সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -০২+৩

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২

মা’কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার অন্য চাচি আর ফুপিদের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। মা ছোট থেকেই আমায় বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য মা বলছি কেন? আমার পরিবারের প্রতিটা সদস্য আমায় একটু বেশিই ভালোবাসে। যেখানে নিজের অক্ষমতার জন্য অন্যদের কথা শুনতে হয় পরিবার থেকে,সেখানে আমার পরিবার সব সময় আমায় সাপোর্ট দিয়ে পাশে থেকেছে। হয়তো এই জন্যই বলে! দুর্বল সন্তানেরা বোঝা হয়, না-হয় একটু বেশিই স্পেশাল হয়। আমি ঠিক সেই স্পেশাল মানুষ। আমার পরিবার আমাকে সব সময় বটবৃক্ষর মতো ছায়া দিয়ে পাশে থেকেছে। সব সময় আমাকে সাহস দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পথ চিনিয়েছে। তাই প্রকৃতির নিষ্ঠুরতম আঘাত আমি আস্তে আস্তে মেনে নিয়েছি। তাই এখন আমাকে কেউ প্রতিবন্ধী বলে খোঁটা দিলে খারাপ লাগে না। আর বড় হওয়ার সাথে সাথেই আমার নিজের এই অক্ষমতার জন্য আফসোস হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আজ আমার মনে হয়! আল্লাহ কিছু অপূর্ণ রাখেন অনেকটা দিয়ে পূর্ণ করার জন্য। আমার বাবা-র পুরো পরিবারটা অনেক বড়। দুই ফুপি আর আমার বাবা-রা তিন ভাই৷ তাঁরা মোট পাঁচ ভাইবোন। বড় ফুপি রোকেয়া,তাঁর এক ছেলে। যে বর্তমানে সৌদি প্রবাসী, স্বামী মৃত! তিনি আমাদের সাথেই থাকেন। তারপর আমার বাবা মন্নান,তার ছেলে মেয়ের কথা তো আপনারা জানেন। মেজ চাচ্চু শাহাজাহান, স্ত্রী পারভীন, ছেলে-মেয়ে দু’জন। ছেলে বড়, যে আমার চুল টেনেছিলো বর্ণভাই, আর মেয়ে আয়শা ক্লাস টেন। ছোট ফুপি সেলিনা,তার তিনজন ছেলে-মেয়ে। দুজন জমজ, সাথী আর পরশ,দু’জনেই আমার সমবয়সী। আর নয়ন সবার ছোট ক্লাস নাইন । স্বামী সন্তান নিয়ে ছোট ফুপি সিলেট থাকে। ছোট চাচ্চু কামরুল, তাঁর স্ত্রী নাসিমা বেগম। বড় মেয়ে মিম,আর ছেলে নাজিম ক্লাস থ্রি। সবার পরিচয় দেওয়া শেষ। এবার আমার সম্পর্কে বলি। অনেকেই ভাবছে,আমি কথা বলছি হাঁটছি তাহলে তখন চাচি আমায় প্রতিবন্ধী বললো কেন? কারণ আমার বা-হাতের দু’টো আঙুল নেই। কনিষ্ঠা আর অনামিকা নামের যে আঙুল দু’টো আছে, সেটা আমার নেই জন্ম থেকেই। শারীরিক ভাবে কেউ অক্ষম হলে তাঁকে প্রতিবন্ধী বলে এটা আমরা সবাই জানি। ঠিক তেমনই আমাকে সবাই প্রতিবন্ধী বলেই মাঝে মাঝেই আঘাত করে। অবশ্য আগে অনেক কষ্ট লাগতো। এখন লাগে না। আমার জীবনের একটা ঘটনা বলি আপনাদের। আমি তখন ছোট, ক্লাস ফোরে পড়ি। ক্লাসের বন্ধুরা হাত গোনাগুনতি খেলা খেলছে। আমি খেলতে চাইলে ওরা সবাই হেঁসে গড়াগড়ি খেতে রইলো। আমি নিজের কান্না আঁটকে জানতে চাইলাম? তোরা হাসছিস কেন? তখন ওরা বললো– “আমাদের সবার দশটা আঙুল তোর আটটা! বাকি দু’টো খেলার সময় তুই কোথায় পাবি? কারো থেকে কি ধার নিবি?” খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। আর ওই শেষ কষ্ট ছিলো আমার। আমার পুরো পরিবার সেদিন থেকে আমাকে ফুল ফীল সাহস দিতে রইলো। যে আঙুল গোনাগুনতি খেলা নিয়ে ওরা আমার সাথে ঠাট্টা করেছিলো। সেই খেলা
খেললো আমার সাথে আমার পুরো পরিবার। আমার বাবা-র আমার পক্ষে খেলা,বড় বোনের খিলখিল শব্দের হাসি,বড় ভাইয়ের চুরি করে আমাকে জিতিয়ে দেওয়া, মায়ের হাতের ঝালমুড়ি! এক নিমিষেই আমার সকল কষ্ট দূর করে দিয়েছে সেদিন। তারপর আর কখনো নিজের এই কমতির জন্য আফসোস হয়নি। কিন্তু হ্যা কষ্ট হয়েছে। যে কষ্টটা আমাকে সমাজের মানুষ গুলো দিয়েছে। তাঁরা আমায় অপয়া বলেও গালমন্দ করেছে। নিজের শরীরটা আস্তে আস্তে গন্ডারের চামড়ার মতো তৈরি করলাম। কেউ কিছু বললে গায়ে লাগাতাম না।পরের কথাগুলো তো হেঁসে কিনবা এরিয়ে যাওয়া যায়! কিন্তু আপন মানুষ গুলোর কথা কিভাবে ভোলা যায়। এই যে আমাদের সাথে থাকা আমার বড় ফুপি। তিনিও আমার জন্মের দিন বলেছিলো। মন্নান একে তো মেয়ে তার সাথে প্রতিবন্ধী একে পেলেপুষে লাভ হবে না। তাঁর থেকে মায়া বারানোর আগে কোন এতিমখানায় দিয়ে আয়। আমার বাবা মুখের উপর না করে দিয়েছিলো সেদিন। কিছু কড়া কথাও নাকি ফুপিকে বাবা শুনিয়েছিলো। ফুপি নাকি রাগ করে সেই থেকে আর আমাদের বাড়িতে আসেনি! এমন কি একটা বারের জন্য ফোনও করেনি। অবশ্য তখন বাবা ইচ্ছে করেই যোগাযোগ করেনি। বাবা বলেন। যে আমার রহমতকে বিদায় করতে চেয়েছে, তাঁর খোঁজ নেওয়া আমার দায়িত্ব নয়। আজ সময়ের চাকা ঘুরে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেই ফুপির চোখের মনি আজ আমি! যাকে কিনা একদিন এতিমখানায় রেখে আসতে বলেছিলো। আসলে সময়ের চাকাটা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আবারও বারোর ঘরে গিয়ে ঠেকে। যেই ঘর কারো সুখ বয়ে আনে, আনে কারো সর্বনাশ। এমন এক বারো ফুপির জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছিলো। ছেলে বিদেশ যাবার এক মাসের মাথায় ফুপা মারা যায়। নিশ্ব হয়ে পড়ে ফুপি। তারপর আমি আর বাবা গিয়ে ফুপিকে কুমিল্লা থেকে খুলনা নিয়ে আসি। বাবা সেদিন আমাকে দেখিয়ে ফুপিকে বললো। ওর জোরাজুরিতেই আজ তোমাকে নিতে আসা আপা। কারণ সে চায় না তুমি একা এখানে পড়ে থাকো। অথচ দেখো,তুমিই একদিন এই মেয়েকে এতিমখানায় রেখে আসতে বলেছিলে। সেদিন যদি ওকে রেখে আসতাম! তাহলে কে আসতো তোমায় আজ নিতে?ফুপির ভুল সেদিন ভেঙে গেলো। আমাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। এগালে ওগালে চুমু খেয়ে ক্ষমা চাইলেন। যে ভুল তিনি আমার শিশুকালে করেছিলেন,সেই ভুলের ক্ষমা চেয়ে আমায় অপরাধী বানাতে চাইছিলেন। আমি ফুপির হাত জড়িয়ে বলেছিলাম। যা আমার অজান্তেই করেছিলেন সেটা না-হয় সেভাবেই থাকুক। কষ্টটা আমার থেকে বাবা-মা পেয়েছিলো। আমি তো তখন দুধের অবুঝ শিশু। খারাপ ভালো বোঝার ক্ষমতা ছিলো না। এটা ঠিক আপুর থেকে ওই ঘটনা শুনে আমার খারাপ লেগেছে। কিন্তু বিশ্বাস করেন ফুপি খারাপ লেগেছে কষ্ট বা আফসোস কোনটাই হয়নি। আমি জানি আজ থেকে অন্য সবার থেকে আমি আপনার সব থেকে প্রিয় ভাইয়ের মেয়ে হবো। হ্যা সত্যি সেদিন থেকে আমি ফুপির প্রিয় হয়ে গেলাম। এই যে ছোট চাচি আমায় কথা শোনাল। এটা যদি বড় ফুপি শুনে! আল্লাহ মালুম কি বলে তাঁকে।

_ কিরে ছোট শয়তানের চাচাতো বোন। এখানে বসে কি ভাবিস। তোর ওই ভাবুক চেহারা দেখে তো পুকুরের জল লজ্জা পাবে।

বেস উনারি কমতি ছিলো এখানে আসার। আপনাদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন পুকুর পারে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। এই একটা মানুষ যার সাথে কথা কম ঝগড়া হয় বেশি । কেন জানি ছোট থেকেই আমি উনাকে সহ্য করতে পারি না। তাঁর বিশেষ কোন কারণ অবশ্য আজও খুঁজে বের করতে পারিনি।

_ কিরে কথা বলিস না কেন? কি ভাবিস এতো ভাবুক হয়ে। জয়নুল আবেদীনও মনে হয় তোর মতো এতো ভাবেনি।

_ আচ্ছা বিয়ে বাড়িতে আপনার কোন কাজ নেই?

_ আছে তো?

_ কি কাজ? আর যদি থেকেই থাকে তাহলে সেগুলো বাদ দিয়ে এখানে কি করছেন?

_ কেন? কাজ করছি।

_ কই কাজ করছেন? আমি তো দেখছি না।

_ কেন? তোর পিছনে লাগাও তো একটা কাজ। তোর মতো অকর্মা ঢেঁকির পিছনে লাগাও কম বড় কাজ নাকি।

_ আপনাকে কে বলেছে আমি অকর্মার ঢেঁকি।

_ তাহলে তুই কি সেটা নিজেই বল। বাড়িতে এতো কাজ থাকতে,তুই কেন শুধু ভাবনা-ভাবনির কাজ করিস।

_ তাতে আপনার কি? আপনার কোন সমস্যা?

_ ছোট বেলায় আমার কোল ভরে যে কবার সিসু করেছিস ,তাতে যদি কোন সমস্যা না হয়ে থাকে! তাহলে আজ কেন হবে?

আবারও সেই এক প্রসঙ্গ টেনে কথা বলছে! আল্লাহ উনার কি কোন কাজ নেই এই বাড়িতে আমাকে পঁচানো ছাড়া। আমি একটু ইনোসেন্ট মুখ করে বললাম।

_ বর্ণ ভাই আপনি আমাকে এভাবে কেন পঁচান?

_ বিয়ের ভূত ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেল আর পঁচাবো না।

_ বিয়েটা আপনার চাচা ঠিক করেছে আমি না।

_ তুই না করে দিবি।

_ আমি কোন দাবিতে না করবো?

_ কেন? তুই বলবি, তুই পড়াশোনা করতে চাস।

_ ছেলে বাহিরের দেশে নিয়ে আমায় পড়ালেখার সুযোগ করে দিবে।

_ এমন সবাই বলে, কিন্তু কেউ আসলে করে না।

_ আপনি কি কোন ভাবে আমাকে এটা বলতে চাইছেন,তাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখবে না?

_ হতেও তো পারে।

_ হবে না।

_ তুই এতো সিউর কি করে?

_ ছেলেটার সাথে আমার মাঝে মাঝেই কথা হয়। সেখান থেকে জানি।

_ ও বাবা এরমধ্যে ফোনেও কথা হয়।

_ না হওয়ার কি আছে বুঝলাম না।

_ তুই তো কোনদিনও বুঝিস না?

_ কি বুঝলাম না,সেটাই তো বুঝলাম না?

_ কিছু না। যা তো সামনে থেকে, মেজাজটাই পুরো বিগড়ে দিলি।

_ আল্লাহ, আমি কী করে আপনার মেজাজ বিগড়ে দিলাম?

_ তুই কি করে বুঝবি,তুই তো সব সময় আমাদের এরিয়ে যাওয়া মানুষ।

_ আমি কখনোই কাউকে এরিয়ে চলি না বর্ণ ভাই।

_ সত্যিই কি তাই? তাহলে গেছে জুনে যখন আয়শার বার্থডেতে তোকে আমি বারবার অনুরোধ করলাম আসার জন্য, কিন্তু তুই এলি না। বললি তোর সামনে পরীক্ষা এখন কোথাও তুই যেতে পারবি না। আসলেই কি তোর পরীক্ষা ছিলো?

বর্ণ ভাইয়া প্রচুর চালাক। তাঁকে মিথ্যা বলেও আমার লাভ হয়নি কোনদিন। জানি আজ বললেও হবে না। কিন্তু যদি বলি মেজ চাচির কথার জন্য যাইনি বেপারটা তাহলে উল্টে যাবে। তাই একটু মিথ্যা বললাম।

_ তখন আমার শরীর ভালো ছিলো না।

_ হা হা হা হা

_ আশ্চর্য এখানে হাসার মতো কি বললাম?

_ মিথ্যা। সে যাইহোক ওখানে মিম তোকে ডাকছে। গায়ে হলুদ লাগাতে যাবি না?

_ না

_ কেন?

_ এমনি।

_ আরে চল্ চল্।

চল্ বলেই বর্ণ ভাই আমার হাতটা ধরে পুকুর পার থেকে বাড়ির ভেতরের দিকে রওনা দিলেন। কিন্তু বর্ণ ভাই কি জানে? তাঁর মা আমাদের এভাবে দেখলে কথার ছুঁচে আমার বুকটা এফোড় ওফোড় করে দিবে। এই কঠিন সত্যটা বর্ণ ভাই হয়তো জানে না। জানলে কখনোই আমার হাত ধরার সাহস পেতো না। কারণ বর্ণ ভাই তাঁর মা’কে প্রচুর ভালোবাসে। আর সেই ভালোবাসা থেকেই শ্রদ্ধা,ভয় সবটাই করে তিনি তাঁর মা’কে।

_ এখানে কি করছো বর্ণ তুমি?

আমার ভাবনা শেষ হয়নি। কিন্তু তাঁর আগেই পারভীন চাচি আমাদের সামনে। আমার বুকটা ধক করে উঠলো। আজও আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না পারভীন চাচির কথার আঘাত থেকে। আমাকে শুনতে হবে তাঁর নিচু স্বরের কিছু বিচ্ছিরি ভাষা। যে ভাষাগুলো শুনে আমার চোখ থেকে জল আপনা-আপনি গড়িয়ে পরবে।
#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৩

মেজ চাচির প্রশ্নে বর্ণ ভাই ধরে রাখা আমার হাতটা ছেড়ে দিলো। কিছুটা এগিয়ে তাঁর মায়ের সামনে দাঁড়ালো।

_ মা মিম ওকে ডাকছে,তাই আমি খুঁজতে এসেছিলাম।

_ আচ্ছা, তুমি যাও। তোমাকে তোমার বাবা ডাকছে। আমি আর নদী আসছি।

_ আচ্ছা মা

বর্ণ ভাইয়া চলে গেলেন। বর্ণ ভাইয়া চলে যেতেই চাচি নিজের আসল রূপে ফিরে এলেন। চোখ গরম করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে। অবশেষে তিনি ব্যর্থ হলেন। তাই তো তিনি আমার বা-হাত চেপে ধরে ছুরে দিলেন তাঁর মুখের বিচ্ছিরি ভাষা।

_ কিরে নষ্টা মেয়ে,এখানে এসেই আবার নষ্টামি শুরু করে দিয়েছি। আর কোন ছেলে পেলি না তুই? বেছে বেছে আমার ছেলেকেই তোর নজরে পরলো। নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে! তোর লজ্জা শরম কিছু নেই নাকি? তুই আবারও আমার ছেলের পিছনে ঘুরঘুর করছিস।

আমি অবাক হয়ে যাই বরাবরই চাচির কথা শুনে। তিনি কিন্তু ভালো করেই জানে আমি কখনোই বর্ণ ভাইয়ের পিছনে ঘুরি না। তবুও আমাকে কথা শোনায়। আচ্ছা চাচি এমন করে কেন আমার সাথে? আমি প্রতিবন্ধী বলে? সে যাইহোক আমার তিনটে আঙুল চাচি খুব জোর দিয়ে চেপে আছে। যাঁর জন্য আমি ব্যথা পাচ্ছি। আমি নিজের হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

_ চাচি আমার হাতটা ছেড়ে কথা বলুন।

_ হে’রে বেহায়া মেয়ে,নিজের অক্ষমতা লুকিয়ে, শরীরর দেখিয়ে পুরুষকে কাবু করা কোথা থেকে শিখলি?

আমার হাতটা তো চাচি ছাড়লো না। উল্টে আরো শক্ত করে ধরে কথাটা বললো।

_ চাচি,বিয়ে বাড়িতে আপনি হয়তো খেয়াল করেননি! সব থেকে শালিন পোষাকটা আমি পড়ে আছি। আর কথায় কথায় আমাকে নষ্ট, বেহায়া,নির্লজ্জ না বলে নিজের ছেলেকে একটু সামলে রাখবেন। কারণ, নিষিদ্ধ জিনিসে মানুষের আকর্ষণ বেশি। আপনার কথায় বোঝা যায়, আমি কিন্তু আপনার ছেলের জন্য নিষিদ্ধ! তাই আমার প্রতি তাঁর আকর্ষন বেশি। এখন এই আকর্ষণ ক্ষণিকের নাকি স্থায়ী আমি জানি না। তাই দয়া করে অন্য কারো দায় আমার উপর চাপাবেন না।

_ বেয়াদব মেয়ে, তুই আমাকে শিখাবি আমার ছেলেকে আমি কিভাবে সামলে রাখবো।

কথাটা বলেই চাচি নিজের বড় বড় নখগুলো দিয়ে আমার নরম হাতটা আরো জোরে চেপে ধরলো। ধারালো নখ আমার নরম চামড়া কেটে দিলো। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে রইলো রক্ত। খুব কষ্ট হলো তখন। চাচি সব সময় আমার বা-হাতটা এভাবেই আঘাত করে। মানুষটা এমন কেন করে আমার সাথে? আমি তো কখনোই বর্ণ ভাইকে বলিনি, যেন তিনি আমার পিছন পিছন ঘোরে। তবুও তিনি ঘুরে। আর তাঁর ফলাফল পেতে হয় আমাকে। আমি বহু কষ্টে হাতটা ছাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিলাম। অসম্ভব জ্বালা করছে হাতে। আমার দু-চোখ ভরে জল নামলো বৃষ্টির ধারার মতো। আমি কেঁদেই দিলাম। কান্নার জন্য আমি কথা তুলতেই পারছি না গলা থেকে। তবুও বললাম।

_ চাচি আপনি ভালো করেই জানেন আমি কেমন? তবুও কেন আমার সাথে এমন করেন? বিশ্বাস করেন চাচি, আমি আমার সীমাবদ্ধতা কখনোই অতিক্রম করিনি। তবুও আমাকে এর জন্য কথা শুনতে হয় প্রতিনিয়ত। আপনি প্রতিবার আমার চরিত্রে কাঁদা ছেটান। অথচ আপনি নিজেও জানেন আমি কেমন? তবুও আপনি আমার সাথে এমন করেন কি জন্য? কেন? কেন চাচি? আমি তো ভালোই আছি আমাকে নিয়ে। তাহলে আপনি কেন আমার চরিত্র নিয়ে বারবার কথা শোনান। আর আমার সামনে এক চেহারা নিয়ে আসেন! আর বাড়ির অন্য সবার সামনে ভিন্ন। কেন? তাঁরা কি আপনায় মেরে ফেলবে? নাকি আমার মা’কে ভয় পান আপনি? ভয় পান আমার বড় ভাইকে। আমি জানি আপনার দুর্বলতা কোথায়। কিন্তু আমি তো কখনোই আপনায় কথা শোনাই না সেগুলো নিয়ে । তাহলে আপনি কেন শোনান আমার অক্ষমতার জন্য ? চাচি আগেও বলেছি, আজও বলছি! আমাকে টাইট দিতে গিয়ে নিজেই নিজের পাপ বারাবেন না দয়া করে।

_ মেয়ে তুই–

_ কিরে নদী তুই এখানে? আর আমি তোকে পুরো বাড়ি খুঁজে মরছি।

আমার বড় বোন ঝর্ণাকে দেখে আমি নিজের হাতটা আড়াল করে নিলাম,সাথে চোখের জল। এখন আমার হাতে নখের আঁচড় দেখলে বিয়ে বাড়িতে অশান্তি বাড়বে বৈ কমবে না। এমনই ছোট চাচির সাথে মায়ের ছোটখাটো একটা ঝগড়া হয়ে গেছে। আর মেজ চাচির এই বেপারটা নতুন নয়। তিনি সবার সামনে এক রূপ ধরে রাখে! সবাই চলে যেতে আবারও নিজের আসল রূপে ফিরে আসে। যে রূপটা শুধুমাত্র আমার জন্য তিনি তুলে রাখেন। আমি আপুকে কিছু বলতে না দিয়ে আপুর হাত ধরে ওখান থেকে চলে এলাম।

_ কিরে এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?

_ এই না বললে আমাকে খুঁজছিলে?

_ হুম,কিন্তু তুই এখানে কি করছিস?

_ কিছু না।

_ তুই কি কেঁদেছিস নদী? কোনভাবে কি ছোট চাচি তোকে কিছু বলেছে?

আপুর কথায় মাথা এদিক ওদিক ঘোরালাম। আপু কী ধরে ফেললো নাকি? কিন্তু ব্যথা তো ছোট চাচির থেকে মেজ চাচি বেশি দিলো। কিন্তু সেটা তো আমি কখনোই কাউকে বলতে পারিনি। মানুষটা এমন করে আমায় আদর করে সবার সামনে! যে তাঁর এটাই যে আসল রূপ তা কেউ বুঝবেই না। কোন রকমে সামলে নিলাম নিজেকে।

_ না আপু। আসলে ময়নার কথা খুব মনে পড়ছে। ওর কথাগুলো মিস করছি। কখনো তো ওকে ছাড়া কোথাও এক বেলার বেশি থাকা হয়নি। তাই মন খারাপ লাগছে।
ময়না পাখি। আমার আড়ালে লুকিয়ে রাখা যতো সুখ, দুঃখ আছে! সব কিছুর সাক্ষী। আমার বলতে না পারা কথাগুলো শোনার সাথী।

_ ওলে বাবুটা আমার। আমি তো জানতাম তোর কষ্ট হবে। তাই তো তোকে বললাম নিয়ে চল। কিন্তু তখন তো বললি খুব পারবি৷ এখন, এখন কি হবে? থাক বাবুটাকে একটা নতুন ময়না কিনে দিবো দুদিনের জন্য । হবে।

_ না,নতুন দরকার নেই। আমি বাড়ি গিয়েই ওর সাথে কথা বলবো।

_ আচ্ছা সোনা বনু আমার। চল্ চল্ সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

যাক আপুকে বোঝাতে পেরেছি। এবার আর আমাকে প্রশ্ন করবে না। বাড়ির সবাই জানে ময়নার প্রতি আমার দুর্বলতার কথা। বড় ভাইয়া আমার বারোতম জন্মদিনে এটা উপহার দিয়েছিলো। আজও আমি যত্ন করে রেখেছি। পিছনে তাকালাম একবার। তখন দেখলাম চাচি নিজের হাত মুচড়ে নিজের রাগ সংযোত করছে। আমি মনে মনে হাসলাম। মানুষটা এমনই করে। আমাকে মন মতো কিছু বলতে না পারলে শান্তি নেই তাঁর । কিন্তু উনি কি শুধুমাত্র বর্ণ ভাইয়ের বেপারটায় আমার উপর রাগ,নাকি অন্য কোন কারণ?

——————–

বিশাল উঠানের এক কোণে মিমের গায়ে হলুদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্য দিকে বাবুর্চীদের রান্নার জায়গায়। ছোট ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করে খেলা করছে। আর বাবুর্চীদের রান্নার একটু দূরে চেয়ার পেতে খোশগল্প করছে মন্নান সাহেব,শাহাজাহান সাহেব,কামরুল সাহেব সাথে বোন জামাই নজরুল। তাদের খোশগল্পে অংশগ্রহন করলো বর্ণ। সে তাঁর বাবা-র কাছে এগিয়ে গেলো।

_ বাবা তুমি আমায় ডাকছিলে?

_ কই না তো।

_ কিন্তু মা যে বললো।

_ এসেছিস যখন বসে পর সমস্যা নেই তো।

কথাটা বললো মান্নান সাহেব।

পাশের চেয়ার থেকে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পরলো বর্ণ। শুনতে রইলো বাবা-চাচাদের কথা।

_ তা ভাইজান ঝর্ণাকে শ্বশুর বাড়ি কবে তুলে দিবে। ( শাহাজাহান)

_ মাস দু পরেই তুলে দিবো। ওরা কোন তাড়া দিচ্ছে না দেখে আমিও কোন তারাহুরো করছি না। মেয়ে তো আমার বিদায় দিতে হবে। তাঁদের পূর্ণ হবে,আমার শূন্য। তাই আমি একটু দেরিই করছি। কিন্তু তোর ভাবি বললো, বড় মেয়ে বিদায় না দিয়ে ছোট মেয়ের বিয়ে বেপারটা কিন্তু ঠিক না। তোর ভাবি তো ছোট মেয়ে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে রাজি নয়। তোরা তো জানিস নদী আমাদে যেন একটু সবাই অবাক হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বর্ন আবারও বললো।

_ দেখেন চাচা, নদীর দুর্বলতা আমরা সবাই জানি! এমন কি মেনেও নিয়েছি এই বিষয়টা। কিন্তু অন্য কেউ তা সহজে মেনে নাও নিতে পারে। যেখানে ছেলেটা নদীকে ভালো করে চেনে না জানে না,সেখানে নদীকে বুঝতে পারাটা কিন্তু কঠিন। আর নদী কিছু না বলতেই আমরা নদীর সবটা বুঝে যাই। সেখানে হঠাৎ যদি অন্য কাউকে নিজের সবটা বোঝাতে হয়! তখন কিন্তু নদীর অনেক কষ্ট হবে। তারউপর বলছেন বিদেশে নিয়ে যাবে। ছেলেটা সব সময় কাজের জন্য বাহিরে থাকবে,নদী একা একা কি করবে ওই দেশে। না আছে চেনা কেউ না আছে প্রিয়জন। হ্যা যদি লেখাপড়া করে সেটা ভিন্ন কথা। তবুও একটা কথা কিন্তু থেকেই যায়! নিজেকে হাজার কাজে ব্যস্ত রাখুক নদী,কিন্তু ওর নিজস্ব একটা আপন কারো কিন্তু প্রয়োজন। মনে করুন সারাদিন ঘরে বাহিরে থেকে নদী বোরিং ফিল করছে। ছেলেটা সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত। তখন যদি ছেলেটা বলে নদী এককাপ কফি দাও! আমি নদীকে কমবেশি জানি,ও সাথে সাথেই না করে দিবে। আর তখন ওদের দুজনার ঝগড়া হবে। অশান্তি হবে, কখনো কখনো ছেলেটা নদীর গায়েও হাত তুলতে পারে। তখন নদী ফোন করে কাঁদবে আর এসব বলবে! আপনাদের হাতে কোন উপায় থাকবে না। কারণ মেয়ে তো বিদেশ,চাইলেও যাওয়া সম্ভব না। তাই আমার মতে নদীকে চেনা পরিচিত কোন ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে দিন,যদি সত্যিই এতো তারাহুরো থাকে নদীর বিয়ে দেওয়ার। আমি আমার মতামত বললাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছে।

কথা শেষ করেই বর্ণ চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো। এখানে আর বসে থাকা যাবে না। যা বিষ ঢালার তা ঢালা হয়ে গেছে। এবার কাজ হবার পালা। আর এদিকে বর্ণের যুক্তিপূর্ণ কথায় চিন্তিত হয়ে বসে রইলো সবাই। আসলেই যদি বর্ণের কথা ঠিক হয় তখন তো সত্যিই চাইলে কিছু করা সম্ভব নয়। হঠাৎ বড় ভাইয়ের দিকে নজর দিলো কামরুল আর শাহাজাহান। শাহাজাহান ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো–

_ আমার মনে হয় বর্ণ কথাটা ঠিক বলেছে ভাইজান।

শাহাজানের কথায় তাল মেলালো কামরুল ও নজরুল। আর এদিকে ভাবুক হয়ে ভাবছেন মান্নান। আসলেই কি এমন কিছু হবে? যদি সত্যি হয়,তখন?

চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here