শ্রাবণ_তোমার_আকাশে পর্ব ২৪

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৪

বেলার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে অন্ধকার একটা ঘরে আবিষ্কার করলো। চারপাশের গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে আবছা আলোর একটি ড্রিম লাইট টিমটিম করে জ্বলছে। বাতাসে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ৷ বেলা বালিশ থেকে নিজের মাথাটক উঠানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু মাথায় প্রচন্ড ব্যথা, মাথার ভেতরটা কেমন ভনভন করছে। একদিকে আবছা আলোর গুমোট অন্ধকারে ও চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখছে, অন্যদিকে বোঝার চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে ও কোথায় আছে। মনে করার চেষ্টা করতেই, প্রথমে শাইনির কথা মাথায় এলো। ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়তেই বেলা চোখ ঢলে উঠার চেষ্টা করলো। শাইনি অসুস্থ ছিলো, ওরা সবাই হাসপাতালের আই সি ইউ ইউনিটের বাইরে দাঁড়িয়ে শাইনির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। কেবিনের ভেতরে ডাক্তার, নার্সদের হুলস্থুল অবস্থা, বিপ বিপ সাউন্ড, চিৎকার, চেঁচামেচি, মাথার যন্ত্রণা যেন চারদিকে কিয়ামত নেমে এসেছিলো। তাঁর মধ্যে শাইনির একবার চোখ খুলে তাকানোটা যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বেলাকে। সেই চোখের মোহনীয় ভাষার দিকে তাকিয়ে ও বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে ছিল অনেকটা ক্ষণ। ক্ষণিক সুখের সময়টা পেরুতেই শাইনি অদ্ভুত ভাবে হাসলো।।দুই গালে তৈরি হলো দুটো ডিম্পল! তখনো জলে ভেজা ছিলো ওর চোখ, নোনতা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো নীলচে রঙের বালিশে। তারপর! তারপর কী হয়েছিলো? বেলা মনে করার চেষ্টা করলো। সফলও হলো! তারপর আচমকাই শাইনির চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো। বেলার যখন ভয়ে হার্টবিট কেঁপে কেঁপে উঠছিলো তখনই ও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ে৷ এরপর আর কোনোকিছু মনে নেই ওর। মস্তিষ্ক আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও বাকি স্মৃতিটুকুর খোঁজ পেতে ব্যর্থ হলো বেলা! মাথাটা দু-হাতে চেপে ধরে ধপ করে আবার বিছানায় বসে পড়লো ও। চোখ দুটো জ্বলছে ভীষণ। গলা শুকিয়ে কাঠ। ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে পানির। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো পানির বোতলটোতল পাওয়া যায় কিনা! কিন্তু ঘর অন্ধকার থাকার কিছুই দেখতে পেলো না। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় বেলা ঘরটাকে দেখে বুঝতে পারলো এটা হাসপাতাল নয়। মুহূর্তেই আঁৎকে উঠলো। ওর তো এখন হাসপাতালে থাকার কথা! কিন্তু এটা হাসপাতাল নয়। বাঁ-হাতে মাথা চেপে, ডান হাতটা মাথা থেকে নামিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরলো। চিনচিনে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হলো। হাত বেয়ে কিছু গড়িয়ে পড়ছে। বেলা অবাক হয়ে অন্যহাতে ডান হাতের ওপর থেকে তরল জিনিসটা ছুঁতেই চটচটে ভাব হলো। হাতে একটা নল লাগানো। তীক্ষ্ম চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে দেখলো খাটের স্ট্যান্ডে স্যালাইনসহ নল ঝুলছে। ভীষণ অবাক হয়ে আনমনে বলল, ‘আমি কোথায় আছি?’

কোনো উত্তর এলো না। একটানে হাত থেকে ক্যানোলা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। পরেরবার পারলো। বিছানা থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের দরজা খুঁজতে লাগলো। একসময় পেয়েও গেলো। কিন্তু দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। বেলা ধাক্কাধাক্কি শুরু করার পরেও কেউ দরজা খুললো না। ঘরের সুইচবোর্ড খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো। সুইচ অন করতেই পুরো ঘরটা ঈষৎ হলদেটে আলোয় ভেসে গেলো। অনেকটা সময় পর চোখে আলো পড়ায় আপনাআপনি চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এলো। বেলা সময় নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। তারপর চোখ খুলে ঘরটাতে নজর বুলালো। একপাশে সেমিডাবল খাট, ওয়ারড্রব, সোফা আর টেবিল রাখা৷ অচেনা ঘর, অচেনা পরিবেশ! এটা কোন জায়গা? আগে কখনো এসেছে বলে তো মনে পড়েনা! বুকের ভেতর কান্নারা দলা পাকিয়ে বসে আছে, ঢোক গিলে তা সংবরণ করে নিলো বেলা। ওকে শাইনির কাছে যেতে হবে। শাইনি এখন কেমন আছে জানতে হবে। আর ও কোথায় আছে? কে এখানে নিয়ে এসেছে? দরজা বন্ধ করা কেন? ওর আসলে হয়েছে কী? বেলা বিষন্ন মনে ভাবলো এখন কী করবে ও! গায়ের পোশাকের দিকে তাকিয়ে আরও হতভম্ব হয়ে পড়লো। হসপিটালে থাকাকালীন ওর পরণে ছিল খয়েরি রঙের সালোয়ার-কামিজ। কিন্তু এখন অফ হোয়াইট রঙের মধ্যে সাদা পাথরের একটা লম্বা টপ পরণে৷ এটা তো ওর কাপড় নয়! এবার বেশ ভয় পেয়ে দরজায় ধাক্কা শুরু করলো বেলা।
‘কেউ আছেন? দরজা খুলুন প্লিজ।

কেউ খুলছে না দেখে বেলা এবার জোরে জোরে শব্দ করতে শুরু করলো এবং ডাকতে লাগলো। হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ নব ধরে মোচড় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। বেলা অবাক হয়ে দেখলো দরজা এতক্ষণ খোলাই ছিলো, শুধু নব মোচড়ালেই খুলে যেত। কিন্তু অচেনা পরিবেশ হওয়ায় এসব কথা মাথাতেই আসেনি ওর। ঘরে ঢুকলো একজন ষাটোর্ধ্ব মহিলা। নির্মল মুখখানি আলোয় ঝলমলে করছে। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে। চেহারায় বেশ মায়া মায়া ভাব হলেও চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বুদ্ধিদীপ্ত সেই চাহনির মালকিনের দিকে দৃষ্টি নিপাত করে বেলার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুতে চাইলো না। অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আপনি কে?’

মহিলাটি সহাস্যে উত্তর দিল, ‘আমি তোমার ফুপি।’

বেলা ভ্রু কুঁচকালো। ফুপি? ওর তো একটাই ফুপি। রুহি আপুর মা মিতালি বেগম। আর সামনে দাঁড়ানো বয়স্ক মহিলাটিকে ও কোনোদিন দেখেনি, না ওনার বিষয়ে জানে সে। বেলা নিষ্প্রভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ফুপি? কিন্তু আমার তো একটাই ফুপি। আর কোনো ফুপি আছে বলে তো আমার মনে পড়ে না! আর আপনার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, কে আপনি তাহলে?’

মহিলাটি ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতেই শান্ত স্বরে বললেন, ‘তুমি বসো মা। আর একী? তুমি ক্যানোলা খুলেছো কেন? হাত দিয়ে তো রক্ত গড়াচ্ছে! এটা কী করলে?’

মহিলাটি উদ্বিগ্ন স্বরে আওড়ালেন কথাগুলো। তারপর হাতের ভেজা তোয়ালেটা ছুঁড়ে মারলেন সোফার উপর। দ্রুত পায়ে এগিয়ে বেলাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে তিনি ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে নিয়ে এলেন।তারপর খুব যত্ন করে ক্যানোলা লাগানো অংশটা তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বেলা শুধু অবাক হচ্ছে। মহিলাটি এত ভনিতা করছে কেন? কে ইনি? আর ওকেই বা এসব করছে কেন আজব! ওনার আচার-আচরণ সবকিছু একদম প্রফেশনাল ডাক্তারদের মতো। ট্রিট করছে ওদেরই মতো।

ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষে মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাথা হচ্ছে?’

‘না।’ ছোট্ট করে জবাব দিলো বেলা।

মহিলাটি ফার্স্ট এইড বক্সটা জায়গামতো রেখে ঘুরে তাকালেন বেলার দিকে। মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছো না তাই তো?’

বেলা মাথা নাড়ালো।

‘আমি শাম্মী। তোমার ফুপি। কেমন ফুপি সেটা আগে বলে নেই! তোমার বাবা আর আমার মা দুজন ফুপাতো ভাই-বোন। সেই সূত্র ধরেই আমি তোমার ফুপি। তুমি হয়তো আমাকে দেখোনি, কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম তোমাকে।’

বেলা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। মহিলাটির পরিচয় জানা দরকার। তারও আগে শাইনি কেমন আছে সেই খবর জানা প্রয়োজন। ও নরম কণ্ঠে বলল, ‘আমি হয়তো দেখিনি আপনাকে। কিন্তু বাবার মুখে কয়েকবার আপনার নাম শুনেছি। বিদেশে থাকতেন বোধহয় নাকি!’

‘হ্যাঁ। আমার ডাক্তারি পড়াকে কেন্দ্র করে চলে যাই কানাডায়। বিয়ে করে নিই সেখানেরই এক বাংলাদেশীকে। স্যাটেল হই ওখানেই। এর মধ্যে আমার ছেলেটাও বড় হতে থাকে। ক্যারিয়ার, সংসার, সন্তান একসাথে সামলাতে গিয়ে এরপর আর দেশে আসা হয়নি।’

‘কখন ফিরলেন?’

‘এইতো সপ্তাহখানিক আগে স্বামী-সন্তান সহ দেশে ফিরলাম। এর মধ্যে তোমার বাবাকে একদিন ফোন করতেই গল্পে গল্পে তোমার কথা উঠে আসলো। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু জানান আমাকে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং দুর্বলতায় তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে। ডাক্তার বলেছিল তোমাকে স্ট্রেস যাতে না দেওয়া হয় প্লাস হাওয়া পরিবর্তন করার জন্য। হসপিটালে এডমিট ছিলে। সব শুনে আমি আর আমার ছেলে মিলে পরামর্শ করি, তোমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। আর গত পরশু আমাদের এখানে তোমাকে নিয়ে আসে তোমার বাবা।’

বেলা থমকে যাওয়া কন্ঠে অবাক হয়ে বলল, ‘গ গত পরশু? মানে? আমি কয়দিন ধরে অসুস্থ? আ আজ কত তারিখ?’

শাম্মী হেসে বললেন, ‘আজ তিন-ই সেপ্টেম্বর। তোমাকে এক তারিখে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিলো। আজ প্রায় পাঁচদিন পর তোমার পুরোপুরিভাবে সেন্স ফিরলো মা।’

বেলার মাথা ঘুরে গেলো। সামান্য বিপি লো হওয়ার কারণে পাঁচদিন পর সেন্স ফিরলো? ও কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আপনি জানেন ওনার অবস্থা কেমন? ওনি ঠিক আছেন কি-না?’

শাম্মী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ওনিটা আবার কে?’

বেলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো, ‘ওনি মানে আমার হাজব্যান্ড। শা শাইনি ওনার নাম। ওনি তো হসপিটালে এডমিট ছিলেন। খুব অসুস্থ! আপনি জানেন ওনি কেমন আছেন? আমাকে এখানে নিয়ে এলো কেন? আচ্ছা আব্বু কোথায়? ডাকুন না আব্বুকে। আমি ওনার কাছে যেতে চাই, আব্বুকে ফোন করে আসতে বলুন না একবার প্লিজ।’

শাম্মী অবাক নয়নে বেলার দিকে চেয়ে রইলো। মেয়েটার পাগলামি করাটা স্বাভাবিক হলেও প্রেসার নেওয়াটা ওর জন্য ক্ষতিকর। আর তিনিই বা কী বলবেন বেলাকে? নাইমুদ্দীন তো এখানে নেই। তিনি বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত হতে বললেন। বেলা চেয়েও শান্ত হতে পারছে না। ওর মনে জমে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। বাবা ওর সাথে এরকম করলো কেন? বাবা কী জানেনা শাইনিকে বেলা কতোটা ভালোবাসে? একপলক না দেখলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে! শাইনি কোথায়? কেমন আছে তাঁর হৃদয় দখল করে নেওয়া সেই পাগলটা? যাঁর সাথে প্রতিটি শ্রাবণ পাহাড়ের ওই ঘরটাতে কাটাতে চায়! যাকে বারবার ‘ভালোবাসি’ বলতে চায় ও!

চলবে…ইনশাআল্লাহ! রেসপন্স করবেন আপনার প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here