সবটাই_তুমিময় পর্ব ২৩+২৪

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২৩

ব্যালকনি দিয়ে বাইরের বিদ্যুৎ চমকানোর আলোটা চোখে পরছে।ঠান্ডা বাতাসও গায়ে এসে লাগছে।পর্দা উড়ে উঠেছে সে বাতাসে।মেঘের ডাকাডাকি শুরু।হয়তো বৃষ্টি হবে আজ।রাতের আধারটাকে কালো মেঘ আরো নিকষ,কুৎসিত কালো বানিয়ে দিচ্ছে যেনো।চোখ‌ সরিয়ে অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-আপনি সবটাই জানতেন!

যেভাবে রেডি হয়ে বেরিয়েছিলেন উনি,সেভাবেই এসেছেন।ঠোটে টেডিস্মাইল‌ নিয়ে পকেটে একহাত গুজে এগোলেন ঘরের ভেতরে।তারপর আয়নার সামনে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে ঘড়ি খুলতে লাগলেন।ল্যাপটপ ছেড়ে বিছানা থেকে নামলাম।হাত মুঠো করে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম।উনি শার্টের উপরের বোতামদুটো খুলে আমার সামনে দাড়িয়ে গোটানো হাতা ছাড়াতে ছাড়াতে লাগলেন।আমার প্রশ্নে থেমে গিয়ে হাসিটা রেখেই তাকিয়ে রইলেন শুধু।আবারো বললাম,

-বলছেন না কেনো?সবটা বুঝে গিয়েছিলেন আপনি?

উনি আরো প্রসারিত এক হাসি দিলেন।কোমড়ে দুহাত গুজে বেশ মজা নিয়ে বললেন,

-তোমার কি মনে হয়?হুট করে এ বাসায় তোমার চুলের রুপচর্চা করার ইচ্ছা জাগ্রত হবে,আমার কাছে হেল্প চাইবে,হাত ধুতে না দিয়ে বউয়ের মতো আদর করে হাত ওড়নায় মুছিয়ে দেবে,অসময়ে দরজা লাগাতে গিয়ে তোমার হাতে ব্যথা লাগবে,তোমার মাথাব্যথা না থাকা সত্ত্বেও ফার্স্ট এইড বক্স ওই রুমে নিয়ে যাবে,আর তো আর,সে বক্স হাতের সামনে না রেখে একপ্রকার লুকিয়ে রাখবে,তোমার এসব মাত্রাতিরিক্ত অস্বাভাবিক ব্যবহার,আমি স্বাভাবিকভাবে নেবো?

তারপর আমার দিকে আরেকটু ঝুকে বললেন,

-তাছাড়া মেঝেতে থাকা একটুকরো লিটমাস পেপার আর লেবুর রসের ঠিক কি সম্পর্ক থাকতে পারে তার আইডিয়া আছে আমার।অতোটাও বোকা আমি নই!

ভুলটা ঠিক ওখানেই‌ ছিলো।তাড়াহুড়োয় হয়তো পরে গিয়েছিলো লিটমাস কাগজ।বললাম,

-সবটা জেনেও আপনি আমাকে….

-হ্যাঁ,চাইলে তখনই তোমার….!তোমার এই ভালোমানষির মুখোশ খুলে দিতে পারতাম।তবে তোমাকে কিছুতে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন ছিলো।যাতে সেটুকো সময় ফাইলগুলোর উপর থেকে নজর সরে তোমার।

বুঝলাম।উনি ডিসট্র্যাক করতে চাইছিলেন আমাকে।মাথা নিচু করে রইলাম।অঙ্কুর বললেন,

-এভাবে অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছো কেনো?অপরাধ করেছো?

…..

-কথা বলছো না যে!কোনো….অন্যায়টন্যায় করে ফেলোছো?

-আপনার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড লাভ ইউ মা?যখন আপনার মা তো আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।এ বাসায় তার পরিচয়,সে মৃত,যেখানে তার মৃত্যুর বিষয়ে কেউ‌ কিছুই জানে না।সে আদৌও মৃত কি না তার সত্যতা নেই।ঘৃনা করে তাকে নাকি?তারপরও পাসওয়ার্ড লাভ ইউ মা?

সোজা হয়ে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুজলেন উনি।হাসিটা রেখেই বললেন,

-বাস্তবতা দিয়ে পাসওয়ার্ড যাচাই করবে?এতটা বোকা তুমি নও অদ্রি!

-সব জেনেও পাসওয়ার্ড পাল্টান নি কেনো?

-না পাল্টিয়ে কি কোনো ক্ষতি হয়েছে আমার?নাকি খুব লাভ হয়েছে তোমার?কিছু পেয়েছো?

উনি বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বিছানার দিকে এগোচ্ছিলেন।বলে উঠলাম,

-আপনার লয়ারের মেইল এসেছিলো।

অঙ্কুর থেমে গেলেন।পিছন ফিরলেন কিঞ্চিত বিস্ময়ে।এবার আমি মৃদ্যু হেসে বললাম,

-সব ডকুমেন্টস্ সরিয়ে ফেলেছেন ঠিকই,কিন্তু সাথে মেইল অপশনটাও হাইড করা উচিত ছিলো আপনার।

অঙ্কুরের চোখমুখ শক্ত হয়ে আসলো নিমিষেই।উনি হাত মুঠো করে বললেন,

-প্রিভিয়াস মেইল ডিলিট করিছি।

-হ্যাঁ।রিসিভ মেইল অপশন তো বন্ধ করেননি তাইনা?মেইল রিসিভ হয়েছে।আর ওনাকে আমি ইমারজেন্সি মেইল করেছি।মেইল‌সেন্ড হয়েছে অঙ্কুর।আর তার রিপ্লাইও দিয়েছেন উনি।

-কি বলেছো তুমি?

-আমি শুধু একবার মেইল করেছি।উনিই প্রথমে মেইল করেছিলেন।সেটাতে লেখা ছিলো,রেজিস্ট্রি পেপার ইস্যুতে আরো সময় লাগবে।বললাম পেপারের কপি সেন্ড করতে,উনি তাই করলেন।এটুকোই!

অঙ্কুর ‌নুইয়ে মাথা নিচু করে রইলেন।তাচ্ছিল্যে বললাম,

-এভাবে অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছেন কেনো?অপরাধ করেছেন কোনো?

উনি টলোমলো চোখে তাকালেন।নিজেকে শক্ত রেখে বললাম,

-কথা বলছেন না যে!কোনো অন্যায়টন্যায় করেছেন?

-অদ্রি ওটা…..

-আমি বলবো?কোনো অন্যায় করেন নি আপনি।বিয়েটা তো বেবির জন্যই করেছিলেন।তা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ হলেই বা কি আসে যায়?আর এটা আমি জানলেই বা কি আসে যায়?আমি কিন্তু স্বাভাবিকই আছি।একদমই অবাক হয়নি,কষ্ট পাইনি।শুধু আমাকে অপমানের ষোলোকলা পুর্ন হলো আপনার।আবার কষ্ট পাইনি বললাম বলে আপনার কষ্ট হচ্ছে না তো অঙ্কুর?

উনি হাত মুঠো করে চোখ বন্ধ করে রইলেন।মৃদ্যু হেসে বললাম,

-দু বছরের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ!বিয়ের দিন বললেই পারতেন।আমি তো জানতামই,সবাইকে বলা আপনার ভাষ্যমতে ভালোবেসে বিয়ে করছেন না আপনি আমাকে।আমাকে জানালে সমস্যা হতো না আপনার।কিন্তু আপনি হয়তো ভেবেছিলেন কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ দেখলে বিয়েটা করবো না আমি।এজন্যই সেদিন আমার চশমা ছুড়ে ফেলেছিলেন আপনি তাইনা?

…….

-যাই হোক,সফল আপনি।বিয়েতে,আমাকে অপমান করতে,কষ্ট দিতে।এই টপিক নিয়ে কথা নাই বলি আর!

উনি চুপ রইলেন।একপা এগিয়ে বললাম,

-এবার আমার বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন অঙ্কুর!মৃত্তিকা ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রির সাথে আপনার কি সম্পর্ক?

অঙ্কুর বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন আমার দিকে।বললাম,

-এতোটা অবাক হচ্ছেন কেনো?মৃত্তিকা এক্সপোর্টের বিষয়ে আমি কি করে জানলাম এটা ভেবে?

……

-আপনি বেশ ভুলোমনা অঙ্কুর।ভুলে যাচ্ছেন,মানুষের সার্চ হিস্ট্রি অনেক কথা বলে।ওগুলো ডিলিট করতেও ভুলে গিয়েছিলেন আপনি।যেখানে আপনার সার্চ লগ জুড়ে শুধুই মৃত্তিকা ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্টস্!

অঙ্কুর মুখ ফিরিয়ে নিলেন।আবারো তার চেহারায় রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।উনি বললেন,

-কতোটুকো জেনেছো?

-জানি না।আপনাকে যতই দেখি ততই রহস্য লাগে আমার কাছে।আপাতত এটুকো জবাব দিন,আপনার বাবার এতো কষ্টে গড়ে তোলা ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানি,টাকায় টাকায় তাকে ভরিয়ে রাখা,শাইন ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট কি করে মৃত্তিকা ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট নামে বদলে গেলো?আর তার বর্তমান মালিক কে?প্রদীপ সরকার!এটা কবে,কখন,কেনো ঘটলো?

-তোমাকে কেনো বলবো?

-কারন আমার জবাব চাই!আপনার বাবার সাথে প্রদীপ সরকারের কি সম্পর্ক,জানতে চাই আমি!

…..

-চুপ করে থাকবেন না অঙ্কুর!জবাব দিন!

….

-আন্সার মি অঙ্কুর!এ বিষয়ে আজ কোনো আপোষ করবো না আমি!আপনি জবাব না দিলে‌….

-বাবার বিজনেস পার্টনার ছিলো প্রদীপ সরকার।

ওনার শান্ত জবাব।কথাটা শুনে ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।নিচদিক তাকিয়ে একটু পিছিয়ে গেলাম।এমনটাই মনে হচ্ছিলো আমার।মা বাবার মৃত্যুর বিষয়ে অঙ্কুরের বাবা অবগত।আর প্রদীপ‌ সরকারের মতো জঘন্য লোক ওনার বিজনেস পার্টনার।কোনোভাবে এরা দুজনেই আমার বাবা মাকে….শরীর যেনো ভর ছেড়ে দিচ্ছে এটা ভেবে।অঙ্কুর এগোতে আসলেই হাত দিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে।বললাম,

-ও।উনি বিজনেস পার্টনার ছিলেন প্রদীপ সরকারের?আর এখন আপনি।তা আপনি যেমন প্রদীপ সরকারের কুকর্মের পার্টনার,আপনার বাবাও তেমনটা ছিলেন বুঝি?

-স্টপ ইট অদ্রি।বাবাকে নিয়ে কোনো কথা নয়!

যতোটুকো সম্ভব চেচিয়ে বলে উঠলাম,

-কেনো নয়?কেনো নয় অঙ্কুর?কোথায়?কোথায় আপনার বাবা?কোথায় সে?

-তুমি জানো বাবা নেই এখানে।

-হ্যাঁ।কোথায় সেটাই তো জানতে চাইছি!কোথায় সে?

-জানার সময় আসলে ঠিক জানবে।

-সময় আসে না অঙ্কুর,ও তো ওর মতো বয়ে চলে।শুধু পরিস্থিতি তৈরী হয়।আর আমি আজ,এই মুহুর্তে,এই পরিস্থিতিতে আর কিছুই ভাবতে পারছি না!বলুন!কোথায় আপনার বাবা?কোথায় মিস্টার অনিক আফতাব?লুকিয়ে আছেন কোথাও?নাকি তার কুকীর্তির জেরে শাস্তিভোগ….

আমাকে শেষ করতে না দিয়ে অঙ্কুর ছুটে এসে হাত চেপে ধরলেন আমার।ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে চেচিয়ে বললেন,

-বাবা বেচে নেই অদ্রি!মারা গেছে!শুনেছো তুমি?চার বছর আগেই মারা গেছে আমার বাবা!অনিক আফতাব মারা গেছে!

কথা শেষ করে আমাকে ঝারা মেরে ছেড়ে দিলেন উনি।ধপ করে বিছানায় বসে পরলেন।স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে উনি।আমিও পাথর হয়ে গেলাম যেনো।চোখ দিয়ে পানি পরছে শুধু।বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলো নিরবতায়।কিন্তু বাইরে ঝড় শুরু হয়ে গেছে।বজ্রপাতের তুমুল শব্দ একটু পরপরই কর্নগোচর হচ্ছে।ব্যালকনির থাই গ্লাস দিয়ে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোও দৃষ্টিসীমায় আবদ্ধ হচ্ছে বারবার।

অঙ্কুরের নিরবতা তার ভেতরের কষ্টটাকে জানান দিচ্ছে।কি হলো জানি‌ না,চোখ মুছে আস্তেধীরে এগিয়ে গিয়ে অঙ্কুরের কাধে হাত রাখতেই হুট করে কোমড় জরিয়ে ধরলেন উনি আমার।পেটে মুখ গুজে শব্দ করে কাদতে লাগলেন উনি।কেপে উঠলাম খানিকটা।কিছুক্ষন আটকে থেকে একহাতে তার গলা জরিয়ে মাথার চুলে আঙুল চালাতে লাগলাম।নিজেও কাদছি আবারো।নিজের মা বাবার মৃত্যুসংবাদ সন্তানের জন্য কতোটা কষ্টের,তার ধারনা আছে আমার।হয়তো এজন্যই সহ্য হচ্ছে না অঙ্কুরের কান্না।একদমই সহ্য হচ্ছে না!
#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২৪

থাই গ্লাসের ওপারে বৃষ্টির ফোটা ফোটা পানি একটা আরেকটার সাথে লেগে গরিয়ে পরছে।রাতের গভীরতা অন্ধকার বাড়িয়েছে,তবে বাগানের আলোর অনেকটাই রুমে ঢোকে এদিক দিয়ে।তাই রুমের লাইট অফ হওয়া সত্ত্বেও আবছা আলোতে মোটামুটি সবটাই দেখা যায়।এ ঘর ছেড়ে গেলে অঙ্কুর আগেরবারের মতো উঠে যাবেন কিনা জানি না,তবে যেতে ইচ্ছে করেনি।আবার ঘুমও আসেনি।উঠে এসে তাই গ্লাস ঘেষে দাড়ালাম।বৃষ্টির শব্দ আসছে না একটুও।খানিকটা টেনে দিলাম কাচের দেয়াল।রিনরিন শব্দতরঙ্গ প্রশান্তি এনে দিলো মনজুড়ে।পানিভেজা বাতাস চোখমুখ ছুইয়ে দিতেই মৃদ্যু শিহরনে গা ভাসাতে ইচ্ছে করে ওই পানিবিন্দুর অসংখ্য বর্ষনে।

চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন ওভাবেই রইলাম।মুখসহ গলার দিকটা ভিজে উঠেছে।সামনের চুলগুলো ভিজে কপালের সাথে লেপ্টে গেছে টের পাচ্ছি।চোখ খুলে বিছানার দিকে তাকালাম।কপাল ধরে এপাশ ওপাশ করছেন অঙ্কুর।এতোক্ষন তো ঠিকই ঘুমোচ্ছিলেন,এখন কি হলো ওনার? বাজপরার শব্দ আসতেই মনে হলো হয়তো বৃষ্টির শব্দ কানে গেছে বলে ঘুমে বিঘ্ন ঘটেছে তার।

লাগিয়ে দিলাম গ্লাস।তখনো কপাল চেপে ধরে রয়েছেন উনি।এবার মনে পরলো কান্নার জন্য নির্ঘাত মাথাব্যথা হচ্ছে ওনার।ওষুধটাও খাওয়াইনি।ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগোলাম।মাঝের কোলবালিশটা সরিয়ে অঙ্কুরের বেশ কাছেই এগিয়ে বসেছি।কাপাকাপা হাত মাথায় রাখলাম তার।উনি জাগেন নি।কিন্তু কপালও ছাড়েন নি।আরেকহাতে তার হাত নামিয়ে দিয়ে হাত বুলাতে লাগলাম তার চুলে।উনি নড়েচড়ে আমার দিক ফিরে একদম কোলে মাথা রাখলেন আমার।কোমড় জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরলেন।গাল বেয়ে পানি গরিয়ে পরলো আবারো।

.

রাত অনেকটাই গভীর হয়েছিলো।অঙ্কুর কাদছিলেন।তাকে জরিয়ে রেখে আমিও কাদছিলাম।বাইরে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি।অনেকটা সময় শব্দ করে কাদার পর উনি ছেড়ে দিলেন আমাকে।হুশ ফিরতেই চোখ মুছে তাকে ছেড়ে সরে দাড়ালাম।উনি হাতের পিঠে চোখ মুছছেন,নাক টানছেন।চেহারা লালচে হয়ে গেছে তার।নাকের ডগাটা বেশি লাল হয়ে আছে।উনি আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন,

-সরি।

অবাক চোখে তাকালাম।আবারো চোখ জলে ভরে উঠলো আমার।বারবার পলক ফেলে সে চোখের পানি আটকে দিলাম কোনোমতে।নাক টেনে নিজেকে সামলে নিলাম।একটা শুকনো ঢোক গিলে গলা স্বাভাবিক করে বললাম,

-সরি?সরি ফর হোয়াট?

অঙ্কুর বেড ছেড়ে উঠে দাড়ালেন।ধরা গলায় বললেন,

-তোমাকে ওভাবে জরিয়ে ধরার জন্য।

টুপ করে চোখের পানি বেরিয়েই এলো।তৎক্ষনাৎ মুছে ফেলে তাচ্ছিল্যে হেসে বললাম,

-ও।বুঝলাম।আসলে কি বলুন তো?কনফিউজড্ হয়ে গিয়েছিলাম,ঠিক কোন কারনে সরি বললেন আপনি আমাকে।আদৌও কোনো কারনের জন্য আপনার গ্লানি আছে কি?আমার কি দোষ ছিলো বলতে পারেন?কি দোষ করেছিলাম আমি?কি না শুনতে,দেখতে হয়েছে,হচ্ছে আমাকে?প্রথমে আমাকে আপনার বাচ্চার সেরোগেট মাদার বানাতে চাইলেন,মানা করেছিলাম বলে আটকে রাখলেন আমাকে,মনিমার অসুস্থ্যতার কথা বলে আমার অমতে বিয়ে করতে বাধ্য করলেন,বিয়ের পরপরই বললেন বিয়েটা শুধু বেবির জন্যই করেছেন আপনি।আজ জানতে পারলাম,এই বিয়েটা দু বছরের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ!এতোসবের পরেও এখন যখন আপনাকে….

-আমাকে কি অদ্রি?

-কিছু না।আপনার শুকরিয়া আদায় না করে পারছি না।যখন যখন আমি কোনো এক অজানা অনুভূতির অববাহিকায় নিজের লক্ষ্যকে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছি,প্রতিবার আপনি আমাকে জানান দিয়েছেন,আমি কে,আপনি কে,আপনার উদ্দেশ্য কি,আর সেখানে আমারই‌ বা কি করনীয়।যাই হোক,থ্যাংকস্!এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন।আপনার বাবা কিভাবে মারা গেছেন?

…..

-চুপ করে থাকবেন না অঙ্কুর!আমার উত্তর চাই!

উনি চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে নিয়ে বললেন,

-প্রশ্ন করো না অদ্রি।প্লিজ!

-কেনো?

-কারন সবটা এখন তোমাকে বলতে পারবো না।আর এটুকো জেনে,বরাবরের মতো তুমি শুধু ভুল বুঝবে আমাকে।

-আপনার মনে হয় আমি আপনাকে ভুল বুঝেছি?

-তোমারও এমনটাই মনে হবে।

বুঝলাম,উনি কোনো জবাব দেবেন না আমাকে।আমার প্রশ্নের উত্তর আমাকেই খুজে নিতে হবে।আর সেটা একজনই দিতে পারবে।প্রদীপ সরকার।সে অবশ্যই জানবে,তার বিজনেস পার্টনার অনিক আফতাবের কতোটুকো,কি জেনে গিয়েছিলো বাবা মা।এজন্য তাদের কি কি ক্ষতি হয়েছিলো।আর সবচেয়ে বড় কথা!কোনোভাবে আমার বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য এই প্রদীপ সরকারই দায়ী কি না!সবটা শুধু উনিই জানেন।ওনার কাছ থেকেই সব কথা বের করতে হবে আমাকে।একবার ওই নোংরা লোকটাকে হাতে পাই,এতো ভয়ংকর ভাবে অত্যাচার করবো,সবটা স্বীকার করতে বাধ্য হবে সে।নিজেকে স্বাভাবিক করে অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-বেশ।আর কোনো প্রশ্ন করবো না আপনাকে।আপনাকে ঠিক বুঝতে চাই।অপেক্ষায় থাকবো,আপনার নিজের স্বীকারোক্তির।

অঙ্কুরের চোখ চকচক করে উঠলো যেনো।এতোক্ষন এতোটা কষ্টে এতোটা কান্নার পরও এই কথাটায় তার এমন রিয়্যাক্ট অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো আমার।উনি হাতের পিঠে নাকটা ডলে উৎফুল্লভাবে বললেন,

-সত্যি বলছো?

-হ্যাঁ।আপনি যখন চান আমি আপনাকে প্রশ্ন না করি,আর প্রশ্ন করবো না আপনাকে।আপনার যখন খুশি,তখনই না হয় উত্তর দেবেন।এখন রেস্ট নিন।

ওনার তৃপ্তির হাসি।চলে আসছিলাম।উনি বললেন,

-খেয়েছো অদ্রি?

-না।গুড নাইট।

-আমিও খাইনি।

পিছন ফিরলাম।এর আগেও একবার এই কথাটা বলেছিলেন উনি।যা অসমাপ্ত মনে হয়েছিলো আমার।অঙ্কুর বললেন,

-আ্ আমিও খাইনি।খাইয়ে দেবে?

আজ কথাটা পুর্ন বলে মনে হচ্ছে।তবে কেনো জানিনা তাচ্ছিল্য আসছিলো ভেতর থেকে প্রচন্ডভাবে।সেটাকে আটকিয়ে বললাম,

-আপনি তো রেডি হয়ে বেরিয়েছিলেন শুধু আমাকে দেখাবেন বলে।সত্যিসত্যি ডিনার করতে গেলে খেয়েই আসতেন।

এটুক বলেই সোজা কিচেনে চলে আসলাম।কিছু খাবার ওভেনে গরম করে ট্রে ভর্তি করে নিয়ে আসলাম রুমে।অঙ্কুর ততক্ষনে চেন্জ করে বেরিয়েছেন।যাওয়ার সময় সুটবুট পরে,সাজগুজ করে এমনভাবে বেরিয়েছিলেন,যেনো সত্যিই‌ ডিনারে যাচ্ছেন।বেডে মাথা চেপে ধরে বসে আছেন উনি।মাথাব্যথা করছে হয়তো।কান্না তো কম করেন নি।ট্রে টা সামনে রেখে বললাম,

-খেয়ে নিন।

-তুমি কিচেনে কেনো গেছো?

-আগুনের কাছে যাইনি।খাবার ওভেনে গরম করেছি।

-কথা সেটা নয়,কথা হলো,আমার জন্য খাবার আনতে গেলে কেনো তুমি?

-আপনিই তো বললেন খাননি,খাইয়ে দিতে।

-খাইয়ে দেবে?

কথা না বাড়িয়ে বিছানায় তার পাশেই বসলাম।খাবার নিয়ে তার মুখের সামনে ধরতেই ওনার সেই‌ চোখে জল মুখে হাসি চেহারা।চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।উনি খাবার মুখে নিলেন।নিচদিক তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,

-আবারো অভিনয় করছো?

চোখ তুলে তাকালাম আবারো।উনি আমার মুখের সামনে খাবার তুলে বললেন,

-বলছো না যে?

-খাবো না।

-খেতে হবে।এন্ড আন্সার মি,আবারো নাটক করছো?এবার বুঝি আরো বড় কোনো প্লান তোমার?

একটা ছোট শ্বাস ফেলে খাবার মুখে নিলাম।বললাম,

-আমি ঠিক কি করছি তা আমি নিজেও জানি না।তবে এই সহমর্মিতাটা,এটা মন থেকেই আসছে এটা জানি।আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন।

-আমার মতো একটা খারাপ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা?কেনো?

-বড্ড অদ্ভুত মানুষ আপনি অঙ্কুর।নিজে তো বলে দিলেন প্রশ্ন করো না অদ্রি।আর প্রতিটা লাইনে লাইনে আমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে উত্তরের আশা করছেন।যাই হোক,সহমর্মিতা দেখানোর কারন কষ্ট হয়েছে আমার।আপনি পিতৃহারা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে।আমারও বাবা নেই।তাই বাবা না থাকার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি।এদিক দিয়ে আপনার আমার কষ্টটা এক।তাই আপাতত আপনাকে অন্যকোনো কথা,কাজ বা প্রশ্নে কষ্ট নাইবা দিলাম।

অঙ্কুর আর কোনো কথা বলেননি।খাইয়ে দিতে লাগলেন আমাকে।তারপর নিজের খাওয়াটাও নিজেনিজেই শেষ করে চুপচাপ শুয়ে পরলেন উনি।তাকিয়ে রইলাম তারদিকে কিছুক্ষন।যখন সে কি চায়,তা বলবে না আমাকে,আমি কি করে জোর করতে পারি তাকে?তবে হ্যাঁ,যে প্রতিশোধ,শাস্তি আর ঘৃনার অগ্নিপথ আপনি বেছেছেন অঙ্কুর,তাতে আপনার আমার সম্পর্কের বিষাক্ততা কোনোদিনও মিটবে না।অদ্রি তো এই অঙ্কুরের বিপরীতে চলেছে,চলবে।আপনার বলা সবটাই তুমিময় কথাটা কোনোদিনও সম্ভব না।আমাদের দুজনের পথ এক হতে পারবে না কোনোদিনও।ভেবে অবাধ্য চোখের জল গরাতে লাগলো।

.

চোখ মুছলাম।অন্ধকারপ্রায় ঘরটাতে অঙ্কুরের উজ্জল চেহারা পুরোপুরি আত্মপ্রকাশে সফল।এমনকি ভ্রুর পাশের লালচে তিলটা অবদি দেখা যাচ্ছে!মাথার একটু বেশিই সিল্কি চুলগুলোতে হাত আটকাতেই পারছি না।নাই বা চোখকে আটকাতে পারছি ওই চেহারার মোহে না পরা থেকে।আস্তেধীরে কোল থেকে সরিয়ে বালিশে তার মাথা এলিয়ে দিলাম।আধশোয়া হয়ে ঝুকে অঙ্কুরের মাথায় হাত বুলাচ্ছি তো বুলাচ্ছি।ক্লান্তি লাগছে না একদমই।এতোটা কাছ থেকে তাকে দেখতে দেখতেই যেনো সব ক্লান্তি উবে যাচ্ছে।মনজুরে একটাই প্রশ্ন,যে লোকটা এতোভাবে কষ্ট দিলো,তার কাছে থেকে এমন প্রশান্তি অনুভব হওয়ার কি কারন?এই গোলকধাধাতেই কোনোভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবো না তো?

সকালে ঘুম ভাঙার পর নিজেকে কারো বুকে আবিষ্কার করলাম।সে মানুষটার হৃদস্পন্দন কানে বাজছে আমার।এটা অঙ্কুর।একহাতে আমাকে জরিয়ে রেখে আরেকহাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন উনি।আস্তেধীরে মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম।মুচকি হাসছেন অঙ্কুর।উনি জেগে আছেন!চুলগুলো এগোমেলো হয়ে আছে তার।খোচাখোচা দাড়িগুলো প্রানহীন না হয়ে চেহারার মাধুর্য্য বাড়াতে কর্মঠ।চোখজোড়া তাদের গভীরতা বজায় রেখে একটু বেশিই দুরন্তপনা দেখাচ্ছে যেনো আজ।উনি বললেন,

-গুড মর্নিং।

ধ্যান ছেড়ে উঠে চুপচাপ বসলাম।অঙ্কুরও উঠে বসে তার বুকে হাত বুলিয়ে বললেন,

-বুক ব্যথা হয়ে আছে।উফ্!

আড়চোখে তাকাতেই উনি মেকি হাসি দিলেন একটা।ইতস্তত লাগছে।তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে,তাকে দেখতে দেখতে,তারই বুকের উপর শুয়ে পরলাম?অঙ্কুর মাথাটা চুলকে বেড ছেড়ে উঠে গেলেন।গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলেন।দরজায় একটু থেমে পেছন না ফিরে বললেন,

-কাল রাতে যা যা হয়েছে,ভুলে যাও।আর তোমার মনিমাকে ফোন করে জানিয়ে দাও,আজ বিকেলেই হানিমুনের জন্য বেরোচ্ছি আমরা।পাঁচদিন পর ফিরবো।উনি যেনো টেনশন না করেন!

#চলবে…
#চলবে…

[ নিড আ ব্রেক!ঘুমাবো!😴
হ্যাপি রিডিং]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here