সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ৩৩+৩৪

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#তেত্রিশ

বাসায় পৌঁছে রেহেনা বেগম সবার আগে স্বামীর রুমে গেলেন তাকে দেখতে। হাসপাতালে থাকলেও তার চিন্তা ছিল মর্জিনা ঠিকঠাক মানুষটার দেখাশোনা করতে পারছে কিনা তা নিয়ে। যদিও এত বছরে মর্জিনা এ বাড়িকে নিজের মতো করে সামলে নিয়েছে। ও আছে বলেই রক্ষে। নয়তো কী যে হত! ওহি বাবার কাছে এসে দেখল বরাবরের মতোই চোখ উপরে দিকে করে তাকিয়ে আছেন। সারাক্ষণ এভাবে থাকতে একটা মানুষের কী কষ্ট হয় না? নাকি সে অনুভূতিটুকু নেই বলেই বাবা এভাবে থাকেন। ওহি প্রায় ভাবে আর চোখের জল ফেলে। এভাবে আর কতদিন তার বাবা কষ্ট পাবেন! সবকিছুর তো শেষ আছে! এই শাস্তি কী তার জন্য যথেষ্ট নয়! সে বাবার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল,

“বাবা তুমি একদম চিন্তা করো না। দিদান এখন ভালো আছেন। খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন। জানো বাবা আজ না ভাবী এসেছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সব আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু আবার ভয় হচ্ছে যদি কিছু ঠিক না হয়। তবে তো এখন যেমন চলছে তার চেয়েও খারাপ হয়ে যাবে সব। আচ্ছা বাবা ভাবীকে কী তুমি বলতে পারবে থেকে যেতে আমাদের কাছে। আমার মনে হয় ভাবী তোমার কথা শুনবে বাবা।”

রেহেনা বেগম বিরক্তির সুরে বললেন,”কেন সবসময় বকবক করিস বল তো? তোর কী মনে হয় তোর বাবা সবকিছু শুনেন? বুঝেন?”

“কেন বুঝবে না মা। আমার বাবা সব বুঝেন। তোমাদের কথা না শুনতে পারেন, আমার কথা শুনেন। এবং আমাকে উত্তরও দেয়। বাবা একদিন বলেছিল আমি যখন ছোট ছিলাম বাবা তখন আমার আধো-আধো বুলিতে অস্পষ্ট কথাগুলো বুঝতে পারতেন। এখন আমিও বাবার না বলা সব কথা বুঝতে পারি। তুমি আর কোনোদিন বলবে না আমার বাবা কিছু শুনতে পায় না।”

ওহির বড় বড় চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। বাবাকে সে অনেক ভালোবাসে। প্রতিদিন এসে নানারকম গল্প করে। সারাদিনের ঘটে যাওয়া সব জানায়। তার ধারণা তার বাবা তার সব কথা শুনতে পান। তাই তো কেউ যদি বলে কিছু শুনতে পায় না, সে রেগে যায়। সত্যি বলতে এ পৃথিবীতে বাবা, মেয়ের সম্পর্কটা অন্যরকম হয়। ছোট বেলা থেকে এ মানুষটাকেই প্রথম তার জীবনের হিরো হিসেবে ভেবে আসে। মেয়েদের প্রথম ভালোবাসা বাবা বলেই আমার মনে হয়। বাবাকে যতটা মেয়েরা ভালোবাসতে পারে, বোধকরি আর কাউকে ততটা ভালোবাসতে পারে না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর সম্পর্ক বাবা, মেয়ের।

★★★

নিরাকে নিজের রুমে টেনে এনে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিল অর্নব। রুমে ঢুকার আগে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে জানিয়ে দিল দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেবে সে। ইমারজেন্সি না হলে যেন তাকে না ডাকা হয়। নিরা হতভম্ব হয়ে অর্নবের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্নব তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। হাতের কবজিটা জ্বলছে তার। বিড়বিড় করে বলল, “দেখতে তো এটুকুনি শুটকি হয়ে গেছে। কিন্তু গায়ে শক্তি এত বেড়ে গেল কী করে!”

“শক্তি আগেও ছিল। তখন দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি। এখন পড়েছে তাই দেখাচ্ছি। আর হ্যাঁ চুপচাপ যদি ফ্রেশ হয়ে খাবার না খাও তবে আরও অনেক কিছু দেখতে পারবে।”

নিরা ঝাঁঝিয়ে বলল,”মোটেও আমি আপনার কথা শুনব না ডক্টর। আপনি কে? আমাকে কেন আপনার কথা শুনতে হবে?”

অর্নব নিরার বসে থাকা চেয়ারটার দুই হাতলে হাত রেখে নিচু হয়ে ওর মুখোমুখি হলো। নিরা ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলে টেনে টেনে বলল, “এটা কী হচ্ছে ডক্টর?”

“তুমি বুঝতে পারছো না কি হচ্ছে?”

মাথাটা একটু পেছনে হেলিয়ে দিয়ে বলল, “না।”

“তুমি এখন খাবার খেয়ে রেস্ট নেবে। মা এলে তারপর বাসায় যাবে।”

“আমি আপনাদের বাসায় যাব না।” হুট করে বলে ফেলল নিরা।

“তো কোথায় যাবে?” ভ্রুকুচকে জিজ্ঞেস করল অর্নব।

“হোটেলে থাকব আমি।”

অর্নব নিজের রাগ সামলাতে পারল না। টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা ছুড়ে মারল ফ্লোরে। নিরা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। এ মানুষটার এতটা বদল কী করে হয়ে গেল! এত ধৈর্যশীল একটা মানুষ। এত অল্পতেই রেগে যাচ্ছে! তার চোখে জল আসলে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। অর্নব বলল, “ওয়াশরুম ওদিকে।”

নিরা চুপচাপ চলে গেল। কোনো কথা বলল না। তার মনে হচ্ছে অর্নব ঠিক নেই। কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে। শুকিয়ে এটুকুনি হয়ে গেছে মুখটা। মানসিকভাবেও এলোমেলো মনে হচ্ছে। এসব কিছুর জন্য সে নিজেই দায়ী। আটকে রাখা কান্নার দল এবার বেরিয়ে এলো। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এলো সে। অর্নব তখন খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়েছে। নিরা দেখল তার পছন্দের সব ভর্তা, ডাল, গরুর মাংসের কালাভূনা। চুপচাপ খেতে বসল। তাকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও নিল অর্নব। অনেক দিন পর পছন্দের সব খাবার পেয়ে তৃপ্তি করে খেল নিরা। লন্ডনে তো সেদ্ধ শাকসবজি, চিকেন ছাড়া তেমন কিছু খেতে পারত না। আলসেমি করে রান্না করত না বলে কিয়ারা যা খেত, তাকেও তাই খেতে হত। মনে মনে খুশি হলো মানুষটা তার সব পছন্দের খাবারের কথা মনে রেখেছে।

“শাকসবজি ছাড়া ওখানে আর কিছু খাওনি তাই?”

“সবই খেয়েছি।” ইচ্ছে করে মিথ্যাটা বললাম।

“তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

“কী দেখতে পাচ্ছেন?”

“কিছু না, খাও।”

খাবার শেষ করে কিয়ারার সাথে কথা বলছে নিরা। অর্নব সেটা বসে বসে দেখছে। নিরার সবকিছুতে আগে থেকে অনেক বেশি স্মার্ট বলে মনে হচ্ছে। কথা বলার ভঙ্গি, আগে থেকে একটু শুকিয়েছে। এতে চেহেরায় লাবন্য এতটুকু কমেনি। বরং বেশ লাগছে। কোমরের চুলগুলো কাঁধে এসেছে বলে অর্নবের একটু খারাপ লাগল। তবে চুলের এই কাটেও মেয়েটাকে দারুণ দেখাচ্ছে। নিরার কথা শেষ হলে অর্নব বলল,

“শরীর চর্চা করো তাই না?”

“হুম।”

“বাহ! এটা ভালো অভ্যাস।” আবার দুজনেই চুপ। দুজন মানুষ এক ঘরে থাকলে কথা না বললে কেমন অস্বস্তি হয়। অদ্ভুত একটা পরিবেশ তৈরি হয়। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর অর্নব বলল, “বিয়ে করোনি?”

নিরা অবাক হয়ে তাকাল। বলল,”আপনি কেন করেননি? দিয়া আপু নিশ্চয়ই এখনো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

” আমি অন্যকারো জন্য অপেক্ষা করছি বলেই বিয়ে করিনি।”

“দিয়া আপুকে এভাবে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না।”

খুব শান্ত গলায় অর্নব বলল,”আমাকে কষ্ট দেয়ার মানে হয় বলছো?”

“দুটো বিষয় যে এক না আপনি জানেন। তাও কেন এসব বলছেন?”

“আমি কিচ্ছু জানি না। জানতে চাইও না।”

“এভাবে সারাজীবন কাটানো যায় না ডক্টর।”

“সেটাই তো বলছি নিরা। এভাবে কাটানো যায় না।” অর্নব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিরার দৃষ্টি নিচের দিকে।

“এসব নিয়ে আমাদের কথা শেষ হয়ে গেছে। আমি খুব শীঘ্রই ফিরে যাব।”

অর্নব নিরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“মিস করেছো আমায়?”

“উঁহু! করিনি।” ইচ্ছে করেই পৃথিবীর বড় মিথ্যাটা বলল সে।

“আমি করেছি। প্রতিদিন করেছি। প্রতি মুহূর্তে করেছি।” অর্নবের গলা ধরে আসছিল।

“চুপ করুন ডক্টর।”

“তোমার ফোনে প্রতিদিন যে অপরিচিত নম্বর থেকে কল যেত। কথা না বলে শুধু তোমার গলা শুনে রেখে দিত সেটা আমার ছিলাম নিরা। তুমি চলে যাওয়ার পর প্রতিটি দিন কতটা যন্ত্রণায় কাটিয়েছি আমি জানি।”

“চুপ করুন না প্লিজ।”

অর্নব শুনল না। বলেই চলল, “জাগতিক সবকিছু থেকে আমি অনেকটা দূরে সরে গেছি নিরা। অল্পতেই রেগে যাই। না খেয়ে থাকলেও ক্ষিদে লাগে না। কোনো কাজে মন বসাতে পারি না। আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হয় আমি বেশিদিন বাঁচব না। যেকোনো সময় হৃদপিণ্ডটা থেমে যাবে। আর আমিও সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে যাব। তুমি ভালো থাকবে।”

হুট করেই নিরা উঠে দাঁড়িয়ে গেল অর্নবের ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে চুপ করিয়ে মাথা নেড়ে বারন করল আর কিছু না বলতে। এতক্ষণ অর্নবের কথা শুনে অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল। এখন আর পারল না। অর্নব থমকে গেল। নিরার চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল। নিরাও বাঁধা দিল না। দুজন-দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। দুজনের চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। মনে হলো মরুভূমির বালিতে বহু আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি নামল। কতদিন, কতদিন পর বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা তৃষ্ণা মিটল।
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#চৌত্রিশ

নিরা গাড়িতে বসে আছে। অর্নব নিরার হাতটা টেনে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে রাখল, নিরার হাতের উপর নিজের হাত রেখে গাড়ি স্টার্ট দিল। নিরা তার দিকে তাকাতেই ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলল,”প্লিজ যতক্ষণ আছো কিছুতেই বাধা দেবে না।”

নিরা কিছু বলল না। ভাবল কয়েকটা দিনেরই তো ব্যাপার কী হবে অত ভেবে। অর্নব গাড়িতে গান চালিয়ে দিল। নিরার খুব প্রিয় একটা গান।

When I feel you, in my heart
Then I hear your voice from your eyes
I will always love you
And I’m waiting for you until the end of time
……..
……..
And I’m wishing my dream will come true
I am lost without you
You are my everything.

নিরার ভীষণ ভালো লাগার এই গানটি। যখন সিঙ্গার ‘ইউ আর মাই এভরিথিং’ বলে তখন মনে হয় পুরো শরীরে শীতল স্রোত বয়ে যায়। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। তার উপর ভালোবাসার মানুষটা যদি পাশে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। বাসার সামনে এসে গাড়ি থামতেই নিরার থমকে গেল। সেই বাড়িতে আবার আসতে হবে কখনো ভাবেনি সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনের কথা। যেদিন দিদান তাকে ভালোবেসে বরন করে নিয়েছিলেন। একটা পরিবারহীন মেয়েকে পরিবারের ভালোবাসা দিয়েছিলেন। একটু একটু করে সব সুন্দর স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তারপর হঠাৎ করেই মনে হলো অনাথ মেয়েটাকে পরিবারহীন করার জন্য তো এই পরিবারের কেউই দায়ী ছিল। হঠাৎ করে মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। ভালো লাগা অনুভূতিগুলো ক্রমশ মেঘে ঢাকা পড়তে শুরু করে।

বাড়িতে পা রাখতেই নিরার মর্জিনা এগিয়ে এসে বলল, “ভাবী আসেন, আমি সেই কত আগে থেইক্যা আপনার লাইগ্যা বইসা আছি।”

“তুমি ভালো আছো?”

“হ, ভাবী ভালা আছি। চলে কোনোরকম। এত বিপদে ভালা থাকা যায় কন? তাও আল্লাহ কইছে যেই অবস্থায় থাইকো বলবা ভালা আছো বুঝঝেননি ভাবী?”

নিরা হেসে বলল, “বুঝেছি মর্জিনা।”

“আপনে আমার লগে আসেন ভাবী আমি আপনারে রুমে নিয়া যাই।”

অর্নব বলল,”আমি নিয়ে যাচ্ছি মর্জিনা। তুই গিয়ে আমাদের জন্য কফি করে নিয়ে আয়।”

“আইচ্ছা ভাইজান।” মর্জিনা চলে যেতেই অর্নব নিরাকে উপরে তার রুমের পাশের রুমটায় নিয়ে গেল। নিরা বলেছিল সে হোটেলে উঠবে। কিন্তু রেহেনা বেগমের অনুরোধে তাকে এ বাড়িতেই উঠতে হলো। রুমে ঢুকে নিরা খাটের উপর বসে পড়ল অনেক ক্লান্ত লাগছে তার। এতটা জার্নি করে আসা, মনের উপর দিয়েও অনেক চাপ গেছে।

অর্নব বলল, “তোমার শরীর খারাপ লাগছে তাই না?

” উঁহু! আমি ঠিক আছি।”

“সে কত ঠিক আছেন দেখছি। এখন গোসল সেরে নেন তাড়াতাড়ি।”

“এই শুনুন আপনি আপনার রুমে যান। এখানে বকবক করবেন না।”

অর্নব দুই পা গুটিয়ে বসে বলল,”আমি ভাবছি আজ এখানে ঘুমাব।”

“এখানে ঘুমাবেন মানে?” নিরা ভ্রুকুচকে বলল।

“শরিয়তমতে আমি আজও তোমার পতি। তাই আমি এখানে ঘুমাতেই পারি।”

অর্নবের কথা বলার ঢঙ দেখে নিরা বলল, “বাজে লোক একটা। বের হোন এখান থেকে।”

“ওয়াও! এই তো আগের নিরা হয়ে যাচ্ছো তুমি। বাজে, কাঠখোট্টা আরও কী যেন বলতে?”

নিরা চুপ করে রইল দেখে অর্নব বলল,”ফ্রেশ হয়ে নাও নিরা। তোমার ভয় নেই আমি এখানে ঘুমাতে আসব না। মজা করছিলাম তোমার সাথে।”

অর্নব উঠে চলে গেল। নিরার মন খারাপ হয়ে গেল। সে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। প্রকাশকের কল। দেশে আসার আগে উপন্যাসের হার্ড কপি স্যারকে মেইল করে দিয়েছিল৷ সবকিছু সে ভুলেই গিয়েছিল। এখন মনে হতেই ফোন ধরে প্রকাশকের সাথে কথা বলে নিল। উপন্যাস আজ সম্পাদক সাহেব সম্পাদনা করে রাতের মধ্যে পাঠাবে। কাল অথবা পরশুদিন প্রেসে পাঠাবে। কোনো কিছু চেঞ্জ করবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

নিরা বলল, “স্যার এন্ডিং আপনার কাছে কেমন লেগেছে?”

“বেস্ট এন্ডিং নিরা। এমনটা তো হওয়ারই ছিল। এ পৃথিবীতে সবকিছু মানুষ যেমন পায় না। আবার অনেক চাওয়া অকারণেই পূর্ণ হয়ে যায়।”

“আপনার কী মনে হয় পাঠক এটা মানবে তো?”

“অবশ্যই। বোদ্ধা পাঠকেরা সব মানে। যেকোনো এন্ডিংয়ের ক্ষেত্রে একটা কারণ থাকে। তোমার এন্ডিংয়ের জন্য এই কারণটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। এবার কেউ যদি তাতে রিয়াক্ট করে তাতে তোমার কিছু করার নেই।”

“আমিও তাই ভেবেছি স্যার। এখন আপনি ভরসা দিয়েছেন তো আমার আর কোনো চেঞ্জের দরকার নেই।”

“নিরা মা আমি তোমায় একটা কথা বলতে পারি? একজন প্রকাশক বা তোমার গুরু হিসেবে নয়। একজন বাবা হিসেবে?”

নিরা নম্রতার সাথে বলল,”স্যার এভাবে বলে লজ্জা দিবেন না। আপনি যা খুশি বলতেই পারেন তার জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই।”

“আমি জানি নিরা তুমি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। সব সিদ্ধান্ত ভেবে-চিন্তে নাও। তোমার কী মনে হয় না তোমার সামনে আসার সময় এসে পড়েছে? বাংলাদেশের সেরা লেখকদের মধ্যে তুমি একজন। তোমার এই জার্নিটা সবার জানা দরকার। তোমাকে দেখে নবীনরা উৎসাহী হবে।”

“স্যার আমি জানি আপনি আমার ভালোর জন্যই বলছেন। সত্যি বলতে আমি মানসিকভাবে এখনো প্রস্তুত হইনি। তবে আপনার কথাটা আমি ভেবে দেখব। এবং খুব শীঘ্রই জানাব। প্লিজ স্যার আমাকে একটু সময় দিন।”

“মাই ডিয়ার! আমি শুধু বললাম তোমায়। কোনো জোর নেই। আমি আসলে দেখে যেতাম আমার মেয়েটার সাফল্য দেখে মানুষ কীভাবে নেয়। কিন্তু তুমি অনেক সময় নিতে পারো। আগে ভেবে দেখো তারপর সিদ্ধান্ত জানাবে।”

“আমি কয়েকদিনের ভেতর আপনার সাথে দেখা করব। আপনি কবে ফ্রী হবেন? আমি ঢাকায় আসব।”

“আমি তো কাল চট্টগ্রাম যাচ্ছি ব্যাক্তিগত কাজে। দেখা হয়ে যাবে কী বলো?”

“তাহলে তো আরও অনেক ভালো হবে। অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা হবে। আমি অনেক খুশি স্যার।”

“আমিও মাই ডিয়ার। কাল তাহলে দেখা হচ্ছে। তখন বাকি কথা হয়ে যাবে। আজকে রাখছি।”

বিদায় নিয়ে নিরা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সে ভাবতে লাগল স্যারের দেয়া প্রস্তাবটা। তারও ইচ্ছে করে প্রকাশে আসতে। কিন্তু সে চায় না কেউ তার পরিচয় জানুক। আসলে এভাবে ছদ্মবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন আর এতকিছু ভালো লাগে না।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই নিরা দেখল অর্নব কফি নিয়ে বসে আছে। ওহি-রেহেনা বেগম হাসপাতালে দিদানের কাছে। তারা চায় এরা একান্তে কিছু সময় কাটাক। নিরা আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে বলল,”কফি ঠান্ডা হয়ে যায়নি?”

“না মর্জিনা আবার গরম করে দিয়ে গেছে।” অর্নব নিরার দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হলো বেজা চুলে কোনো মেয়েকে এতটা সুন্দর দেখায় সে জানত না তো! নাকি যাকে মানুষ ভালোবাসে তার সবকিছুই অকারণে ভালো লাগে!

দুজনে বারান্দায় গিয়ে সোফায় বসল। কফিতে চুমুক দিতেই নিরার মাথাটা হালকা হয়ে গেল। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। চাঁদনী রাত আকাশে তাঁরার মেলা। ঝিরিঝিরি বাতাসের শব্দে অলস শরীর ঘুমিয়ে পড়তে চায়।

কিছুক্ষণ পর অর্নব ডাকল, “নিরা?”

“হু?”

“তুমি রাইটার ইপ্সিতা রাহমানকে চেনো?”

নিরা থমকাল। ভয় পেয়ে গেল অর্নব কী জেনে গেল ইপ্সিতা আর কেউ নয় সে! নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল,”না চেনার কী আছে। বাংলাদেশের আলোচিত একজন রাইটার। উনাকে নিয়ে তো প্রায় দেখি চর্চা হয়।”

“জানো নিরা। মেয়েটার লেখায় কিছু কিছু ঘটনা এমনভাবে উঠে আসে যেন আমাদের জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে।”

“এমন মনে হতেই পারে। যেকোনো লেখকের কোনো না কোনো লেখায় পাঠক নিজেকে খুঁজে পায়। আর এই পাওয়াটাই লেখকের সাথে পাঠককে কানেক্ট করে।”

“তুমি বুঝলে না। আচ্ছা বাদ দাও এটা। তোমার কথা বলো কীভাবে কাটিয়েছো সেসব সময়?”

“এই তো ভালোই ছিল।”

“আচ্ছা ওহির বিয়ে ঠিক হলো কার সাথে?”

“ওর পছন্দ করা ছেলেটা। ইঞ্জিনিয়ার দুজনের সম্পর্ক আছে। আমাদের জানানোর পর দেখলাম সবকিছু ঠিক আছে তাছাড়া ও সুখে থাকবে এটাই সবচেয়ে বড় কথা, তাই রাজি হয়ে গেলাম। দিদানের অসুস্থতার জন্য, নয়তো বিয়ে হয়ে যেত।”

“যাক ভালোবাসা পূর্ণতা পাক এটা দোয়া করি।”

“শুধু অন্যের জন্য দোয়া করলে নিজের জন্য কেন করো না।”

নিরা শান্ত গলায় বলল,”কারণ আমাদের জীবনে পূর্ণতা বলে কোনো শব্দ নেই।

“কেন নেই?”

“আমার মনে হয় ভালোবাসা সাথে বিচ্ছেদ শব্দটার জন্ম হয়েছে। দুজন জমজ ভাই। একটা আসলে অন্যটা তো থাকবেই। তাই তো আমাদের ভাগ্যে বিচ্ছেদই লেখা আছে।”

“এভাবে বেঁচে থাকা যায় নিরা?” অর্নবের গলা ভারী হয়ে আসল।

“এই যে শ্বাস নিতে পারছি তো ডক্টর।”

“বেঁচে থাকা আর শ্বাস নেয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য নিরা। জিন্দালাশও শ্বাস নেয়। কিন্তু বেঁচে থাকে না।”

“আমার বিচ্ছেদ সহ্য হয় না নিরা।”

“সময় সব সইয়ে দেয়।
সময়ের চেয়ে বড় সহ্য করার মেশিন দ্বিতীয়টি নেই ডক্টর।”

“সবসময় সব সইয়ে দেয় না নিরা।”

নিরা নিজেও জানে এ কথাটি কতটা সত্যি। তাই সে চুপ করে রইল। তার নীরবতা দেখে অর্নব আবার বলল,”যখন তুমি মনে আসো। তখন ঘুম আসে না। সেকি! অসহ্য যন্ত্রণা বোঝানো যায় না। মনে হয় এর চেয়ে মৃত্যু অনেক বেশি সুখের।”

অর্নবের প্রতিটি কথা নিরার বুকে শেলের মতো বিঁধছে। সে জানে এই প্রতিটি বাক্য তার জন্যও নিযুত-কোটি গুন সত্য। তার জন্যও যে অর্নববিহীন জীবন মৃত্যু বৈ কিছু নয়।

কফির কাপটা টেবিলে রেখে নিরা হাতজোড় করে বলল, “আমায় ক্ষমা করে দিন। তার বিনিময়ে যা চান চেয়ে নিন।”

“আমি যা চাই তুমি তা দিতে পারবে না নিরা।
আমার জন্য একটা দোয়া করো শুধু। আল্লাহ যেন তোমার খেয়াল আমার মন থেকে দূর করে দেন।”

অর্নবের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে উঠে চলে গেল নিজের রুমে।

শেষ কথাটা শুনে নিরার চোখ বেয়েও জল পড়তে লাগল। কতটা যন্ত্রণা পেলে একটা মানুষ এমন কথা বলতে পারে সে জানে। সেও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। তার ক্লান্ত শরীরটা সে রাতে ঘুমাতে পারল না।সমস্ত ঘুম নিয়ে অর্নব পাশের রুমে চলে গেল। তখন অর্নবের বলা একটা কথাই সে বিড়বিড় করে বলল, “যখন তুমি মনে আসো। তখন ঘুম আসে না। সত্যি ঘুম আসে না অর্নব।”

দুটো মানুষ নির্ঘুম রাত কাটালো। পাশাপাশি থেকেও তারা রয়ে গেল যোজন-যোজন দূরে। দূরে! বহু দূরে!

চলবে

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

…………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here