#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#বারো
চাঁদনি রাত! মেঘমেদুর আকাশে তাঁরার দেখা নেই৷ মেঘে ডাকা আকাশটা গুমোট হয়ে আছে। সে আকাশে অর্ধচন্দ্রের একফালি কালো মেঘকে ঠেলেঠুলে উঁকি দিচ্ছে ধরনীতে। নিরা সে আকাশটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে অর্নব।
নিরা আকাশপানে দৃষ্টি রেখেই প্রশ্ন করল, “কী দেখছেন বলুন তো ডক্টর?”
অর্নব থমকাল। চকিতেই দৃষ্টি শূন্যে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “আকাশের চাঁদটা।”
নিরা হাসল। অর্নব সে হাসি খেয়াল করে নিজেও হাসল। নিরা তার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম মনে হলো এ লোকটার চলাফেরায়, কথাবার্তায় যেমন ধারালো ভাব আছে। তেমনি হাসিটাও শানিত। একটু দাম্ভিক সেই হাসি। তবে দেখে মনে হয় কিছু একটা বিশেষ আছে, যার জন্য সহসা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। নিরার ভালো লাগছে। এ মুহূর্তটা সব রকম বিভেদকে আড়াল করে তীক্ষ্ণ এক টুকরো স্বস্তির বাতাস বয়ে চলেছে দুজনার মধ্যে।
“হঠাৎ হানিমুনে যেতে রাজি হলে যে?”
হানিমুন কথাটা শুনে নিরা চমকাল। বুকের ভেতরটায় ধড়ফড় করল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, “আসলে আমি দিদানকে অনেকবার বলেছি যেতে চাই না। অনেক বাহানাও দেখিয়েছি। কিন্তু তাতে দিদান কিছুই শুনলেন না। তাই অগত্যা রাজি হতে হলো। তবে আমি চাই আপনি দিদানকে কোনো একটা অজুহাতে বুঝিয়ে বলেন যে আপনি পারছেন না যেতে।”
“আমিও চেষ্টা করেছি। দিদান আগে থেকে সব এমনভাবে সেট করে রেখেছেন যে আমার অজুহাতের সব দরজা তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন।”
নিরা চুপ করে রইল। তার চুপ থাকা দেখে অর্নব বলল, “নিরা তুমি চিন্তা করো না। দরকার হলে দিদানকে সব সত্যি বলে দেব। তাও যাব না আমরা।”
নিরা কিছুক্ষণ কী ভেবে বলল, “না থাক এখনো অনেকটা সময় বাকি। আপনি কাউকে কিছু বলবেন না। বরং চলুন আমরা ঘুরে আসি। হানিমুন না হোক পিকনিক তো করাই যায়, বলুন?”
অর্নব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। এখন কাউকে কিছু বলা মানে সবকিছু এলোমেলো করে ফেলা। যা সে চাইছে না।
অর্নব গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি সিওর তো নিরা?”
নিরা মিষ্টি হেসে বলল,”হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর।”
অর্নব হাসল তার সেই দাম্ভিক অথচ সুন্দর হাসিটা।
★★★
নিরা সুটকেসে জামা কাপড় গোছাচ্ছে। অর্নব পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। নিরা বলল, “আপনার কী কী নেব?”
অর্নব অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে৷ বলল, “কী বলছো? আমার জিনিসপত্র তুমি গোছাবে?”
নিরা ভ্রুকুচকে বলল, “কোনো সমস্যা?”
“না কোনো সমস্যা নেই।” অর্নব হাসল।
অর্নবের কথামতো তার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল সে। অর্নবের মনে হচ্ছে নিরা সত্যি সত্যি তার বউ৷ যে তার বিষয়ে খেয়াল রাখছে। মনের অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। নিরা সব গুছিয়ে শুয়ে পড়ল। সকাল আটটায় তাদের ফ্লাইট তাই রাতেই গুছিয়ে রাখল। এমন সময় অর্নবের ফোন বেজে উঠল। ফোনটা নিরার বালিশের নিচে থাকায় সে বের করে অর্নবের দিকে এগিয়ে দিল। না চাইতেও ফোনের স্কিনে দেখল দিয়া কল দিয়েছে। হঠাৎ হাসিখুশি মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফোনটা এগিয়ে দিল। অর্নব দিয়ার নম্বর দেখে নিরার দিকে তাকাল। নিরার মুখে অন্ধকার নেমেছে। অর্নবের খারাপ লাগছিল। ভাবল দিয়াটার কোনো টাইম সেন্স নেই। এখন কোনো সময় হলো কল দেয়ার। ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। নিরা ওপাশ ফিরে শুয়েছিল।
অর্নব চলে যাওয়ার শব্দ শুনে। উঠে বসল। হঠাৎ করে মনটা কেন যেন খারাপ হয়ে গেল তার। এত রাতে ডক্টর দিয়া কল দিয়েছে। মানে প্রতিদিন হয়তো কল দেয়। নিরার আড়ালে এভাবে তাদের কথা হয়। নিরা নিজেকে সামলে নিতে চাইল। ভাবল আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি এটা তো হওয়ারই কথা ছিল। তারা একই হাসপাতালে কাজ করে সারাদিন নিশ্চয়ই একসাথে থাকে। তখন তো আমি দেখতে যাই না। এখন কল দিয়েছে ভেবে কেন খারাপ লাগছে! আমি কী নিজেকে ডক্টরের বউ ভেবে ফেলছি। না এটা হতে পারে না। যদি এমন কিছু আমার মন ভেবেও থাকে তবে তা অন্যায় হবে। এমন অন্যায় করাটা উচিত হবে না। যা আমার নয় অকারণে তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা।
নিরা নিজেকে অনেক বুঝাল। চুপচাপ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কাত হয়ে শুয়ে পড়ায় সে বুঝতে পারল তার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে জল টুকু শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আবার অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ছে।
★★★
অর্নব কল ধরতেই দিয়া বলল, “এটা কী শুনছি অর্নব। তুমি নাকি হানিমুনে যাচ্ছো?”
“দিদান ছাড়ছে না। এ মুহূর্তে আমার পক্ষে সত্যিটা বলা সম্ভব নয়। ধরে নাও বেড়াতে যাচ্ছি। হানিমুন শব্দটা যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, সে অর্থে কিছুই হচ্ছে না।”
দিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে অর্নব। কী করলে এ কষ্ট থেকে রেহাই মিলবে বলবে প্লিজ?”
অর্নব চুপ। তার কাছে এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। অনেক সময় আমাদের কাছে, অনেক প্রশ্নের জবাব থাকে না। চেয়েও আমরা কিছুই বলতে পারি না। এই মুহূর্তটা ঠিক তেমন।
দিয়া কোনো উত্তর না পেয়ে বলল, “তুমি খুব পাষাণ ডক্টর অর্নব। খুব খারাপ।”
অর্নব অস্ফুটস্বরে বলল,”আই এম স্যরি দিয়া। প্লিজ ফরগিভ মি।”
“আই উইল নেভার ফরগিভ ইউ। নেভার, এভার!”
“প্লিজ দিয়া। তুমি এভাবে বললে আমার খারাপ লাগবে।” অর্নবের গলায় আকুলতা স্পষ্ট।
দিয়া চিৎকার করে বলল, “আমি এতটা উদার হতে পারছি না অর্নব। পারছি না আমি। নিজের ভালোবাসাকে অন্য কারো সাথে দেখতে কেমন লাগে সে তুমি বুঝবে না।”
অর্নব বার কয়েক দিয়াকে ডেকে গেল। দিয়া চুপচাপ কেঁদে গেল। একটা সময় অর্নব শুনল দিয়ার হেচকি উঠেছে তার সাথে কাশি শুরু হয়েছে। তাই কল কেটে দিয়েছে। অর্নব সোফায় বসে পড়ল। নিজেকে এ মুহূর্তে সবচেয়ে অপরাধী মনে হচ্ছে। সে জানে দিয়া কষ্ট পাচ্ছে। সে কষ্টটা শুধু তার জন্যই। জীবনে কিছু কিছু সময় আমাদের করার কিছু থাকে না। তখন সময়ই হয়ে উঠে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। মানুষকে কলের পুতুলের মতো করেই নাচাতে থাকে এ সময়। তখন অতি ক্ষমতাবান মানুষও কিছুই করতে পারে না।
★★★
অর্নব খেয়াল করে দেখল রুমে আলো নেভানো। তার মানে নিরা ঘুমিয়ে গেছে। ফোনটা হাতে দেয়ার সময় নিরার চেহেরায় আজ সে রাগ দেখেছে। সে রাগটা কেন! দিয়া কল করেছে বলেই কী সে রাগ করেছে! নাকি আমি ভুল দেখলাম। মেয়েটাকে বুঝা যায় না। বিধাতার সৃষ্টি সবচেয়ে জটিল বোধহয় এ নারী জাতি। এদের বুঝার ক্ষমতা কারো নেই। হয়তো তারা নিজেই তাদের বুঝতে পারে না।
অর্নব নিরার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। আলতো সুরে ডাকল, “নিরা?
নিরা জবাব দিল না। আবার ডাকল অর্নব, ” ঘুমিয়ে পড়েছো?”
“উঁহু।”
“তোমায় একটা প্রশ্ন করি?”
“করেন?”
অর্নব ক্ষানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, “হুট করে আমাদের বিয়ে হয়ে যাওয়াটাকে তুমি কী ভাবো?”
“ভাগ্য।” নিরা ছোট্ট করে দূর্বল স্বরে বলল।
অর্নব অবাক হয়ে বলল, “ভাগ্য? কীভাবে একটু ব্যাখ্যা করবে?”
“আমার ইচ্ছে করছে না।”
“প্লিজ নিরা বলো না।”
“হুট করে জানা নেই, শোনা নেই একজনকে বিয়ে করতে হয়েছে মানে তো সেটা তো ভাগ্যই। যা পূর্বে নির্ধারিত ছিল। ভাগ্য না হলে এমনটা হবে কেন? আমি আপনার, আর আপনি আমার ভাগ্যে ছিলেন বলেই এমনটা হয়েছে। নয়তো বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পরও কেন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন।”
“এত বড় একটা ঘটনাকে তুমি শুধু ভাগ্য বলে উড়িয়ে দিচ্ছো নিরা? গ্রামের মানুষের কী কোনো দোষ ছিল না?”
নিরা হাঁটু গুঁজে উঠে বসল। অর্নবও তার মুখোমুখি উঠে বসেছে। পাশের সাইড টেবিলের উপর ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুরো ঘরময় আবছা হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
নিরা বলল, “যদি গ্রামের মানুষকে দোষ দেই। তবে আমরাই কষ্ট পাব। আমি ছোট বেলা থেকে নিজের সব না পাওয়াকে ভাগ্য বলে ভেবে নিয়েছি। মা ছিল না। মায়ের ভালোবাসা কেমন জানা হয়নি। সেটাও ভাগ্য হিসেবেই ধরে নিয়েছি। সবসময় একা বড় হয়েছি। কখনো কষ্ট হলে কাউকে বলার মতো পাইনি। খুশি হলে তা ভাগ করার জন্য কাউকে পাইনি। তাও আমাকে ভালো থাকতে হয়েছে। আমি ভালো ছিলামও। কেন জানেন?”
“কেন?”
“কারণ আমি সবকিছুকে ভাগ্য বলে ভেবে নিয়েছি। ভেবেছি আমার সৃষ্টিকর্তা এসবেই আমার ভালো রেখেছেন। তিনি চেয়েছেন আমার জীবন এভাবেই যাপিত হোক। তাই আমার জীবন এমন এলোমেলো হয়েছে। যদি ভাবতাম এসব কিছুর জন্য কেউ দায়ী তবে আমি কষ্ট পেতাম। সারাদিনের একাকিত্ব শেষে যে সান্ত্বনাটা দিয়ে নিজেকে ভালো রাখতাম তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইনি।”
নিরা কিছুক্ষণ থামল, আবার বলল, ” যখন কোনো মানুষ ভেবে নেয় তার ভাগ্যে ছিল বলেই এসব ঘটছে তবে সে সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখতে পারে। আর এ বিশ্বাসটায় একটা শান্তি আছে, যা ভেতরটাকে শান্ত রাখে। কিন্তু যদি মনে করে, না জীবন তার থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। তার আরও অনেক কিছুই পাওয়ার ছিল তবে তার ভেতরটা প্রতি মুহূর্তে সে না পাওয়াটাকে পাওয়ার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠবে। এতে করে খারাপ পথে যেতেও দ্বিধা করবে না। আর খারাপ পথে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। তারচেয়ে এই ভালো নয় কি গ্রামের মানুষদের অভিযোগ না করে সবটা ভাগ্য বলে মেনে নেয়া? জীবনে কতকিছুই তো পাওয়া হয় না। তাই বলে সেসবের জন্য অন্যকাউকে দায়ি করে লাভটা কী?”
অর্নব মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিরার কথাগুলো শুনছে। অদ্ভুত মুগ্ধতায় চারপাশ ছেয়ে গেছে। এই ছোট্ট মেয়েটা এত সুন্দর করে কী করে কথা বলতে পারে! কত কঠিন কথা কত সহজে বলে ফেলেছে। অথচ এ মেয়েটাকে সে নিতান্তই ছেলেমানুষ ভেবেছে! আসলে জীবনের সবচেয়ে বড় পরিপক্বতা বোধহয় অঅভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আসে। বয়সের মধ্যে দিয়ে নয়। নিরার জীবনের না পাওয়ার ঝুলিটাই তাকে এত সুন্দর করে কঠিন কথাকেও সহজভাবে প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছে। তার হৃদয় মন্দিরে একটা স্নিগ্ধ মিষ্টি বাতাস তিরতির করে বয়ে চলেছে। সে বয়ে চলা সুখানুভূতির নাম যে ভালোবাসা সেটা অর্নবের কাছে তখনও অজানাই ছিল।
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#তেরো
সকাল, সকাল তৈরি হয়ে নিচে নেমে এসেছে নিরা, অর্নব। তাদের বিদায় জানাতে অপেক্ষা করছেন পরিবারের সবাই। নিরা একে একে সবাইকে সালাম করল। শাশুড়ির কাছে যেতেই তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “আমার ছেলের দিকে খেয়াল রেখো। আমাকে সালাম করতে হবে না।”
নিরা বলল,”রাখব।”
দিদান নিরার চিবুক ধরে বললেন, “তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।”
অর্নবের বাবা বললেন, “কিছু সুন্দর মুহূর্ত মুঠো ভরে নিয়ে এসো। যা আগামী দিনগুলোতে মনে রাখার মতো সুন্দর স্মৃতি বহন করবে। সংসার করার মানসিকতা তৈরি করবে।”
নিরা অর্নব হাসল। তারা বেরিয়ে পড়ল। আজ ড্রাইভার তাদের এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসবে। ভোরের আকশে মিঠে রোদ উঁকি দিচ্ছে। সে ঝকঝকে রোদ জানাল গলে যখন নিরার মুখের উপর এসে পড়ল তখন অর্নবের মনে হলো কোনো অপার্থিব সৌন্দর্য নিরার আদুরে গালে খেলা করে গেল। এই প্রথম তার মনে হলো মেয়েটা সুন্দর! আশ্চর্যজনক সুন্দর! ভয়ানক সুন্দর! যা তার ভেতরটা অস্বাভাবিক করে তুলছে। হৃদপিণ্ডটা অতি দ্রুত লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। নিরা জানালায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছে। বসবাসের জন্য ঢাকা শহর থেকে চট্টগ্রাম অধিক বাসযোগ্য। প্রাকৃতিক পরিবেশ, গাছপালা মিলিয়ে অসাধারণ উপভোগ্য জায়গা। ঢাকা শহর মানেই তো গাড়ির শব্দ, শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ। এর চেয়ে চট্টগ্রাম ঢের ভালো।
★★★
প্লেনে উঠে নিরার ভীষণ বিরক্ত লাগছে। এটা তার প্রথম ফ্লাই। আগে ভাবত প্লেনে উঠা মানে শান্তির একটা জার্নি। কিন্তু তার ভুল ধারণা ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। ফ্লাই জার্নির চেয়ে ট্রেন জার্নি আরও ঢের ভালো লাগে তার। জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল কতটা উপরে উঠে এসেছে তারা। এমন সময় কেবিন ক্রু এসে তাদের কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে গেল। নিরা পানি চাইল।
নিরার পানি খাওয়া শেষ হলে অর্নব বলল, “কেমন লাগছে বলো?”
“ভালো।” ছোট করে উত্তর দিল সে।
“কিন্তু তোমার নাকের ডগায় বিরক্তি ঝুলে আছে দেখছি?”
নিরা ভ্রুকুচকে বলল, “তাই নাকি? কই আমি তো দেখছি না।” কথাটা বলেই নিরা নিজের মুখটা উঁচু করে নাক দেখার চেষ্টা করল।
অর্নব ওর এই ভঙ্গি দেখে ফিক করে হেসে দিল। ওর এমন প্রাণ খোলা হাসি দেখে নিরা চকিতেই তার দিকে ফিরে তাকাল। নিজের অজান্তেই নিরা মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল এ পৃথিবীর সব কোলাহল। সম্মোহিতার মতো দেখতে লাগল সেই হাসি দাম্ভিক অথচ সুন্দর হাসিটা! যার মোহ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল খানিকক্ষণ।
কিছুটা সময় পর অর্নব হাসতে হাসতেই নিরার দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পারে তার সামনে থাকা মানুষটা তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে। অর্নবের হাসিটা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। তার মনে হলো মেয়েটার চোখে ভয়ংকর কিছু একটা সে দেখতে পাচ্ছে, যা এর আগে কখনো সে দেখেনি।
অর্নবের চোখ যখন নিরার মুখের উপর স্থীর হয়ে গেল তখনই নিরা চট করে বাইরের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
অর্নব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্যদিকে চোখ সরাল। দুজনের এই লুকোচুরি খেলায় যে ভালোবাসা নামক একটা শব্দটা দুজনের হৃদয়ে গেড়ে বসেছিল তারা তখনও তার হদিসই পেল না। শুধু একে-অপরের উপর অভিমান নিয়ে মাঝখানে যোজন-যোজন দূরত্ব নিয়ে চলতে লাগল অজানার উদ্দেশ্যে।
★★★
কাশ্মীরে তাদের জন্য আগে থেকেই হোটেল বুক ছিল। দিদানের ছোট ভাইয়ের মেয়ে একজন পাকিস্তানি ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। তারাই অর্নবদের জন্য রুম বুক করে রেখেছে। রুমে ঢুকে ফুল দিয়ে সাজানো দেখে দুজনে দুজনের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল। অর্নব পরিস্থিতি স্বাভাবিক কররা জন্য বলল, “দিদান কী যে করে না। এসব তুমি মাথায় আনবে না নিরা। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
নিরা কিছু না বলে চুপচাপ রুমটা ঘুরে দেখতে লাগল।
ফ্রেশ হয়ে খেয়ে তারা ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল। নিরা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। তার সেই সাধারণ সাজ চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপিস্টিক এতেই যেন তার সৌন্দর্য উপচে পড়ছে। এত সাধারণ সাজে সে কাউকে এতটা সুন্দর দেখতে লাগে অর্নবের জানা ছিল না।
দুজনে পাহাড়ি রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে। অনেক মানুষ তাদের আশেপাশে ঘুরছে। চারদিকের সবুজ পাহাড় দেখে নিরা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ তার ভেতরের নরম ছেলেমানুষ মেয়েটা বেরিয়ে আসছে। নিরার চোখে মুখে খুশি দেখে অর্নবের ভেতরটাও শান্তিতে ভরে উঠে। বিয়ের পর এই প্রথম নিরাকে এতটা খুশি দেখছে সে। যদি এখানে না আসত তবে নিরার এমন একটা সুন্দর দিক হয়তো তার দেখাই হত না।
সবুজ প্রকৃতির সাথে সবুজ শাড়ি পরা নিরাকেও যেন প্রকৃতির বুকে প্রকৃতির কন্যা বলেই মনে হচ্ছে।
অর্নব নিরাকে বলল, “এর আগে কোথাও ঘুরতে গিয়েছো নিরা?”
“আমাদের দেশে কয়েক জায়গায় ঘুরা হয়েছে। বাবার সাথে সেসব দিনগুলো আজ শুধুই স্মৃতি। মানুষের জীবনের স্মৃতিগুলো কেন ধরা যায় না বলুন তো? মাঝে মাঝে রাগ হয় এই সিস্টেমটার উপর। ”
অর্নব নিরার কথা শুনে হাসল। নিরা রাগ করার ভঙ্গিতে বলল, “এভাবে একদম হাসবেন না তো। বিরক্তি লাগে। সিরিয়াস কথায় হাসির কী হলো?”
“কিছু না।” অর্নব তখনও হাসছে।
নিরা তাকে হঠাৎ করে স্নিগ্ধ গলায় বলল,”আপনার হাসিটা খুব সুন্দর!”
অর্নব চমক লাগা চোখে তার দিকে তাকাল। এ মেয়েটা তার প্রশংসা করছে! আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে কে জানে!
“আজ হঠাৎ এত প্রশংসা কী কারণে বলো তো?”
নিরা ঠোঁট কামড়াল। হঠাৎ বেফাঁস কথা বলে এখন নিজেই বিপদে পড়ে গেল।
হঠাৎ নিররা ফোন বেজে উঠল। নিরা হাসতে হাসতে ফোনটা চোখের সামনে ধরতেই দেখল মায়ান কল দিয়েছে। অর্নবের হাসি একটু একটু করে তখন মিইয়ে যাচ্ছিল। নিরার ফোনটা এখন তারও চোখের সামনে। সে অবাক গলায় বলল, “মায়ান কেন কল দিয়েছে তোমায়?”
চলবে