শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব শেষ

#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’শেষ পর্ব
_________________

দেখতে দেখতে এক শ্রাবণ পেরিয়ে অন্য শ্রাবণের আগমন ঘটল কিছু দিন হলো। রাতের স্নিগ্ধময় শ্রাবণধারার পর প্রভাতে সূর্যের কঠিন তাপটাও আজ মধুময়। প্রভাতের কিরণ সরাসরি নিজ চোখে পড়তেই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে নিলেন চন্দ্রা। রুদ্রের বুকে আরেকটু গভীরভাবে নিজের মুখশ্রী এঁটে নিলেন। রুদ্র বিরক্ত হলেন এতে। কেননা তিনি চন্দ্রাকে দেখতে ব্যস্ত ছিলেন এতক্ষণযাবত। আলতো হাতের স্পর্শে চন্দ্রার কেশে হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠলেন রুদ্র,

—” মহারাণী আমার, নিদ্রা থেকে জাগ্রত হবেন কখন? বেলা হতে চলল তো!”

কিন্তু চন্দ্রার কোনো সারাশব্দ এলো না। রুদ্র আবারও চন্দ্রাকে ডাকতেই চন্দ্রা ঘুমু ঘুমু কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন,

—” আরেকটু।”

—” তাহলে আমার দিকে ফিরো। আমি তোমাকে দেখবো।”

—” পরে। এখন ঘুমাবো।”

রুদ্র খানিকটা রাগ করে বলে উঠলেন,

—” শয্যা থেকে উঠে পরো তাহলে। অনেক ঘুমানো হয়েছে!”

চন্দ্রার বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে। পরপরই রুদ্রের দিকে মুখ করে মাথা উঁচু করে রইলেন চন্দ্রা। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় বলে উঠলেন,

—” ফিরেছি আপনার দিকে। এখন ঘুমাতে দিন। নিদ্রা আসছে প্রচুর!”

রুদ্র হেসে উঠলেন এবার। চন্দ্রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠলেন,

—” তবুও উঠে পরো চন্দ্রা। তুমি এতক্ষণ ঘুমালে পরবর্তিতে আমার কন্যাও এভাবে ঘুমাবে।”

—” সে তো সারাদিনই ঘুমায় আমার গর্ভে।”

রুদ্র মুচকি হেসে বললেন,

—” আচ্ছা, আমার কন্যা আসতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে চন্দ্রপ্রভা? কতদিন হলো ও তোমার গর্ভে?”

চন্দ্রা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

—” উমঃ! নবম মাস আরম্ভ হলো।”

রুদ্র মিটিমিটি করে হেসে উঠলেন হঠাৎ-ই। তবে তা মৃদুস্বরে। যা চোখ এড়ালো না চন্দ্রার। চন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

—” হাসছেন কেন?”

রুদ্র কণ্ঠে রসিকতা এনে বলে উঠলেন,

—” ভাবছি, এজন্যই হয়তো আমার বৌ এতো স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে। আগের চিকোনচাকোন রাণী এখন গুলুমুলু হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে তোমার নামও ঠিক করে ফেলেছি চন্দ্রা। রাণী গুলুমুলু! অতি সুন্দর না?”

চন্দ্রা রাগলেন অনেকটা। রুদ্রের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রুদ্র এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। এতে চন্দ্রা মুখ ফুলিয়ে রুদ্রের বুকের সঙ্গে লেপ্টে রইলেন। তবে মনের মাঝে চিন্তা দানা দিলো তার। আসলেই তো চন্দ্রা আগের চেয়ে অধিকমাত্রায় স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছেন। কোনোকাজ তেমন ঠিক মতো করতে পারেন না। আচ্ছা? রুদ্র কি তাকে আর পছন্দ করেন না? কেননা তার নিজেরই তো কেমন কেমন মনে হয় নিজেকে। ভাবতেই মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল চন্দ্রার। চন্দ্রাকে মন খারাপ করতে দেখে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বললেন,

—” মন খারাপ করেছো কেন? নামটা পছন্দ হয় নি?”

চন্দ্রা উত্তর দিলেন না সাথে সাথে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

—” আচ্ছা সম্রাট? আমার এই স্বাস্থ্য বেড়ে যাওয়ায় আপনি কি আমাকে আর ভালোবাসবেন না?”

রুদ্রের ভ্রু যেন আরও কুঞ্চিত হলো এবার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে চন্দ্রাকে নিজের বাহুডোরে আরও দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে রুদ্র বলে উঠলেন,

—” তোমার রুপ থেকে আমি তোমাকে অধিক ভালোবাসি রাণী। তাছাড়া তুমি কি জানো তোমাকে এভাবে দেখতে কতটা সৌম্য মনে হয়? আগের চন্দ্রা থেকে এ চন্দ্রাকে আমার আরও বেশি ভালো লাগে। আর তুমি তো অধিক স্বাস্থ্যবান হও নি। পেটটা অনেকটা বেড়ে গেছে এটাই। এতে এত মন খারাপের কি আছে? মন খারাপ করবে না একদম।”

রুদ্রের কথায় চন্দ্রার মনে হলো তার মন খারাপ নিমিষেই হারিয়ে গেছে। এর পরিবর্তে মুখে এসে হাজির হয়েছে একরাশ হাসি। যা দেখে রুদ্রের মুখেও ফুটে ওঠে এক চিলতি হাসি। চন্দ্রা রুদ্রের দিকে তাকালেন এবার। চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন,

—” সম্রাট, আপনাকে কিছু বলার ছিল।”

—” রুদ্র নামটি কি তোমার পছন্দ নয়? প্রতিমুহুর্তে তোমার সম্রাটই ডাকতে হবে?”

চন্দ্রা মুচকি হেসে বললেন,

—” অবশ্যই! আচ্ছা শুনুন, আমি না কূঞ্জনরাজ্যে যেতে চাই।”

এ পর্যায়ে রুদ্র আবারও ভ্রু কুঁচকালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

—” কিছু দিন আগে না ঘুড়ে এলে৷ এখন আবারও?”

চন্দ্রা মন খারাপ করে বললেন,

—” হুম! আমি যেতে চাই। ”

—” আচ্ছা! তবে এখন না। পূর্বে আমাদের রাজকুমারী এ ধরণীতে এসে নিক তারপর!”

চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে খুশিতে বলে উঠলেন,

—” ধন্যবাদ সম্রাট! আপনার মতো সম্রাট এ ধরণীতে একটাও নেই। আপনিই অনন্য-অন্যতম।”

চন্দ্রার কথায় রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আফসোসের সঙ্গে বললেন,

—” তোমার কথা শুনলেই আমি অনেক ভালো। নতুবা আমার মতো খারাপ মানুষ একটিও নেই। ইহা কেমন বিচার চন্দ্রপ্রভা?”

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে মুখটা কেমন যেন করলেন রুদ্র। চন্দ্রা খিলখিল করে হেসে উঠলেন এতে। রুদ্র সেদিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,

— ” ভালোবাসি প্রিয়তমা! ”

_____________________

রাণী অমরা বসে আছেন রুদ্রের অগ্রে। মুখে একরাশ বিষন্নতা। রুদ্রের মুখে গম্ভীরতা সুস্পষ্ট। বেশ বিরক্তি নিয়েই রুদ্র প্রথমে বলে উঠলেন,

—” আপনাকে প্রহরে প্রহরে স্বর্ণ-মুদ্রা দিতে বাধ্য নই আমি মাতা। তাছাড়া আপনি তো ধরণীতে আর মাত্র কয়েকদিনের অতিথি। এত স্বর্ণ-গহনা নিজের সঙ্গে রেখে কি করবেন?”

রাণী অমরা রেগে গেলেন হয়তো। তবুও নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে থমথমে গলায় বলে উঠলেন,

—” নিজের মাতার সঙ্গে এরুপ ব্যবহার কি ওই চন্দ্রা শিখিয়েছে তোমায়?”

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,

—” অর্থাৎ? কি বোঝাতে চাইছেন?”

—” বুঝতে পারছো না কি বোঝাতে চাইছি? ওই চন্দ্রা যে তোমাকে আমাদের বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে সেটা কি আমি বুঝি না মনে করেছো? বিন্দু, লতাকে ওই চন্দ্রার জন্য দেখতেই পারো না। ওর জন্য রত্নমাকেও হত্যা করতে পিছাও নি। এখন আবার আমি! তোমার আপন মাতা! তোমার এসব কান্ডে আমার তো লজ্জায় মাথা কাঁটা যাচ্ছে রুদ্র।”

রুদ্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে উঠলেন। খানিকটা উচ্চস্বরেই! কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলে উঠলেন,

—” হাসালেন মাতা। আপনি নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করুন তো, আদৌ কি আপনাদের অপছন্দ করতে আলাদা কোনো কারণ বা মাধ্যম যেমন, চন্দ্রা প্রয়োজন? আচ্ছা মাতা? আপনার কি লজ্জাও আছে নাকি? পদ্ম শুধু মাত্র আপনাকে সহ্য করতে না পেরে আজ এখানে না থেকে কিরণদের সঙ্গে অন্য রাজ্যে থাকছে! আপনার পুত্র-কন্যার মধ্যে কেউই আপনাকে পছন্দ করেন না আপনার কৃতকর্মের জন্য। ইহা কি আপনার জন্য লজ্জাজনক নয়? কোথায়? আমি তো আপনাকে লজ্জা পেতে দেখছি না! বরং এতকিছুর পর আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে রুচি না থাকা সত্ত্বেও আপনার সঙ্গে একই রাজপ্রাসাদে থাকছে। আপনার কি ভালো লাগছে না ইহা?”

রাণী অমরা জবাব দিতে পারলেন না। প্রবল অপমানে রাগে গা ‘রিরি” করছে তার। কিছুদিন যাবত রুদ্র যাতা ব্যবহার করছে তার সঙ্গে। কারণটা হয়তো ইহা যে রাণী অমরা চন্দ্রার গর্ভের সন্তানকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে অর্থাৎ, দাস-দাসীদের দিয়ে করাতে চেয়েছিলেন। তবে তা রুদ্রের অগোচড়ে! এবং দাস-দাসীগণ ধরা পরে যাওয়ার পর তাদের হত্যা করার সময়ও তারা রাণী অমরার নাম ঘুনাক্ষরেও প্রকাশ করে নি। তাহলে রুদ্রের এরুপ ব্যবহারের কারণ? নাকি রুদ্র কোনোরুপভাবে জেনে গেছেন সত্য? ভাবনার মাঝেই রুদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,

—” আমার আরও কর্ম আছে মাতা। আর কিছু বলার না হলে যেতে পারেন।”

রুদ্রের এই সামান্য কথায়ও অপমান বোধ করলেন রাণী অমরা। রাগী দৃষ্টিতে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন রাজদরবার থেকে। মস্তিষ্কে একটাই চিন্তা ঘুরঘুর করছে তার। যেভাবেই হোক চন্দ্রা এবং রুদ্রকে শাস্তি দিতে হবে। কেননা পরিস্থিতি হাতের নাগালে নেই। তাই নাগাল পেতে হলে যদি রুদ্রকে হত্যাও করতে হয় তাহলেও রাণী অমরা পিছাবেন না। কিন্তু এমন কি করবেন তিনি? প্রশ্ন ভাবার কিছু প্রহরবাদই একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার মস্তিষ্কে। সঙ্গে সঙ্গে নোংরা একটি হাসি হাসলেন তিনি। এবার হয়তো স্বর্ণ-মুদ্রার মতো লোভনীয় জিনিস পেতে তার রুদ্রের কাছে ভিক্ষা চাইতে হবে না। তিনিই হবেন সেগুলোর একমাত্র অধিপতি! রাজ্যের সকলে তার কথায় চলবে রুদ্রের কথায় নয়। ভাবতেই আরেক দফা আনন্দে মেতে উঠলেন রাণী অমরা।

____________________

দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও দু’টো দিন। চন্দ্রা নিজ কক্ষে দর্পণের অগ্রে কেদারায় বসে আছেন। কিরণ তার কেশ আঁচড়ে দিচ্ছে। সে সময় রুদ্র এসে হাজির হলেন কক্ষে। ইশারায় কিরণকে যেতে বলতেই সে মাথা নত করে কক্ষের বাহিরে চলে যায়। রুদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন চন্দ্রার দিকে। সয়ং নিজে অধিক যত্নসহকারে চন্দ্রার চুল আঁচড়ে দিতে আরম্ভ করেন। এতে মুচকি হেসে বলে উঠলেন চন্দ্রা,

—” বাহ্ঃ! এত যত্ন নিচ্ছেন যে? কি ব্যাপার?”

রুদ্র খানিকটা ভাব নিয়ে বললেন,

—” কাজ করছি। বিরক্ত করো না।”

চন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন রুদ্রের দিকে। এতে বিশেষ ভাবগতি প্রকাশ করলেন না রুদ্র। চন্দ্রা মুখ ফুলিয়ে নিলেন। নড়েচড়ে বসতেই রুদ্র উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,

—” উহুঃ! নড়ছো কেন? আমি বিরক্ত হচ্ছি।”

চন্দ্রা আরও বেশি নড়াচড়া শুরু করলেন এবার। রুদ্র ভ্রু ক্রুটি করে বিরক্তি নিয়ে তাকালেন চন্দ্রার পানে। রুদ্রের এহেন চাহনী দেখে মৃদু হাসার চেষ্টা করলেন চন্দ্রা। রুদ্রের হঠাৎ কি হলো কে জানে! চন্দ্রার ললাটে নিজের অধর ছুঁইয়ে দিলেন আলতো করে। পরপরই সরে দাঁড়ালেন। চন্দ্রার গালের দু’পাশে হাত রেখে চেপে ধরলেন। মৃদু স্বরে বললেন,

—” কিছু হবে না তোমার চন্দ্রা! আমি কিছু হতে দেবো না তোমার। পাশে থাকবো সবসময়!”

রুদ্রের কথার মানে বুঝতে পারলেন না চন্দ্রা। হঠাৎ এমন কথা বলার কারণ কী? বিস্ময় নিয়ে রুদ্রের দিকে তাকাতেই রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—” আমি যুদ্ধে যাচ্ছি চন্দ্রপ্রভা। প্রার্থনা করো আমাদের জন্য!”

চন্দ্রা রুদ্রের পানে এবার ভীতু দৃষ্টিতে তাকালেন। অনেকটা চেঁচিয়ে বললেন,

—” অর্থাৎ? কি বলছেন এসব?”

রুদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

—” রত্নমার পিতা রক্ষণ সেন তার কন্যার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার চিরশত্রু বিক্রমের সহায়তা নিয়ে রাজ্যে আক্রমণ করেছে হঠাৎ-ই। একটু আগে তথ্যটি জ্ঞাত হলো আমার। ইতোমধ্যে রাজ্যের রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি এসে গেছে তারা।”

রুদ্র থামলেন। চন্দ্রার সিক্ত নয়নে এক পলক তাকাতেই থমকে গেলেন। চোখ সরিয়ে নিলেন দ্রুত। কিছু না বলেই চলে যেতে নিলে চন্দ্রা রুদ্রের হাত ধরে আটতে ফেলেন তাকে। সিক্ত নয়নে বারংবার আকতি করছেন যেন রুদ্র তাকে ছেঁড়ে না যান। রুদ্র বুঝতে পারেন চন্দ্রার মনের কথা। চন্দ্রার হাতে হাত রেখে জড়ালো কণ্ঠে বলে ওঠেন,

—” আমি আছি তো চন্দ্রা। কিচ্ছু হ..হবে না তোমার। খুব দ্রুত ফিরে আসব তোমার কাছে। চিন্তা করবে না।”

কথাটা বলে এক প্রহরও দাঁড়ালেন না রুদ্র। বেড়িয়ে গেলেন কক্ষ থেকে। চন্দ্রা ঝাপসা হয়ে যাওয়া চক্ষুজোড়া নিয়ে রুদ্রের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন মাত্র।

রুদ্র কক্ষ থেকে বের হয়েই পথি মধ্যে যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে ফেলেন। কেননা কিছুক্ষণ আগে একজন সৈনিক এসে বলেছেন যে শত্রু রাজদরবারে ডুকে গেছেন ইতোমধ্যে। রুদ্র একটা কিছু বুঝতে পারছেন না, এতো সৈন্য, এত পাহারাদার থাকা সত্ত্বেও তারা রাজ্যে কিভাবে প্রবেশ করল? করলেও কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি কেন? তাছাড়া রাজ্যের বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউই রাজের গুপ্তপথ সম্পর্কে জানে না। একমাত্র রুদ্রের মাতা রাণী অমরা বাদে! ভাবনার মাঝেই রুদ্র রাজদরবারের কাছাকাছি এসে পড়লেন। হঠাৎ শত্রুদলেন একজন সৈন্য রুদ্রকে আঘাত করতে এলেই তার গর্দান ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেন রুদ্র। তারপর….তারপর শত্রু দলেন এক একজনকে মৃত্যুর শয্যায় শয্যাশায়ী করতে আরম্ভ করলেন। তবে রাজদবারের কোথাও রক্ষণ সেন এবং বিক্রমকে দেখতে পান নি তিনি। খানিকবাদ হঠাৎ রাজসিংহাসনের পানে চোখ যেতেই স্তব্ধ হয়ে যান রুদ্র। চন্দ্রার গর্দানে তলোয়াড় ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রক্ষণ সেন এবং বিক্রম। বিক্রমের পাশে নিজ মাতা রাণী অমরা ও স্ত্রী বিন্দু এবং লতাকে দেখতে পেলেন রুদ্র। চন্দ্রা বাদে তাদের সবার মুখেই নোংরা হাসি। রুদ্রের বুঝতে আর বাকি রইল না রাণী অমরা এবং তার দু’জন স্ত্রী বিন্দু ও লতা রক্ষণ সেনের সঙ্গে মিলিত। তারাই রাজ্যে আসার গুপ্তপথ জানিয়েছেন রক্ষণ সেন এবং বিক্রমকে। আপন জনের এমন বিশ্বাসঘাতকতা দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে যান রুদ্র। এ সুযোগে শত্রুদলেন একজন সৈন্য পেছন থেকে রুদ্রের পেটে তলোয়াড় ঢুকিয়ে দেয়। এতে কোনোরুপ চেঁচিয়ে উঠলেন না রুদ্র। শুধু হাঁটু গেঁড়ে বসে নিস্পলক তাকিয়ে রইলেন চন্দ্রার দিকে। তলোয়াড়ের ধারালো আঘাতে তার গর্দান খানিকটা কেটে গেছে। রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে! তবে সেদিকে খেয়াল নেই চন্দ্রার। সে রুদ্রকে আঘাত পেতে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পরেছে। সে কান্নায় নেই কোনো শব্দ! এদিকে রুদ্রের সৈনিকগণ রুদ্রের এহেন অবস্থা দেখে হাত থেকে তলোয়াড় ফেলে দিলেন। মাথা নিচু করে রুদ্রের মতো হাঁটু গেড়ে বসে পরলেন তারা। বিজয়ের হাসি যেন হাসছে শত্রুদলেন সবাই। হঠাৎ বিক্রম চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে উঠল,

—” রাণী, কষ্ট হচ্ছে বুঝি আপনার? নিজের স্বামীকে এভাবে দেখে? উফফ! আপনার এখনই গর্ভগতী হতে হলো? নতুবা আপনার সাথে রাত কাটাতে পারতাম আমি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। সাথে আপনারও যে আপনি আপনার স্বামীর অগ্রে তারই চোখের অগ্রে হত্যা হবেন। তবে আনন্দের বিষয় হচ্ছে আপনি আগে হত্যা হবেন না। তার আগে হত্যা হবেন রুদ্রের মাতা অমরা এবং তার দু’জন স্ত্রী। সুন্দর না কথাটি?”

মুহুর্তেই যেন হাসি উবে গেল রাণী অমরা, বিন্দু এবং লতার। বিস্ময় নিয়ে বিক্রমকে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই বিক্রম তাদের গর্দান ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা চিৎকার দিয়ে তাদের তিনজনেরই দেহ স্থলে লুটিয়ে পরে। উচ্চস্বরে হেসে উঠল এবার রক্ষণ সেন এবং বিক্রম। রাণী অমরার মৃত দেহকে উদ্দেশ্য করে রক্ষণ সেন বলে উঠলেন,

—” আপনার প্রস্তাব ঠিক মানতে রাজী নই আমি অমরা। আমার এই রাজ্যে পুরোটা প্রয়োজন। যা আপনি থাকলে হতো না! তাই পথের কাঁটাকে সরিয়ে দিলান। ভালো করেছি তাই না?”

কথাটা বলেই আবারও উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন রক্ষণ সেন। রুদ্রের উদ্দেশ্যে আফসোসের সঙ্গে বলে উঠলেন,

—” কেমন অনুভূতি হচ্ছে রুদ্র? নিশ্চয়ই খারাপ? আমারও খারাপ লেগেছিল। কষ্ট হয়েছিল যখন তুমি আমার কন্যা রত্নমাকে হত্যা করেছিলে। যার প্রতিশোধ এখন তোমার থেকে তোমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী চন্দ্রাকে হত্যা করে…!”

কথাটুকু শেষ করতে পারলেন না রক্ষণ সেন। এর আগেই রুদ্র বিকট শব্দে হেসে উঠলেন। রুদ্রকে এরুপ হাসতে দেখে বিস্মিত হয়ে সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। রক্ষণ সেনও অবাক! স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন রুদ্রের দিকে৷ এ সুযোগে রুদ্র তার হাতে থাকা তলোয়াড় ছুঁড়ে মারলেন রক্ষণ সেনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণ সেনের বাম চোখ গলে মস্তিষ্ক ভেদ করে ঢুকে গেল তলোয়াড়টি। পরপরই রুদ্র আরেকটি তলোয়াড় নিয়ে দ্রুত গতিতে বিক্রনের দিকে ছুঁড়ে মারবার আগেই চন্দ্রা রক্ষণ সেনের স্থলে লুটিয়ে পরার আগ মুহুর্তে তার হাত থেকে তলোয়াড় নিয়ে বিক্রমের পেটে পুড়ে দিলেন। সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠে বিক্রমও লুটিয়ে পরল স্থলে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব! রুদ্রও তাই! তিনি ভাবতেও পারেন নি চন্দ্রা এহেন কাজ করবেন। তবে মনে মনে খুশি হয়েছেন প্রচুর। এদিকে নিজ রাজ্যের রাজাকে হারিয়ে শত্রু দলেন সৈন্যগণ এবার নিজের হাত থেকে তলোয়াড় ফেলে হাঁটু গেড়ে বসে আত্মসমর্পণ করলেন। সেদিকে একবার তাকিয়ে চন্দ্রা যতদ্রুত সম্ভব পেটে এক হাত রেখে এগিয়ে এলেন রুদ্রের পানে। বহু কষ্টে রুদ্রের সঙ্গে পা মেলে বসে পড়লেন স্থলে। কাঁপাকাঁপা হাতে রুদ্রের মুখটি ধরলেন তিনি। চক্ষু থেকে যেন স্রতের মতো পানি ঝরঝর করছে তার। রুদ্রের পেটের ক্ষতটির দিকে একবার তাকিয়ে রুদ্রের মুখের দিকে তাকালেন এবার। কেমন রক্তিম হয়ে আছে রুদ্রের চোখ দু’টো। মায়াভরা দৃষ্টিতে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে মৃদু কম্পিত এবং কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন চন্দ্রা,

—” আপনার কি কষ্ট হচ্ছে সম্রাট? চিন্তা ক..করবেন না। আমি আছি আপনার সঙ্গে!”

কষ্ট হলেও রুদ্র হাসার চেষ্টা করলেন। ঝাপসা চোখে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর কণ্ঠে জোড়ালো ভাবে বললেন,

—” ভালোবাসি রাণী! ”

কথাটা বলেই চন্দ্রার কাঁধে ঢলে পরলেন রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন চন্দ্রা!

____________________

তীব্র আলোয় চোখ কুঁচকে রাখলেন রুদ্র। পরপরই মিটমিট করে চোখ খুলে আশেপাশে তাকাতেই চমকে উঠলেন। একটি কুঁড়েঘর সমেত জায়গার পুরাতন শয্যায় শুয়ে আছেন তিনি। শরীরে পুরাতন পোশাক তার! উঠে বসার চেষ্টা করতেই পেটে ব্যথা অনুভব হয় রুদ্রের। মনে পড়ে যায় সেদিনের যুদ্ধের কথা। কিন্তু চন্দ্রা কোথায়? পেটে এক হাত রেখে উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগলেন রুদ্র। কোত্থেকে চন্দ্রা এসে হাজির হলেন সেখানে। কোলে তার এক ছোট্ট শিশু। রুদ্র অনেকটা অবাক হলেন চন্দ্রাকে দেখে। কেননা সে একজন সাধারণ প্রজাদের মতো পোশাক পরিধান করেছেন। চন্দ্রার পেটও আর ভারী নেই। তবে কি শিশুটি রুদ্র এবং চন্দ্রার সন্তান? তাছাড়া রুদ্র এখানে কিভাবে? রাজ্য থেকে এখানে কিভাবে এলো তারা? প্রশ্নগুলোর উত্তর একমাত্র চন্দ্রাই দিতে পারবেন।

চন্দ্রা রুদ্রকে জাগ্রত হতে দেখে মুচকি হাসলেন। কোলের শিশুটিকে পাশের একটি ছোট্ট পুরাতন শয্যায় শুঁইয়ে দিয়ে রুদ্রের দিকে এগিয়ে তাকে ঠিক করে বসিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন,

—” আমাকে ডাকতেন! নিজে কষ্ট করে উঠতে গেলেন কেন?”

রুদ্র জবাব দিলেন না চন্দ্রার প্রশ্নের৷ নিজেই প্রশ্ন করে উঠলেন,

—” আমরা এখানে কেন চন্দ্রা? এটি কোন স্থান? আর তোমার হাতের শিশুটি? সে কে? আমাদের সন্তান? আচ্ছা, তুমি এভাবে পোশাক পরেছো কেন? আমাকেও সাধারণ প্রজাদের মতো পোশাক পরিধান করিয়েছো! আমরা এখানে কিভাবে এসেছি চন্দ্রা?”

রুদ্রের এত্তগুলো প্রশ্নে চন্দ্রা হেসে দিলেন। পরপরই রুদ্রের হাতে হাত রেখে বললেন,

—” আপনি আমাকে কতটুকু ভালোবাসেন রুদ্র?”

—” তোমার ভাবনারও বেশি। তবে ভালোবাসা পরিমাপ করার মতো মূর্খ নই আমি। শুধু অনুভব করেছি সেটা।”

চন্দ্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—” আমি যদি আপনাকে আপনার রাজ্য ছেড়ে আমাকে নিয়ে অন্য সাধারণ প্রজাদের মতো বসবাস করতে বলি? আপনি কি আমার কথা রাখবেন?”

রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন,

—” আমি ধন-সম্পদে ভালোবাসা কখনোই পাই নি চন্দ্রা। শুধু পেয়েছি তোমার মাঝে। সুতরাং সে রাজ্য,ধন-সম্পদ ছেড়ে তোমাকে নিয়ে অন্য সাধারণ প্রজাদের মতো জীবনযাপন করতে আমার সমস্যা নেই। শুধু তুমি পাশে থাকলেই চলবে।”

চন্দ্রা মুচকি হাসলেন এবার। খানিক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

—” সম্রাট আমি আপনাকে নিয়ে চিরদিনের জন্য সিংহরাজ সম্রাজ্য ছেড়ে এখানে সাধারণ প্রজাদের মতো বসবাস করতে নিয়ে এসেছি। ওখানে… ওখানে আমাদের অনেক শত্রু সম্রাট! যদি আপনার আবারও ক্ষতি হয়। তাই..!”

চন্দ্রার ব্যকুলতা দেখে রুদ্র মুচকি হাসলেন। চন্দ্রার গালে হাত রেখে বললেন,

—” ভালো করেছো চন্দ্রা। আমারও ওই রাজ্যে দম বন্ধ হয়ে আসতো। মাতার স্মৃতি যে রয়ে গেছে সেখানে! আচ্ছা, আমাকে এখানে আনলে কিভাবে? আমি তো টেরই পেলাম না!”

—” আপনি প্রায় কয়েক দিন অজ্ঞান ছিলেন সম্রাট। আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায়ই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।”

রুদ্র এবার খানিকটা শব্দ করে হাসলেন। হাসি থামিয়ে শয্যায় শয্যাশায়ী শিশুটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—” ওই শিশুটি কি আমাদের সন্তান চন্দ্রা?”

চন্দ্রা মাথা নাড়ালেন। বললেন,

—” আপনার রাজকন্যা!”

রুদ্রের চোখে জল এসে পড়ল হঠাৎ। সিক্ত নয়নে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

—” আমি তাকে কোলে নিতে চাই চন্দ্রা।”

চন্দ্রা উঠে দাঁড়ালেন। শিশুটিকে কোলে নিয়ে রুদ্রের দিকে এগিয়ে দিলেন। রুদ্র যত্নসহকারে কোলে নিলেন শিশুটিকে। শিশুটির ললাটে একবার অধর ছুঁইয়ে পরক্ষণে চন্দ্রার ললাটে অধর ছোঁয়ালেন। খুশিতে কেঁদে দিলেন রুদ্র এবং চন্দ্রা। তাদের সঙ্গে কেঁদে উঠলেন তাদের শিশুটিও। যেন পিতা-মাতাকে কাঁদতে দেখে ছোট্ট শিশুটিরও কান্না পাচ্ছে। তবে শিশুটি কি জানে তার পিতা-মাতা খুশিতে কাঁদছে! হঠাৎ রুদ্র তার কন্যা এবং চন্দ্রাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মৃদু স্বরে বলে উঠলেন,

—” ভালোবাসি তোমারে চন্দ্রা,
ভালোবাসি মোর কন্যারে!
ভালোবাসি তোমাদের ওই সিক্ত নয়নের মাঝে ভালোবাসা!”

.
_______________ সমাপ্ত _______________
(এত দিন পাশে থাকার জন্য এই ক্ষুদ্র লেখিকার তরফ থেকে আমার সকল পাঠিক/পাঠিকার জন্য রইল অবিরাম ভালোবাসা❤)
Ishanur Tasmia

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here