলামো করে তাহলে তার কথা যেন কিরণ শোনে। কিন্তু চন্দ্রাকে কোনোরুপ একা না ছাঁড়ে। ভাবতেই আরশিতে(আয়নায়) দেওয়ালের ওপাশে লুকিয়ে থাকা চন্দ্রাকে আরো একবার দেখে নিলেন রুদ্র। কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে রত্নমার অতি নিকটে এগিয়ে গেলেন। নিজের সাথে রত্নমাকে মিশিয়ে গালে স্পর্শ করতে লাগলেন গভীর ভাবে। রত্নমা রুদ্রের স্পর্শে আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। চন্দ্রা এসব দেখতে পারছে না আর। নিজেরই কেমন গা ঘিনঘিন করছে। একটা মানুষ এতটা জঘন্য হয় কিভাবে? একবার এর কাছে তো একবার ওর কাছে। রুদ্র কি ক্লান্ত হন না এসবে? প্রশ্নটা বেশ ভাবায় চন্দ্রাকে। তবে এখন এসব কিছু নিয়ে ভাবলে চলবে না। চন্দ্রার মুখ্য লক্ষ হল রুদ্রের দুর্বলতা অথবা এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করা যার প্রতিদানে সে এই নরক থেকে বেরোতে পারবে। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও দেওয়ালের ওপাশে লুকিয়ে রুদ্র আর রত্নমার কথোপকথন শোনার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে সে। কক্ষের বাহিরেই হয়তো দাঁড়িয়ে আছে কিরণ।
এদিকে রুদ্র রত্নমার গাল স্পর্শের পাশাপাশি আড়চোখে দর্পণের দিকে তাকাচ্ছেন। চন্দ্রার বিরক্তিমাখা মুখশ্রী বেশ উপভোগ করছেন রুদ্র। রত্নমাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে রুদ্রের মাঝে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে রুদ্রকে। তার সেই কাজে ব্যঘাত ঘটিয়ে রুদ্র মৃদু স্বরে বলে উঠলেন,
—” তোমার অবশিষ্ট কেশ যদি আমি কেটে ফেলি তাহলে কেমন হবে রত্নমা?”
রুদ্রের কথায় চমকে উঠল রত্নমা। দু’কদম পিছিয়ে গেলো। তা দেখে রুদ্র উচ্চস্বরে হেসে উঠল। আবারও রত্নমার কাছে এসে বলল,
—” ভয় পাচ্ছো কেন? ভালোবাসার মানুষকে ভয় পেতে নেই। এতে পাপ হয়। অধিক পাপ! যার শাস্তি আমি তোমাকে দিবো।”
রত্নমা ঠিক বুঝতে পারল না রুদ্রের কথা। সব কিছু কেমন উলোটপালোট হয়ে গেছে তার। অথচ তাকে এভাবে দেখে দিব্বি হাসছেন রুদ্র। রত্নমাকে হা করে থাকতে দেখে রুদ্র আবারও হাসলেন। হাত দিয়ে রত্নমার থুতনি ধরে মুখ বন্ধ করে দিলেন। ধীর কণ্ঠে বললেন,
—” আজ রাতে তৈরি তো তুমি রত্নমা?”
এ যেন না চাইতেও হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। কিন্তু রত্নমা এটা বুঝতে পারছে না হঠাৎ রুদ্রের এত পরিবর্তন কেন? সন্দেহ হতে গিয়েও কেন যেন সন্দেহ করতে পারছে না রত্নমা। এত দিনের অপেক্ষার পর যখন রুদ্রই নিজ থেকে তার কাছে আসছে তখন এত ভাবনার কিসের? এদিকে চন্দ্রা বারংবার রুদ্রের এসব বাজে কথা শুনে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে রেখেছেন। এখানে যে কোনো কাজের তথ্য জানা সম্ভব নয় তা বুঝে গেছেন ইতোমধ্যে। তাই রত্নমার কক্ষ থেকে বেরিয়েই কিরণকে নিয়ে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হোন চন্দ্রা। দর্পণে চন্দ্রার চলে যাওয়া দেখে রত্নমা থেকে দু’কদম দূরে এসে দাঁড়ান রুদ্র। বলে উঠেন,
—” তাহলে রাত্রিবেলা দেখা হচ্ছে তোমার সঙ্গে আমার।”
রত্নমা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,
—” জ্বী অবশ্যই রু…. সম্রাট!”
রুদ্র আড়চোখে একবার তাকান রত্নমার দিকে। পরক্ষণেই আবার বলে উঠেন,
—” রাত্রি বেলা আমার কক্ষে না চন্দ্রার কক্ষে আসবে রত্নমা। সাথে কিছু দাসীকে নিয়ে অধীক সংখ্যক ভালো ভালো অলংকার এবং বস্ত্র নিয়ে আসবে। এবং তা অবশ্যই একজন নারীর বিয়ের অলংকার ও পোশাক হতে হবে।”
রত্নমা ভ্রু কুঁচকে বলে,
—” একজন নারীর বিয়ের পোশাক ও অলংকার? কেন? তাছাড়া রাত্রে চন্দ্রার কক্ষে গিয়ে আমি কি করব? আমার তো তখন আপনার কক্ষে হওয়া উচিত। আপনাকে সঙ্গ দিতে!”
এবার রুদ্র বিরক্ত হলেন। বিরক্তিতে ডান ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,
—” আমাকে সঙ্গ দিতে বলেছি আমি? শুধু রাত্রিবেলা দেখা হওয়ার কথা বলেছি। এত বেশি বোঝো কেন হাঁ?”
রত্নমা ঠিক বুঝলো না রুদ্রের কথা। অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল রুদ্রের দিকে। রুদ্র থেমে থেমে আবারও বললেন,
—” তোমাকে তো একটা কথা বলা হয় নি। আগামীকাল আমার সঙ্গে চন্দ্রার বিবাহ হচ্ছে।”
ব্যাস, এতটুকু কথা যথেষ্ট ছিল রত্নমার অশান্ত মনটাকে মুহুর্তেই লাভার মতো জ্বলে উঠাবার জন্য। তবে রত্নমা চিৎকার করার আগেই তার মুখ চেপে ধরলেন রুদ্র। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
—” ভুলেও এমন ভুল করবে না রত্নমা। নতুবা অনেকদিন হলো কারো গর্দান তলোয়াড় দ্বারা ক্ষত-বিক্ষত করি নি আমি। এতে আমার তলোয়াড়েরও মন অশান্ত হয়ে আছে। এমন না হয় তলোয়াড়কে শান্ত করতে তোমার গর্দান উড়িয়ে ফেলি আমি।”
রত্নমা ‘টু’ শব্দটিও আর করল না। ভয়-ভীতিতে আরষ্ঠ হয়ে রিতিমতো কাঁপতে লাগলো সে।
___________________
নিজ কক্ষে পায়চারী করছে চন্দ্রা। কিভাবে এখান থেকে মুক্তি পাবে সে চিন্তায় গভীর ভাবে মগ্ন সে। কখন থেকে যে রুদ্র এসে তার অগ্রে দাঁড়িয়ে আছে সে দিকে কোনো খেয়ালই নেই তার। হঠাৎ সামনে তাকাতেই চন্দ্রা চমকে যান। রুদ্র তার অগ্রে বুকে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু দুটো কিঞ্চিত কুঁচকানো তার। চন্দ্রা তার দিকে তাকাতেই বাঁকা হাসলেন রুদ্র। এগিয়ে যেতে লাগলেন চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মাত্র। রুদ্র চন্দ্রার অতি নিকটে এসে কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
—” এখনও তৈরি হও নি যে? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি?”
চন্দ্রা বিরক্তিতে রুদ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
—” এতটা নোংরা কেন আপনি? প্রথমে রত্নমা তারপর আমি! নির্লজ্জ! আপনাকে দেখতেই গা জ্বলে ওঠে আমার।”
রুদ্র বাঁকা হেসে বললেন,
—” কি করব বলো। একটায় পোষায় না আমার। এজন্যই তো তিনটে বিবাহ করলাম। এবং কালকে তোমাকে করব।”
এ কথার পিঠে চন্দ্রা আর জবাব দিলেন না। রুদ্র চন্দ্রার আরেকটু কাছে এসে বললেন,
—” রত্নমার কক্ষে কেন গিয়েছিলে তুমি? আমার সঙ্গে সাক্ষাত না করে আবার চলেও আসলে, রত্নমাকে আমার সঙ্গে দেখে বুকে জ্বালা হচ্ছিলো বুঝি?”
চন্দ্রা অবাক হলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—” আপনি কিভাবে জানলেন আমি রত্নমার কক্ষে গিয়েছিলাম?”
—” অনেক ভাবে! প্রথমত, মনে রাখবে এ রাজ্যের সকল সদস্য আমার দাস। সে হিসেবে কিরণও কিন্তু। দ্বিতীয়ত, রত্নমার কক্ষের দর্পণে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তোমায়। জানো চন্দ্রা, তুমি আসলে অনেক বোকা! আমি কক্ষে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তো বললে- আমি নির্লজ্জ। একবার রত্নমাকে তো আরেকবার তোমাকে। এখানে তুমি কিভাবে বুঝলে আমি তোমার আগে রত্নমার কাছে গিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই অন্যজন থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করেছিলে নতুবা লুকিয়ে লুকিয়ে রত্নমার কক্ষে গিয়েছিলে, তাই না? আচ্ছা এত কষ্টের কি ছিল? আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল বুঝি?”
এরুপ কথায় চন্দ্রা রেগে রুদ্রকে ধাক্কা মারতে চাইলেন। কিন্তু এক ফোঁটাও সরাতে পারলেন না তাকে। ব্যর্থ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
—” সরুন আমার কাছ থেকে।”
রুদ্র সরলেন না। বরং চন্দ্রার কপালে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—” তৈরি হয়ে নাও জলদি। নতুবা এ নির্লজ্জ নির্লজ্জতার সীমা অতিক্রম করে ফেলবে। এবং তা তুমি করতে বাধ্য করবে।”
.
______________চলবে____________
দেড়ি হওয়ার জন্য অনেকগুলো সরি। প্রচুর ব্যস্ত ছিলাম আমি। ইনশাল্লাহ এখন থেকে প্রতিদিন নয়তো একদিন পরপর গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব।
Nusrat Jahan Ira, Aysha Siddika, Afrin Shuvra সহ আরও অনকের কমেন্ট দারুণ থেকেও দারুণ ছিল❤
Ishanur Tasmia