সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -০৪+৫

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৪

বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বোনা কুলো। আমরা এটা কম বেশি সবাই চিনি। আমাদের ঘরেও একটা আছে। মা মাঝে মাঝেই সেটায় চাল ঝাড়ে। আজকে কিন্তু কেউ চাল ঝাড়ছে না। আজ কুলো সাজানো হ’য়েছে রঙ তুলি দিয়ে। আলতা দিয়ে কুলোর চারিপাশে নকশা তৈরি করা হয়েছে। সেই নকশা করা কুলোয় রাখা হয়েছে মিম আপুর গায়ে হলুদের হলুদ। শুধু হলুদ না আরো অনেক কিছু আছে। ধান,দূর্বা ঘাস,গিলাবাটা,মেহদিপাতা বাটা, মেথি,পান-সুপারি আর সাথে একটা কুপী। কি সুন্দর লাগছে দেখতে কুলোটা। সবাই মিম আপুর গালে, হাতে, গলায় হলুদ লাগাচ্ছে। আর মিম আপু লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে। আমার বেস লাগছে দেখতে। কলস ভর্তি নদীর পানি। সেই পানির মুখে আম পাতার পাঁচটা পাতা দিয়ে মুখের উপর দিয়ে ঢাকা। সেটাও দেখতে বেস লাগছে। একে একে সবাই মিম আপুকে হলুদ লাগালো। সবাই যখন আমাকে বললো লাগাতে,তখন আমি না করে দিলাম। আমার না কেউ শুনতে রাজি নয়। আমাকে জোরাজোরি করছে আয়শা সাথে আমার বোন ঝর্ণা। কিন্তু তাঁরা জানে না দু’টো হায়নার চোখ আমার দিকে তিখন্ন নজরে তাকিয়ে আছে। আমি কারো কথা শুনলাম না দেখে মা-ও বললো।

_ নদী যা মিমকে হলুদ লাগা।

আমি মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে না করলাম। কারণ আমি জানি এখন ছোট চাচি কিছু না বললেও পরে আমায় কথা শুনাবে। আর এই নিয়ে একটা ঝামেলা হবে। একটার পর একটা ঝামেলা আমার ভালো লাগবে না। তাই আমি কোন কথা না বলেই ওখান থেকে চলে আসতে নিলাম। কিন্তু ধুম করেই আমার বড় ভাইয়া সাগরের সামনে পরলাম। ভয়ে আমার আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি সাগর ভাইয়াকে খুব ভয় পাই। কিন্তু ভাইয়া কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন কিছু করেনি,যাঁর জন্য তাঁকে ভয় পেতে হবে। তবুও আমি ভয় পাই। কেন পাই জানি না। বাবা-র থেকে-ও আমার মনে হয় ভাইয়া খুব গম্ভীর! তাই হয়তো ভয়টা বেশি।

_ সবাই যখন বলছে যাও মায়া হলুদ লাগাও।

_ আসলে ভাইয়া–

ভাইয়া আমার হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলেন। ভাইয়া আমায় মায়া বলেই ডাকে। কেন ডাকে জানি না। অবুঝ থেকে বোঝা বয়স হতে এই নামেই ডাকে। কখনো ঘটা করে জিজ্ঞেস করা হয়নি,কেন ডাকে। ভাইয়া অল্পতেই আমার ভেতরের সব খবর পেয়ে যায়। হয়তো মিম আপুকে কেন হলুদ লাগাবো না তাও ধরে ফেলেছে। ভাইয়া আমার হাত ধরেই হলুদের বাটি থেকে আমার হাতে হলুদ মাখিয়ে নিলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরেই মিম আপুর গালে হলুদ লাগালো। ভাইয়া আমার কানে কানে বললো–

_ আমি থাকতে আমার বোনকে কেউ অপয়া বলতে পারবে না। যদি কেউ বলে তাঁর মুখে আমি কাঁচা আটা মাখিয়ে দিবো।

ভাইয়ার কথায় আমি খিলখিল করে হেঁসে দিলাম। আমার হাসি দেখে ভাইয়া আমার নাক টেনে দিলো,সাথে একটু হলুদও লাগিয়ে দিলো আমার নাকে। এবার আমি ভাইয়ার হাতে হলুদ মাখিয়ে মিম আপুর গালে লাগাতে গেলাম! হঠাৎ দেখলাম ভাইয়ার হাত অসম্ভব কাঁপছে। একটু আগেও তো আমার হাত ধরে মিম আপুকে হলুদ লাগালো,কই তখন তো এমন হয়নি। একটু আগে স্বাভাবিক থাকা মানুষটার হঠাৎ কি হলো ? তাহলে? তাহলে কি বেপারটা অন্য কোন কারণ ? একটু মিম আপুর দিকে তাকালাম। তখন দেখলাম একটু আগে যেই চেহারায় হাসির ঝিলিক ছিলো,তা এক মুহূর্তে মেঘের রূপ ধারণ করেছে। তার মানে? যা বোঝার আমি বুঝে গেলাম। আমার বলতে না পারা সব কষ্ট গুলো ভাইয়া ধরে ফেলে,আর আমি কিনা ভাইয়ার এতো বড় কষ্ট ধরতে পারলাম না। কেমন বোন আমি ছি্। আমি ভাইয়ার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই ভাইয়া চোখ সরিয়ে নিলো। যতোই তুমি চোখ সরাও না কেন ভাইয়া আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। আমি ভাইয়াকে ধরে সরে দাঁড়ালাম। আপুর গোসল শেষ করবে বড়োরা। ভাইয়া চলে গেলো। আমি ঘরে যাবো তাঁর আগেই চোখ পড়লো বর্ণ ভাইয়ের দিকে। আমার এই কাজে একমাত্র বর্ণ ভাই আমায় সাহায্য করতে পারে। মেজ চাচি যদি আমায় আরো কিছু কটু কথা শোনায় আমি শুনতে রাজি। কিন্তু কোন মতেই আমি দু’জন ভালোবাসার মানুষকে আলাদা হতে দিবো না। আমি কিছু না ভেবেই বর্ণ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু হুট করেই ঝর্ণা আপু সামনে এসে দাঁড়ালো।

_ কিরে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিস কেন?

_ তোর ফোন কোথায়?

_ ফোন কোথায় তোকে কেন বলবো?

_ শাওন তোকে একাধারে ফোন করছে। তোকে না পেয়ে আমায় কল করেছে নে কথা বল।

বিরক্তিতে আমার মনে হলে শাওনকে ধরে কিলাই। সময় পেলো না ফোন দেওয়ার। বিরক্ত নিয়ে ফোন কানে তুলে একটু লোকজনের থেকে দূর দাঁড়ালাম ।

_ আসসালামু আলাইকুম

_ ওলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?

_ আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?

_ আমিও আলহামদুলিল্লাহ। তা কি করছো?

_ বিয়ে বাড়িতে মানুষ কি করে?

_ কে কি করে জানি না। তুমি কি করছো সেটা বলো?

_ হলুদ লাগাচ্ছিলাম আপুকে।

_ তুমি হলুদ লাগাওনি গালে

_ না

_ কেন?

_ এমনই

_ আচ্ছা

_হুম

_নদী

_ হুম

_ শাড়ি পড়েছো?

_ না,আমি আপনায় আগেও বলেছি কোন অনুষ্ঠানে আমি রংচঙয়ে পোষাক পড়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি না।

_ জানি তো। তা-ও জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো। তুমি তোমার সবটা না-হয় আমার জন্যই তুলে রাখো। আমি তোমার আসল নকল সব রূপটাই দেখবো বিয়ের পর,একটা হলাল সম্পর্ক গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি। একটা অনুরোধ করবো।

_ কি অনুরোধ?

_ তোমার সাধারণ লুকের একটা ছবি দিবে।

_ একদম না।

_ তাহলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভিডিও কল দেই তুমি রিসিভ করো। প্লিজ না করো না। আমি খুব কষ্ট পাবো।

_ আপনি কষ্ট পেলে আমার কী?

_ তোমার খারাপ লাগবে না আমায় কষ্ট দিতে।

_ উঁহু লাগবে না।

_ আমি জানি তুমি হেজাব পড়ে আছো। তাহলে? এক ঝলক দেখি প্লিজ নদী,প্লিজ।

_ আচ্ছা দিন।

_ ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।

_ ধন্যবাদ বলে দেখছি আপনি আমার কান গরম করে দিচ্ছেন। ভিডিও কল দিতে হলে দিন না হলে আমি গেলাম।

_ এই না না,আমি দিচ্ছি।

লোকটা কল কেটে দিলো,কয়েক সেকেন্ড পর ভিডিও কল দিবে। তাঁর সাথে আমার সপ্তাহে তিন-চারবার কথা হয়। কখনো কখনো প্রতিদিনও হয়। কিন্তু সেটা কয়েক মিনিট কিনাবা সেকেন্ডে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমি ভালোই বুঝতে পারি মানুষটা আমায় ভালোবাসে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম! একজন শিক্ষিত, স্মার্ট ছেলে হয়ে কেন আমার মতো মেয়ে বিয়ে করতে চায়? যে একজন প্রতিবন্ধী। কি দেখে আমার মতো মেয়েকে বউ করতে চাচ্ছে। তাঁর উত্তর শুনে সেদিন আমি অবাক হয়েছিলাম। বলেছিলো– কেউ কখনোই পারফেক্ট হয় না! যাঁর মন যতো সুন্দর, সে ততোই পারফেক্ট। শরীর দিয়ে কি হবে! সময় শেষে তা ফুরিয়ে যাবে। আমার তুুমি হলেই হবে,অন্য কিছুর দরকার নেই। সেদিন তাঁর কথায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাই তো মনে হয়নি মানুষটা আমায় খারাপ রাখবে। এই জন্য হয়তো বুকের ভেতরে একজনের জন্য জন্ম নেওয়া সুপ্ত অনুভূতি গুলো আমি আড়ল করতে পেরেছি এই মানুষটার জন্য। হঠাৎ হাতের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। আমি রিসিভ করে সামনে ধরলাম। ফোনের স্কিনে ভেসে উঠলো এক উজ্জ্বল রঙের মুখ। যাঁর ঠোঁটে সেই অমায়িক হাসিটা এখনো আছে। শরীরে জড়িয়ে আছে সাদা পোষাক। গলায় ঝুলছে একটা কার্ড। কার্ডে তাঁর মুখটা স্পষ্ট না। কিন্তু মানুষটা যে সেই তা স্পষ্ট, কারণ সেই অমায়িক হাসি আছে। আমি মুখ তুলে বললাম —

_ দেখা হয়েছে

_ মাসআল্লাহ্,তুমি এতো সুন্দর কেন?তুমি যদি এই লুকটাকে সাধারণ বলো? আমি বলবো এমন সুন্দর করে সাজতে কেউ পারবে না।

_ ও তাই

_ ওভাবে তাই বলো না। হায় ম্যা তো লুট গেয়া।

_ যান না কে বারন করেছে।

_ ওই যে ফোনের স্কিনে ভেসে থাকা মেয়েটা বলেছে।

_ আমি কখন বললাম।

_ আমি যদি লুটিয়ে যাই,তাহলে তাঁর সৌন্দর্য দেখে কে বারবার আহত হবে।

_ একটু বেশি হচ্ছে কিন্তু।

_ উঁহু কম হচ্ছে। বাকি সৌন্দর্যের বিস্তারিত আমি বিয়ের পর দিবো।

_ একজন বাচ্চা মেয়ের সাথে এসব বলতে আপনার মুখে আটকাচ্ছে না।

হঠাৎ পিছন থেকে এই আওয়াজটা আসতেই আমি পিছন ঘুরে তাকালাম। তাকিয়ে তো আমি অবাক। বর্ণ ভাই। হায় আল্লাহ এখানেও চলে এসেছে। না জানি কি শুরু করে। হাত ঘুরিয়ে ফোনটা কাটতে নিলে,আমার হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিলো বর্ণ ভাই। হুট করেই ফোনটা কেটে দিয়ে গটগট করে সামনে এগিয়ে গেলো। আমি পিছনে পিছনে গেলাম। বারবার ফোনটা চাইলাম, কিন্তু দিলো না। সরাসরি ফোনটা নিয়ে আপুর হাতে দিলো।

_ তোর লজ্জা করে না,ছোট বোনকে প্রেম করার সুযোগ করে দিতে। কোথায় ওকে এসব থেকে দূরে রাখবি,তা না করে ওকে নিজে থেকেই এসবে ঢুকিয়ে দিয়েছিস। তোর মতো বোন আমি একটাও দেখিনি। নিজে তো বিয়ে করে বরের বাড়ি চলে যাবি। তখন তো এই পাগলীকে আমাদের সামলাতে হবে। এতোটুকু পিচ্চি মেয়ে কিনা এই বয়সে প্রেম করে। আল্লাহ কি দিনকাল পড়লো। এই জন্যই বলে সাবধান হও। সময় তার মানে এসে গেছে সাবধান হওয়ার। এরপর উল্টো পাল্টা কোন লোক নদীকে চাইলেই ফোন এগিয়ে দিবি না। আগে আমার সাথে কথা বলে তারপর ফোনটা ওর হাতে দিবে। মনে থাকবে। না থাক,মনে না থাকলে সমস্যা নেই। আমি দিনে একশো মেসেজ কিনবো,তোকে ঘন্টায় ঘন্টায় মনে করিয়ে দিবো।

কথাগুলো শেষ করে বর্ণ ভাই হেঁটে চলে গেলো। আর বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম আমি,ঝর্ণা আপু,মিম আপু,আয়শা। আসলে সবাই বুঝতে চাইছে আমি কার সাথে প্রেম করেছি। আসলেই তো আমি কার সাথে প্রেম করছিলাম? আচ্ছা আপনারা কি জানেন,আমি কার সাথে প্রেম করছিলাম? জানলে প্লিজ আমায় জানাবেন। এই মুহূর্তে সব আমার মাথার উপর থেকে যাচ্ছে! তাই আসলে কার সাথে প্রেম করছিলাম মনে পরছে না
#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৫

কিরে তুই কার সাথে প্রেম করছিলি?

_ কার সাথে প্রেম করছিলাম মানে? তুই ফোনের লাইনে কাকে ধরিয়ে দিয়ে এসেছিস?

_ শাওনকে

_ হ্যা শাওন।

_ তুই বর্ণকে বলিসনি শাওন অন্য কেউ না! যাঁর সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে সে?

_ তিনি বলার সুযোগ দিয়েছে। ছিনতাইকারীদের মতো ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে তোর কাছে চলে এসেছে।

_ দেখো এই ব্যপার আর আমরা কি না কি ভাবলাম।

_ তোরা কি ভাবলি?

_ কিছু না

_ আয় বোস।

_ হুম

আমি আপুদের পাশে বসলাম। মিম আপুকে ঝর্ণা আপু সাজিয়ে দিচ্ছে। ঝর্ণা আপু খুব সুন্দর করে সাজাতে পারে। আপু মাঝে মাঝে আমাকেও সাজিয়ে দেয়। মিম আপুকে খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। দেখি কাজ হয় কিনা? আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

_ আচ্ছা, মনে করো তোমরা একজনকে ভালোবাসো। তো তাঁকে পাওয়ার চান্স একদম নেই। তবুও কি তাঁকে পাওয়ার জন্য মনে ক্ষীণ পরিমাণ আশা রাখবে।

_ কি আজগুবি প্রশ্ন করছিস নদী? তোর মাথা ঠিক আছে?

_ আরে তুই চুপ থাক তো আপু। মিম আপু তুমি বলো।

_ আআমি কি বলবো।

_ আমার প্রশ্নের উত্তর।

_ যেখানে আমি জানিই তাঁকে পাওয়ার কোন চান্স নেই! তাহলে কেন আশা করবো তাঁকে পাওয়ার।

_ আচ্ছা মেনে নিলাম। ধরো তুমি যেই মানুষটাকে পাবেনা বলে ধরে নিয়েছিলে! হুট করে সেই তোমার হয়ে গেছে,তখন তুমি কি করবা?

আমি খেয়াল করলাম আমার এই প্রশ্নে মিম আপু আনমনা হয়ে গেছে। আমি মিম আপুকে ঝাকিয়ে বললাম।

_ কি হলো বলো

_ আল্লাহর নিকটে শুকরিয়ার দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবো।

_ ইনশাআল্লাহ, তুমি তৈরি হয়ে না-ও আপু নামাজ দুই রাকাত পড়ার জন্য।

আমি আসছি। এই কথা বলেই আমি দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি জানি ওদের মধ্যে কেউ আমার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু আমি তো জানি আমি কি বলেছি। আমি দৌড়ে খুঁজতে রইলাম নয়নকে। এই মুহূর্তে আমার নয়নকে খুব দরকার। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পেয়ে গেলাম। তিনি মিষ্টি খাচ্ছে। আহহ কি তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। দেখে মনে হবে মিষ্টি না অমৃত খাচ্ছে। আমি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম।

_ কিরে কি খাচ্ছিস?

মুখের একটা মিষ্টি শেষ করে অন্য একটা মিষ্টি মুখে পুরতে নিয়েছে সবে নয়ন। আমার কথায় একরাশ বিরক্ত নিয়ে তাকালো। যেন আমি খুব কঠিন প্রশ্ন করে ফেলেছি।

_ কিরে ওভাবে কি দেখছিস? এভাবে দেখিস না,কারণ আমি তোর বোন! মিষ্টি না। কখন জানি আমায় মিষ্টি ভেবে কামর বসিয়ে দিস আল্লাহ।

_ উঁহু, তুমি আর মিষ্টি!যাচ্ছে না। তুমি আর নিম পাতা ঠিকঠাক।

_ কি বললি তুই?

_ তুমি যা শুনতে পেয়েছো সেটাই।

_ তোকে তো—

বাকিটা শেষ করলাম না। কারণ এখন এই নয়নকে আমার প্রয়োজন। ওকে ঘাঁটালে আমার কাজ হবে না। তাই ওর গায়ে হাত বুলালাম।

_ ভাই আমার মিষ্টি খাচ্ছিস খা। মিষ্টি খাওয়া তো সুন্নত। আমাদের প্রিয়নবী মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতেন। একদিন হয়েছে কি জানিস? একদিন একল–

_ জানি এই কাহিনী। তাই এটা না বলে আসল কাহিনী কী সেটা বলো?

আমাকে ঘটনাটা বলতে দিলো না। সে যাহোক। আমি আমার আসল কাজে ফিরে আসি।

_ বর্ণ ভাইয়া কোথায় একটু খুঁজে দিবি। প্লিজ ভাই। তোর কাজ হয়ে গেলে এককেজি মিষ্টি খাওয়ার টাকা দিবো।

_ তুমি কী আমায় লোভ দেখাচ্ছো?

_ এএএমা একদম না। আমি তো পারিশ্রমিক দিবো বলছি। আমার কাজটা করে দিলে আমি তোকে খুশি হয়ে দিবো। ওটা কি লোভ দেখানো হয় বল ভাই।

_ বেপার কী বলো তো আপু? নয়ন ছাড়া তো মুখ থেকে বুলি ফোটে না। আজ পুরো ভাইয়ে চলে গেলে।

_ হ্যা বুঝতে পারছি, আমি তো তোর আপন বোন নই তাই এভাবে বলছিস।

_ শুরু করে দিয়েছো তোমার ড্রামা। ঠিক আছে ঠিক আছে কোন মিষ্টি কেনার টাকা দিতে হবে না। এমনই বিয়ে বাড়িতে মিষ্টির মেলা বসে। সেখানে তোমার এককেজি মিষ্টির টাকা পান্তাভাতের মতো।

_ কিহহ

_ কিছু না,কাজটা কি সেটা বলো। না হলে আমি গেলাম।

_ এই না না,আমি বলছি। শোন বর্ণ ভাইয়া কোথায় একটু খোঁজ লাগা তো?

_ কেন?

_ একটু দরকার

_ আচ্ছা

নয়ন আচ্ছা বলেই দৌড়ে গেলো। আমি ওখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিছু সময় পর নয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এলো। দুই হাঁটুর উপর হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম।

_ কিরে পেলি।

_ হুম

_ কোথায়?

_ ধানখেতে আছে। তোমাকে ওখানেই যেতে বলেছে।

_ ধানখেতে?

_ হ্যা,ভাইয়া বলেছে যা বলার তোমাকে ওখানে গিয়েই বলতে।

_ তুই বলে দিয়েছিস আমি উনাকে খুঁজছি।

_ হ্যা,তুমি তো উনাকে খুঁজচ্ছোই তাই না?

_ কিন্তু তুই উনাকে বলতে গেলি কেন?

_ তুমি কী আমায় বারন করেছিলে আশ্চর্য ব্যপার-সেপার।

_ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।

লোকজনের আড়ালে কথা বলি মাঝে মধ্যে সেটাও ধরে ফেলে মেজ চাচি। আর এবার কিনা ধানখেতে কথা বলবো। ঠিক ধরে ফেলবে। সে যাইহোক, আগে কাজের কাজটা তো ঠিক করি। ছোট চাচাদের বাড়ি থেকে ধানখেত বেশি দূরে নয়,মাত্র তিন মিনিটের পথ। খেতে নতুন ধান লাগানো হয়েছে । এই ধানের কি নাম আমি জানি না। কিন্তু ধানের প্রতিটা চারায় ধানের শীষ দেখা যাচ্ছে। হয়তো কিছুদিন পর ধান কাঁটার সময়ও হয়ে যাবে। ধান খেতের আলবেয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু বর্ণ ভাই কই ? হঠাৎ একটা হাত ইশারা করলো আমার দিকে। হাতের দিকে ভালো করে খেয়াল করলাম,দেখলাম আরো একটু ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণ ভাই। আমি এগিয়ে গেলাম। বর্ণ ভাইয়ের সামনে দাঁড়াতেই তিনি বসতে বললেন। আমরা বসে পরতেই দুই জমির ধান আমাদের আড়াল করে দিলো। কেউ পুরোপুরি সামনে না এলে বুঝবেই না এখানে কেউ বসে আছে। এখন আমার মনে হলো, এর থেকে নিরাপদ জায়গা নেই কথা বলার মতো।

_ কিরে কি বলবি?

বর্ণ ভাইয়ের কথায় ভাবনা ছেৎ পড়লো।

_ হু

_ বললাম কি দরকার আমায়। পালিয়ে টালিয়ে যাওয়ার জন্য যদি সাহায্য চাস,আমি কিন্তু পারবো না! আগেই বলে দিলাম। কারণ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে পারবো না।

_ আপনার কী মনে হচ্ছে আমি এমন কিছু বলবো?

_ বলতেও পারিস,তোকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। আর তুই তো কোন জরুরি কাজ ছাড়া আমায় মনে করিসনি, এটা ভালো করেই আমার জানা।

_ দেখেন বর্ণ ভাই আমি সিরিয়াস।

_ আমি কখন বললাম তুই মসকরা করছিস।

_ আমি একটা জরুরি কথা বলতে এখানে এসেছি। আর এই কাজে আপনায় আমার খুব দরকার।

_ বলে ফেল।

_ আমার মনে হচ্ছে, মিম আপু আর সাগর ভাইয়া একে অপরকে ভালোবাসে। এখন মিম আপুর বিয়ে হ’য়ে যাচ্ছে। ভাইয়া খুব কষ্ট পাচ্ছে।

_ আচ্ছা

_ আপনি এমন ভাবে আচ্ছা বলছেন,যেন এটা স্বাভাবিক।

_ তুই কখন এসব জানলি?

_ আধাঘন্টা আগে।

_ তুই যদি চার বছরের প্রেম কাহিনীটা আজ জানতে পারিস,আর সেটা যদি স্বাভাবিক হয়ে থাকে। তাহলে এটা কেন স্বাভাবিক নয়?

_ মামানে?

_ সাগর ভাইয়া আর মিম প্রায় চার বছর ধরে একে-অপরকে ভালোবাসে।

_ আপনি জানতেন?

_ হুম,আরো চার বছর আগে থেকেই।

_ তাহলে কিছু করছেন না কেন?

_ ওরা একজন একজনকে ভালোবাসে। ওরাই যদি কিছু না করে আমি কী করবো?

_ আপনি কি করবেন মানে?

আমি রেগে গেলাম। উনি কিনা চারবছর আগে থেকেই এই বিষয়টা জানে। তাহলে আমায় বা অন্য কাউকে বললো না কেন? অন্তত আব্বুকে বললে তো এমনটা হতো না। মিম আপু যথেষ্ট সুন্দর। আর আমার ভাইয়াও কোন অংশে কম নয়। তাহলে? তাহলে কেন তাঁরা কেউ কাউকে বলেনি।

_ শান্ত হয়ে বস নদী। মাঝখান থেকে কথা শুনে রিয়াক্ট করার কিছু নেই।

_ মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?

_ আগে বস তারপর বলছি।

আমি বসলাম। নিজেকে শান্ত করছি।

_ হুম বলুন আমি শান্ত আছি।

_ তোর কী মনে হয়? মিম নিজের ভালোবাসা নিজের করে পেতে কোন চেষ্টাই করেনি। করেছে,কিন্তু ছোট চাচি পুরোপুরি না করে দিয়েছে। আর মিম যদি কোন প্রকার অন্য কাউকে এই বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করে, তাহলে চাচি গলায় দঁড়ি দেবে বলেও ওকে থ্রেট দিয়েছে। তাই ওদের ভালোবাসা ওখানেই মাটিচাপা পড়েছে। আর সাগর ভাইয়া যতোটা গম্ভীর, তাঁর থেকে বেশি ভীতু। আমার মনে হয় প্রতিটা মানুষ তাঁর ভালোবাসার কাছে ভীতু থাকে। মিম বলে দিয়েছে, সাগর ভাইয়া যদি কোন প্রকার অশান্তি করে তাহলে মিম বিষ খাবে। এরা একে অপরেকে মৃত্যুর হুমকি দিয়ে দমিয়ে রেখেছে। এখানে তোর আমার কি করার আছে।

_ ওরা যেমন, ওদের সাথে আমাদের তেমন করতে হবে।

বর্ণ ভাইয়ার ওই কথাগুলোর পর যে আমার এমন কোন কথা থাকতে পারে,তা যেন বর্ণ ভাই বুঝতে পারেনি। তাই আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো।

_ মানে?

_ মানে হলো,ছেলের পরিবার বাইক দাবি করেছে। ছোটচাচা বাইকের অর্ডার দিয়ে এসেছে। কাল দুপুরের আগে চলে আসবে সেটা। যদি সেই বাইক না আসে তখন। আর আমার মনে হয় ছেলের পরিবার লোভী। লোভী না হলে মেয়ের বাড়ি থেকে ফার্নিচার আর ছেলের জন্য বাইক দাবি করতো না। তাঁর মানে বাইক না আসলে তাঁরা রেগে যাবে। আর রেগে গেলে ঝামেলা হবে। আর ঝামেলা হলে—

_ বিয়ে ভাঙার হুমকি দিবে।

_ ইয়েস এটাই হবে।

_ কিন্তু বাইক আসবে না কেন?

_ কারণ যে অর্ডার দিয়েছে, সে না করে দিয়েছে। তারিখ কালকের থেকে পরশুর করে চেঞ্জ করে দিয়েছে। তাই আসার কথা থাকলেও বাইক আসেনি।

_ কিন্তু ছোট চাচা মানবে।

_ আমরা সবাই জানি ছোট চাচি কেমন? তাহলে ছোট চাচাকে বুঝিয়ে বললে ঠিক বুঝবে। আমার মনে হয় না,মিম আপুর ভালোবাসার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কোন কথা ছোট চাচা বলবে। কারণ তিনি ভালোবাসাকে সাপোর্ট করে। এমন কি আব্বুও করে।

_ হু তাইতো, এটা তো আমার মাথায় ছিলো না।

_ আপনার ওই গোবর ভরা মাথায় এসব আসবেও না। আমাকে দেখেন আমাকে।

_ তোকে দেখে লাভ নেই,ওই তো পেত্নীর মতো দেখতে।

_ আমি পেত্নীর মতো দেখতে?

_ হ্যা তো।

_ তাহলে পেত্নীর মতো ঘাড় মটকে দিয়ে রক্ত খাই।

_ খা, কে বারন করেছে ? কিন্তু শরীরে একটু পারফিউম মেখে আসিস। কি বিচ্ছিরি গন্ধ তোর গায়ে ইয়াক থুঃ-থুঃ।

_ আমার গায়ে গন্ধ, আপনার ইয়াক আসছে। আর কখনো যেন আপনাকে আমার ধারে কাছে না দেখি।

কথাগুলো বলেই আমি ওখান থেকে রাগ করে চলে এলাম। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে বর্ণ ভাইকে এক নজর দেখার চেষ্টা করছি। বর্ণ ভাই সেই ধানের আলপথের ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো। চোখ বুজে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো।

আমারো পরানো যাহা চায়!তুমি তাই , তুমি তাই গো– আমারো পরানো যাহা চায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here