সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -০৮+৯

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৮

বাবা-র কথা মতোই ভাইয়া আর মিম আপুর বিয়ে শেষ হতেই আমরা ফিরে এসেছি নিজেদের বাড়িতে। আমাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। প্রায় রাত একটা বেজে যায়। আমরা মাইক্রোবাস ঠিক করে বরিশাল থেকে খুলনায় ফিরে আসি। রাত অনেক হওয়ায় আমারা সবাই কিছু শুকনো খাবার কিনে নিয়ে আসি। যে যাঁর মতো করে বিস্কুট, কেক, পাউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আমাদের বাড়িটা অনেক বড় করে বাবা তৈরি করেছে।হয়তো তিনতলা নয়,কিন্তু দোতলা। উপর নিচ মিলে মোট আটটা রুম। আমরা যখন সবাই একসাথে হই,তখন বাবা আর চাচ্চুরা এক ঘরে ঘুমায়! আর মা চাচিরা এক রুমে। আমরা বোনেরা এক রুমে, ভাইয়েরা এক রুমে। অবশ্য আমাদের বাড়িতে যথেষ্ট রুম রয়েছে। কিন্তু তখন সবাই খোশগল্পে এতো মগ্ন থাকে যে,ঘুমানোর কথা আর মনে থাকে না। তাই সবাই সবার মতো করে গল্প করার ঘর খুঁজে নেয়। এবারো ব্যতিক্রম হয়নি। সবাই আগের মতোই যে যাঁর মতো ঘরে ঢুকে গেছে। কিন্তু আমি ছাদে আছি। ছাদের শক্ত ফ্লোরে বসে ভাবছি! চাচি তখন আমাকে কীভাবে প্রতিবন্ধী বলে অপমান করলো। অবশ্য তখন কথাটা গায়ে না লাগলেও এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা আমার ওই দু’টো আঙুল কি আমার সকল গুন কে পিছনে ফেলে দিয়েছে। হ্যা দিয়েছে তো? না-হলে সব সময় কেন নিজের শরীরে প্রতিবন্ধীর তকমা লাগানো হয়। এই প্রতিবন্ধীর জন্যই তো আমার কিশোরী মনে জন্ম নেওয়া বর্ণ ভাইয়ের জন্য সুপ্ত অনুভূতি গুলো বিবেকের দেয়াল দিয়ে চাপা দিয়েছি। বর্ণ ভাইয়া আমায় পছন্দ করে এটা আমি ক্লাস নাইনে থাকতে জেনে যা-ই। কিন্তু আমি কখনোই তাঁর অনুভূতি বুঝেও তাঁকে বুঝতে দেয়নি,আমার ভেতরের অনুভূতি। হয়তো অনেকেই আমাকে পাগল বা নেকা ভাবতে পারে। কিন্তু আমি আবেগ দিয়ে ভাবার থেকে বিবেক দিয়ে বেশি ভাবি। হয়তো আমার ম্যাচিউরিটি বয়স হয়নি! কিন্তু আমাদের মতো অক্ষম মেয়েদের অনেক কিছুই বুঝতে হয় বোঝার বয়স হওয়ার আগেই। আমিও বুঝে নিয়েছি।

_ কিরে পিচ্চি এতো রাতে ছাদে কি করছিস? যদি তোকে ভূতে ধরে নিয়ে যায়।

হঠাৎ চিরচেনা কন্ঠে, আড়ালে থাকা নিজের চোখের জলটা আড়ালেই মুছে নিলাম। কারণ আমি চাই না বর্ণ ভাইয়া আমার এই সুপ্ত অনুভূতির কথা জানুক। আমি চাই না,আমাকে নিয়ে তাঁর মায়ের সাথে তাঁর একটা দুরত্ব সৃষ্টি হোক।

_ রাতের আকাশের চাঁদ দেখি। আপনি এখানে কি করছেন?

_ ঘুম আসছিলো না,তাই ছাদে চলে এলাম। কিন্তু আমি কি জানতাম এখানে আগে থেকেই পেত্নি বসে আছে। আগে জানলে আসতাম না।

_ এখন তো জানলেন,তাহলে চলে যান।

_ না,এখন আর যাওয়া যাবে না। তো বল তারা দেখছিলি নাকি সপ্তর্ষিমন্ডলকে দেখছিস?

_ সে যাকেই দেখি,দেখছিলাম নিশ্চয়ই কাউকে।

_ মন খারাপ?

_ মন খারাপ হতে যাবে কোন দুঃখে।

_ চাচি তখন বাহিরের লোকের সামনে ওই কথাটা বলায়।

না বলতেও মানুষটা আমার ভেতরের খবর ঠিক পেয়ে যায়।

_ হা হা হা হা

_ হাসছিস কেন?

_ আপনার কথা শুনে।

_ আমি হাসির কি বললাম?

_ ওই যে, ওই কথাটা বললেন! কেন প্রতিবন্ধী বলতে ভয় হয়।

_ না,আমার সত্যি বলার শতসাহস আছে। কিন্তু কারো দুর্বলতায় আঘাত দিয়ে নিজের শত সাহস প্রমাণ করার সাহস আমার নেই।

_ আমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও কি এমন করতেন?

_ জানি না,এখন অবধি তেমন পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি।

_ ঘরে যান,কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে।

_ তুই কি ভয় পাচ্ছিস?

_ আমার ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।

_ তোকে চাচা-চাচি এতো আগলে রাখে,তবুও তুই এতো ভয় পাস কেন?

_ কারণ কেউ কেউ আমাকে আড়ালে খুব আঘাত করে।

_ কেউ কেউ বলতে কারা?

_ খুব আপন কেউ

_ মানে কি বলতে চাইছিস? একবার তাঁর নামটা বল?

_ বললে কি করবেন?

_ অনেক কিছু

_ সময় আসুক বলবো। এখন চলে যান।

_ এখানেই বসে থাকবি।

_ ভালো লাগছে।

_ এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করাটা কি খুব জরুরি?

বর্ণ ভাইয়ার কথায় আমি কিছুটা থমকে গেলাম। কারণ সে মাঝে মাঝেই এমন প্রশ্ন করে,যাঁর কোন উত্তর আমার কাছে থাকে না। হঠাৎ চোখটা জ্বলতে শুরু করলো! কারণ এখনই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়বে। রাতের আঁধারকে একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হলো। কারণ এই আঁধারটা না থাকলে ঠিক আমি বর্ণ ভাইয়ার কাছে ধরা পরে যেতাম,এই অবাধ্য চোখের জলের জন্য। নিজেকে যথাক্রমে সামলে বললাম।

_ বিয়ে তো কাল হয়ে যাচ্ছে না,হবে এক বছর পর। আর আপনি এমন ভাবে বলছেন,বিয়ে যেন রাত পোহালেই।

_ আগে জানতাম এক বছরে তিনশো পয়ষট্টি দিন। কিন্তু তোর বিয়ের খবর শুনে মনে হচ্ছে, হয়তো পয়ষট্টি দিনও বাকি নেই।

_ আমাদের সব মেয়েকেই এমন ভাবে চলে যেতে হবে। কারণ আমাদের বাবা-মা আদর করে আমাদের মানুষ করে অন্য বাড়ির বউ হওয়ার জন্য। আয়শাও হবে একদিন। আমি যাচ্ছি তো কি হয়েছে! আয়শা তো আছে। আমি যাচ্ছি, আপনি থাকেন।

বর্ণ ভাইয়ার প্রশ্নটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে আমি ওখান থেকে চলে এলাম। কারণ না এলে তাঁর কথার জালে ঠিক ফেঁসে যেতাম।

বর্ণ দাঁড়িয়ে রইলো। অন্ধকারে ঢাকা নির্জন রাতের আকাশ পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। কোন ভাবেই কি নদীকে সে বোঝাতে পারবে না তাঁর মনের কথা। সে যতোবারই নদীকে বোঝাতে গেছে, নদী ততবারই অন্য ভাবে ব্যপারটা বুঝে নিয়েছে। তাহলে কি বর্ণ ব্যর্থ তাঁর ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে। হঠাৎ বর্ণের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করে কানে তুললো।

_ কিরে বলতে পেরেছিস?

_ হুম

_ কি বললো।

_ উল্টোটা।

_ উল্টোটা মানে?

_ প্রতিবার যেমনটা হয়,এবারও তেমটাই হয়েছে। আমি বোঝাতে চেয়েছি আমার মনের খবর! সে ধরিয়ে দিয়েছে কাজিন হিসেবে আমার কষ্টের খবর।

_ আচ্ছা, তোর মনে হয় না, ও কোন ভাবে তোকে এরিয়ে যায়।

_ এমনটা নয়।

_ আমি শুনেছি, কোন ছেলে তাঁর দিকে কোন নজরে দেখে! সেটা মেয়েরা অল্প সময়ের মাঝেই বুঝে যায়। আর তুই কতোবার ওকে বোঝাতে চেয়েছিস,অথচ ও বুঝতে চায়নি। কেন জানি ব্যপারটা আমার হজম হচ্ছে না।

_ তোর হজম না হলে হজমি খা। কিন্তু আমাকে নতুন বুদ্ধি দে। যা করার এই দু’দিনের মধ্যে করতে হবে। আর না হলে নতুন কোন অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই করতে পারবো না। আবারও তো তৃষ্ণা পাবে ওকে না দেখলে।

_ আমি মরছি আমার জ্বালায় আর তুই কিনা পরে আছিস, ওই এক জ্বালায়।

_ তুই আবার কোন জ্বালায় পরে আছিস?

_ নদীকে তুই কীভাবে বোঝাবি সেই জ্বালায়।

_ ও, তাঁর মানে আমারটা আর তোরটা কি আলাদা।

_ ওই তো একি হলো।

_ হারামি তোর মতো বন্ধু পিটিয়ে সোজা করতে হয়।

_ সে এখানে এসে না-হয় করিস। আগে ভাব কি করবি।

_ হুম

_ আচ্ছা এখন রাখছি,তোর টেনশনে আজকাল আমি ঠিক মতো ঘুমাতেও পারি না। কাল কথা হবে রাখছি।

রাখছি বলেই ফোনটা কেটে দিলো বর্ণের প্রাণপ্রিয় বন্ধু সায়মন। স্কুল লাইফ থেকে এখনো তাঁদের বন্ধুত্ব। এতো লম্বা সময়ের বন্ধুত্ব, তাই গভীরতাও অনেক।

—————–

রান্না ঘরে এলাহী আয়োজন। এই এলাহী আয়োজন করছে মা,পারভীন চাচি, রোকেয়া ফুপি , সেলিনা ফুপি। জা আর দুই ননদ নিয়ে নাস্তার আয়োজন করছে মিনা বেগম,মানে আমার মা। পারভীন চাচি রুটি ভাজছেন। রোকেয়া ফুপি পাউরুটিতে জেলী মাখিয়ে প্লেটে রাখছে। সেলিনা ফুপি রুটি বেলে দিচ্ছে। আর আমার মা আলু-ভাজি নামিয়ে চায়ের পানি চুলায় তুলে দিয়েছেন। ঠিক তখন রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম আমি। রোকেয়া ফুপির গলা জড়িয়ে ধরলাম।

_ কি করছো ফুপি?

_ এই তো পাউরুটিতে জেলী মাখিয়ে রাখছি। আমার ময়নার ঘুম ভেঙেছে।

_ সে অনেক আগেই ভেঙেছে। দাও আমি পাউরুটিতে জেলী লাগাই।

_ না, তুই যা এখান থেকে।

আমি জোর করে ফুপিয়ে আর হাত থেকে জেলী মাখানো চাকুটা কেঁড়ে নিলাম।

_ তুমি আমার শক্তির কাছে চুনোপুঁটি। আমি তোমায় জন্ম দিয়েছি,না তুমি আমায় দিয়েছো। আমার সাথে আমার মেয়ে লাগতে আসে হু।

আমার এমন কান্ডে মা, বড় ফুপি,সেলিনা ফুপি হেঁসে দিলো। সেলিনা ফুপি বলে উঠলো।

_ হ্যা তাই তো আমরা তো তোর মেয়ে! মাঝে মধ্যে কেন যে ভুলে যাই। বড় আপা সাবধানে, মা কখন জানি ভুলের জন্য কানমলা দেয়।

_ হুম মনে রাখবো কাল থেকে, আজ তো ভুলে গেছি।

এই কথা বলেই বড় ফুপি আর ছোট ফুপি হেঁসে দিলো,সাথে আমিও হাসলাম। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পাউরুটিতে জেলী মাখাচ্ছি। হঠাৎ বড় ফুপি আমার হাত কেঁড়ে নিলো।

_ ময়না, তোর হাতে এগুলো কিসের দাগ? দেখে মনে হচ্ছে নখের আঁচড় এগুলো।

ফুপির কথায় আমি ভরকে গেলাম। ফুপি ইচ্ছে করে মায়ের সামনে এমনটা করলো,তা আমি ভালোই বুঝলাম। এখন হাজারটা প্রশ্নের সমক্ষে পড়তে হবে।আমি তো হাতের কথা ভুলে গেছিলাম। আমার হাতটা নখের আঁচড়ে লাল হয়ে আছে। আর যেখানে যেখানে নখ ঢুকে গেছে, সেখানে দাগ স্পষ্ট। এবার, এবার কি বলবো। একবার আমার হাতের দিকে তাকালাম। কেন জানি খুব রাগ হলো। বিনা অন্যায়ে এমনটা মেজ চাচি আমার সাথে এমনটা করেছে। তাই হুট করেই রেগে গিয়ে বললাম–

_ আসলে ফুপি একটা হায়না আমার উপর ভুলবশত আক্রমণ করে বসেছিলো। এটা সেটারি দাগ।

আমার কথার মানে আর কেউ না বুঝলেও বড় ফুপি আর পারভীন চাচি ভালোই বুঝলো। আমার মুখে ওমন কথা শুনে বড় ফুপি মুচকি হেঁসে দিলো!
পারভীন চাচি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি যেন ভেবে,রূপ বদলেই আমার হাত ধরে আফসোসের সুরে বললো।

_ ইসস এতো সুন্দর হাতটা কার ইচ্ছে হলো আঘাত করতে। সে কি খেয়াল করেনি তোর বাকি আঙুলগুলো নেই। সেটা দেখে একটু দয়া করতো। ইসস আমার খুব কষ্ট লাগছে তোর হাতটা দেখে। নাসিমা টাও তোকে কষ্ট দেয়। ওদের মাঝে কি কোন দয়া মায়া নেই।

আমি অবাক হলাম না চাচির এমন রূপে। কারণ এমন ব্যবহার চাচি সবার সামনেই করে থাকে সব সময় । আমি হাতটা আস্তে সরিয়ে নিলাম। তারপর চাচির উদ্দেশ্য বললাম–

_ আসলে চাচি,কে আমায় কথা শোনায় আর কে আঘাত করে! এটাই আমি জানি না। মাঝে মাঝেই বিরক্ত হই মানুষ রূপী কিছু গিরগিটির রঙ বদল দেখে। মানুষ কেমন করে যে গিরগিটির থেকেও দ্রুত রঙ বদলায়! আমি সেই মানুষটাকে দেখে আশ্চর্য হই। কিন্তু কি করার,সবাই তো আর মানুষ নয়! কিছু মানুষ রূপী অমানুষও হয়।

আমি আর কিছু বললাম না। ওখান থেকে চলে এলাম। আমি জানি আমার কথার মানে আমার মা আর ছোট ফুপি বুঝতে পারেনি। কিন্তু যে আঘাত দিয়েছে, আর যে দেখেছে তাঁরা ঠিক বুঝে নিয়েছে।

_ মিনু,এতো আগলে রাখার পরেও যদি আমার ময়নাকে কেউ আঘাত করতে পারে! আমার মনে হয় সে আরো আঘাত করবে। সামনে সে আরো অনেক কিছু করতে পারবে আমার ময়নাকে। ময়না আমাদের সংসারের রহমত। ওকে কে সত্যি ভালোবাসে আর কে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় করে এটা তোর আর মান্নানের দেখা উচিত। সারাক্ষণ আগলে রাখার পরও যদি আমার তোতাপাখিকে কেউ এভাবে আঘাত করতে পারে! ভবিষ্যতে সে কিন্তু আরো ভয়াবহ হতে পারে এই আমি বলে রাখলাম।

_ আপা আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না?

_ আমি শুধু বলেছি,মেয়েকে আরো একটু আগলে রাখ! খোঁজখবর নে কে আসলে তোর মেয়েকে সত্যি ভালোবাসে। যেন আর কোন হায়না আঘাত করতে না পারে তোর মেয়েকে। কারণ সে যে বহুরূপী। ক্ষণেক্ষণে নিজের রঙ বদলায়। নদী কিন্তু অনেক চাপা স্বভাবের। ও কিন্তু তোদের থেকে কথা আর আঘাত দু’টো লুকাতেই শিখে গেছে। তাই এবার তোদের উচিত মেয়ের উপর একটু বেশি নজর দেওয়া। বলা তো যায় না কখন কোথা থেকে দোমুখো সাপ ছোবল মারে।

ইনশাআল্লাহ চলবে,,

কিছু বলে যান।#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৯

_আমি শুধু বলেছি,মেয়েকে আরো একটু আগলে রাখ! খোঁজখবর নে কে আসলে তোর মেয়েকে সত্যি ভালোবাসে। যেন আর কোন হায়না আঘাত করতে না পারে তোর মেয়েকে। কারণ সে যে বহুরূপী। ক্ষণেক্ষণে নিজের রঙ বদলায়। নদী কিন্তু অনেক চাপা স্বভাবের। ও কিন্তু তোদের থেকে কথা আর আঘাত দু’টো লুকাতেই শিখে গেছে। তাই এবার তোদের উচিত মেয়ের উপর একটু বেশি নজর দেওয়া। বলা তো যায় না কখন কোথা থেকে দোমুখো সাপ ছোবল মারে।

_ আপা সত্যি কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন?

_ বুঝতে হবে না। মান্নান উঠেছে।

_ হুম আপা উঠেছে।

_ বাকি কাজগুলো তোরা কর,আমি আসছি।

আসছি বলেই রোকেয়া বেগম রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর রান্নাঘরে রেখে গেলেন দু’টো চিন্তিত আর একটি রাগী মুখ। রান্নাঘর ছেড়ে ভাইয়ের রুমের দিকে এগোচ্ছে রোকেয়া বেগম। মান্নান সাহেব চোখের চশমাটা ঠিক করে খবরের কাগজে মনোযোগ দিলেন। ঠিক তখন রোকেয়া বেগম ঘরে ঢুকলেন।

_ মান্নান ব্যস্ত তুই।

হঠাৎ বড় বোনের গলার আওয়াজ পেয়ে,খবরের কাগজ থেকে চোখ সরালেন মান্নান।

_ না আপা,কিছু বলবেন আপনি?

_ হুম

_ বসেন আপনি।

নিজের চেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মান্নান। রোকেয়া বেগম চেয়ারে বসলেন। ভাইয়ের হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন। বোনের ইশারা পেয়ে মান্নান সাহেব বসলেন।

_ মেয়েকে তো সবাই মিলে আগলে রাখিস সকল ঝড় থেকে। কিন্তু মাঝে মধ্যে যে কিছু ধমকা হাওয়া এসে মেয়েকে কষ্ট দিচ্ছে, সে খেয়াল কি রাখিস।

_ আপা আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। যদি ছোট বউয়ের কথা বলে থাকেন! তাহলে বলবো আমি যথেষ্ট প্রতিবাদ করেছি।

_ ছোট বউ ছাড়াও,আরো কিছু মানুষ আছে যাঁরা নদীকে পছন্দ করে না। তুই নদীর বা-হাতটা দেখিস একটু। কিভাবে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে নখ দিয়ে।

_ কী বলছেন আপা? কার এতো বড় সাহস আমার মেয়েকে এভাবে আঘাত করছে।

_ তোর ছোট মেয়েটা হয়েছে তোর মতো চাপা স্বভাবের। এই যে ভাই বউয়ের এতো কটু কথা শুনেও কখনোই দুঃখ প্রকাশ করিসনি! শুধুমাত্র সবাইকে আগলে রাখবি বলে। ঠিক তেমন তোর মেয়েটাও নিজের দুঃখ প্রকাশ করছে না,সংসারে অশান্তি লাগার ভয়ে। আমি চাইলেই তাঁর নামটা তোকে বলে দিতে পারি। কিন্তু তোর মেয়ে আমাকে দিয়ে কথা আদায় করেছে! যেন আমি এই কথা কাউকে না বলি। কিন্তু আমার মনে হয় নামটা না জানালেও,তোদের সতর্ক করা উচিৎ আমার। তাই তোদের সাবধান করলাম।

_ কিন্তু আপা নদী কার কি ক্ষতি করেছে?

_ জানি না। তুই থাক আমি গেলাম। আর আমার কথাগুলো একটু মাথায় রাখিস।

কথা শেষ করে রোকেয়া বেগম ঘর থেকে চলে গেলেন। আর ওদিকে মান্নান সাহেব চিন্তায় পরে গেলেন। কে তাঁর আদরের মেয়েকে তাঁদের আড়ালে কষ্ট দিচ্ছে। বড় আপা যখন বলেছেন,তাঁর মানে কিছু নিশ্চয়ই দেখে তারপর বলেছেন। এখন তাঁকে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মান্নান সাহেব উঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে গুড়িগুড়ি পায়ে ড্রইংরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।

————–

_আমি শেষ বারের মতো বলছি ভাইয়া আমাকে তিন হাজার টাকা দাও।

_ যদি না দেই কি করবি?

_ তোমার বাসরে গিয়ে অনশন ডাকবো।

_ তাহলে এতো প্ল্যান করে বিয়েটা কোন দুঃখে দিতে গেলি।

_ দুঃখে তো দেইনি,সুখে দিয়েছি। তোমার প্রতি আমার দয়া হয়েছে।

_ কেন জানি মনে হচ্ছে তোর সাহস তিনগুণ বেড়ে গেছে আমার আর মিমের বিয়ের ব্যপারে মাথা ঘামিয়ে।

_ সে তুমি যা ভাবো ভাবতে পারো আগে দাও?

_ কি করবি সেটা তো বল?

_ তুমি আগে দাও

অগত্যা সাগরকে বাধ্য হয়ে পকেট থেকে এক হাজার তিনটে নোট বের করে দিতে হলো।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাইয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের তিনটা নোট সবার দিকে তাক করলাম।

_ টেন টেনা, অবশেষে টাকা আদায়ে আমি সাকসেসফুল। এবার বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আপুর।

আমি আপুর দিকে তাকালাম। আপু আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো।

_ বলছি কী,আব্বুকে আমি কিছু বললে আব্বু শুনবে না। তাঁর থেকে তুই বাবাকে রাজি করা।

_ একদম না, কথা কিন্তু এটা ছিলো না।

_ আরে আপি ঝর্ণা আপু যখন বলছে এই দায়িত্বটাও তুমি করো।

কথাটা বললো মোহন।

_ একদম বাজে কথা বলবি না তুই। প্ল্যান তোরা করেছিস রাতে! কই তখন তো তোরা আমায় খোঁজ করিসনি। আর এখন কাজের বেলায় আমি।

_ তুমি রাতে ঘরে ছিলে না আপু। আমরা তো তোমায় খুঁজেছিলাম?

এবার আমি দমে গেলাম। কারণ রাতে তো সত্যি আমি ঘরে ছিলাম না। তাই বললাম।

_ আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু কথা দিতে হবে,ফুল কিনতে আমি একা যাবো। সব দায়িত্ব গুলো যখন আমি পালন করছি,তাই ফুল কেনার দায়িত্বটাও আমার। আর হ্যা ফুল কিনে যা থাকবে,সব টাকা আমার। কেউ কিন্তু সেই টাকা ভাগ চাইতে পারবি না।

আমার কথা শুনে সবার মুখটা চুপসে গেছে।

_ কী রাজি তো?

_ আচ্ছা

মুখ গোমড়া করে সবাই একসাথে বললো।

_ ঠিক আছে আমি যাচ্ছি আব্বুর কাছে।

আমি আব্বুর কাছে গেলাম। ঘরে উঁকি দিলাম। কিন্তু আব্বু নেই। তাই আশেপাশে খোঁজ নিতেই আব্বুকে খাবার টেবিলে বসে থাকতে দেখলাম। আমি এগিয়ে গেলাম। আব্বুর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। আব্বু রুটি খাচ্ছে। আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন।

_ নাস্তা করেছো?

_ না

_ করবে না?

_ হুম করবো।

_ হা করো

আব্বু আমার মুখের সামনে রুটি আর ভাজি তুলে ধরলেন।

_ না আব্বু তুমি খাও, আমি পরে খাবো।

_ হা করতে বলেছি।

আমি হা করলাম। আব্বু যত্ন করে আমার মুখে রুটি পুরে দিলো। আব্বু আমায় খাইয়ে দিচ্ছে আর আমি চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছি। কারণ আব্বু যখন আমায় খাইয়ে দেয়, তখন আমার পেট না ভরা অবধি খাওয়াতে থাকে। কেমন করে যে আব্বু বুঝতে পারে আমার পেটে কতটুকু ধরবে,আমি জানি না। আম্মু বলতো– আমি যখন ছোটবেলায় খাবো না বলে বায়না করতাম। তখন ভাইয়া আমায় কোলে নিয়ে ঘুরতো, আর আব্বু খাইয়ে দিতো। আর আমি সবটা গাপুসগুপুস করে খেয়ে নিতাম। তখন বাবা বলতো মা’কে — আমার মেয়ে কতো ভালো, আর তুমি কিনা আমার মেয়ের নামে মিথ্যা বলছো। মা তখন মুখ ঝামটি দিতো। সাথে আমার গালটাও একটু টেনে দিতো। আমি তখন মুখ ভেটকে কেঁদে দিতাম। বাবা-র বুকে কাঁদতে কাঁদত ঘুমিয়ে যেতাম। ছোটবেলার কাহিনী হয়তো আমার মনে নেই! কিন্তু মায়ের মুখে শোনার পর থেকে আজও মনে পড়লে চোখের কোণে জল জমে। এতো ভালোবাসে আমার পরিবারটা আমায়। আমার ছোট বেলার কথা ভাবার সময়ের মধ্যে বাবা কিন্তু আমায় তিনটে রুটি খাইয়ে দিয়েছে। এখন আমার পেট পুরোপুরি ভরে গেছে। পানি খেয়ে আব্বুর দিকে তাকালাম। আব্বু নিজের মুখে সবে রুটি দিয়েছে,আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

_ কিছু বলবে তুমি?

_ আসলে আব্বু,ভাইয়ার বিয়েটা তো তারাহুরো করে হয়ে গেছে। তাই আমরা ভাই বোনেরা মিলে ছোট্ট একটা আয়োজন করতে চাইছিলাম। তাই আরকি—

_ বুঝতে পেরেছি। কেনাকাটা করতে যাওয়ার আগে আমার থেকে টাকা নিয়ে যেও।

_ না আব্বু, ভাইয়ার থেকে নিয়েছি।

_ তবুুও নিয়ে যা-ও

_ আচ্ছা আব্বু

খুব খুশি লাগছে। ইসস আজ ভাইয়ার বাসর ঘর সাজাবো,উফফ ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে। আমি দৌড় দিলাম।

_ নদী

হঠাৎ আব্বুর ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আব্বুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আব্বু পানির গ্লাস থেকে পানি খেলেন।

_ জ্বি আব্বু

_ বসো

আমি আবারও বসলাম।

_ তোমার দাদা যখন মা-রা যায়,তখন আমি বিয়ে করেছি মাত্র তিন বছর। ছোট দুই ভাই আর এক বোনের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। বড় আপাকে তো বাবা থাকতেই বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তোমার মা,তোমার দুই চাচা,এক ফুপি,তোমার দাদি সবার খাবারের যোগাড় আমাকেই করতে হতো। তোমার মা’কে একটা কথা বলেছিলাম! আমার পরিবারকে সব সময় ভালোবাসতে হবে! নাহলে আমার ভালোবাসা সে কখনোই পাবে না। তোমার মা আমার সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। যখন আমি সংসার সামলাতে হিমসিম খাচ্ছি,তোমার মা পাড়ার ছোটছোট বাচ্চাদের টিউশনি করানোর দায়িত্ব নিলো নিজের কাঁধে। তখন একজন বাচ্চা ত্রিশদিন পড়িয়ে তোমার মা রোজকার করতো মাত্র পঞ্চাশ টাকা। দশজন বাচ্চা তোমার মা পড়িয়ে মাস শেষে আমার হাতে পাঁচশ টাকা তুলে দিতো। অভাবের সংসারে ওই পাঁচশ টাকা আমার কাছে হাজার পঞ্চাশ ছিলো। আজ সেই পাঁচশ টাকার মূল্য আমি তোমার মা’কে লক্ষ দিয়েও শোধ করতে পারবো না। সেই কষ্টের টাকা দিয়ে ভাই বোনকে মানুুষ করেছি। আজ তোমর বড় হয়েছো, ধীরে ধীরে আমাদের পরিস্থিতি বদলে গেছে। কিন্তু সেই দুঃসময়ের কথা আমি আজও ভুলিনি। এতো কষ্ট করে সংসার আগলে রাখলেও ভাইদের কিন্তু আমি আগলে রাখতে পারিনি। তাঁরা বিয়ে করলো, নিজেদের সংসার আর কর্মের দোহাই দিয়ে আজ সবাই আলাদা। আমি মেনে নিয়েছি ওদের সব কথা। কিন্তু কিছু শর্ত দিয়ে,তারপর ওদের চাওয়া পথে ছেড়ে দিয়েছি। শর্তের কথা তুমি জানো। আমার ভেতরে আক্ষেপ থাকলেও এই নিয়ে তোমার মা কখনোই আক্ষেপ করেনি! কেন এতো কষ্ট করার পরে-ও আমার ভাইয়েরা সুখের সময় আলাদা হ’য়ে গেছে। কিন্তু কোথাও আজ মনে হয়,এতো কষ্ট হয়তো করেছি বলেই আজ-ও তোমার চাচারা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। একটা সিদ্ধান্ত জানালে সেটা ফেলতে পারে না। কিন্তু আমি চাই! আমার সন্তানেরা কখনোই কোন ত্যাগ না করুক সংসারের কথা ভেবে। তুমি আমার ঘরের রহমত নদী। তোমাকে কেউ কষ্ট দিক আর সেটা তুমি আড়াল করে রাখে সবার ভালোর জন্য! এটা আমি চাই না। যদি কাউকে কিছু না-ও বলো! অন্তত প্রতিবাদ করো নিজের হয়ে। আমার নদী কারো অন্যায় নীরবে সহ্য করুক আমি চাই না। যদি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, আমার এতো দিনের গড়ে তোলা সংসারে আগুন লাগে! আমি কিছু মনে করবো না। আর না সেই জ্বলতে থাকে আগুনে পানি ঢালবো। কিন্তু আমি চাই তুমি প্রতিবাদী হও। আজ আমরা আছি! কাল যখন থাকবো না,তখন তোমাকেই এই কঠিন পৃথিবীতে একা লড়াই করে বেঁচে থাকতে হবে। আশা করছি তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছো।

মনে মনে বললাম। হ্যা বাবা ফুপি যে নামটা ছাড়া বাকি সবটা বলে দিয়েছে! তা ভালোই বুঝতে পারছি।

চলবে ইনশাআল্লাহ,,

গল্পের রেসপন্স দেখে,লেখার আগ্রহ হারিয়ে গেছে। কেউ গল্প পড়ে কিছুই বলে না। শুধু নাইস নেক্সট লিখে হারিয়ে যায়। খুব খারাপ লাগে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here