সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ১৪+১৫

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#চৌদ্দ

২০২১, ফেব্রুয়ারী ০৩। নিরা মাত্র ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হতে যাবে এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। চকিতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল, নিজেই বলে উঠল, ” এখন আবার কে করল!” দেখল বাংলাদেশি নম্বর, তবে তার চেনা নয়। ফোনটা হাতে নিয়ে ইতস্তত করল সে। ভাবতে ভাবতেই কল কেটে গেল। ফোনটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখতেই আবার বেজে উঠল এবার রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে কারো গলার আওয়াজ পেল।

“কেমন আছো ভাবী?” গলাটা চিনতে ভুল হলো না তার।
“আলহামদুলিল্লাহ ওহি। তুমি কেমন আছো?”

“এইতো চলছে এক রকম। ভাবছিলাম তোমায় কল করি কিন্তু তুমি ফ্রী থাকবে কিনা তা ভেবে আর করা হয়নি। তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”

নিরা স্মিত গলায় বলল, “ভালোই চলছে। তোমার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো?”

“চলছে। ভাবী ভাইয়া ভালো নেই।”

“তোমার কথা বলো ওহি। অন্যকারো কথা আমি জানতে চাইনি!”

“পৃথিবীর সবচেয়ে মিথ্যে কথা এটা। আমি জানি তুমি প্রতি মুহূর্তে ভাইয়ার কথা জানতে চাও।”

নিরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমার ভুল ধারণা ওহি।”

“কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক আমি জানতে চাই না। শুধু জানি তুমিবিহীন আমার ভাইয়া জীবিত হয়েও মৃতের মতো আছে। প্লিজ ভাবী সবকিছু ভুলে যাও। ফিরে এসো।”

“আমার ও দেশে কিছুই নেই ওহি। আমি আর কখনো বাংলাদেশে ফিরে যাব না। ও দেশের সব মায়া কাটিয়ে চলে এসেছি আমি। আর ফেরার পথ নেই।”

ওহির মুখটা যন্ত্রণায় এটুকুনি হয়ে গেল, সে বলল,”ভাবী তুমি এত নিষ্ঠুর জানতাম না। আমার বিয়েতে অন্তত এসো। আমি তোমার অপেক্ষা করছি।”

নিরার চোখে-মুখে হতাশার রেখা ফুটে উঠল।
“শোনো ওহি তুমি তো জানো আমি কী অবস্থায় ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছি। এরপর আমার পক্ষে যাওয়া যে সম্ভব নয়। তাছাড়া ওই বাড়িতে গেলে ওই মানুষগুলোকে দেখলে আমার সব মনে পড়ে যাবে। এতে আমি ভালো থাকব না। না চাইতেও তোমার ভাইয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলব। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এটা চাই না।”

ওহি বুঝতে পারল কোনো লাভ হবে না একে বুঝিয়ে তাই উত্তেজিত গলায় বলল, “আমার ভাইয়ার কিছু হলে আমি তোমাকে কখনো মাফ করব না ভাবী। কখনো না।” ওহির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। ফোনটা কাটার আগেই পেছনে ফিরে দেখল অর্নব দাঁড়িয়ে আছে। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “কেন ওকে কল করেছিস?”

ওহি জবাব না দিয়ে কাঁদছে। ফোনটা কানের পাশ থেকে সরিয়ে হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে।

অর্নব বোনকে জড়িয়ে ধরল। ভাইয়ের বুকে মাথা রাখতেই ওহির কান্নারা আস্কারা পেয়ে দ্বিগুণ গতিতে বেরিয়ে এলো। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগল। অর্নব বলল, “নিরা আর আসবে না আমার কাছে ওহি। কখনো আসবে না। এ জীবনে আমার আর ভালো থাকা হবে না। এ-ই সহজ কথাটা আমি মেনে নিয়েছি। তোরাও মেনে নে লক্ষ্মী বোন আমার।”
কথাগুলো বলতে অর্নবের কষ্ট হচ্ছে। তার সুকুমার মুখ খানায় মেঘমেদুর ছায়া পড়ল। নিজের ভেতরের রক্তক্ষরণ মুখের অবয়বে ফুটে উঠেছে।

জীবনের নিয়ম বড় অদ্ভুত! কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানে না। নয়তো গ্রামের সেই নিরা নামের সাধারণ মেয়েটা, এতটা অসাধারণ হয়ে উঠবে সে কী জানতো! যে মেয়েটা একা ঘরে ঘুমাতে ভয় পেত, সে আজ নিজের দেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ একা প্রবাসে কীভাবে থাকছে! কীভাবেই বা একা বাসায় রাতে ঘুমায়! সময়ের সাথে জীবন তাকে অনেককিছু শিখিয়ে দিয়েছে। কীভাবে লড়াই করে বাঁচতে হয় সে জানে। আর এ-ও জানে সে কীভাবে ভাগ্যকে নিজের পক্ষে করতে হয়।

★★★

নিরা ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ। অনেকবার হ্যালো, হ্যালো বলার পরও ওহির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই ফোন কেটে দিল। আচমকা তার মনের আকাশে কৃষ্ণমেঘের ছায়া পড়ল। ওহির কথাগুলোকে যতই সে এড়িয়ে যাক। সে জানে অর্নব তাকে ছেড়ে ভালো নেই। দু’বছর আগে হলে এ কথাটা শুনে সে সুখী হতে পারত। কিন্তু এখন সেটা কিছুতেই পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে অর্নবের মন থেকে তার নামটা সৃষ্টিকর্তা মুছে দিক। শর্ট টাইম মেমরি লস হওয়ার এক রোগ আছে বলে সে জানে। সে খুব করে চায় অর্নবের সে রোগটা হোক। তার স্মৃতি থেকে ২০১৯ এর আটটি মাস মুছে যাক। মুছে যাক নিরা নামক শব্দটি। নিরা খাটের উপর বসল। এখন আর ফ্রেশ হতেও ইচ্ছে করছে না। কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট! যে অভিমান, অনুরাগ নিয়ে সে দেশ ছেড়েছে সে অভিমানের দেয়ালটা টপকিয়ে ভালোবাসা নামক শব্দটা ডালপালা গজিয়েছে। যা অভিমানকে ছাড়িয়ে গেছে।

সম্পূর্ণ অজানা এক পুরুষকে অপ্রস্তুত ভাবে বিয়ে করার পর যে তার প্রেমে ডুবে যাবে সে কে জানতো! যাকে এক মুহূর্তের জন্য সহ্য হতো না। তাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ফেলবে সে কে জানতো! জীবনের এ মুহূর্তে এসে তার মনে হচ্ছে এ জীবন তাকে নিয়ে জঘন্য এক খেলায় মেতে উঠেছে। সে খেলায় তাকে রোজ ভেঙেছে। রোজ সে নিজেকে গড়েছে। অনেক মূল্য চুকাতে হয়েছে তাকে। কী হতো যদি আট – দশটা মেয়ের মতো সাধারণ একটা জীবন হতো তার। কী হতো! আজ বাবাকে খুব মনে পড়ছে তার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তার জন্য হলেও মাঝে মাঝে দেশে ফিরতে হতো। কিন্তু আজ আর দেশে ফেরার জন্য কোনো অজুহাত রইল না তার কাছে। এ জীবন তাকে সম্পূর্ণ একা করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এমন এমন কঠিন ও জঘন্য সত্যি তার সামনে দাঁড় করিয়েছে যে, সে এখন আর চাইলেও ফিরতে পারবে না অর্নবের কাছে। জীবনে কিছু ভালোবাসা অপূর্ণ থাকে। সে না হয় সেই অপূর্নতায় নিজের সুকজ খুঁজে নেবে। পা দুটো ঝুলিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল সে। নানা চিন্তায় মাথাটা বড্ড ধরেছে। এখন এক কাপ কফি খেতে হবে। তারপর হঠাৎ তার মনে হলো সে কফি খেত না। অথচ আজকাল কফি ছাড়া চলেই না। ভাবল জীবন আসলেই পরিবর্তনশীল।

নিরা কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে বসল। ওয়াশরুমে ঢুকে পরিস্কার হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে কফি মেশিনে কফি বানিয়ে নেয়। দুটো টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ করল। খাবার গুলো নিয়ে বাইরে আসল। তার বাসাটা খুব সুন্দর। দোতলা বাড়ি। তবে নিচ তলাটা সম্পূর্ণ রুম করা হলেও উপরের তলায় শুধু একটা প্লট। বাকি দুটো প্লটের জায়গায় সুন্দর করে বসার জন্য খালি রাখা হয়েছে। উপরে ছাদ নেই। শুধু রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বড় ছাতা রাখা হয়েছে। এখানে দু’সেট সোফা দু’জায়গায় রাখা হয়েছে। দেখতে বেশ লাগে। বাসার চারপাশে সবুজ গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসে ভরা মনোমুগ্ধকর উঠোন। এখানে এসে বসতেই এক মুহূর্তের জন্য তার মনটা ভালো হয়ে গেল। ঝিরঝির বাতাস বইছে সে বাতাসের ঝাপটা এসে তার খোলা চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।

কাঁটা চামচ আর চুরির কলাকৌশলে টোস্টটা কেটে মুখে পুরে দিল সে। টোস্ট ডিমসেদ্ধ খেয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখল ম্যাপলগাছের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এ পরিবর্তনটা দেখতে বেশ সুখকর অনুভূতি হয় তার। একটু তীব্র বাতাসে ম্যাপল পাতা ঝরে পড়া, বাতাসে উড়তে থাকা, সবুজ ঘাসের ওপর ম্যাপল পাতার অলস শুয়ে থাকার দৃশ্য সত্যি মনকে মোহিত করে। ইংল্যান্ডে ডিসেম্বর আসার আগেই প্রায় সব গাছ তার পাতা হারিয়ে নিজের সৌন্দর্য বিসর্জন দিয়ে নিতান্তই দীনহীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু সময়ের মধ্যে প্রকৃতির এই অভাবনীয় পরিবর্তন কেমন যেন নিরার মন খারাপ করে দেয়। নভেম্বরের শেষ থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিকে দেখলে মনে মায়া জন্মে। কোথাও কোনো সবুজের আবাহন নেই, কোমলতার পরশ নেই, কমনীয়তার পেলব নেই, এ যেন এক রুক্ষ ধূসর প্রান্তর।

★★★

নিরা ফোনটা হাতে নিয়ে পুরনো ছবিগুলো দেখতে লাগল। একটা ছবিতে তার চোখ আটকে গেল। ছবিটি কাশ্মিরে তুলেছিল তারা। সেদিনের কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার। সেদিন তারা কাশ্মিরে পৌঁছে ঘুরতে বেরিয়েছিল হঠাৎ তার ফোনে মায়ান কল দেয়। অর্নব তাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মায়ান তাকে কেন কল দিয়েছে। উত্তরে সে বলেছিল সে জানে না। সেদিন সত্যি সে জানতো না মায়ানের কলের উদ্দেশ্য। ফোন রিসিভ করতেই সেদিন মায়ান তাকে বলেছিল অর্নবকে ফোনে পাচ্ছে না, তাই ওহি থেকে নিরার নম্বর নিয়েছে অর্নবকে ফোনটা দেয়া যাবে কিনা। ফোন লাউডে ছিল বলে অর্নব সবটাই শুনেছে। সে ফোনটা নিয়ে কথা বলল মায়ানের সাথে। নিরার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। সেদিন যে মায়ান তাকে ডেকেছিল এবং সেটা অর্নবকে বলতে বারন করেছিল তা অর্নবকে জানানো দরকার। যদিও পরে সে মায়ানের সাথে দেখা করেনি, তাও তার অবচেতন মন বলছে মায়ান ছেলেটা স্বাভাবিক নয়। কিছু একটা তার ভেতর এমন আছে যা অর্নব বা আর কেউই জানে না। অর্নবকে সবটা বলবে ভেবেও নিরা বলেনি। ভাবল বাড়ি ফিরে বলবে। এখানে ঘুরতে এসেছে শুধু শুধু মুড অফ করিয়ে কী লাভ!

ফোনটা লাউডে থাকায় নিরা অর্নব আর মায়ানের কথোপকথন শুনছিল। মায়ান বলেছিল, “দিয়া খুব কাঁদছে অর্নব তুই ওকে এভাবে ঠকাতে পারিস না। তুই কী করে হানিমুনে যেতে পারলি!”

অর্নব নিরার মুখের দিকে একবার চেয়েছিল। নিরা নির্লিপ্ত ভাবে হাঁটছে। সে দ্রুত এগিয়ে যেতে নিলে অর্নব এ প্রথম না বলে তার হাত ধরে থামিয়ে দিল। চোখের ইশারায় বুঝাল এখানেই থাকতে। অগত্যা নিরা দাঁড়াতে বাধ্য হলো। অর্নব মায়ানের উত্তরে বলেছিল, “আমি দিয়ার সাথে বুঝে নেব। তুই চিন্তা করিস না।”

মায়ান নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার সমস্যা দিয়া কাঁদছে বলে নয়। তার সমস্যা নিরাকে নিয়ে অর্নব হানিমুনে গেছে। তার মতে আগুন আর ঘি পাশাপাশি থাকলে গলতে বেশি সময় লাগে না। তাছাড়া সুন্দর পরিবেশ। একা নির্জনতায় যৌবনে পদার্পণকারী দুজন ছেলে-মেয়ের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে! মায়ান ভাবল হ্যাঁ অঘটনই তো! তার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে এটা সে কিছুতেই মানতে রাজি না। সে যদি তার কাগজে সই করা স্বামীও হয় তাও না।

মায়ান নিজের রাগকে যথা সম্ভব সামলে নিয়ে বলল, “চিন্তা করব না, মানে? তুই নিরা আর দিয়ার সাথে এমন করতে পারিস না।”

আচমকা অর্নবের রাগ হয়ে গেল। সে বলল, “দিয়ার সাথে আমি কিছুই করছি না। নিরা আমার বউ তাকে আমি যা খুশি করতে পারি। তার জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।”

হঠাৎ এমন কথা শুনে নিরার মনের আকাশে তিরতির করে আলগোছে একফাঁলি সুখের হাওয়া বয়ে গেল। সে হাওয়ায় শরীরে প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মনের প্রতিটি কোণে কোণে গূঢ় সত্যটা আন্দোলিত করেছে। তার কানে বারবার একটাই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘নিরা আমার বউ!’
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#পনেরো

সেদিন অর্নবের এক বাক্যের একটা কথা আজও নিরার কানে বাজে। ‘নিরা আমার বউ।’ গত দু’বছরে তার জীবনে যে আমূল-পরিবর্তন এসেছে তার মাঝে অর্নবের সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত আজও তার মনে গেঁথে আছে। সময়ের নিয়মে অনেক মানুষ জীবনে আসে, আবার অনেকে চলেও যায়। এটাই জীবনের নিয়ম কিংবা এটাই মানুষের নিয়ম। না চাইতেও অনেক কিছু আমাদের মানতে হয়। যা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। তাই ছেড়ে দিতে হয় নিঃশব্দে। এই যে এই মুহূর্তে নিরার চলমান জীবনের গতি যে দু’বছর আগের থেকে ঠিক উল্টো দিকে বইছে তা তো সে চায়নি। সে চায়নি বলেই যে জীবনের পরিবর্তন আসেনি এমনটাও তো নয়। সময়ের প্রয়োজনে সবকিছু ঠিক নিজের গতিতে চলতে থাকে।

সেদিন মায়ানের সাথে কলে কথা বলার পর। অর্নব খানিক সময়ের জন্য কেমন যেন চুপসে গিয়েছিল। পাশাপাশি অনেকটা পথ হাঁটার পরও একটি কথাও বলেনি। সেদিন সে কী অত ভেবেছিল নিরা জানে না। তার বারবার মনে হচ্ছিল মায়ান তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে এটা বলে দেয়া দরকার। পরক্ষণেই সে ভাবল আগে দেখা করে মায়ানের কথা শুনবে তারপর অর্নবকে সবটা খুলে বলবে। নিরা তখন প্রথম কথা বলেছিল, “আপনারা বিয়ে করছেন কবে?”

অর্নব প্রশ্নটা শুনে চলার গতি থামিয়ে দিল। তার মুখটা তখন থমথমে, কপালের রেখাগুলো কুচকানো, চোখে বিস্ময়। অর্নব বলল, “কারা কবে বিয়ে করছে?”
নিরা তার চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, “আপনার আর দিয়া আপুর।”

অর্নব কিছু না বলে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিরার মনে হচ্ছিল অর্নব তার মুখে সন্ধানী দৃষ্টিতে কিছু একটা খুঁজছিল। সে কিছু একটা কী সে জানে না। সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল। কিছু কিছু চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ভেতরটা কেমন যেন হিম হয়ে আসে। হৃদপিণ্ডটা কবুতরের সিনার মতো দূর্বল হয়ে আসে। নিরার তেমনটাই হয়। এই মানুষটার গাঢ় চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। মনে হয় তার ভেতরের যে তোলপাড় সে কোনো মুহূর্তে মুখের আদলে ফুটে উঠবে। সে ধরা পড়ে যাবে মায়া – মায়া চোখের চাহনিতে। যা সে কিছুতেই চায় না। যা হবে না তা ভেবে শুধু শুধু কেন কষ্ট পাবে।

অর্নব তার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, “এখানে ঘুরতে এসেছি। এখন অন্তত এসব কথা থাক না নিরা।”
কথাটা বলার সময় তার গলার স্বরে যে দূর্বলতা সে দেখেছে সেই প্রথম এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়েছিল সামনে থাকা গাঢ় চোখের মানুষটা তার খুব কাছের, খুব আপন! কিন্তু সেদিন সে মুহূর্তে সে কী ভেবেছিল আজ তারা যোজন – যোজন দূরত্বে থাকবে!

★★★

হোটেলে ফিরে তারা যখন ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিল। তাদের দরজায় কড়া নড়ল। অর্নব দরজা খুলতেই দুটো ছেলে – মেয়ে হাসি হাসি মুখে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। মেয়েটার তেইশ – চব্বিশ হতে পারে। অর্নব সৌজন্যের হাসি হাসল। ছেলে – মেয়ে দুটো হেসে বলল, “আজ আমাদের ফার্স্ট এ্যানেভার্সেরি তাই রাতে হোটেলের সামনে এখানে যত কাপল আছে সবাইকে নিয়ে আড্ডা দিতে চাই। আশাকরি আপনারাও আসবেন। আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে আপনাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলাম। আপনাদের অপেক্ষায় থাকব। ততক্ষণে নিরা অর্নবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই দম্পতি এতটাই হাসি – খুশি যে তাদের সচরাচর বারণ করা যায় না। অর্নব নিরার দিকে তাকাল যেন চোখে চোখে সম্মতি চেয়েছে। নিরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লে সে বলল, ” আমরা অবশ্যই আসব।”

দম্পতি হাসল। মেয়েটা বলল, “কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?”

অর্নব হাসিটা ধরে রেখেই বলল, “নিশ্চয়ই?”

“আপনাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তাই না?” মেয়েটার কথা বলায় এমন একটা ভঙ্গি ছিল যে উপস্থিত সবাই না হেসে পারল না। অর্নব হেসে বলল, “আপনার ধারণা একদম সঠিক। ”

তারা বিদায় নিয়ে চলে গেলে। দরজা বন্ধ করে দুজনে বিছানায় এসে বসে। নিরার ঠোঁটে তখনও মিষ্টি হাসি লেগেছিল। সে বলল, “কী সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা তাই না?”

অর্নব নিরার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল তারপর বলল,”হয়তো।”

নিরা ভ্রুকুটি করে পাল্টা প্রশ্ন করল,”হয়তো কেন?”

“হয়তো এই জন্যই যে আমার কাছে অতটা আহামরি লাগেনি। তোমার কাছে ভালো লেগেছে আমার কাছে লাগেনি বলেই হয়তো বলেছি।”

নিরা খাটের পাশে ঝুলে থাকা পা দুটো বিছানায় গুটিয়ে বসে ঝগড়া করার ভঙ্গিতে বলল, “পুরুষ মানুষ এমনই। ঠিক মেয়েদের খুঁটিয়ে – খুঁটিয়ে দেখে বউয়ের সামনে এমন ভাব ধরে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। যত্তসব ন্যাকামি।”

অর্নব নিরার এমন আচরণে চোখ বড় বড় করে তাকাল। ঠোঁট কামড়ে বলল, “তা সে যদি করেও থাকি তাতে তোমার কী সমস্যা বলো তো?”

নিরা তক্ষুনি ফোঁস করে উঠে বলল,”আমার কিছুই না। শুধু সত্যি কথাটা বলার সাহস নেই সেটাই মানতে পারছি না। অকারণে মিথ্যে বলার কী দরকার ছিল?”

নিরার এমন অদ্ভুত আচরণে অর্নবের বেশ মজা লাগছিল। সে তাকে আরও রাগানোর জন্য বলল, “কী যে বলো নিরা! আমি কেন তোমায় মিথ্যে বলতে যাব বলো তো?”

“একশো বার মিথ্যে বলেছেন। হাজার বার বলেছেন। পুরুষ জাতের এই একটা সমস্যা ঘরে যতই সুন্দরী বউ থাকুক বাইরে চুক চুক করবেই।”

” বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কী নিজেকে সুন্দরী বলে দাবী করছো নিরা?”

“দাবী করার কী আছে! আমি তো সুন্দরীই!”

“তুমি কী নিজেকে আমার বউ বলে দাবী করছো নিরা?”
“দাবী করার কী আছে? আমি তো আপনার বউই!”
কথার পিঠে কথাটা বলে ফেলার পর নিরার মনে হলো এটা সে কী বলল! মনে মনে নিজেকে বলল কাঠখোট্টা ডক্টরের সামনে বোকামিটা কেন করলি নিরা? তোর আর বুদ্ধি হলো না।

অর্নব তখনও নিরার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। তার দাম্ভিক অথচ সুন্দর হাসিটা। নিরা নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। এমন সব পরিস্থিতিতে না সামনে বসে থাকা যায়। না হুট করে সামনে থেকে চলে যাওয়া যায়। সে এক অস্বস্তিকর অনুভূতি। যেন মাটি ফাঁক হোক, আর সে লজ্জা ডাকতে মাটির নিচে ঢুকে যাক। পরক্ষণেই তার মাথায় আবার একটা কথা এলো সে কী মনে মনে অবচেতন ভাবে নিজেকে অর্নবের বউ ভাবতে শুরু করেছে! নয়তো হুট করে এসব কেন বলবে! একজন মানুষ যখন অবচেতন ভাবে কিছু একটা ভাবে তখন তার অসতর্কতায় মুখ দিয়ে সেটা বেরিয়ে আসে। তারও কী তাই হয়েছে! যা সে সতর্ক অবস্থায় বলতে পারে না। তাই কী অসতর্ক অবস্থায় বলে ফেলেছে। নিজেকেই যেন নিজের কাছে অচেনা লাগল তার। সে জানে না ভালোবাসা কী! কেমন লাগে কাউকে ভালোবাসলে। জীবনের তেইশটি বসন্ত পার করলেও তার কাছে প্রেম নামক শব্দটি কোনো অসাধারণ অর্থ নিয়ে ধরা দেয়নি। তাই তার মনের কোণে আলগোছে কোনো একফাঁকে প্রেম নামক শব্দটি যে ঢুকে পড়েছে সে বুঝতেই পারেনি।

অর্নবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন নিরার দিকে। সে ভাবছে তাকে কী নিরা ভালোবাসে? নয়তো এমন কথা কেন বলেছে? নাকি মেয়েদের স্বভাবটাই এমন। নিজের স্বামীকে অন্য কোনো নারীর সাথে হেসে কথা বলতে দেখলেই তাদের ভেতরে হিংসা জেগে উঠে। শুধু কী এ স্বভাব সুলভ আচরণের জন্যই নিরা এমন করেছে! কিন্তু এ স্বভাব বোধটার জন্যও তো কাউকে আগে ভালোবাসার দরকার। যদি কাউকে ভালোই না বাসে। তবে হিংসাটা আসবে কোথায় থেকে! নিরা তাকে ভালোবাসে এটা ভাবতেই তার মানসলোকে স্নিগ্ধ ও নির্মল অনুভূতি আলতোভাবে দোলা দিয়ে গেল। যেন জীবনে প্রথম এমন এক অনুভূতির সাথে সে পরিচিত হলো যার হদিস এতদিন কোথায় সে পায়নি। কিছুতেই সে এ প্রগাঢ় অনুভবকে কোনো কিছুর বিনিময়ে হারিয়ে ফেলতে নারাজ।

বর্তমান

নিরা বসে বসে অতীতের স্মৃতিচারণ করছিল। নিজের জীবনের অসংখ্য খারাপ স্মৃতি থেকে কুড়িয়ে আনা এ সুন্দর মুহূর্তগুলো তাকে অবসরে শান্তি দেয়, কিন্তু স্বস্তি দেয় না। কারণ এ শান্তিটার সাথে স্বস্তির কোনো যোগাযোগ নেই। মানুষের এমন কিছু অনুভূতি আছে যা একসাথে শান্তি ও স্বস্তি দুটো দিতে পারে না। তার মধ্যে অন্যতম সুখের স্মৃতি কিংবা ভালোবাসা। মানুষ যখম ভালোবাসার মানুষের কাছাকাছি থাকে, তখন যে সুখটা তার ভেতরে বিরাজ করে তা কখনো স্বস্তি দিতে পারে না। নিরার মনে হচ্ছে অতীতের স্মৃতি তাকে অবসরে শান্তিটা দিলেও তার সাথে সাথে তা আবার ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা চিত্তে অস্বস্তি নিয়ে আসে। যা সেই শান্তিটুকুও কেড়ে নেয়।

নিরা অন্যমনস্ক হয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কারো কথায় তার সম্বিৎ ফেরে। কেউ তাকে বলছে, “হেই লিরা? হোয়াটসঅ্যাপ?”

নিরা অস্ফুটে বলল, “ইউ?”

চলবে
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here