শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব ২০

#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’❤
#’লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
#’পর্বঃ ২০
__________________

শ্রাবণ মাস শেষ হতে চলল প্রায়। গুটিকয়েক ঘণ্টা, দিন পেরিয়ে গেল মাঝেই। চন্দ্রা রোজ একবার করে রুদ্রকে বলেন ‘কূঞ্জনরাজ্যে’ তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রুদ্র এড়িয়ে যান প্রতিবারই! আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অন্ধকারের গভীরতা দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেক রাত্রি হয়েছে এখন। রাজ্যের সবার নিদ্রিত ভাব বিরাজ করেছে সর্বত্র। শুধু বিশাল বড় কক্ষে দু’টি প্রাণ এখনো নির্ঘুম!

চন্দ্রা দাঁড়িয়ে আছেন জানালার ধারে। রুদ্র কেদারায় বসে! দুশ্চিন্তায় দু’হাতে চুল শক্ত করে আকড়ে ধরে মাথা নিচু করে আছেন রুদ্র। আপনা-আপনিই চন্দ্রার গাল বেয়ে পানি পরছে। কারণ হয়তো ইহা, রুদ্র আজকে বেশ জোড়ে ধমক দিয়েই চন্দ্রাকে বলেছেন, তিনি চন্দ্রাকে নিয়ে কূঞ্জনরাজ্যে কখনোই যাবেন না৷ ‘কেন?’ শব্দটি জিজ্ঞেস করতেই রুদ্র তাকে এড়িয়ে ওভাবে কেদারায় বসে পরেছেন। আর চন্দ্রা নীরবে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চক্ষু জোড়ার অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। খানিকবাদ পর রুদ্রের খেয়াল হয় চন্দ্রার কথা। অপরাধবোধ কাজ করে তার ভেতর। ধীর পায়ে চন্দ্রার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেন রুদ্র। চন্দ্রা স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। না নিজেকে ছাড়ানোর কোনো প্রচেষ্টা, না ক্রোধিত হয়ে কিছু বলা! শুধু নীরবে অভিমানগুলো প্রকাশ করছেন চন্দ্রা। রুদ্র হেসে দিলেন হঠাৎ! চন্দ্রাকে আরো নিবিড়ভাবে নিজের বলিষ্ট বাহুডোরে আবদ্ধ করে বাঁকা হেসে বলে ওঠেন,

—” হঠাৎ আমার ওপর অভিমান? অভিমান তো ভালোবাসার মানুষদের কাছে প্রকাশ পায় চন্দ্রা! তুমি কি ভালোবাসো আমায়?”

জবাব দিলেন না চন্দ্রা। দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। অভিমান যেন তীব্র হচ্ছে তার। তবুও কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোড়ালো এবং কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠেন চন্দ্রা,

—” আমাকে কেন আপনি ‘কূঞ্জনরাজ্যে’ নিয়ে যেতে চাইছেন না? আমার কি আমার জন্মভূমিতে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই? নাকি আমার পিতা-মাতার মতো এ অধিকারও ছিনিয়ে নিতে চান?”

রুদ্র অবাক হলেন এরুপ কথায়। কষ্ট পেলেন খানিকটা। চন্দ্রার কণ্ঠে অভিমানের পাশাপাশি স্পষ্ট বিদ্রুপের আভাস। যা ভালো লাগে নি রুদ্রের। তবে খারাপ লাগাটা প্রকাশ করলেন না তিনি। চন্দ্রাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তার কেশ ঠিক করার অযুহাতে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন রুদ্র,

—” অভিমানটা এত তীব্র কেন রাণী? একটু কি অভিমান কমানো যায় না? আমি যে তোমার কথা রাখতে পারবো না।”

চন্দ্রা চট করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে রুদ্রকে বলে ওঠেন,

—” কেন পারবেন না? আমার কি ইচ্ছে করে না আমার জন্মভুমিতে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে? আমার এখানে দমবন্ধ হয়ে আসে সম্রাট। আমি ‘কূঞ্জনরাজ্যে’ যেতে চাই। দয়া করে আমাকে নিয়ে চলুন সম্রাট।”

—” এখানে কি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছো না তুমি? দমবন্ধ হয়ে আসার প্রশ্নই আসছে না চন্দ্রপ্রভা! কেন বুঝতে পারছো না আমি ওখানে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই না!”

—” কেন? ওখানে নিয়ে গেলে কিরুপ সমস্যা হবে?”

রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো এবার। চন্দ্রাকে ছেড়ে কেদারায় পূর্বের নেয় ঝুঁকে কপালের দুই’পার্শ্বে হাত রেখে বসে রইলেন তিনি। চন্দ্রা আহত হলেন। চোখ গড়িয়ে পরল দু’তিন ফোটা জল! আকাশের দিকে আবারও তাকালেন তিনি। চোখ বন্ধ করে মনে মনে নিজ মাতা-পিতার প্রতিচ্ছবি দেখার প্রসায় করলেন। তবে এর আগেই রুদ্রের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল চন্দ্রার কর্ণকুহরে,

—” আমি দুঃখীত চন্দ্রপ্রভা! আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি কিংবা দিতে চাইছি না। আমি শুধু তোমাকে নিজের সঙ্গে, নিজের কাছাকাছি রাখতে চাইছি।”

—” ‘কূঞ্জনরাজ্যে’ কি আমি একাকিত্বভাবে যাবো সম্রাট? আপনিও তো যাচ্ছেন আমার সঙ্গে। তাহলে?”

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,

—” মনে ভীতি কাজ করে চন্দ্রা। ওখানে গিয়ে তুমি যদি আমাকে ফেলে চলে যাও!”

—” আমি কেন চলে যাবো?”

—” আমি জানি না। শুধু আমার মনে ভীতি কাজ করে। আমি চাই না তুমি সেখানে যাও। সত্যি চাই নি, আর না চাইছি!”

চন্দ্রার কেমন যেন লাগলো বিষয়টা। ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

—” আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?”

রুদ্রের নির্লিপ্ত কণ্ঠ,

—” জানি না।”

রুদ্রের কথার ধরণ দেখে এবার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে দিলেন চন্দ্রা। বললেন,

—” আপনি এতকিছু করার পরও আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করছি। সেদিকে আপনি কিনা আমাকে বিশ্বাসই করতে পারছেন না? অথচ আমি সবদিক দিয়েই নির্দোষ!”

রুদ্র কেদারা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ধীর পায়ে চন্দ্রার দিকে এগিয়ে বললেন,

—” আমি কিরুপ তা তুমি জানো… আমি বিশ্বাস করি তোমাকে! ভালোবাসি! কিন্তু ভয়ও কাজ করে..! আচ্ছা, আমি তোমাকে কূঞ্জনরাজ্যে নিয়ে যাবো। তবে কথা দাও আমাকে ছেড়ে যাবে না!”

রুদ্র অতি কাছে এসে দাঁড়ালেন চন্দ্রার। চন্দ্রা রুদ্রের চোখে চোখ রেখে তাকালেন। কেঁপে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে। রুদ্রের চোখ লাল হয়ে আছে। অথচ সেই চোখে জলের কোনো আভাস নেই। যেন কান্না আটকে রাখার অদম্য চেষ্টা করছে মানুষটি। কেমন যেন অনুভূতি হলো চন্দ্রার। মায়ারও অধিক কিছু। ভাবনার মাঝেই হঠাৎ রুদ্র তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,

—” ছেঁড়ে যাবে না তো চন্দ্রা?”

চন্দ্রা থমকান। শুকনো ঢোল গিলে রুদ্রের পিঠে আলতো করে হাত রেখে ধীর কণ্ঠে বলে উঠেন,

—” কখনো না!”

______________________

প্রভাতের প্রথম ভাগ এখন। রাণী অমরার কক্ষে বিন্দু,লতা এবং পদ্ম বসে আছেন। রাণী অমরা তাদেরই অগ্রে কেদারায় বসে। পদ্মর বেশ বিরক্ত লাগছে এখানে। একে তো তার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষদের সঙ্গে বসে আছে সে। তারওপর এতক্ষণ যাবত বসে আছে সে কেউই একফোটা কথার সূত্রপাতও করছে না৷ এভাবে মূক(বোবা) সেজে বসে থাকার তো কোনো মানে হয় না। এবার বেশ বিরক্তি নিয়েই বলে উঠল পদ্ম,

—” মাতা? কিছু না বলার হলে আমি কি যেতে পারি আমার কক্ষে?”

রাণী অমরা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

—” সবসময় এভাবে কথা বলো কেন পদ্ম? আমি তোমার সম্পর্কে মাতা!”

পদ্ম অবাক হয়। সে এমন কি বলল যে রাণী অমরা “সবসময় এভাবে কথা বলো” বলে তাকে সম্মোধন করল? বিরক্তিটা যেন আরো বেড়ে গেল তার। রাণী আমরা এবার শান্ত স্বরে বললেন,

—” তোমার দুই ভ্রাতাগণের সংবাদ কি? তারা তো তাদের মাতার সঙ্গে একবার সাক্ষাত করতেও আসতে চায় না।”

এরুপ কথায় এবার রাগ হলো পদ্মর। রুচি বাঁধছে তার। নিজের কৃতকর্ম কি তিনি জানেন না? কোন মুখে এসব বলেন তিনি? ভ্রু কুঁচকে অতি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল পদ্ম,

—” নিজের অতীত ঘাটুন মাতা। বুঝতে পারবেন ভ্রাতাগণ কেন সাক্ষাত করতে আসেন না!”

বলেই আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না পদ্ম। চলে গেল কক্ষ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বিন্দু ও লতা নিজেদের মাঝে গীবত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বিন্দু রাণী অমরাকে বলে উঠল,

—” দেখুন মাতা আপনার কন্যা কিরুপ ব্যবহার করছে আপনার সঙ্গে। ওই চন্দ্রার জন্যই এসব হচ্ছে। সে-ই আপনার নামে সবার কানে বিষ ঢেলে দিচ্ছে।”

বিন্দুর কথায় লতা সায় দিয়ে বলল,

—” জ্বী মাতা এমনই হবে। দেখেছেন না কিভাবে সম্রাটকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। এভাবে তো আপনি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন না মাতা। আমি বলি কি, আপনি সম্রাটকে বলে ওই চন্দ্রার কোনো একটা ব্যবস্থা করুন তো।”

বিন্দু এবং লতার কথায় বিশেষ একটা ভাব গতি বোঝা গেল না রাণী অমরার। তবে ভেতরে ভেতরে তিনি তাদের কথাগুলো নিয়েই গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন। রুদ্রকে কিছু বলে আদৌ কি চন্দ্রাকে কোনোরুপ শাস্তি দেওয়া যাবে?

.
_____________চলবে____________
(রি-চেক করিনি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
Tahsina Khan Saima, Promi Montaha, Arrushi A,সহ অনেকের মন্তব্য দারুণ ছিল।
Ishanur Tasmia

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here