সবটাই_তুমিময় পর্ব ২৯+৩০

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২৯

এয়ারপোর্টে গাড়িতে বসে অপলক দৃষ্টিতে অঙ্কুরের হাসিমুখ দেখে চলেছি।প্রেস-মিডিয়া আর অঙ্কুরভক্তের জনস্রোতের মাঝেও খয়েরী শার্ট পরিহিত,সানগ্লাস চোখে,সুঠাম দেহের অধিকারী সে ব্যাক্তিকে ঠিকই চোখে পরছে।চারপাশে পাঁচ ছয়জন কালো শার্টপ্যান্ট পরা লোকজন হাত দিয়ে ঘিরে রেখেছে তাকে।এগোতে এগোতে কখনো দুচারজনের হাতে হাত ছুইয়ে দিচ্ছেন,তো কখনো হাত থেকে কাগজ নিয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন।হঠাৎই কারো সাথে দাড়িয়ে যাচ্ছেন সেলফির জন্য।এমনিতেও উনি যথেষ্ট সময় ওনার ফ্যানদের সংস্পর্শে থাকেন।ম্যাচ জিতে এসে যেনো আরো বেশি মিশে যেতে চাইছেন সবার মাঝে ।

আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রোহান ভাইয়া কোথাও গেছেন।অঙ্কুরের সাথে আর কথা হয়নি আমার।তবে আসার সময় এলিনার সাথে দেখা করেছিলাম।একই ফ্লাইটে এসেছি আমরা।তবে সেই অচেনা হয়ে।চেনা কি কোনোদিনও ছিলাম?আদৌও চেনার চেষ্টা করেছিলাম কি?করেছিলাম তো!কিন্তু আপনিই বারবার ভুল পরিচয় দিয়েছেন নিজের অঙ্কুর।হ্যাঁ তবে সেটারও যথেষ্ট কারন ছিলো।ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।এরমধ্যেই রোহান ভাইয়া গাড়িতে এসে বসলেন।ইতস্তত করে বললাম,

-আ্ আমি আমার বাসায় যাবো রোহান ভাইয়া।

উনি সিটবেল্ট লাগাতে ব্যস্ত ছিলেন।চোখ তুলে স্বাভাবিকভাবে বললেন,

-হ্যাঁ।অঙ্কুর তো এমনটাই বলেছে।তোমাকে তোমার বাসায় নিয়ে যেতে।আমরা ওখানেই যাচ্ছি।

জোরে শ্বাস ছাড়লাম।চোখ ভরে উঠছিলো,তবুও কান্না থামিয়ে দিলাম কোনোভাবে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম।এই রাস্তায় আগে আসা হয়নি,নতুন রাস্তায় আশপাশটা দেখায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম সর্বোচ্চ।লাভ হয়নি।হুটহাট চোখের জল বেরিয়ে আসছিলো।মুছে নিচ্ছিলাম তৎক্ষনাৎ।বারবার।

অনেকটা রাস্তা আসার পর রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার।দেখলাম গাড়ির সামনে রাখা রোহান ভাইয়ার ফোনটা বাজছে।কানে গোজা হেডফোনে কল রিসিভ করলেন উনি।কিছু না বলে মুচকি হেসে গাড়ি ব্রেক করলেন রোহান ভাইয়া।একটু বিস্ময়ে তাকালাম তারদিক।উনি নেমে গিয়ে পেছনে রাখা তার ব্রিফকেস,ট্রলি আর কোটটা নামিয়ে নিলেন।তারপর আমার জানালার পাশে একবার ঘড়ি দেখে ফাকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।বললাম,

-এখানে থামলেন কেনো?এসবই বা নামালেন কেনো?

উনি নিরুত্তর।পরপরই পেছনে কিছু একটা দেখে আমার দিকে সৌজন্যে হেসে বললেন,

-হ্যাভ আ নাইস জার্নি।বাই।

ট্রলি টেনে চলে গেলেন রোহান ভাইয়া।সিটবেল্ট খুলতে খুলতে চেচাতে লাগলাম,

-মানে?কোথায় যাচ্ছেন আপনি র্….

সিটবেল্ট খোলা শেষ হয়নি আমার।না কথা শেষ হয়েছে।টের পেলাম পাশে ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছেন কেউ।মাথা তুলে তাকাতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো আমার।অঙ্কুর!ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন উনি।বেশ কিছুটা সময় বিস্ময়ে তাকিয়ে সিটবেল্টটা আবারো ঠিকঠাকমতো লাগিয়ে নিলাম।মাথা নিচু করে সরু গলায় বললাম,

-আপনি এখানে?

-আমাকে প্রশ্ন করার অধিকার নেই তোমার।

মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম।উনি বললেন,

-মায়ের কাছে যাবো।এখন যখন আমিও যাচ্ছি,আলাদা করে তোমার জন্য রোহানের পেট্রোল খরচ করার কি দরকার?এমনিতেও তো কম করিনি তোমার জন্য।আর তার বিনিময়ে তুমিও কম করোনি।

কিছুই বলার ছিলো না আমার।চাইলে হয়তো জবাব দিতে পারতাম।হয়তো প্রশ্নও ছুড়ে দিতে পারতাম তাকে,আমার দোষটা কোথায়?যখন উনিই বারবার ভুল বুঝিয়েছেন আমাকে,আমার কি করনীয় ছিলো?কিন্তু এসব কথা তোলার কোনো মানে হয়না।এসব ভাবনাচিন্তার মাঝেই বাসায় পৌছালাম আমরা।কোনোদিক না তাকিয়ে টেনেটুনে নিজের ট্রলিটা টেনে বের করে দরজায় দাড়ালাম।

কলিং বেল আমার আগেই অঙ্কুর টিপে দিয়েছেন।পাশে তাকালাম।সানগ্লাস খুলে ফেলেছেন উনি।শার্টটার কলার আর হাতাটা টেনে ঠিক করে নিলেন।চুলগুলো উল্টে দুহাত সামনে রেখে মুখে বড়সর হাসি টেনে এমনভাবে দাড়ালেন যেনো শান্তশিষ্ট কোনো ছোট বাচ্চা।যেনো কেউ তার গাল টেনে তাকে বলে গেছে,এইযে বাবু,এইখানে ভদ্রভাবে চুপচাপ দাড়াও,চকলেট দেবো তোমাকে।আর তিনি সেই চকলেটের আশায় এতো ইনোসেন্সি দেখাচ্ছেন।এসব ভেবে কপাল কুচকে ফেললাম।এই আবোলতাবোল ভাবনার জন্য নিজের উপরও রাগ হলো।দরজা খুলে দিলো মনিমা।সাথেসাথে চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু আমার।ভেতরে ঢুকে আস্তেকরে জরিয়ে ধরলাম মনিমাকে।চোখ বন্ধ করে নিরবে কাদছিলাম।অনেকটাসময় পর মনিমা বললো,

-যা হওয়ার হয়ে গেছে আন্নু।ভুলে যা।

মাথা তুললাম।মনিমাও কেদেছে।মনিমা চোখের পানি মুছে ফেললো।আমারও চোখমুছ মুছে দিয়ে কপালে চুমো দিয়ে সামনে থেকে সরে দাড়িয়ে হাসিমুখে বললো,

-দেখ কারা এসেছেন।

এতোক্ষনে ড্রয়িংরুমে চোখ বুলালাম আমি।অনেকগুলো অচেনা মুখ।এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে আমার দুগাল ধরে কাদতে কাদতে বললো,

-আমার অনিতার মেয়ে!

বিস্ময়ে মনিমার দিকে তাকালাম।মনিমা আস্তেকরে মাথা উপরনিচে নাড়লো।এটা আমার নানীমা।নানীমা জরিয়ে ধরলো আমাকে।আমিও তাকে জরিয়ে কাদছি।একটুপর আরেকজন উঠে এসে কাধে স্পর্শ করলো আমার।তারদিকে ফিরলাম।মনিমা বললো,

-তোর দাদীমা।

দাদীমা বলে তাকেও জরিয়ে ধরলাম।দাদীমা কাদছিলো না।হাসছিলো।তবে চোখে জল ছিলো তার।দাদীমা বললো,

-আমার আকাশের মেয়ে!একদম বাবার মতো হয়েছিস তুই বোনু!

-না সাবু।ও তো আকাশ অনিতা দুজনের মেয়ে।আহানিতা।তবে হয়েছে আমার মতো।তাইনা বোনু?

এটা অবশ্যই দাদু।এগিয়ে যেতেই সেও কেদে দিলো।তারপর চোখের পানি মুছে হাতের লাঠিটা সোফায় ঠেকালো।আমার গালে হাত রেখে বললো,

-এইতো আমার মতো,আমার নাতনি।

তার হাত চেপে ধরে শব্দ করে কাদতে লাগলাম আমি।দাদু বললো,

-আর কাদিস না বোনু।যাদের উপর অভিমান করছিলাম,তাদেরই তো হারিয়ে ফেলেছি আমরা।এখন তুই এভাবে কাদলে যে আমাদের অপরাধবোধ বাড়বে!

নাক টেনে চোখ মুছে নিলাম।হাসি ফোটালাম মুখে।বললাম,

-তোমরা হঠাৎ?

ওরা সবাই একটু আটকে গেলো।মনিমা বললো,

-কালকের নিউজটা দেখে আমিই কল করেছিলাম ওনাদের।তোকে একা সামলানোর সাহস হচ্ছিলো না।

দাদীমা বললো,

-তোর কাকু কাকিমা আসতে চেয়েছিলো।আমরাই আনি নি।সময় করে নিয়ে আসবো।

-হ্যাঁ হ্যাঁ দাদীমা।ও তুমি শুধু কাকু কাকিমা কেনো?তোমার গ্রামের ঝাড়সুদ্ধ নিয়ে এসো।সময় আমি করে দেবো।ডোন্ট ওয়ারি।

অঙ্কুরের কথায় বাকশুন্য হয়ে রইলাম।তবে ওনাকে দেখে আরো অবাক হয়েছি।গায়ের খয়েরি শার্টটার বদলে এখন কালো টিশার্ট,ট্রাউজার।কপালের সামনের চুলগুলো ভেজা।বোঝাই যাচ্ছে ফ্রেশ হয়েছেন সবে।উনি চেন্জ করেছেন!কোথায়?কখন?আমার বিস্ময়ের চাওনিকে না দেখে,বেশ সুন্দরমতো তার ড্যাম কেয়ার ভাব বজায় রেখে,মনিমার পাশে এসে তাকে একহাতে জরিয়ে দাড়ালেন।হাসিমুখে অঙ্কুরের বুকে মাথা ঠেকালো মনিমা।দাদু আমাকে ছেড়ে তার সামনে দাড়ালো।অঙ্কুর সুন্দরমতো হেসে সালাম দিলেন দাদুকে।দাদু বললো,

-কেমন আছো অঙ্কুর?

-ফার্স্টক্লাস জমিদারমশাই।আপনি?

-ভালো।এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে?

-মাকে ছাড়া ভালো লাগছিলো না।

-খেলেছো কিন্তু ভালোই।

-থ্যাংকস্।

মনে হলো দাদু ক্রিকেটভক্ত।আর অঙ্কুরের খেলারও।হয়তো মনিমা বলেছে,অঙ্কুর তার ছেলে,তাই এভাবে কথা বলছে।আর অঙ্কুর সবার সাথেই ফ্রিলি কথা বললেও দাদুর সামনে কিছুটা গুটিয়ে আছেন বলে মনে হচ্ছে।মনিমা বললো,

-আন্নু?তুই যা,ফ্রেশ হয়ে আয়।

মাথা নেড়ে চলে আসলাম ওখান থেকে।রুমে ঢুকে অঙ্কুরের লাগেজ দেখে আরেকদফা অবাক হলাম।ভেবেছিলাম হয়তো মনিমার রুমে থাকবে এগুলো।একটা শ্বাস ফেলে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখি দাদুর সামনে গুটিশুটি মেরে বসে কথা বলছেন অঙ্কুর।আমাকে দেখে দাদীমা বললো,

-আন্নু?আয় বোনু?এদিকে আয়?

এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলাম।নানীমাও পাশেই বসে।নানীমা আমার গালে হাত বুলিয়ে বললো,

-কতো বড় হয়ে গেছিস তুই!

দাদীমা বললো,

-হ্যাঁ।আমার আকাশের মেয়ে,সেও এতোবড় হয়ে গেছে!

-বড় হয়ে গেছে,বিয়ে দিয়ে দাও!

কথাটা বলে দাদুর দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন অঙ্কুর।দাদু বললো,

-ঠিকই বলেছো দাদুভাই।তবে এখনই না।সবে কাছে পেলাম ওকে,এখন তো আদরে আদরে ভরিয়ে রাখবো সবাই মিলে।শশুড়বাড়ি দেরিতেই পাঠাবো।

দাদুভাই হাসলো।অঙ্কুরের চেহারায় বিরক্তি।পরপরই একটা টেডিস্মাইল দিয়ে ডাক লাগালেন,

-মা?ও মা?মা?

মনিমা ছিলো না ওখানে।সারা বাড়ি কাপিয়ে হাক ছেড়েছেন উনি।অন্যকেউ,অন্যসময় হলে রাগ হতো আমার।কিন্তু মনিমাকে এভাবে ডাকছেন উনি,খুশি লাগছিলো।মনিমা হাত মুছতে মুছতে এসে বললো,

-কি হলো?এভাবে ডাকছিস কেনো অঙ্কুর?

মনিমাও স্বাভাবিক।তারমানে সিডনে যাওয়ার আগে সবটা ভালোভাবেই মিটমাট করে গেছেন অঙ্কুর।উনি বললেন,

-বয়স হয়েছে না তোমার?একা একা কিচেনে কেনো যাও বলোতো?এটাকে নিয়ে গেলেও তো পারো?

এটা বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন উনি।কিছুই বললাম না।উঠে দাড়িয়ে পা বাড়ালাম কিচেনের দিকে।মনিমা বললো,

-আন্নু?তুই থাক।অঙ্কুর?তুই তো জানিস আগুনে ফোবিয়া ওর।

-আগুনে ফোবিয়া।কিচেনের অন্য কোনো কাজে না।এটা ওটা এগিয়ে দিলেও তো পারে।এতো ননীর পুতুল বানানোর কি মানে?

দাদু মুখ খুললো এবার।বললো,

-আমার নাতনি কাজ কেনো করবে?আর আফরা?তোমারও কাজ করতে হবে না।আমি….

-আমি যাচ্ছি কিচেনে।তুমি শান্ত হও দাদু।সত্যিই তো,যেটুকো পারি সেটুকো করা উচিত আমার।

মনিমাকে টানতে টানতে নিয়ে আসলাম একপ্রকার।যেটুকোই করেছি,চুলা থেকে চারহাত দুরে দাড় করিয়ে রেখেছিলো আমাকে।এককাপ কফি আর তিনকাপ চা সাথে বিস্কুট দিয়ে বললো সবাইকে দিয়ে আসতে।ড্রয়িংরুমে আসতেই শুনলাম দাদু হাসতে হাসতে বলছে,

-তবে আমিও কিন্ত কাচা খেলোয়ার নই দাদুভাই।গ্রামগন্জের মাটি লেগে আছে এখনো গায়ে।চাইলে সে খেল দেখিয়ে তোমার পাত্তা কাটতেই পারি।

অঙ্কুর বাকা হেসে বললেন,

-তোমার থেকে এক্সপেক্টেশন বেড়ে গেছে জমিদারমশাই।বুড়ো বয়সেও এনার্জী যে ভালোই তা বেশ বুঝতে পারছি।শতহোক,আকাশ ইলিয়াসের বাবা,অদ্রির দাদু বলে কথা!এটুকো তেজ তো তোমাকেই মানায়!তবে এই জমিদারগিরি এখানে দেখিও না।এটার দখলদার পুরোটাই আমি।

এবার দুজনের কথার ধরন দেখে আজব লাগছিলো।আমার কিচেনে যাওয়ার পরপরই সবটা পাল্টে গেলো?চুপচাপ এগোলাম।টি টেবিলে ট্রে রেখে বাকিসবাইকে চা দিয়ে অঙ্কুরের সামনে কফিমগটা ধরলাম।উনি কিছু না বলে উঠে গেলেন ওখান থেকে।পকেটে হাত গুজে দুলতে দুলতে সোজা আমার ঘরে ঢুকেছেন উনি।দাদু,দাদীমা,নানীমা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।ইতস্তত করে বললাম,

-উ্ উনি ভেবেছেন ওটা মনিমার রুম।তাই….

একসাথে ও বলে চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো তিনজনই।কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে।এতোক্ষন অঙ্কুরের ব্যবহার আর এদের কথাবার্তা সবই তো স্বাভাবিক ছিলো।এটুকো সময়ের মধ্যে হুট করে কি হয়ে গেলো?সবটা অস্বাভাবিক লাগছে কেনো আমার?
#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৩০

-তোর বাবা তোর দাদুর অনুমতি ছাড়া বিয়ে করেছিলো বলে এতোগুলো বছর এতো রাগ ছিলো তার।এখন তোর বিয়েটাও তার অনুপস্থিতে হয়ে গেছে জানলে সে কতোটা রাগ করবে তার আন্দাজ করতে পারছিলাম।তাই তোর আর অঙ্কুরের বিয়ের ব্যাপারে ওদেরকে কিছু জানানোর সাহস হয়নি আমার আন্নু।আ’ম…আ’ম সরি।

ভুল বলেনি মনিমা।ঠিকই তো!বাবার‌ বিয়ে নিয়ে দাদুর রাগ ছিলো।সবেমাত্র তাদের কাছে পেলাম।এই চুক্তির বিয়ে,যা দুদিন পর ভেঙেই যাবে,এই বিয়েটা নিয়ে তাদের সাথে কোনো মনোমালিন্য চাইনা আমি।মনিমা আমার কাধ ধরে বললো,

-কিন্তু সত্যিটা তো সত্যিই আন্নু!ওনাদের তো জানাতে হবে!আমি অঙ্কুরকে ফোনে কিছুটা বলেছিলাম,তাই হয়তো ও চুপ আছে।তুই আগে ওকে বুঝিয়ে,তারপর দুজনে মিলে ভালোভাবে তোর দাদুকে বলে দে।তোরা বুঝিয়ে বললে সে ঠিক বুঝবে।

মাথা উপরেনিচে নাড়লাম।মনিমা কফির মগ আমার হাতে দিয়ে বললো,

-অঙ্কুরের সাথে কথা বলে দেখ ও কি বলে।এদিকটা আমি সামলাচ্ছি।

কথা তো বলতেই হবে।তবে বিয়ে সম্পর্কে দাদুদের জানানোর বিষয়ে না,বিয়েটা ভাঙার সম্পর্কে তোমাকে জানানোর বিষয়ে।কফিমগ নিয়ে রুমে ঢুকলাম।অঙ্কুর ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ নামাচ্ছেন।মগটা টেবিলে রেখে মাথা নিচু করে বললাম,

-আপনার কফি।

উনি একপলক তাকিয়ে ব্যাগ থেকে আরো জামাকাপড় নামানোতে মনোযোগ দিলেন।দু পা এগিয়ে বললাম,

-এসব এখানে কেনো নামাচ্ছেন?

…..

-এটা আমার ঘর সেটা জানেন?

…..

-আপনার মনিমার কাছে থাকার হলে এসব নিয়ে মনিমার ঘরে চলে যান।এখানে কেনো….

উনি নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই বললেন,

-বলেছি না?আমাকে প্রশ্ন করার অধিকার নেই তোমার।সাজেশন দেওয়ারও অধিকার দেইনি তোমাকে।

-বিষয়টা অধিকারের না,সাজেশনেরও না।বিষয়টা আপনাকে আপনার সীমা মনে করিয়ে দেওয়া।মনিমা বলেছে তো আপনাকে,বিয়ে নিয়ে দাদুরা কিছু জানে না।এখন আপনি আমার ঘরে ভুল করেই ঢুকুন,বা জেনেবুঝে,এ ঘরে থাকাটা আপনাকে মানায় না।ওরা গ্রা‌ম থেকে এসেছে।আপনার এ ঘরে থাকাটা নিয়ে আকাশকুসুম ভাবতেই পারে।

-হু কেয়ারস্?কে কি জানলো কি জানলো না তা এএসএ কেনো ভাববে?

-আই কেয়ার!তাদের জানা,মানা,বোঝা এগুলোই আমার কাছে মানে রাখে এখন।তারাই এখন আমার সব।কোনোভাবে,কোনোকিছুর বিনিময়ে তাদের হারাতে পারবো না আমি।আর এই মিথ্যে বিয়ের জন্য তো একদমই না!সো,ভালো এতেই,তারা সবটা যেমন জানে তেমনই জানুক।আর তেমনটাই ঘটুক!

উনি থেমে ভ্রুকুচকে তাকালেন আমার দিকে।বললেন,

-মানে?

-মানে এই চুক্তির বর বউ খেলা সম্পর্কে তাদের জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই।বরং মনিমাই জানুক বিয়েটা কিভাবে,কেনো হয়েছিলো।আর তারপর সিম্পলি ডিভ্….

মুহুর্তের মধ্যে ঠিক কি হয়ে গেলো,কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম আমি।একপ্রকার ছুটে এসে দুহাত পিছনে মুড়িয়ে ধরে,আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছেন অঙ্কুর।বিস্ময়ে তারদিকে তাকিয়ে আমি।এতো রাগের তো কিছুই বলি নি।কিন্তু তার চেহারায় রাগ স্পষ্ট বুঝতে পারছি।অঙ্কুর রাগ নিয়ে বললেন,

-কি বলতে চাও তুমি?

-আমি চাই এই চুক্তির বিয়ে সম্পর্কে দাদুরা কিছু না জানুক আর মনিমা সবটা জানুক!

-তোমার কোনো ধারনা আছে মা এসব শুনলে কি হবে?

-কতোদিন লুকোবেন?বিয়েটা তো দু বছরের,আমার সেইফটির কথা ভেবে করেছিলেন।এখন প্রদীপ সরকার জেলে।আই অ্যাম সেইফ নাও!আপনার বাসায় তো আর ফিরছি না আমি।তো সে দুবছর অবধি ভাববো কেনো?আপনিও তো ভাববেন না।তো তাকে তো বলতে হবে,আপনার আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন তাইনা?

অঙ্কুর আরো শক্তিতে নিজের সাথে আটকে ধরলেন আমাকে।মাঝে একচুল দুরুত্বও নেই আর।রাগে কপালের রগ ফুটে উঠেছে তার।দাতে দাত চেপে বললেন,

-জমিদারমশাইকে আসতে দেখে‌ তোমার মুখে বেশি বুলি ফুটেছে বলে মনে হচ্ছে?

-কথাগুলো ভুল বলিনি তো!তাছাড়া দাদু আসলেই কি,না আসলেই বা কি!আপনি জানেন অদ্রি সত্যি বলতে ভয় পায় না!আমারই ভুল ছিলো নিজেকে দোষী ভাবা।দোষটা তো আপনারও কম না!

-হাউ ডেয়ার ইউ?

-আমাকে ছাড়ুন!দরজা খোলা।কেউ দেখে নিলে…ছাড়ুন!

অঙ্কুর এবার ঠেলে কাবার্ডে আটকে দিলেন আমাকে।নড়াচড়া করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।পারিনি।হাতে ব্যথাও পাচ্ছি।কটমটে চোখে তাকিয়ে বললাম,

-ছাড়তে বলেছি আপনাকে!

-ছাড়বো না!

ওনার সোজা জবাবে আর কিছুই বলার পেলাম না।নিজের মতো করে গায়ের জোর খাটাতে লাগলাম।উনি বললেন,

-এতো চালাক রিপোর্টার হয়েও আমার মতো সামান্য স্পোর্টম্যানের সাথে বুদ্ধির জোরেই পারলে না পর্বতশৃঙ্গ!গায়ের জোরে পারবে এমনটা ধারনা করাও ভুল।লিভ ইট!

-ছাড়ুন আমাকে!

-ইউ কান্ট অর্ডার মি!

উনি‌ চেচিয়ে বললেন কথাটা।একটু কেপে উঠলাম।কিছুক্ষন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অঙ্কুর গলা নামিয়ে বললেন,

-আমার এতোটা কাছে থেকেও তোমার এই চোখ তুলে তাকানো,এই কড়া গলায় কথা বলা,এসব সহ্য হয়না আমার অদ্রি।কন্ট্রোল‌ দেম!অর আ’ইল লুজ মাই কন্ট্রোল অভার মি!

-কি বলতে কি চাইছেন আপনি?

অঙ্কুর ঝুকলেন অনেকটাই।চোখ খিচে বন্ধ করে অন্যদিক ফিরলাম।ওনার উষ্ণ শ্বাস গলায় লাগছে আমার।দম আটকে আসছে।আচমকাই হৃদপিন্ডটা যেনো লাফাতে শুরু করেছে।উনি ফিসফিসিয়ে বললেন,

-কিছু না।তবে এগুলোকে খুব বেশিদিন চলতে দেবো না অদ্রি।কেড়ে নেবো তোমার এই মাত্রাতিরিক্ত সাহস।সাহসের স টাও অবশিষ্ট রাখবো না তোমার।চোখ নামিয়ে নুইয়ে‌ যেতে হবে তোমাকে।বাধ্য হবে তুমি।জাস্ট লাইক দিস ওয়ে।দেখে নিও!

উনি ছেড়ে দিলেন আমাকে।এতোক্ষনে শ্বাস নিলাম আমি।বুকে হাত দিয়ে জোরেজোরে শ্বাস ফেলছি।অস্থির লাগছে।অঙ্কুরের দিকে তাকাতেই তার টেডিস্মাইল।একহাতে লাগেজ টেনে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন উনি।গলা উচিয়ে বললাম,

-খালি হাতে কফিমগটাও নিয়ে যান?আপনার জন্য বারবার এ ঘর ও ঘর করতে পারবো না!

উনি থামলেন।পেছন ফিরে বললেন,

-করতে হবে না।আমি আর মা কালই বাসায় ফিরছি।

একদন্ড না দাড়িয়ে অঙ্কুর বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।পাথর হয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলাম।পানি গরাতে লাগলো চোখ দিয়ে।অনেকগুলো কড়া কথা শুনিয়েছি তাকে।কিন্তু সেও তো আমাকে কঠোরতাই ফেরত দিয়েছে।উনি নিশ্চিত,বিয়েটা ভেঙে দেবেন।সবটা জানলে মনিমা কি বলবে?আমার কি হবে?আমি কি করে থাকবো?মনিমাকে ছাড়া।অঙ্কুরকে ছাড়া!

.

ডিনার শেষে মনিমার সাথে আমার ঘরে‌ নিচে বিছানা করে শুয়েছি।বেডে দাদীমা,নানীমা।ওরা অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।অঙ্কুর আর দাদু মনিমার ঘরে ঘুমিয়েছেন।মনিমা শুয়ে শুয়ে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তাকে জরিয়ে ধরে শুয়ে আছি।এই কপালটাও শুধু আজ রাতের জন্য।বুক ভারি হয়ে আছে।হয়তো কাল থেকে মনিমার সামনে যাওয়ারও অনুমতি থাকবে না আমার।কিভাবে থাকবো তাকে ছাড়া?কিভাবে এই চুক্তির বিয়ের সত্যিটা তাকে বলবেন অঙ্কুর?কিভাবে সেই বা মেনে নেবে সবটা?মনিমা আমার কপালে চুমো দিয়ে বললো,

-জায়গাটা কেমন ছিলো আন্নু?তোরা দুজনে ঘুরেছিস তো?নাকি অঙ্কুর শুধু প্র্যাকটিস নিয়েই ছিলো?

-সবটা ভালো ছিলো মনিমা।

-তোর দাদুকে বলার বিষয়ে অঙ্কুর কি বললো রে?

-উনি বলেছেন সময় হলেই বলবেন।

-জানিস তো,আমি তো স্পষ্ট দেখেতে পাচ্ছি,অঙ্কুর তোর দাদুকে তোদের বিয়ের কথা বলেছে,আর তোর দাদু লাঠি নিয়ে ধাওয়া করতে শুরু করেছে ওকে।এতো তাড়াতাড়ি নাতনির কাছছাড়া হয়ে যাবে সে রাগে!

মনিমা হাসলো।তারপর আবার বললো,

-আমিও তোকে ছাড়া থাকতে পারতাম না আন্নু।কষ্ট হতো।উপর ওয়ালাও দেখ চায়না,আমি আর কষ্ট পাই।তাইতো অঙ্কুরের সাথেই তোর বিয়েটা হয়েছে বল?

চুপ থেকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম মনিমাকে।মনিমা বললো,

-ভয় পাস না!লক্ষ্মী মেয়ে আমার!তোর দাদু ঠিক বিয়েটা মেনে নেবে দেখিস।একদম চিন্তা করিস না।

টুপ করে চোখের জল বেরিয়ে এলো।মুছে নিলাম।মনিমা আবারো কপালে চুমো দিয়ে বললো,

-এখন ঘুমিয়ে পর।অনেক রাত হয়েছে।

অনেকটা সময় পর হাত থেমে গেলো মনিমার।ঘুমিয়ে পরেছে।উঠে বসে তাকিয়ে রইলাম তারদিকে।এই মানুষটা নিজের সব ছেড়ে আমাকে বড় করলো,এতো ভালোবাসা দিলো।কখনো বুঝতেও দেয়নি তার মনে কতো কষ্ট।আজ যখন সেগুলোও পুষিয়ে যাচ্ছে,আমাকেই এখন তার জীবন থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে।রাত কতো গরিয়েছে হিসেব নেই।বাইরে থেকে দুবার ঠুসঠাস আওয়াজ এলো।দাদু বয়স্ক লোক,তার কিছু লাগতে পারে ভেবে আস্তেধীরে বেরিয়ে আসলাম রুম থেকে।কিন্তু রুমের বাইরে এসে দেখি অঙ্কুর অন্ধকারেই একহাতে কপাল চেপে ধরে ড্রয়িংরুমের মিনি কাবার্ডের ড্রয়ার টানাটানি করছেন।এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-মাঝরাতে এরকম শব্দ করছেন কেনো?বাসায় তিনজন বয়স্ক মানুষ আছে।ঘুমোচ্ছে তারা।এভাবে শব্দ করলে জেগে যেতে পারে,মনে হলো না একবারও?

অঙ্কুর থামলেন।আমার দিক ফিরে বললেন,

-মাথাব্যথার ওষুধ কোথায়?

-প্রায়ই বলেন মাথাব্যথা হয়।ভালো ডক্টর দেখান না কেনো?

-তোমার তাতে কিছু যায় আসে?

…..

-অকারনে মাথাব্যথা হয় না আমার।

উনি আবারও ড্রয়ারে খোজাখুজি শুরু করলেন।কথা না বাড়িয়ে ওষুধের বক্স আনতে গেলাম।ওটা মনিমার ঘরে।গিয়ে দেখি দাদু চরম আওয়াজে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।পুরো বিছানা,ঘর কেপেকেপে উঠছে যেনো।ভুল বলেন নি অঙ্কুর।এই শব্দে দুমিনিট বসলে আমার মাথা ফেটেই যাবে।বক্স খুলে দেখি মাথাব্যথার ওষুধ নেই!গুটিগুটি পায়ে আবারো ড্রয়িংয়ে ঢুকলাম।অঙ্কুর তীব্র বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-ওই বক্স চেক করেছি আমি।অন্যকোথাও নেই?

-না।

উনি কপাল ধরেই সোফায় বসে পরলেন।একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

-এ্ এতো রাতে কফি খেলে ঘুম হবে না আপনার।

-ডোন্ট গিভ দিস লেইম এক্সকিউজ!কিচেনে যাবে না সেটা বলো।কফি খেলে ঘুম হবে না আপনার!

আমাকে ভেঙচিয়ে কথাটা বললেন উনি।কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলাম।উনি বিরক্তি নিয়েই বললেন,

-যাও ঘুমিয়ে পরো!আমি ড্রয়িংয়ে সোফাতেই অন্তত শান্তিমতো ঘুমাই?যাও!

কুশন মাথার নিচে দিয়ে বড় সোফাটায়‌ গুটিয়ে শুয়ে পরলেন উনি।এপাশ ওপাশ করছিলেন।চোখের উপর হাতের পিঠ রেখে বলে উঠলেন,

-যাচ্ছো না কেনো?

চুপচাপ সামনে থেকে সরে ওনার পিছন দিকটায় দাড়ালাম।উনি তখনো উশখুশ করছেন।এগিয়ে গিয়ে আস্তেধীরে মেঝেতে তার সামনে বসে পরলাম।কপালের উপর থেকে হাতটা নামাতেই চোখ খুলে ফেললেন উনি।ধীর গলায় বললাম,

-আপনি‌ ঘুমোন,আ্ আমি হাত বুলিয়ে…

-আবারো নাটক?

চোখ ভরে উঠলো আমার।উনি চোখ বন্ধ করে বললেন,

-মজা করেছি।জানি এখন নাটক করে আর হাসিল করার কিছু নেই তোমার।যাই হোক,নিজে থেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছো!একরাতের জন্য পতিব্রতা হয়ে গেলে নাকি?

এটুক থেকে আমাকে বঞ্চিত নাই বা করলেন অঙ্কুর।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলে দিলাম,

-একরাতের জন্যই তো!শেষবারের মতো!

ধ্যান ভাঙতেই অঙ্কুরের ঠোটের মুচকি হাসিটা চোখে পরলো।চোখ নামিয়ে নিলাম।আমার দিকে পাশ ফিরে দুহাত মাথার নিচে গুজে শুয়ে পরলেন উনি।একদম বাচ্চাদের মতো।চুপচাপ তার মাথায় হাত বুলিয়ে খুতিয়ে খুতিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে।তার কথা জানিনা,তবে আমার বড্ড শান্তি লাগছিলো।

#চলবে…
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here