সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ১৬+১৭

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#ষোলো

রাতের আঁধার কেটে সোনালী আভায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবী। জানালা গেলে রোদের ঝিলিক মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় অর্নবের। ঘুম ভাঙলে আজও সেই সব দিনগুলোর মতো পাশ ফিরে প্রথমে নিরাকেই দেখতে চায়। যখনই তার পাশের বালিশটা খালি পড়ে আছে দেখে, তখনই তার ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। চোখের মুখে স্পষ্ট ব্যাথার রেখা ফুটে উঠে। বুকের ভেতর বয়ে চলে সমুদ্রের জোয়ার। যা শুধু কেড়ে নিতে জানে, কাউকে কিছু দিতে জানে না।
দু’বছর পার হয়ে যাবার পরও আজও তার মনে হয় কোনো এক সকালে ঘুম থেকে উঠে সে দেখবে তার পাশে গুটিশুটি হয়ে আদুরে একটা মেয়ে ঘুমাচ্ছে। তার ফর্সা নরম আদুরে গালে রোদের ঝিলিক খেলা করেছে তা দেখে দিন শুরু করতে তার ভীষণ ভালো লাগত। মনে হতো একটা সুখ, সুখ অনুভূতি তার সারাটাদিন হেসে খেলে কাটিয়ে দেয়ার শক্তি দিত। আজও ঠিক সকাল হয়। নিয়ম অনুযায়ী সে পাশ ফিরেও দেখে কিন্তু এখন আর তার নিজের মানুষটাকে দেখতে পায় না। শুধু মনে হয় তার ভেতরটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। নিশ্বাসের গতি কমে আসছে। সে জানে হয়তো এভাবেই একদিন তাকে মরে যেতে হবে।

ফ্রেশ হয়ে অর্নব হাসপাতালে চলে যায়। নিরা যাওয়ার পর থেকে খুব একটা বাসায় নাস্তা করে না। প্রথম প্রথম দিদান জোর করে একটু – আধটু খাইয়ে দিত। নিরা চলে যাওয়ার পর দিদানও ধীরে ধীরে বিছানায় পড়ে গেলেন। শরীরের যন্ত্রগুলো দিনদিন অকেজো হয়ে ধরা দিচ্ছে। আজকাল উনার নিজের খাবারেই অনিহা। বিছানায় শুয়েও অর্নবের জন্য চিন্তা করেন। প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছেন আবার তাকে বিয়ে দিতে। নিরাকে ছাড়া যে উনার নাতি ভালো থাকবে না। তা তিনি ভালো করেই জানতেন।তারপরও মনে মনে ভাবতেন নিরা ফিরে আসুক। নিরার মতো ভালো বউ আর পাবে না অর্নব। কিন্তু সময় চলে গেছে নিরার ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং যে ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল আজকাল সেটুকুর পথও বন্ধ হয়ে গেছে।

অর্নবের মা ছেলের চিন্তায় দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। নিরার চলে যাওয়ায় তার কষ্টও কম হয়নি। তিনি ভাবেন মেয়েটার মাঝে অদ্ভুত এক শক্তি আছে। যার দ্বারা মানুষকে মায়ার বাঁধনে খুব সহজেই বেঁধে ফেলে। কিন্তু আমরা না চাইলেও তো অনেক কিছুই ঘটে যায়

★★★

কিয়ারার সাথে বসে আছে নিরা আরেক মগ কফিতে চুমুক দিচ্ছে। কিয়ারা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “লিরা তোমার কী মন খারাপ?”

নিরা হেসে বলল, “একটুখানি কিয়া। কিন্তু তুমি এত তাড়াতাড়ি আসবে বলোনি তো?”
কিয়ারা নিরার রুমমেট। তারা একসাথে থাকে। গতমাসে কিয়ারার বাবা মারা যাওয়ায় সে মায়ের কাছে দু’মাস থাকবে বলে গিয়েছিল। কিন্তু মাস গড়াতেই সে যে চলে আসবে এটা জানত না নিরা। কিয়ারাকে ভালোবেসে নিরা কিয়া বলে ডাকে। কিয়ারা নিরা শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে না। তাই তাকে লিরা বলেই ডাকে।

নিরার প্রশ্ন শুনে কিয়ারা হাসল। বলল, “আমি ভেবেছি তুমি একা আছো। তাই চলে এলাম। তাছাড়া আমার মা এখন ভালো আছেন। তাই দেরি না করে চলে এলাম।”

টেবিলের উপর রাখা কিয়ারার হাতের উপর হাত রেখে নিরা বলল, “তুমি অনেক ভালো কিয়া। এখানে তুমি আমার যেমন খেয়াল রাখো, আর কেউ হয়তো পারবে না।” কিয়ারা হেসে তার ফোনে একটা গান চালু করল। গানটা খুব জনপ্রিয়। ‘ইউ আর মাই এভরিথিং!”

আচমকা গানটার মুখরাটা কানে যেতেই নিরার মনে বিষন্নতার বৃষ্টি নামল। ফিরে গেল সেই সোনালী অতীতে। এক টুকরো স্নিগ্ধ স্মৃতিতে।

সেদিন হোটেলে এক দম্পতি তাদের দাওয়াত দেয়ার পর তারা সেখানে গিয়েছিল। নিরার পরনে নীল সুতি শাড়ি ছিল। শাড়ির উপর লং জ্যাকেট। নিরাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল। দুজনে পাশাপাশি হেঁটে যখন সেখানে পৌঁছাল। তখনই সাথে সাথে সবাই তাদের স্বাগত জানাল। মোস্ট বিউটিফুল কাপল হিসেবে তারা সেদিন অনেক নাম আখ্যা দিল। শীতের রাতে কাঠ জ্বালিয়ে সে কাঠের চারপাশে গোল হয়ে সব কাপল বসেছিল। পাশে ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘ইউ আর মাই এভরিথিং’ গানটা চলছিল। সে গানের সাথে সবাই ঠোঁট মেলাচ্ছিল। শুধু নিরার ভেতরে অস্বস্তি কাজ করছিল। এ গানের প্রতিটি লিরিকের সাথে সাথে তার ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠেছিল।

তার খুব মন চাচ্ছিল এমন একটা গানের প্রতিটি শব্দে কাউকে খুঁজুক। কাউকে ভেবে হৃদয় রোমাঞ্চিত হোক। এবং সেদিনই প্রথম সে নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছিল। চোখ বন্ধ করে যখন সে কাউকে অনুভব করতে চাইল তখন একটা ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। যখনই সে ছবিটি দেখল। তখনই চোখ খুলে পাশে বসা মানুষটির দিকে ভালো করে তাকাল। একে একে সব মিলিয়ে দেখল। এবং বুঝল তার মানসলোকের চিত্রটির সাথে তার পাশে বসে থাকা মানুষটির হুবহু মিল। সেই তীক্ষ্ণ নাক, গাঢ় চোখ, অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। সেদিন সে বুঝেছিল তার মনের কোণে অর্নবের জন্য ভালোবাসা জায়গা করে নিয়েছে। তাও সে বিশ্বাস করতে চাইল না। সে জানে কিছুদিন পর তাকে চলে যেতে হবে। যেখানে মায়া করে লাভ হয় না। সেখানে মায়া কাটাতে শিখতে হয়। সেও তাই মনের এই পাগলামিকে পাত্তা দিল না। ক্ষণিকের ভালো লাগা বলে নিজেকে মানাতে চাইল।

গানটা চলাকালীন দুজনের বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হয়ে গেল। দুজনের চোখে কুণ্ঠা, মনে অস্বস্তি। চেয়েও কেউই স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছিল না। জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন খুব স্মার্ট মানুষকেও বোকা মনে হয়। তাদেরও তেমনটাই মনে হচ্ছিল। হয়তো নিজেদের মনের দ্বিধাকে সরাতে পারছিল না। কিংবা দুজনেই ভাবছিল মুখ খুললেই হয়তো দুজন দুজনের কাছে ধরা পড়ে যাবে। এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। গান থামার পর একটু স্বাভাবিক হলো। গান শেষ হলে সেখানে একটা খেলার আয়োজন করা হলো। খেলাটা এরকম যে একটা ঝুড়িতে কতগুলো কাগজ ভাঁজ করা থাকবে। সব দম্পতি এক টুকরো কাগজ উঠিয়ে নেবে। এবং সে কাগজে যা লেখা থাকবে তাদের তাই করতে হবে।

অর্নব নিরা কিছুটা ঘাবড়ে গেল এটা শুনে। কাগজে কী না কী লেখা থাকে দুজনে – দুজনের দিকে তাকাতেই মনের ভাষা বুঝে গেল। তারা এ খেলার হোস্ট হবে বলে কাটাতে চাইল। কিন্তু নীল-তাঁরা দম্পতি তা শুনলো না। আজ যাদের বিবাহ বার্ষিকী তাদের নাম নীল- তাঁরা। অগত্যা নিরাদের খেলতেই হলো। একে – একে মোট নয় দম্পতি তাদের লটারিতে উঠা কাজ সম্পন্ন করল। সবার শেষে নিরাদের পালা এলো। ভয়ে ভয়ে কাগজ উঠিয়ে সেটা খুলে দুজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। নিরা ঠোঁট খিচিয়ে মাথা দোলাল। কিন্তু তাঁরা এসে খপ করে নিরার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে সিটি বাজিয়ে বলল, “লেটস স্টার্ট মোস্ট বিউটিফুল কাপল!”

নিরা অর্নবের দিকে বোকার মতোন চেয়ে আছে। এ মুহূর্তে তার মাথায় একটা কথাই আসছে ‘নো ওয়ে।’ কিন্তু সে কথাটা মুখে আনতে পারল না। নীল যখন কাগজটি জোরে পড়ে শোনালো সবাই শিস দিয়ে তাড়াতাড়ি করতে বলল। অর্নব নিরার এ মুহূর্তে এদের ডিমান্ড পূরণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এখন যদি তারা তা না করে তবে সবাই ভাববে এরা বিবাহিত না। এবং অবিবাহিত হওয়ার পরও দুজন একটা হোটেলে রাত কাটাচ্ছে। এতে বরং ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই অর্নব ধীরে ধীরে নিরার দিকে এগিয়ে আসল। নিরা তখন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে তাকিয়ে রইল অর্নবের পথের দিকে। উৎসুক জনতার দৃষ্টি তাদের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে নিরার সামনে এসে দাঁড়াল। নিরার চোখে মুখে আতঙ্ক। সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় অর্নব তার অধরে গাঢ় চুমু খেল। নিরা নিজের অজান্তেই চোখ বুজঁল। আশেপাশে তখন করতালির শব্দ, অথচ এর কিছুই কানে তাদের যাচ্ছে না। অর্নব যখন নিরাকে ছাড়ল তখন নিরার মস্তিষ্ক শূন্য, মুখে রক্ত জমাট বেঁধেছে। চোখে বিস্ময়! অর্নবের মুখও তখন আরক্ত। সে নিজের জানে না এমন একটা কাজ কেন করল। এ মুহূর্তে ভুল ঠিক কিছুই তার মাথায় নেই। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিম স্রোত তখনও বেয়ে নামছে। শুধু মনে হচ্ছে সে কোনো অলীক জগতে আছে। বাতাসে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ তখনও উড়ে বেড়াচ্ছিল। সেটা কী নিরার শরীরের ঘ্রাণ! তা ভেবেই তার ভেতরটা রোমাঞ্চিত হলো। সে জানে না কেন তার মধ্যে তখন কোনো খারাপ লাগা কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল চারপাশে বসন্ত নেমেছে। সুক্ষ্ম অথচ তীব্র একফাঁলি প্রগাঢ় অনুভব তার হৃদ মাঝারে বয়ে যাচ্ছিলো। এমন সুন্দর, সুখী অনুভূতি জীবনের প্রথম সে পেল। চারদিকে মানুষের ঠাট্টায় যখন তার সম্বিৎ ফেরে, তখন দেখল নিরা তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিরা হনহনিয়ে রুমে চলে গেল। তখনই একটা ভয় তার ভেতরে রক্ত জমাট করল। নিরা তাকে কী খারাপ ছেলে ভাবছে!

নীল তখন তার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “ভাবী বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। তাই রুমে চলে গেল। আসলে বাংলাদেশের মেয়েদের লজ্জা আসলে একটু বেশি। তবে আপনাদের পারফর্মেন্স ভালো ছিল। এই যে দেখুন আমি ছবি তুলে রেখেছি। আপনাকে পাঠিয়ে ডিলিট করে দেব। ভাবলাম এমন একটা মুহূর্ত আপনাদের নিশ্চয়ই সারাজীবন মনে থাকবে।”

অর্নব তার ফোন থেকে ছবিগুলো নিল। এবং নীল তার সামনেই ছবিগুলো ডিলিট করল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে যখন রুমের দিকে পা বাড়াল তখন তার ভয় করছে। নিরাকে কীভাবে ফেইস করবে সেটা ভেবে বুক হিম হয়ে আসছিল। নিরা যদি তাকে বাজে ছেলে ভেবে অপমান করে তবে সে কীভাবে তার সামনে যাবে। নানা ভাবনায় সে যখন রুমে আসল তখন দেখল নিরা কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। শুধু একটা চোখ দেখা যাচ্ছে। সে চোখের কোণে জলের দাগ স্পষ্ট। তারমানে নিরা কাঁদছে! তার জন্য নিরা কাঁদছে এটা ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।

নিরাকে অনেকবার ডাকতে চেয়েও অর্নব পারেনি। তার ভয় হচ্ছিল যদি নিরা তাকে যা তা বলে অপমান করে! তবে সে সইতে পারবে না। সে রাত অর্নব বারান্দায় কাটিয়েছে। কয়েকবার নিরাকে দেখে গেছে। কিন্তু তার পাশে ঘুমানোর সাহস পায়নি। সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে তখন দেখে নিরা তার সামনে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে সে বলল, “তুমি?”

“হ্যাঁ আমি। এ ঘরে কী আমি ছাড়া আর কেউ থাকার কথা ছিল?” নিরা ভ্রুকুচকাল।

অর্নব উঠে বসে বলল, “না তা নয়। কিন্তু চা কোথায় পেলে?”

“হোটেলের বয় এসে দিয়ে গেছে। এই নিন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

অর্নব চা নিল। নিরাকে বেশ সহজ দেখাচ্ছে। রাতের বিষয়ে যেন কিছুই তার মনে নেই এমন ভাব দেখাচ্ছে। অথচ সে ভেবেছিল নিরা তাকে ছোট বড় কথা শোনাবে। কিন্তু এমন কিছু হলো না দেখে অবাক হয়েছিল। মনে মনে অবশ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

আজ যখন কিয়ারা সেই গানটা বাজাল নিরার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেছে। সেদিন সেই অনুভূতি তার পাত্তা না পেলেও কিংবা ঝাপসা থাকলেও আজ সবকিছু স্পষ্ট। বরং স্বচ্ছ জলের মতো স্পষ্ট। আজকে তার সেই অনুভূতি এতটাই ফুলেফেঁপে উঠেছে যে আজ তার পাত্তা দেয়া, না দেয়া কিছু আসে, যায় না। তার মনে অর্নব এতটাই গেড়ে বসেছে যে ঘুম থেকে উঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত তার মনে থাকে। এমনকি ঘুমের ঘোরেও এ মানুষটাকে খুঁজে ফেরে সে। তাতে অবশ্য লাভ বিশেষ কিছুই হয় না। শুধু এক আকাশ শূন্যতাই পায়। এমন উন্নত দেশে থেকেও তার মন শুধু সে গত হওয়া সময়গুলোকে পেতে চায়। সেদিন অর্নবের ঘাবড়ে যাওয়া তার চোখ এড়ায়নি। তাই তাকে অস্বস্তিতে না ফেলতে রুমে চলে এসেছিল। রুমে এসে খুব কেঁদেছিল। কিন্তু সেটা দুঃখের অশ্রু ছিল না। তার নারী জনমে প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়েছিল বলে এতটুকু খারাপ লাগেনি। একটা অজানা অচেনা ভালো লাগার অনুভূতি তার ভেতরটা ছেয়ে গেল। এবং সে বুঝতে পারল সে অর্নবকে ভালোবাসে। তাই ভালোবাসার প্রগাঢ় স্পর্শ তাকে সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচয় করাল। আজও তার কাছে সেদিনের দৃশ্যটা জীবন্ত। তার আট মাসের দাম্পত্যের এটুকুই ছিল স্বামী – স্ত্রীর পাওয়া। আজ তার মনে হয় এটাই ছিল য়ার নারী জনমে প্রথম চুমু, ও পুরুষের প্রথম স্পর্শ। যা মনে হলে আজও তার হৃদযন্ত্রটা কেঁপে ওঠে।
তার অন্ধকার জীবনে কিছু সুখের স্মৃতির মধ্যে এটিই অন্যতম।
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#সতেরো

অর্নব হাসপাতালে তার কেবিনে বসে আছে। নিরাকে আজ ভীষণ মনে পড়ছে। আজ তার দুটো ও.টি আছে। অথচ তার মন বিধ্বস্ত হয়ে আছে। সে জানে একজন ডাক্তারের দায়িত্ব কী। তার প্রফেশনাল লাইফ, আর পার্সোনাল লাইফ সে কখনোই এক করেনি। নিজের ব্যক্তি জীবনের টানাপোড়েনে কখনো নিজের দ্বায়িত্ব ভুলে যায়নি। নিজের সব কষ্টকে আড়ালে রেখেই দিন কাটিয়েছে। গত হওয়া দুটো বছর তার কাছে দু’হাজার বছরের চেয়েও দীর্ঘ মনে হয়েছে। কাউকে ভালোবাসায় যে এতটা কষ্ট থাকে তা সে জানত না। নিরা নামের সাধারণ মেয়েটা কখন যে তার মনে এতটা জায়গা দখল করে নিয়েছে টেরও পায়নি। আজকে ভীষণ খারাপ লাগছে তার। ওটি দুটো শেষ করে দ্রুত বের হয়ে যেতে হবে। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। এমন সময় তার রুমে দিয়া প্রবেশ করল। তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল। দিয়া সামনের চেয়ারটায় বসে অর্নবকে দেখতে লাগল। দিয়া দেখতে বেশ সুন্দরী। প্রথম দর্শনে যেকোনো পুরুষের নজর কাড়ার মতো। কিন্তু সে ভেবে পায় না তার সামনে বসে থাকা মানুষটি তার ব্যপারে এতটা নির্লিপ্ত কেন! কেন এতগুলো বছর চেয়েও এ মানুষটার মনে নিজের জন্য এতটুকু জায়গা করতে পারল না। দিয়াকে চুপচাপ দেখে অর্নব বলল, ” কিছু বলবে?”

“অনেক কিছুই তো বলতে চাই। তোমার কী শোনার মতো সময় হবে?”

“কেন হবে না! আমি যা পছন্দ করি না সে টপিক বাদ দিয়ে যা খুশি বলতে পারো?

” এইতো একটা নির্দিষ্ট গণ্ডি বেধে দিলে। এখন আর কথা বলে ভালো লাগবে না”

“তাহলে না বলাই ভালো।” অর্নবের কথা শুনে দিয়ার রাগ হয়ে গেল। সে উত্তেজিত গলায় বলল, “নিরা আসবে না এ সামান্য কথাটা কেন বুঝছো না তুমি?”

“তুমি কেন বুঝছো না। নিরা না আসলেও আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। ইনফ্যাক্ট তোমাকে না শুধু, এ পৃথিবীর কোনো মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারব না।” অর্নবের গলা চড়ল।

“কেন পারবে না অর্নব? আমার এত বছরের অপেক্ষার কী কোনো দাম নেই? নিরা যদি ফিরে আসতো আমি কিছুই বলতাম না। নীরবে সরে যেতাম কিন্তু এখন আর সে আসার কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না।” দিয়ার গলায় অভিমান অভিযোগের মিশ্রণ দূর্বল শোনাচ্ছে।

“লিসেন দিয়া আমি তোমায় ভালোবাসতে না পারলে বিয়ে কেন করব বলতে পারো? কেন আমি তোমাকে ঠকাব?শুধু কী নারী পুরুষের মধ্যে যে শারিরীক সম্পর্ক তৈরি হয় সেটার জন্য? দেখো এমন যদি হয় তবে আমাদের দেশে এমন অনেক নারী আছে যারা টাকার বিনিময়ে নিজেদের বিক্রি করে। তাহলে কেন তার জন্য বিয়ে করতে হবে? দেখো দিয়া এ উদাহরণটা তোমাকে ছোট করার জন্য দিচ্ছি না। শুধু বুঝাচ্ছি আমার শরীর মন শুধু ওই একজনকেই চায়। এরপর দ্বিতীয় কোনো নারী আমার জীবনে আসতে পারবে না।”

দিয়া চুপ করে টেবিলের উপর রাখা প্যাপার ওয়েটটি ঘুরাচ্ছে। তার চোখে একসাথে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আবার সেই চোখেই অগ্নি ঝরছে। সে উত্তেজিত গলায় বলল, “তুমি খুব খারাপ অর্নব। খুব খারাপ। আমার কষ্টটা তুমি কোনো দিন বুঝলে না। জানো তো আমি একজন সফল ডক্টর হয়েও নিজের মনকে থামাতে পারি না। নিজেকে বুঝাতে অপরাগ। অথচ প্রতিদিন কত মানুষকে আমি সুস্থ করে তুলছি। কিন্তু নিজেকে সুস্থ করে তুলতে পারছি না।”
দিয়া কথাটা বলে হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছল। আবার বলল, “জানো তো এ পৃথিবীতে মানুষ যতই শক্তিশালী হোক নিজের মনকে বশে রাখতে কেউ পারে না। আমি জানি তুমি নিরাকে ভালোবাসো। আমি জানি তুমি কোনোদিন আমাকে চাইবে না। সব জেনেও আমি তোমার কাছে ফিরে আসি এর কারণ আমি আমার মনকে তোমায় নিয়ে ভাবার থেকে দূরে রাখতে পারি না। মনে হয় তোমাকে নিয়ে ভাবাই আমার একমাসের কাজ। সব বুঝেও আমি তোমার সাথে অবুঝপনা করি।” দিয়ার ঠোঁটের কোণে যন্ত্রণার হাসি দেখা গেল।

অর্নব চুপ করে আছে। দিয়া যে তাকে ভালোবাসে সে তা কিশোর বয়স থেকে বুঝত। কিন্তু কেন যে এতটা কাছে থেকেও সে দিয়াকে ভালোবাসতে পারল না! আসলে ভালোবাসা একসাথে সারাজীবন থাকলে যেমন হয় না। তেমনি এক মুহূর্তের দেখায়ও হয়ে যায়। এসবকিছুই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে। দিয়াকে দেখে তার মায়া হচ্ছে এ মুহূর্তে ভাবছে দিয়াকে ভালোবাসতে পারলে সে নিজেও বেঁচে যেত। কিন্তু সে জানে এটা কখনোই সম্ভব নয়। তার সবটা জুড়ে শুধু নিরা রয়েছে।

অর্নব অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলল, “দিয়া আমার একটা কথা রাখবে প্লিজ?”

দিয়া জল ভরতি চোখ নিয়ে তার দিকে তাকাল দূর্বল গলায় বলল,”বলো?”

“তুমি বিয়ে করে নাও দিয়া। খালামণি কষ্ট পাচ্ছেন তোমার জন্য। আমার জন্য তাদের কষ্ট দিও না। এভাবে শুধু কষ্টই পাবে। অন্য কেউ এলে আমাকে ভুলে যেতে পারবে তুমি।”

দিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “যেটা তুমি নিজে পারো না, সেটা অন্য কাউকে কী করে করতে বলো? তুমি তো অন্য কাউকে বিয়ে করে নিরাকে ভুলতে চাইছো না। তাহলে আমাকে কেন বলছো?”

“কারণ আমি ভুলতে চাই না। তাছাড়া আমি এটা জানি নিরা আমাকে ভালোবাসে। সেটুকু নিয়েই আমি থাকতে পারব। তোর বেলায় তো এমনটা না। তুমি যাকে ভালোবাসো, সে তোমায় ভালোবাসে না। তাই এটাই তোমার জন্য ভালো।”

দিয়ার রাগ বেড়ে গেল। সে টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে অর্নব পিছু ডেকে বলল, “একবার ভেবে দেখো দিয়া।” দিয়া তা শুনলো কিনা বোঝা গেল না। সে চলে গেল।

অর্নব বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফোনটা হাতে নিয়ে নিরার ছবি দেখতে লাগল। আজ দু’বছর সে নিরার সাথে কথা বলে না। প্রায় নিরার ফোনে কল দেয় নিরা হ্যালো বললে সে কল কেটে দেয়। কথা বলে না। কারণ নিরার বারণ সে যেন কখনো নিরাকে কল না দেয়। মাঝে মাঝে যখন নিরার গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করে তখনই কল দিয়ে তার গলার স্বর শুনলেই সে ফোন রেখে দেয়। ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবিতে চোখ আটকে যায়। কাশ্মীরের সেই খেলার ছবিটি। যা নীল তুলেছিল। ছবিটি জুম করে দেখে সে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করে সেদিনের সময়গুলো। তারপর ফিরে যায় অতীতে সেদিন কী ভয়টাই না পেয়েছিল। অথচ সকালে নিরা কত স্বাভাবিক আচরণ করল। সেদিন দুজনে একসাথে চা খেয়ে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল। নিরা সেদিন খুব হাসিখুশি ছিল। আজও সে জানে না সেদিন এত খুশি থাকার কারণ কী ছিল। শুধু জানে নিরাকে সেদিন পাহাড়ি রাজকন্যাদের মতো মনে হচ্ছিল। এত সুন্দর একটা মেয়ে কী করে হতে পারে সে ভাবে।

এসব ভাবতেই তার ভেতরকার যন্ত্রণাটা আরও বেড়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছে আজ তাকে ড্রিংকস নিতে হবে। কোনোকালেই তার এসব বাজে অভ্যাস ছিল না। কিন্তু নিরা চলে যাওয়ার পর থেকে তাকে ভুলতে মায়ানের সাথে একদিন ড্রিংকস করেছিল। সেই থেকে শুরু এখন মাঝে মাঝেই এসব ছাইপাঁশ গিলে নিজেকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চায়।

★★★

নিরা ভার্সিটির শেষে একটা লাইব্রেরিতে কাজ করে। সেখান থেকে মাসে যা আয় করে তাতে তার দিব্বি চলে যায়। যদিও তার একাউন্টে বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আসে কিন্তু সেই টাকা শুধু জমছে একটা পয়সাও খরচ করনি সে। সে টাকা কখনো খরচ করতে পারবে বলে মনেও হয় না। ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। লন্ডনের রাস্তা গুলো দারুণ। সে যে রাস্তায় আসা যাওয়া করে সেখানে চেরি ফুলের অসংখ্য গাছ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। এই যে সে হাঁটছে তার দুপাশে সাদা আর গোলাপি রঙের চেরির বেশি চোখে পড়ছে। যদিও চেরি ফুলের স্থায়িত্ব খুব বেশি দিনের হয় না। এভাবে ফুলের মাঝে হাঁটতে তার বেশ লাগে। নিচে অনেকগুলো ফুল ঝরে পড়ে আছে। সে হাতেএ মুঠোয় বন্দী করল এক মুঠ। চেরির এই আলতো রূপের মুগ্ধতার রেশ তার কাটতে চায় না। প্রায় সে অকারণে নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যায়। যখন দেখে এখানে কাপলরা হাত ধরাধরি করে হাঁটছে তখন মনে হয় সে যদি অর্নবের সাথে হাতে হাত রেখে হাঁটতে পারত! এমন রোমাঞ্চকর জায়গায় প্রিয়জনের সাথে থাকার আনন্দই আলাদা। কিন্তু পরক্ষণেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। যখন ভাবে এ জীবনে আর কখনো সে অর্নবকে দেখতে পারবে না। কোনোদিন তাকে ছুঁয়এ দেখতে পারবে না। ঝগড়া করতে পারবে না কারণে অকারণে।

নানা ভাবনায় কারো গলায় নিরার সম্বিৎ ফেরে। পেছনে তাকিয়ে দেখে ছয় ফিট লম্বা, ফর্সা বাদামি চোখের একজন সুপুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । ভদ্রলোকের হাতে চেরি ফুল। নিরা তাকে দেখে বলল, “জ্যাক কেমন আছো?”

“ভালো। তুমি?”

“আমিও ভালো।” নিরা উত্তর দিল।

জ্যাক তার হাতের ফুলগুলো নিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার জন্য বিউটিফুল লেডি।”

নিরা হেসে বলল, “আমি তো তোমাকে বলেছি জ্যাক আমি বিবাহিত। তাহলে আমি কী করে তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি?”

“আমি জানি বর্তমানে তুমি একা আছো। তাই আমার তোমার অতীত সম্পর্কে কোনো সমস্যা নেই। আমাকে বিয়ে করবে তুমি?”

নিরা হেসেই বলল, “আমি দুঃখিত জ্যাক। আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি।”

জ্যাক হাসল। বলল, “আমি অপেক্ষা করব।”

নিরা বিনিময়ে হেসে চলে আসল। জ্যাকের সাথে তার পরিচয় লন্ডনে আসার পরপরই। তাদের ভার্সিটির সিনিয়র সে। এখন অবশ্য বাবার ব্যবসা দেখছে। ছয় মাস আগেই তার পড়া শেষ হয়েছে। প্রথম দেখা থেকেই জ্যাকের সাথে তার ভাব হয়ে গেছে। এ দেশের ছেলেরা বেশ মিশুক। এখানে ছেলে মেয়ের মেশা মানে প্রেম নয়। এখানকার ছেলেরা খুব ভালো বন্ধু হয়। তাদের বন্ধুত্ব হওয়ার ছয় মাস পর জ্যাক তাকে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেয়। নিরা তাকে না করে দিলে সে খুব সহজভাবে নেয় বিষয়টা। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের ছেলেরা ঠিক বিপরীত। তারা মেয়েদের প্রত্যাখান মেনে নিতে পারে না। কিছু ছেলে রাগ করে এসিড ছুড়ে মারে। কেউ বা জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। খুব কম সংখ্যক ছেলে মেনে নেয়। কিন্তু এখানে এসব নেই। তাদের মতে ছেলেদের যেমন ভালো লাগা থাকতে পারে, মেয়েদেরও থাকতে পারে। তাই এসব বিষয় বেশ সাধারণ ভাবেই নেয় তারা।

হঠাৎ নিরার একটা কথা মনে হলো। এই যে অর্থশালী, দেখতে সুদর্শন, ও উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরও জ্যাককে সে ভালোবাসতে পারল না। এটার কারণ অর্নব। এটাকেই হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা বলে। নয়তো এত দূরে এসেও কেন সে সেই একটা মানুষেই মজে আছে! কেনই বা সামনে এত এত সম্ভাবনা থাকার পরও সে তাতে রাজি হতে পারছে না। কোন এক গুণী মানুষ যেন বলেছিলেন, “যখন কাউকে সত্যিকারের ভালো যায়। তখন অন্য কাউকে ভালোবাসার ইচ্ছেটাই মরে যায়।” এ কথাটা যে ধ্রুব সত্য আজ সে টের পাচ্ছে। তার সাথে ভালো লাগছে এটা ভেবে যে সে তার ভালোবাসায় সৎ থাকতে পারছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here