সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -০৬+৭

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৬

কেমন করে সবাই খাচ্ছে দেখছেন বর্ণ ভাইয়া? মনে হচ্ছে বউ এরাই নিয়ে যাবে।

_ তোর ভাই যদি কেচাল না করতো বউ তো এদেরি নেওয়ার কথা ছিলো।

_ আমার ভাই কোন কেচাল করেনি,সে ভালোবেসে। ভালোবাসা কোন পাপ নয়।

_ তুই বলছি কথাগুলো।

_ হুম বলছি।

_ মনে রাখিস কিন্তু কথাগুলো।

_ কেন?

_ সময় এলেই বুঝবি।

_ সে দেখা যাবে।

আজ মিম আপুর বিয়ে। বরযাত্রী খাওয়া দাওয়া করছে। বিয়ের সব নিয়মকানুন মানা হয়েছে! সাথে আমাদের প্ল্যানও সাজানো শেষ। কিছুক্ষণ পর বিয়ে হবে। তাঁর আগেই বোম ফাটবে। আর সেটা ফাটাবো আমরা। এখন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি এক কোণে। আমি,বর্ণ ভাইয়া,ঝর্ণা আপু,নয়ন,আয়শা,মোহন এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর সাগর ভাইয়া কোথায় কেউ জানি না। অবশ্য এখন তাঁকে প্রয়োজন নেই। আমাদের এই প্ল্যানে কেউ সামিল নেই। আমি ছোট চাচ্চু আর বর্ণ ভাইয়া ছাড়া। হঠাৎ স্টেজ থেকে একজন ইশারা করলো আমাদের দিকে। আমি আয়শা,নয়ন আর মোহন এগিয়ে গেলাম। আমরা যেতেই বরের পাশ থেকে তাঁর একজন বন্ধু বললো।

_ তা বেয়াইন সাহেবা আমাদের খাওয়া শেষ, হাত কে ধুয়েমুছে ছাফ করবে?

এদের কথা শুনে আমার তিনশো ডিগ্রি রাগ উঠলো মাথায়। হাত না সাথে পা-ও ধুয়ে দিবো একটু অপেক্ষা করো। যে সম্পর্ক ব্যবহার করে আমাদের সাথে এমন করছো, সেটাই হবে না। কিন্তু এগুলো সব আমার মনে মনে বলা কথা। মুখে বললাম অন্য কিছু।

_ কেন ভাই সাহেব, খাওয়ার আগে কী আমরা হাত ধুয়ে দিয়েছিলাম নাকি? যে এখন এঁটো হাত আমরা ধুয়ে দিবো।

_ এটাই তো বিয়ে বাড়ির নিয়ম।

কথাটা বলে উঠলো বরের ডান পাশে বসা এক যুবক। আমি উনার কথায় উত্তর দিলাম।

_ কেন? হাত যদি ধুয়েমুছে ছাফ না করি,তাহলে কী আমাদের মেয়েকে আপনাদের ছেলে বিয়ে করবে না?

_ এমনটা নয়,আপনারা উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন বিষয়টা?

_ আমরা হাত ধুয়ে দিতে পারবো না। নিজেদের হাত নিজেরাই ধুয়ে নিন।

_ নদী শুনে যা তো।

বর্ণ ভাইয়া ডাক দিলো আমায়। এটা আমাদের প্ল্যানের একটা অংশ। সেটা উনাদের বুঝতে দিলে চলবে না। আমি বর্ণ ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম।

_ হ্যা ভাইয়া বলো।

_ খবর শুনেছিস?

_ কি খবর?

_ বাইক নাকি দিবে না চাচ্চু? ঘরের ফার্নিচার কিনতেই টাকা ফুরিয়ে গেছে?

_ কি বলছেন আপনি? এবার কি হবে?

_ কি আর হবে,চাচ্চু হয়তো এদের কাছে সময় চাইবে।

_ এরা কি শুনবে

_ দেখা যাক।

কথাগুলো শেষ করেই আমরা ওখান থেকে সরে গেলাম। কারণ আমাদের কাজ হয়ে গেছে। আমাদের কথা বরপক্ষের এক মুরুব্বির কানে গেছে। বিয়ে বাড়িতে বরপক্ষের লোকগুলো সব কান পেতে থাকে। কিছু এদিক ওদিক শুনলেই হয়েছে। তাই তো,আমাদের বলা এসব কথা এক কান থেকে দুই কান ছড়িয়ে পড়তে সময় নিলো না। বরপক্ষের মাঝে শুরু হলো একটা চাপা আওয়াজ। যাক কাজ হয়েছে তাহলে। আমরা সবাই কেটে পড়লাম।

—————

_ বাইক আসবে না মানে? কি বলছো তুমি এসব?

_ কি বলছি তুমি বুঝতে পারছো না। ওদের কিছু সমস্যা হওয়ায় ওরা আজ বাইক ডেলিভারি করতে পারবে না। কাল করবে ইনশাআল্লাহ। আজ ওদের বুঝিয়ে বলতে হবে।

_ তোমার কি মনে হয় শুনবে ওরা?

_ শুনবে না কেন? তুমিই তো বলেছো, পরিবার ভালো ছেলে ভালো। তাহলে তাঁরা আমাদের অসুবিধাটা বুঝবে না। আর আমরা দিবো না তো বলছি না। আজ না দিয়ে কাল দিবো। জামাই না হয় তিনদিনের মেলানিতে এসে বাইক নিয়ে যাবে।

_ কিন্তু কথা তো এটা ছিলো না।

_ কথা যেটাই থাকুক,এখানে তো আমার হাত নেই। এখন কী তুমি বলছো আমি বাইক নতুন আরো একটা কিনতে যাবো?

_ এটা কোথায় বলছি।

_ দেখো নাসি,বাইক কেনা শেষ, সাথে সেই টাকাও পরিশোধ। তাই নতুন করে তো কিছু করা সম্ভব নয়। আমি বেয়াই সাহেবের সাথে কথা বলছি।

_ যদি ওরা কোন ঝামেলা করে?

_ ঝামেলা কেন করবে এটাই তো বুঝতে পারছি না?

_ আমি জানি না। তুমি যা ভালো বুঝো তাই করো।

_ আচ্ছা

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কামরুল সাহেব বরযাত্রীর স্টেজের দিকে। ততোক্ষণে তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ। কামরুল সাহেবের পিছন পিছন এলেন নাসিমা বেগম। তিনি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলেন। এগিয়ে গেলেন কামরুল সাহেব। বরের পাশেই বসে আছেন সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন মুরুব্বি। তিনি কিছু নিয়ে অন্য একজন মুরুব্বির সাথে কথা বলছেন। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। কামরুল সাহেব এগিয়ে গেলেন। হবু বেয়াই সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিত বুঝে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন ফখরুল ইসলাম। আন্তরিকের সাথে উঠে দাঁড়ালো। কামরুল সাহেব বললেন।

_ একটু কথা ছিলো জরুরি, যদি আসতেন।

কামরুল সাহেবের এমন কথার অপেক্ষায় বুঝি ছিলেন ফখরুল ইসলাম। তিনি পানের পিক পাশে ফেলে মুখ খুললেন।

_ দেখেন ভাই সাহেব,কথা কিন্তু আমি আগেই পাকা করে নিয়েছিলাম আপনার স্ত্রীর সাথে। এখন যদি আপনার কথা না রাখেন আমরা কি অন্য কিছু ধরে নিবো।

কামরুল সাহেব বুঝে নিলেন,কাজ যা হবার তা হয়ে গেছে। তাই কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতেই তিনি বললেন।

_ আপনি কিন্তু ছেলে বিয়ে দিচ্ছেন, বিক্রি করছেন না। আমরা তো দিবো,কিন্তু একটু দেরি হবে।

_ কথা কিন্তু এটা ছিলো না ভাই।

_ আমরাও বুঝতে পারছি,কিন্তু একটু আমাদের বোঝার চেষ্টা করেন।

_ কবে দিবেন?

_ এই মুহূর্তে কথা দিতে পারছি না।

_ তাহলে আমিও কিন্তু কথা দিতে পারছি না বিয়েটা হবে কিনা?

_ আপনি কি আমাদের থ্রেট দিচ্ছেন।

খুব রাগী সুরে বলে উঠলো মান্নান সাহেব কথাটা। মান্নান সাহেবের কথায় আরো কিছু মুরুব্বি এগিয়ে এলো। ফখরুল ইসলাম একটু অপমান বোধ করলেন। তাই তিনিও রেগে গেলেন।

_ যদি আপনারা কথা নাই রাখতে পারেন,তাহলে কথা দেন কেন?

_ কথা আমরা কেউ দেইনি,কথা দিয়েছে আমরা ছোট ভাইয়ের বউ। আমার ভাইয়ের বউ হয়তো ভুলে গেছে পণ নেওয়া বা দেওয়া দু’টোই অপরাধ।

_ সেটা আপনার আগেই বোঝানো উচিত ছিলো আপনার ছোট ভাইয়ের বউকে? আমরা কিন্তু পণের কথায় রাজি হওয়াতেই বিয়ের কথা এগিয়ে নিয়েছি।

ফখরুল ইসলামের কথায় মান্নান সাহেব আরো রেগে গেলো। তাই তিনি ভাইয়ের দিকে তিখন্ন নজরে তাকালেন।

_ আমাদের কাছে পণের বিষয়টা গোপন করে গেছো দেখে আমরাও আগ বারিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আর এখন এসে অপমান করছে এরা। বলে কিনা পণের জন্য তোমরা রাজি হয়েছো দেখে,তাঁরা তাদের ছেলে বিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি হয়েছে। ছি্ কামরুল, এটা আমি তোমার কাছে আশা করিনি। তুমি যদি এর পরে-ও এই বিয়ে দিতে চাও! তাহলে আমি এই মুহূর্তে তোমার বাড়ি ত্যাগ করবো। আর কখনোই তুমি আমার মুখোমুখি হবে না।

ভাইয়ের কড়া সুরের কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলো কামরুল। তাই পাল্টা বলার মতো কোন কথা খুঁজে পেলেন না তিনি। কিন্তু তিনি কিছু বলার মতো খুঁজে না পেলেও তাঁর স্ত্রী পেলো। তাই তো আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললেন।

_ বড় ভাইজান কোথায় সমস্যার সমাধান করবেন, তা না করে আরো সমস্যা জটিল করছেন কেন?

কথাটা বলেই মাথা নিচু করে নিলো নাসিমা৷ পরিবারের সবাই মান্নান সাহেবকে শ্রদ্ধা করেন। সাথে সবাই তাঁকে ভয়ও পায়। ছোট ভাইয়ের বউয়ের কথা শুনে মান্নান বললো।

_ শোন ছোট বউ,সমস্যা অন্য কারনে হলে হয়তো আমি সমাধান করতাম। কিন্তু পণের বিষয়ে আমি কোন সাপোর্ট করবো না। তাই আমার মতে এই বিয়েটা না দেওয়াই ভালো। আজ সামান্য বিষয়ে তাঁরা এতো রিয়াক্ট করছে। তোমার কি মনে হয় এই পরিবারে তোমার মেয়ে সুখে থাকবে। যেখানে কিনা তাঁকে সুখ কিনতে হবে,বাপের রক্ত ঝড়ানো টাকা দিয়ে। আজ দু-হাত ভারে দাও। দুই বছর ভালো থাকবে। কাল যখন দিতে পারবে না,তখন তোমার মেয়েকে যে ভালো রাখবে তাঁর কি কোন গ্যারান্টি আছে তোমার কাছে। তাই এখানে বিয়েটা না দেওয়াই ভালো।

_ আপনি শুধু আপনার কথাই বলে গেলেন ভাইজান। আজ যদি আমার মেয়ের বিয়ে না হয়, আমাদের সম্মান থাকবে এই গ্রামে। আপনারা তো আজ বাদে কাল শহরে ফিরে যাবেন! তখন আমাদের কি হতে পারে বুঝতে পারছেন।

_ তুমি বুঝতে পারছো না ছোট বউ। পণ দিয়ে কখনোই কারো সুখ কেনা যায় না। তাই আমার কথা শুনো।

_ একদম না। সমাধান যখন দিতে পারবেন না,তখন জ্ঞান দেওয়ারও কোন দরকার নেই। মেয়ে আমাদের যা করার আমরা ক—-

_ নাসি,একদম চুপ। অনেক সহ্য করেছি আর না। আজ পর্যন্ত আমি নিজের ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলিনি,আর তুমি কিনা ভাইয়ের মুখে মুখে তর্ক করছো।

বড় ভাইয়ের মুখের উপর এমন কথা বলায় রেগে গেলো কামরুল। তাই তো নিজের স্ত্রীকে ধমকে উঠলো।

_ আমাকে না ধমকে নিজে একবার ভেবে দেখো বিয়ে ভেঙে গেলে আমাদের মেয়ের কি হবে? কে করবে আমাদের মেয়েকে বিয়ে?

নাসিমার কথা শুনে ফখরুলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সম্মান বাঁচাতে হলেও তাঁদের ছেলের সাথে ওদের মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না। কারণ কোথা থেকেই ভাইয়ের হাত ধরে নদী সামনে এগিয়ে এসে বলে উঠলো।

_ কেন চাচি সাগর ভাইয়া মিম আপুকে বিয়ে করবে।

ইনশাআল্লাহ চলবে,,

একটু বিজি ছিলাম তাই গল্প দিতে দেরি হলো দুঃখিত। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। খুব তাড়াতাড়ি লিখেছি জানি না কেমন হয়েছে। আর একটু রেসপন্স করার আহ্বান রইলো।#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৭

_ কেন চাচি সাগর ভাইয়া মিম আপুকে বিয়ে করবে।

মুরুব্বীদের মাঝে হঠাৎ আমার কথাটা যেন বিনা মেঘের বজ্রপাতের সৃষ্টি হলো। গুঞ্জন শুরু হলো চারিদিকে। বাবা অবাক নয়নে আমার দিকে তাকালেন। আমার বাবা বুদ্ধিমান। তাই সব কথা শুনে বুঝে তারপর উত্তর দেন। তাই তিনি আমার কথায় অবাক হয়েছে, কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। কারণ তিনি আগে পুরো বিষয়টা বুঝবে তারপর কথা বলবে। কিন্তু আমার কথায় রেগে গেলেন ছোট চাচি। হুট করেই কি ভেবে তিনি আমার দিকে তেড়েমেরে ছুটে এলেন। তিনি যথেষ্ট পরিমাণ রেগে গেলেন। তাই তো নিজের হিতাহিত জ্ঞান শক্তি হারিয়ে ফেললেন। এতো মানুষের ভিরে তিনি বলে উঠলেন।

_ প্রতিবন্ধী ব্যয়াদপ মেয়ে এসব তোর কাজ এবার আমি ভালোই বুঝতে পারছি।

ছোট চাচির কথায় যেন আমার বাবা আশ্চর্য হলেন। তিনি গর্জে উঠলো।

_ ছোট বউ মুখ সামলে কথা বলো। তুমি হয়তো আমাকে খেয়াল করোনি। তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমার সামনে আমার মেয়েকে প্রতিবন্ধী বলছো।

_ আপনি হয়তো খেয়াল করেননি ভাইজান নদী কী বলেছে?

সাপের মতো হিসহিসিয়ে কথা বললো ছোট চাচি। বাবা তাঁর কথার বিপরীতে বললেন–

_ আমি কানে খুব ভালো শুনতে পাই। বয়স হলেও আমি যথেষ্ট স্পষ্ট শুনতে পাই। তাই আমার মেয়ে যা বলেছে তা আমি শুনতে পেয়েছি। আর আমরা কম বেশি সবাই জানি, নদী কখনোই কোন ব্যপারে তেমন একটা থাকে না। এই বিষয়ে যখন আছে! তারমানে কিছু একটা তো আছেই। তাই সাবধান, আমার সামনে আমার মেয়েকে এমন কিছু বলবে না! যেন আমি ভুলে যাই তুমি আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী।

বাবা ছোট চাচিকে ধমকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বরের বাবার উদ্দেশ্য বললো।

_ আমরা পণ দিয়ে মেয়ে বিয়ে দিবো না। তাই আপনারা যেতে পারেন।

_ আমি আপনাদের নামে মানহানীর মামলা করবো। এভাবে আমাদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্য কেসফাইল করবো। না করতে পারলে আমার নাম ফখরুল ইসলাম না।

_ আঙ্কেল,আপনি যদি আমাদের নামে কেসফাইল করেন,তাহলে আমরাও কিন্তু বসে থাকবো না! যৌতুকের দাবিতে আপনার নামে উল্টো কেস ঠুকে দিবো। তাই সাবধান, আমাদের সাথে লাগতে আসবেন না। এই গ্রামে থাকি না বলে ভাববেন না আমাদের কেউ চেনে না। গ্রামের সবাই আমাদের খুব ভালো করেই চেনে। আমাদের বিপদে ফেলতে গেলে,আপনারা নিজেরাই উল্টে বিপদে পরবেন। তাই চলে যান।

একদমে কথাগুলো শেষ করলো বর্ণ ভাইয়া। বর্ণ ভাইয়ার কথায় আমার বাবা চাচাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু রাগ হয়ে গেলেন মেজ চাচি। তিনি বর্ণ ভাইয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন একটু দূরে।

_ তোমার এসবের মাঝে কথা বলার কি দরকার? যাঁদের ঝামেলা তাঁদের মিটাতে দাও।

_ তুমি কবে থেকে নিজের সার্থ্য দেখতে শুরু করলে আম্মু। তাঁদের ঝামেলা নয়,আমাদের ঝামেলা বলো। কারণ পরিবারটা আমাদের। আমরা কর্মের খাতিরে আলাদা থাকলেও দিন শেষে কিন্তু আমরা সবাই এক। তাই তুমি বারন করলেও আমি শুনবো না। তাদের বুঝতে হবে! আমার বাবা-চাচাদের শক্ত লাঠি আছে। কেউ আমাদের বাপ-চাচার দিকে আঙুল তুললে সেই আঙুল ভেঙে দেওয়ার মতো তাঁদের অনেক গুলো শক্ত লাঠি আছে। আর এখানে একদিকে আমার বোন অন্য দিকে ভাইয়ের জীবন জড়িয়ে আছে। না চাইলেও আমায় জড়াতে হবে। তাই আমার হাতটা ছাড়ো।

ছেলের এমন কঠিন সুরের কথায় চাচি অবাক হলো। তাই আপনা-আপনি হাতটা সরে গেলো বর্ণ ভাইয়ের হাত থেকে। বর্ণ ভাই এগিয়ে এলো আমার বাবা-র নিকট। বরপক্ষের লোকের দিকে ফিরে বললো–

_ দেখুন আমাদের ভুল হয়েছে আমরা মানছি। কিন্তু আপনাদের দোষও কিন্তু কম নয়। তাই আপনারা চলে যান। আমাদের পরিবারের ঝামেলা আমাদেরকে মিটিয়ে নিতে দিন।

বর্ণ ভাইয়ের কথার উপর আর কোন কথা তাঁরা খুঁজে পেলো না। তাই একেএকে সবাই চলে গেলো। রইলাম বলতে আমরা সবাই। নয়ন আর মোহন গিয়ে কিছু চেয়ার নিয়ে এলো। সবাই এক জায়গায় বসলো। বাবা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

_ নদী,তুমি যখন শুরু করেছো তুমিই শেষ করো।

আমি বাবা-র কথায় নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। মাথা নিচু করে বললাম।

_ বাবা সাগর ভাইয়া মিম আপুকে ভালোবাসে। সে ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারেনি। আমি সব জেনে ছোট চাচ্চুকে বলেছি। তিনিও রাজি।

_ আর মিম,সে কী সাগরকে পছন্দ করে।

_ হ্যা বাবা করে।

_ মিথ্যা কথা বলছে নদী। মিম কখনোই সাগরকে ভালোবাসেনি। যদি সত্যি ভালোবাসতো,তাহলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম।

আমার কথা শেষ হতেই ছোট চাচি কথাটা বলে উঠলো। চাচির কথায় বাবা খানিকটা বিরক্ত হলেন। কারণ চাচির চেহারাই বলে দিচ্ছে চাচি মিথ্যা বলছে। তাই বাবা আয়শাকে বললো।

_ আয়শা

_ জ্বি চাচ্চু।

_ যাও তো সোনা, মিম আপুকে ঘর থেকে নিয়ে এসো। বলো আমি ডাকছি।

_ আচ্ছা

আয়শা ছুটে গেলো মিম আপুকে আনতে। কিন্তু চাচি রেগে গিয়ে বললো।

_ আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না ভাইজান,যে নিজের মেয়ের উপর ভরসা করে আমার মেয়েকে ডেকে পাঠালেন।

_ বিশ্বাস করার মতো এখন পর্যন্ত কোন কাজ কী তুমি করেছো? আমি কেন এখানের সবাই জানে তুমি নদীকে পছন্দ করো না। তাহলে নদীর সব কিছুই তুমি মিথ্যা প্রমাণ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। সত্যিটা শুনতেই মিমকে ডাকা।

_ কিন্তু

_ আর একটা কথাও তুমি বলবে না নাসি। কারণ তোমার মুখে কথা মানাচ্ছে না। তুমি একটার পর একটা অন্যায় করে যাচ্ছো।

কথাটা বলে উঠলো ছোট চাচ্চু

_ এখন ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমায় কথা শোনাচ্ছো।

_ কামরুল তোর কোন কথা বলার দরকার নেই। যা শোনার আমি মিমের মুখেই শুনবো।

বাবা মিম আপুকে প্রশ্ন করলো।

_ মিম,নদী বলছে তুমি সাগরকে পছন্দ করো কথাটা কি সত্যি।

মিম আপু নিশ্চুপ। বাবা আবারও জিজ্ঞেস করলেন।

_ যদি নদীর কথা মিথ্যা হয় তাহলে কিন্তু তোমাকে অন্য জায়গায় আমরা বিয়ে দিতে বাধ্য হবো। যতোই আমরা শক্ত থাকি না কেন? সমাজ কিন্তু কথা শোনাতে ছাড়বে না আমাদের বা তোমাকে। তাই তুমি যদি জলদি কিছু বলো তাহলে তোমার সাথে সাথে আমাদের সবার ভালো। আমি কি অন্য কোথাও ছেলে দেখবো তোমা–

_ না চাচ্চু,আমি- আমি আসলে–

আর কিছু মিম আপু বলতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠলো।

_ আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। সাগর আমি তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি।

_ আসলে বাবা,ছোট চাচি—

_ একদম অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করবে না। কারণ অজুহাত দেওয়া মানুষ আমি পছন্দ করি না। একবার অনন্ত আমায় জানাতে এই বিষয়ে। আজ যদি বর্ণ,নদী আর কামরুল এসব না করতো? কি হতো বিষয়টা বুঝতে পারছো। সারাজীবন তুমি ভেতরের জ্বলতে সাথে মিম। আর মিমের এই জ্বালার আগুনে অন্য একটা ছেলে জ্বলতো। যদি এই জন্য ওই ছেলেটা ওকে অত্যাচার করতো, তখন কি করতে তুমি? কিছু করতে পারতে। আর নাসিমা বুঝদার হয়ে এমন অবুঝের মতো কাজ করাটা যেন সব অন্যায় ছাড়িয়ে গেছে। ছি্। এসব আশ্চর্য জনক ঘটনা দেখে আমি অবাক হলাম। এবার তুমি কি করবে নাসিমা। সন্তানের সুখ,নাকি নিজের ইগো ধরে রাখবে।

_ আমি আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ে বিয়ে দিবো না। আমি চাই না আমার মতো আমার মেয়ে আপনার বেড়াজালে আঁটকে থাকুক সারাজীবন। দমবন্ধ হওয়ার মতো কষ্ট অনুভব করুক।
নিজের সব হুকুম অন্যের উপর জাহির করেন। নিজেকে তো কখনোই কারো হুকুম পালন করতে হয়নি,তাই হুকুম মানতে কতোটা কষ্ট হয় আপনি কি করে বুঝবেন। আপনি আসলে সার্থ্যবাদী একজন লোক। আপনি সারাজীবন শুধু ছোট ভাই আর বউয়ের উপর হুকুম জাহির করেছেন। আপনার মতো নিচু আর ছোট মনের মানুষ একজনও নাই।

_ নাসি–

ছোট চাচ্চু চিৎকার করে চাচিকে ধমকে উঠলো। সাথে থাপ্পড় মেরে বসলেন।

কামরুল সাহেব নিজ স্ত্রীর গালে থাপ্পড় মেরে বসলেন। যে ভাই কিনা তাঁদের সব সময় আগলে রেখেছিলো। বাবা-র মৃত্যুর পর একটা বটবৃক্ষর মতো ছায়া হয়ে সঙ্গ দিয়েছিলো! আজ কিনা সেই ভাইয়ের দিকে আঙুল তুলছে তাঁর স্ত্রী। এটা যেন তিনি মেনে নিতে পারলেন না। তাই আরো একটি থাপ্পড় উঠালেন স্ত্রীকে মারার জন্য। কিন্তু সেই থাপ্পড় নাসিমার গাল অবধি পৌঁছাতে পারেনি। কারণ কামরুল সাহেবের হাতটা ধরে ফেলেছেন মান্নান সাহেব। তিনি ভাইকে উল্টো একটা থাপ্পড় মারলেন।

_ ছি্ কামরুল আমি তোমায় এই শিক্ষা দিয়েছি। ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে, বড় ভাই, বউদের সামনে নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলছো। ঘরের দরজা আঁটকে যা বোঝানোর বোঝায়,কিন্তু সকলের সামনে নিজ স্ত্রীকে তুমি অপমান করতে পারো না। আমি তোমায় আগেও বলেছি, এখন আবার বলছি! নারীজাতি সম্মানিত। তাঁদের সম্মান করো।

_ ভাইয়া ও কোন সাহসে তোমার দিকে আঙুল তুললো।

_ সম্পর্ক একটা নদীর মতো! তাঁকে বইতে দিতে হয়, ভাগ করতে নেই। এই কথায় যদি কেউ আমাকে বলে নিজের হুকুম তালিম করা,তাতে আমার কিছু যায় আসে না। যে যেখানেই থাকি না কেন? বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করানোর দিন একসাথে থাকতে হবে সবাইকে! এতে যদি কাউকে আমি বেড়াজালে আঁটকে রাখি,তাহলে হ্যা আমি রেখেছি। প্রতিটা ছেলে-মেয়ের ভালো খারাপের খবর নিয়ে তাঁদের কোনটা ভালো হবে আমার মতামত জানানো টাকে যদি কেউ হুকুম মনে করে,তো তাঁকে করতে দাও। যতোই অশান্তি থাকুক একজন আরেকজনের সাথে, পরিবারের অনুষ্ঠানে সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। দুই ঈদে সবাইকে নিজেদের বাবা-র ভিটায় উপস্থিত থাকতে হবে। কারো বিপদ হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে! এটা যদি কারো কাছে দমবন্ধ করার মতো কষ্ট হয়,তাহলে হোক কষ্ট। মরে তো যাচ্ছে না। তাই এই বিষয়ে আর কোন কথা হবে না। মিম আমার বাড়ির বউ হবে,এটাই শেষ কথা। আর যদি কারো আপত্তি থেকে থাকে! সত্যি বলতে আমার তাতে কিছুই যায় আসবে না। বর্ণ ইমাম সাহেবকে ডেকে আনো। এই মুহূর্তে বিয়ে হবে। আর সবার সামনে হবে। আর নয়ন,তুমি গাড়ি ডেকে আনো।আমরা এখনি বাড়িতে ফিরবো বিয়ের কাজ শেষ হলেই। আমার সাথে এখন সবাই যাবে। শুধু কামরুল আর ছোট বউ বাদে।

_ ভাইয়া আমিও–

_ আমি যা বলেছি সেটাই শেষ কথা। ছোট বউয়ের রাগ ঠান্ডা হলে,সে নিজেই যাবে! তখন তুমি ওর সাথে যাবে। এখন শুধু আমরা তিন পরিবার যাবো। ছোট বউয়ের সাথেই তুমি আসবে একা নয়। কারণ আমি কঠিন মানুষ, কোন পাথর নই। তাঁর মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি, সাথে ঘরের রহমত। কষ্ট কিন্তু কম হচ্ছে না। রেগে থাকলেও সন্তানের জন্য কষ্ট কিন্তু বাবা-মায়ের কম নয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

কিছু বলে যান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here