সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ৩১+৩২

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#একত্রিশ

ওহিকে যখন তার মা জিজ্ঞেস করেছিল অর্নব কোথায়! তখন একটুর জন্য সবাই থমকে গিয়েছিল। নিরারও খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করবে কিন্তু করতে পারেনি। মানুষ চাইলেও সবকিছু করতে পারে না। যাকে ছেড়ে চলে গেছে তার জন্য উদ্ধিগ্ন হলে লোকে তাচ্ছিল্য করবে বৈ কি। তাই তো মনের সমস্ত ইচ্ছাকে থামিয়ে রেখে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় মায়ান বলল, “রক্ত দেয়া শেষ হয়েছে। এক ঘণ্টা রেস্ট নিতে বলেছি। ও তো শুনতেই চাইছিল না। তাও অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রেখে এসেছি।”

নিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মায়ানের দিকে হাসার চেষ্টা করে বলল, “কেমন আছেন মায়ান ভাইয়া?”

“আলহামদুলিল্লাহ! তুমি ভালো আছো নিরা?”

“জি ভালো।”

দিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “কেমন আছো আপু?”

“ভালো আছি। আসো তো তোমায় একবার ছু্ঁয়ে দেখি। এটা আসলেই নিরা নাকি ভূত!”

নিরা এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল, “ডক্টররা ভূতে বিশ্বাস করে জানতাম না তো!”

দিয়া হাসল। নিরা জিজ্ঞেস করল, “দিদানের জ্ঞান কখন ফিরবে?”

“এক ঘণ্টাও ফিরতে পারে। আবার আটচল্লিশ ঘণ্টাও লাগতে পারে। ব্রেইন স্ট্রোক করছে। ভেতর থেকে ফাইট করার ইচ্ছে খুব কম। তাই কিছুই বলা যাচ্ছে না। আই এম স্যরি টু সে। এখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।”

নিরা দপ করে বসে গেল সামনে থাকা বেঞ্চে। শেষ বয়সে এসে মানুষটা শুধু কষ্টই পেয়ে গেল। নিজেকে এর জন্য কিছুটা দায়ী করছে সে। তার শাশুড়ি রেহেনা বেগম এসে পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “এতে তোর কোনো দোষ নেই মা। একটা সময় আমাদের সবাইকে যেতে হবে। আমরা ক্ষুদ্র মানুষ শুধু দোয়াই করতে পারি। মা ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তুই এসে গেছিস এবার সব ভালো হবে।”

নিরা অবাক হলো। তারমানে এরা ভাবছে সে একেবারের জন্য চলে এসেছে! কিন্তু এটা তো সত্যি নয়। সে কখনোই এখানে থাকতে পারে না। নিরা মায়ের কাঁধে মাথা রাখল এমন সময় পাশের গলি থেকে একটা গলার আওয়াজ পেল। মুহূর্তেই দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। হৃদপিণ্ডের গতি ক্রমশ বাড়তে লাগল৷ কেঁপে উঠল সে। সেই চেনা গলা। যেন হাজার বছর পর শুনতে পেয়েছে। চেয়েও কিছুতেই মুখ তুলতে পারল না। কাত হয়ে মায়ের কাঁধে পড়ে রইল।

অর্নব হাত দিকের তাকিয়ে আসছে এদিকে। মায়ানকে বলছে, “দিদানের কী অবস্থা এখন? দেখা করা যাবে?”

উপস্থিত সবাই চুপ। পুরো করিডরে নীরবতা বিরাজ করছে। অর্নব উত্তর না পেয়ে তাকাল মায়ানের দিকে। সবার দৃষ্টি তার দিকে। নিরার দিকে খেয়াল না করেই মায়ানকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “কিরে খারাপ কিছু হয়ে যায়নি তো কথা বলছিস না কেন?” ক্রমশ তার গলা চড়ে যাচ্ছে।

মায়ান কিছু না বলে নিশ্চুপ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। অর্নবও তার চোখের দিকে তাকাল। ভ্রু কুচকে বলল, “কিছু তো বল?”

মায়ান ইশারায় নিরাকে দেখাল। অর্নব বিরক্ত গলায় সেদিকে তাকিয়ে বলল, “ওদিকে কী দেখাস?”
একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিতেই ধীরে ধীরে আবার তাকাল। দেখল তার মায়ের কাঁধে কেউ একজন ভর দিয়ে আছে। কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলো মুখের উপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। কোমরের চুলগুলো কাঁধে উঠে আসলেও একটুও চিনতে ভুল হলো না। দু’হাতে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। এক মুহূর্ত লাগল না মানুষটাকে চিনতে। উপরের দিকে এগিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে সবকিছু মিথ্যা। প্রতিদিনের মতোই স্বপ্ন। আবার তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তাকালেই বুঝি হারিয়ে যাবে। দিয়া বলল, “তুই যা দেখছিস আমিও তাই দেখছি অর্নব।”

অর্নব আস্বস্ত হয়ে আবার তাকাল। নিরা আগের মতোই রয়েছে। রেহেনা বেগম তার মুখটা ধরে চুলগুলো সরিয়ে বললেন, “অনেকটা জার্নি করে এসেছিস। অর্নবও রক্ত দিয়েছে। তুই ওর সাথে বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আয়। তোরা এলে আমরা যাব।”

নিরা শাশুড়ির উদ্দেশ্য বুঝতে পারল৷ সে বলল, “না মা দিদানের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আমি এখানে বসে থাকব।”

ওহি বলল, “এতটা পথ এসেছো। আমি নিশ্চিত কাল রাত থেকে তুমি ঘুমাওনি। এখন যদি তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো তবে আমাদের চিন্তা আরও বেড়ে যাবে ভাবী।”

ওহির গালে হাত রেখে নিরা বলল, “কিচ্ছু হবে না আমার ওহি। তোমার আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি এতটা দূর্বল।”

আর কেউ কিচ্ছু বলতে পারল না। অর্নবের পুরো শরীর কাঁপছে হঠাৎ মনে হলো মাথা ঝিমঝিম করছে। ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে লাগলেই মায়ান ধরে ফেলে নিরার মুখোমুখি থাকা বেঞ্চে বসিয়ে দেয়।

“ঠিকমতো না খেয়ে থাকলে এমন তো হবেই। কে শুনে কার কথা। আমার হয়েছে যত জ্বালা। এখন সবাই অসুস্থ হয়ে যা আমি শুধু সুস্থ থাকি।” বলতে বলতেই কাঁদতে লাগলেন রেহেনা বেগম। অর্নব বেঞ্চের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, “প্লিজ মা কেঁদো না। আমি ঠিক আছি। এটুকুতে কিছু হয় না।”

আসলে সে তো জানে তার শরীর ক্রমশ দূর্বল হয়ে কেন আসছে। উপোস থেকে যে শরীরকে কাবু করতে পারেনি৷ নিরার দিকে একবার তাকানোতেই এতটা দূর্বল লাগছে! এই এত বছরেও নিরার প্রতি এতটুকু অনুভূতি কমেনি। বরং নিজের সবথেকে দূর্বল জায়গা মনে হচ্ছে এ মেয়েকে। একবারও তাকিয়েই ইচ্ছে করছে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখতে। কয়েকটি থাপ্পড় দিয়ে বলতে, “এতদিন কেন আসোনি?”

নিরা চুপচাপ বসে আছে। দিয়াকে বলল, “আমি কী দিদানকে একবার দেখতে পারি?”

দিয়া জানাল বাইরে থেকে দেখতে পাবে। ভেতর থেকে না। অর্নব এত কাছ থেকে গলার স্বরটা শুনতে পেয়ে এত চিন্তার মাঝেও একটুখানি স্বস্তি পেল৷ নিরা উঠে দাঁড়াল। দিয়াকে অনুসরণ করে চলে গেল।

ওহি তার মাকে নিয়ে গেল দিয়ার কেবিনে। উনার এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। উনারা চলে যেতেই মায়ান এসে অর্নবের পাশে বসল। বলল, “স্মার্ট ডক্টর অর্নব যে কাউকে দেখে এতটা নার্ভাস হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি!”

“তোকে কে বলেছে বুঝতে! আমি কাউকে দেখে নার্ভাস হইনি। শরীর একটু খারাপ তাই এমন হয়েছে।”

“জীবনে এই একটি জায়াগায় তুই নিজেকে লুকাতে পারিস না অর্নব। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।”

“কিচ্ছু ঠিক হবে না মায়ান। তুই নিরাকে চিনিস না।”

“হয়তো নিরাও নিজেকে চেনে না। জীবনের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে এসে মানুষের মন পাল্টায়। তুই এবার আর ওঁকে ভালো মানুষি দেখিয়ে যেতে দিস না।”

“ও চলে যাবেই। আচ্ছা এসব বাদ দে। ভালো লাগছে না।” অর্নব স্মিত গলায় বলল।

নিরা বাইরে থেকে দেখছে দিদানের শরীরে নানা রকম যন্ত্র লাগানো। মুখটা দেখে চেনাই যাচ্ছে না। শুকিয়ে এটুকুনি হয়ে গেছে। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। এ মানুষটার অনেক ভালোবাসা সে পেয়েছে। পরিবারের স্বাদ পেয়েছে শুধু মাত্র তার জন্য। জীবনের এ পর্যায় এসে মনে হচ্ছে এ পৃথিবীর সব মিথ্যে। শুধু মাত্র মৃত্যুই একমাত্র সত্যি। বাকিসব দুরাশা।

★★★

অর্নব বসে রইল চুপচাপ। শুধু মনে হচ্ছে নিরা কেন এসেছে। এবার চলে গেলে যে সে বাঁচতে পারবে না। নিজেকে তো বুঝিয়ে নিয়েছিল সে। সবকিছু এলোমেলো কেন হচ্ছে। জীবনের এ খেলা আর ভালো লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে নিরাকে ফেইস করবে কীভাবে। নিরার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না। কিছুতেই না।
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#বত্রিশ

“আমাদের জীবনে কিছু কিছু মানুষ ক্ষণিকের জন্য আসে, আবার হারিয়ে যায়। ঠিক যেমন ‘সন্ধ্যা তারা’। সন্ধ্যার আকাশে অল্পকিছু সময়ের জন্য সন্ধ্যা তারা উদিত হয়। আবার মিলিয়ে যায়। নিরাও আমার জীবনে তেমন দিয়া। আমি ওকে ভালোবেসেছি। ডাক্তারি পড়তে পড়তে কখনো আমার এসব দিকে মনই যায়নি। অথচ সেই আমি নিরাকে একবার দেখা মাত্রই ভালোবেসে ফেলি। কত স্বপ্ন দেখেছি তাকে নিয়ে সেটা আর নাই বা বলি।” কথাটা বলে মায়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দিয়া তার কেবিনে তার সামনের চেয়ারটায় বসে আছে।

দিয়া বলল, “আমি তো তোকে অনেক বেশি সিরিয়াস দেখেছিলাম নিরার ব্যাপারে। ভেবেছিলাম তুই ওকে তোর করেই নিবিই। কিন্তু হঠাৎ করে তোর পাল্টে যাওয়া আমার ভেতরটাও পাল্টে দিল। ভাবলাম তুই যদি তোর ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারিস আমি কেন পারব না।”

মায়ান দিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই জানিস যেদিন আমি অর্নবকে নিরাকে ভালোবাসার কথা জানালাম। সেদিন অর্নব একটুও রাগ না করে বলেছিল। নিরাকে সে তার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তবে সে জানে না নিরা কাকে ভালোবাসে। যদি কখনো প্রমাণ হয় নিরা আমাকে ভালোবাসে তবে অর্নব তার জীবন থেকে সরে দাঁড়াবে। একবার ভেবে দেখেছিস কতটা ভালোবাসলে নিজের বিয়ে করা বউকে তারই সুখের জন্য ছাড়া যায়! অর্নবের কাছ থেকে এসে সে-রাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি। শুধু মনে হয়েছে কাউকে পাওয়াটাকে নিশ্চয়ই সত্যিকারের ভালোবাসা বলে না। ত্যাগ করাতেই সব ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।”

মায়ান একটু থেমে আবার বলল, “যেখানে নিরা ভালো থাকবে। সেখানেই তাকে থাকতে দেয়াটা ভালোবাসার প্রমাণ। যেমনটা অর্নব করেছে। ওরা দুজন-দুজনকে এতটা চায়, তাও দুজনেই নিজেদের মতামতকে সম্মান করেছে। আমি জানি কাউকে ভালোবেসে কাছে না পাওয়াটা কতটা যন্ত্রণার। অথচ তাদের দুজনের হাতেই পরস্পরকে ধরে রাখার ক্ষমতা থাকলেও, কেউই জোর করে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি। একটা সম্পর্কে ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সম্মান করাটা। মেয়েরা ভালোবাসা ছাড়া নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেও যেখানে সম্মান নেই সেখানে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। অর্নব আমাকে এই গভীর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে। তাই তো আমিও নিরাকে তার গতিতে ছেড়ে দিয়েছি। আজকে ওদের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? আজও কতটা সম্মান করে একে-অপরকে। আমি জানি না প্রকৃতি কী চায়! কেনই বা দিনশেষে সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর পরিণতি এতটা ট্রাজেডি হয়। আমি হয়তো অর্নব নিরার জন্য কিছুই করতে পারব না। কিন্তু বিশ্বাস কর দিয়া। আমার মোনাজাতে ওদের জন্য সবসময় দোয়া থাকে। ওদের ভালোবাসা যেন শেক্সপিয়রের ট্রাজেডি না হয়।”

দিয়া অবাক হয়ে মায়ানের কথাগুলো শুনছিল। বলল, “নিরা, অর্নবের বিশুদ্ধ সম্পর্কের সংস্পর্শে এসে আমাদের ভেতরটা কেমন পবিত্র হয়ে উঠেছে। জানিস আমিও চাই ওরা এক হয়ে যাক। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শেষ
হোক।”

মায়ান বলল, “তা তুই কেন বিয়ে করছিস না বল তো?”

“অর্নবের মতো কাউকে পেলে জানাস। তক্ষুনি বিয়ে করে নেব।”

মায়ান ম্লান হাসল। দিয়া উঠে চলে গেল দিদানকে দেখতে।

★★★

দিদানের জ্ঞান ফিরেছে শুনে নিরা করিডর থেকে দৌঁড়ে গেল। তার পিছু পিছু বাকিরাও গেল। নিরা দিদানের বেডের সাথে রাখা চেয়ারটায় বসে তার হাতটা ধরল। দিদান একটু একটু করে চোখ খুলে তার দিকে তাকালেন। নিরাকে দেখে একটুও অবাক হলেন না। যেন তিনি জানতেন নিরা আসবেই। নিরা দেখল আগের সেই দিদানের মধ্যে, আর আজকের মানুষটার মধ্যে অনেক তফাৎ। যেন বিশ বছর পর তাকে দেখছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন। তিনি হাসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে হাসিটা বড্ড ম্লান দেখাল। তিনি বললেন, “আমি জানতাম তুই আসবি। তোকে আসতেই হতো।” কথাগুলো ভেঙে ভেঙে বলছিলেন তিনি। কথা বলতে যে কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে কারোই অসুবিধা হচ্ছে না।

নিরা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল,”দিদান আমি এসেছি আর আপনি এভাবে শুয়ে থাকবেন! তা হবে না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন তো কত কথা জমা হয়ে আছে জানেন? এই বছরগুলোতে আপনাকে কতটা মিস করেছি জানেন?”

অর্নব দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। নিরার ডানে ওহি, বামে রেহেনা বেগম। মায়ান, দিয়া পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দিদান বললেন, “তুই এসে গেছিস আমি ভালো হয়ে যাব।”

উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।সবার মনে হয়তো একটাই চিন্তা সব ঠিক হয়ে যাক। আসলেই কী সব ঠিক হয়ে যায়!

দিদান রেহেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কাঁদছো কেন বউ মা? আমার কিচ্ছু হবে না। তোমাদের রেখে যাব না।”
তার কথা শুনে রেহেনা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ওহিরও চোখ বেয়ে জল পড়ছে।

দিদান বললেন, “আমার দাদু ভাই কোথায়?”

অর্নব নিরার পাশে এসে দাঁড়াল। ওহি সরে গিয়ে তাকে জায়গা দিল। দিদান হাসলেন। বললেন,”কী ভয় পাইয়ে দিলাম?”

অর্নব বলল, “এত কথা বলা শরীরে জন্য ভালো না। তুমি এখন চুপ করো। পরে সব কথা বলো।”

“ডাক্তাররা সবসময় এমন হয় কেন বল তো?” দিদান নিরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

“এখন সত্যি অনেক বিশ্রামের প্রয়োজন আপনার দিদান। চুপ করে শুয়ে থাকুন তো।”

অর্নব বলল, “সবাইকে বেরিয়ে আসতে।”

সবাই বেরিয়ে এলো। করিডরে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্নব বলল, “ওহি তোরা বাসায় চলে যা। দিদান এখন বেটার আছেন। তোদের এখন ফ্রেশ হয়ে আসা দরকার। তোরা এলে আমি যাব।”

রেহেনা বেগম বললেন, “নিরা তুইও চল মা। এতটা পথ এসেছিস। ফ্রেশ হয়ে আসিস।”

“না মা তুমি যাও। আমি থাকব দিদানের কাছে। তোমরা এলে না হয় আমি যাব। প্লিজ মা জোর করো না।”

রেহেনা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ওহি বলল, “ভাবী থাক মা। একজন মেয়ে থাকা দরকার আমরা এলেই না হয় সে যাবে।”

রেহেনা বেগম মেয়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তাই আর কথা বাড়ালেন না। নিরার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “আমরা আসি তাহলে?”

তারা চলে গেলে নিরা বেঞ্চে গিয়ে বসল। মায়ান, দিয়াও চলে গেল। অর্নব দাঁড়িয়ে রইল অপ্রস্তুত হয়ে। নিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “সবার সাথে কথা বললে আমার সাথে বললে না তো?”

নিরা মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “মনে হচ্ছে আমার সাথে কেউ কথা বলেছে। এমন ভাব!”

“এতদিন পর এসেও এভাবে ঝাঁঝিয়ে কথা বলছে! মানুষ এতটা অমানবিক কী করে হতে পারে।” অর্নবের কপাল কুঞ্চিত হলো।

“হু শুধু আমারই দোষ। নিজে তো ধোয়া তুলসীপাতা।”

পাশে দিয়ে অন্য ডাক্তার যাওয়ার সময় তাদের কথোপকথন শুনে দাঁড়িয়ে বলল, “এই যে ম্যাডাম আমাদের হাসপাতালে ডাক্তার অর্নবের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে না। বুঝলেন?”

অর্নব ভদ্রলোকের কাঁধে হাত রেখে বলল,”উনি আমাকে আরও অনেক নামে ডাকত। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ‘কাঠখোট্টা ডক্টর।”

ভদ্রলোক বললেন,”বাহ! সাহস আছে বলতে হবে। আমার তাহলে এখানে থাকা ঠিক হবে না।”

চলে যেতে নিলেই আবার পেছনে এসে অর্নবকে বললেন, “ঝগড়াটা আপনার রুমে গিয়ে করেন। নয়তো আশেপাশের সবাই যেভাবে তাকিয়ে আছে।”

অর্নব হাসল। নিরা এসেছে পর্যন্ত এই প্রথম তার হাসি দেখল। সুখে মনটা ভরে গেল। কতদিন পর সেই হাসিটা দেখছে সে।

নিরা বলল, “উনি কী বললেন?”

“তোমার না জানলেও চলবে।”

নিরা চুপ করে বসে রইল। অর্নব বলল, “চলো আমার রুমে। আমি খাবার অর্ডার করেছি। এখনই এসে যাবে। তুমি হাতমুখ ধুয়ে নেবে।”

“আমি এখানেই ঠিক আছি ডক্টর।”

অর্নব এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। যেন একটা হার্টবিট মিস করল। কতদিন পর সেই ডাকটা শুনতে পেল। বুকের একোণ-সেকোণে গুচ্ছ গুচ্ছ সুখে ভরে গেল। মনে হলো অনেকদিন এমন সুখের দেখা পায়নি সে।

তারপর বলল, “চলো নিরা?”

“আমি যাব না। আমার ক্ষিদে নেই।”

অর্নব কিছু না বলে নিরার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল, “আমি আগের মতো ভদ্র ডক্টর নই যে তোমার সব কথা শুনব। আমি যা বলব তাই শুনবে তুমি।”

নিরা অবাক হয়ে গেল। অর্নব তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের অনেকেই কৌতূহল নিয়ে সেটা দেখছে। নার্সরা একসাথে দাঁড়িয়ে নানা কথা বলা শুরু করেছে।

মায়ান, দিয়া আড়ালে থেকে এতক্ষণ তাদের দেখছিল। নার্সদের ভিড়ে কাছে গিয়ে বলল, “মেয়েটা অর্নবের বউ। এভাবে দেখার কিছু নেই। সবাই নিজের কাজে যাও।”

ধীরে ধীরে সবাই চলে গেল। মায়ানের দিকে তাকিয়ে দিয়া হাই ফাইভ দিয়ে হাসল। অনেক দিন পর মানুষটার স্পর্শ পেয়ে নিরার বুকের ভেতর তীর তীর করে বয়ে যাচ্ছে স্রোতস্বীনি নদী। সে নদীর উত্তাল ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে বহুদূর।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here