সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -১০+১১

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১০

মনে মনে বললাম। হ্যা বাবা ফুপি যে নামটা ছাড়া বাকি সবটা বলে দিয়েছে! তা ভালোই বুঝতে পারছি।

কোন মতে আব্বুর কথা শুনে ওখান থেকে চলে এলাম। এবার আমার ফুপির সাথে কথা আছে। সেদিন চাচি যখন আমাকে আঘাত করছিলো আর খারাপ কথাগুলো বলছিলো! পুরোটাই ফুপি শুনে নিয়েছে। আমি অনেক করে বলেছিলাম,যেন বাবা-মাকে এসব না বলে। কিন্তু ফুপি ঠিক সবটা বলে দিয়েছে। অবশ্য বলে দিয়ে ঠিক করেছেন একদিকে! না হলে বাবা-র এতো সুন্দর কথাগুলো মিস করতাম। বাবা বরাবরই আমাকে একটু বেশি ভালোবাসেন। আজ আরো একবার প্রমাণ পেলাম। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে ফুপিকে পেয়ে গেলাম তাঁর ঘরে। ফুপি মুখে পান গুচ্ছেন। আমি গিয়ে পাশে বসলাম।

_ সবই তো বলে দিছো,নামটাও বলে দিতে।

আমার কথা শুনে ফুপি চুনের হাতটা কাগজে মুছে তাকালেন আমার দিকে।

_ আমিও ভেবেছিলাম বলা উচিত, কিন্তু কথা দিয়ে কথা ভাঙা লোক আমি না।

_ হ্যা তুমি তো খুব ভালো মানুষ। সবটা মা’কে আর বাবাকে বলে দিছো,শুধু চাচির নামটা ছাড়া। এখন ষোলকলা পূর্ণ করো গিয়ে নামটা বলে।

_ বলা উচিত তাই না রে,আমিও তাই ভাবছি! সবটা যখন বললাম নামটাও বলা উচিত। তুই বস আমি গিয়ে নামটা বলে আসি।

এই কথা বলেই ফুপি উঠে হাঁটা শুরু করলো। আমি দৌড়ে ফুপিকে ধরলাম। ফুপি দেখছি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটানোর জন্য উঠে পরে লেগেছে।

_ এই এই তুমি কি করছো? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আব্বু আর মা যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে তুমি ভাবতে পারছো?

_ এতো ভাবাভাবির কাজ নেই তো আমার। ওর এতো সাহস কোথা থেকে আসে সেটাই আমি জানতে চাই ।

_ পরে জেনো,আজ না।

_ তুই ছাড় দিস বলে পার পেয়ে গেছে।

_ চিন্তা করো না আর ছাড় দিবো না।

_ কেন? মান্নান তোকে কিছু বলেছে?

_ বলেনি বুঝিয়েছে। জানো ফুপি আগে শুনেছি বাবা অনেক কষ্ট করেছে আমাদের এই সংসার আগলে রাখার জন্য। আজ তাঁর কিছু অংশ শুনলাম বাবার নিজ মুখ থেকে। সব সময় তো তুমি চাচ্চুরা বলতে,আজ বাবা নিজ মুখে বলেছেন।

_ শুধু নিজের কথা বলেছে,তোর মায়ের কথা বলেনি! তাঁর সংসারে জন্য ত্যাগ,পরিশ্রম, ভালোবাসা এগুলো কিছু বলেনি।

_ বলেছে ফুপি। জানো ফুপি আমি অনেক ভাগ্যবতী, এমন একটা পরিবারে জন্ম নেওয়ার জন্য। ক’জনার এমন পরিবার আছে। অনেকের তো এমন পরিবার পাওয়ার স্বপ্ন থাকে। আর দেখো আমি সেই পরিবারে বড় হয়েছি,তাঁদের আদর, যত্ন, ভালোবাসা পেয়ে।

_ তুই যেদিন জন্ম নিলি সেদিন তো আমি–

_ বাদ দাও ফুপি,পিছনের কথা ভেবে কষ্ট পেয়ো না। আমি বা মা-বাবা কিন্তু সে-সব কিছুই মনে রাখিনি,তুমিও রেখো না।

_ তুই এতো ভালো কেন? তুই ঠিক তোর বাবা-র মতো হয়েছিস।

_ সব সময় বলো আমি বাবা-র মতো হয়েছি,তাহলে যখন আমাদের পরিবারটাকে বাবা-র মতো আগলে রাখতে চাই,তখন কেন রাগ করো?

_ শোন মা,তোর বাবার দায়িত্বে ছিলো পুরো পরিবারের! কিন্তু তোর তো তাই নয়। তাহলে তুই কেন ওদের মিথ্যা দোষারোপ গুলো নিজের কাঁধে নিস।

_ ফুপি,কেউ যদি কাউকে আঘাত দিয়ে সুখ পায় তাহলে তাকে সুখ পেতে দাও। কারণ কাউকে দুঃখ দিয়ে নিজেকে সুখি করা খুব কঠিন। অন্য কারো সুখ কেঁড়ে নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ সুখি হতে পারেনি।তোমার কি মনে হয় চাচি হবে সুখি? কখনোই না,সে যে অহংকারের জোরে আজ এতো বড় বড় কথা বলছে,একদিন তা ঠিক ক্ষয়ে পড়বে।

_ তাই যেন হয়। হ্যারে হাতে কিসের টাকা।

_ ভাইয়ার বাসর ঘর সাজাবো,তাই ভাইয়ার থেকে টাকা নিয়েছি জোর করে।

_ ফুল কিনতে যাবি?

_ হুম, তোমার জন্য একগুচ্ছ শুভ্র নির্মল রজনীগন্ধা নিয়ে আসবো। তুমি ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখো।

_ তোর এখনো মনে আছে আমার পছন্দের কথা। সেই কবে বলেছিলাম,আমার রজনীগন্ধা ফুল খুব প্রিয়।

_ প্রিয় মানুষ গুলোর প্রিয় জিনিস কখনোই ভুলতে নেই। এটা ঘোর অন্যায়। এই অন্যায়ের শাস্তি খুব ভয়াবহ। আমি বাবা এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে চাই না। এতো কঠিন শাস্তি পাওয়ার থেকে প্রিয় মানুষগুলোর প্রিয় জিনিসগুলো মনে রাখা সহজ।

_ ওরে আমার পাকা বুড়ি।

_ এই আমি এখনো কচি ডাবের মতো,তুমি আমায় পাকা কেন বলছো।

_ হা হা হা হা,ফাজিল মেয়ে।

_ আমার জানটুস,আমার মনটুস।

_ ওভাবে বলিস না,তোর হবু জামাই স্ট্রোক করবে।

_ করলে করুক,আমাকে তাহলে তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে না।

_ এটাই তো ভাবি,তুই চলে গেলে বাড়িটা পুরোই অন্ধকারে ছেয়ে যাবো।

_ উফপ ফুপি মন খারাপ করো না তো। বরকে পটিয়ে পাটিয়ে তোমাকেও আমার সাথে নিয়ে যাবো।

_ হ্যা আমি তো নির্লজ্জের মতো জামাই বাড়ি গিয়ে থাকবো।

_ ইসস থাকলে কি হবে?

_ কিছু না, যা কোথায় যাবি বলে।

_ ওওও হ্যা,আমি তো ভুলেই গেছি। তুমি থাকো।

আমি ফুপির ঘর থেকে বেরিয়ে আপুর ঘরে গেলাম। কারণ সবার ওই ঘরেই থাকার কথা। অবশেষে সবাইকে পেয়েও গেলাম। সবাই সবার মতো বসে আছি। ঝর্না আপু ফোন টিপছে,মোহন হাল্কা সাউন্ড দিয়ে গান শুনছে,নয়ন আর আয়শা মিলে কিছু বিষয়ে আলাপ করছে। আমি দায়সারভাবে চেয়ারে শব্দ করে বসে পড়লাম। চেয়ার টানার শব্দে ওরা সবাই আমার দিকে তাকালো। এক ছুটে সব ক’জন হুরমুর করে আমার সামনে দাঁড়ালো।

_ কিরে এতো দেরি কেন তোর? বাবা কী অনুমতি দেয়নি? ( ঝর্ণা আপু)

_ আমি জানতাম দিবে না,যে পরিস্থিতিতে বিয়েটা হলো তাতে না দেওয়ারি কথা।( নয়ন)

_ আজ পর্যন্ত আপু কিছু বলেছে আর বাবা না করে দিয়েছে এমন কিন্তু হয়নি। তাহলে বোধহয় বাবাও ভিতরে রাগ হয়ে আছেন( মোহন)

_ কিরে নদী কিছু বল। ( ঝর্ণা)

এদের সবার কথা শুনে আমি লম্বা একটা হাই তুললাম। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলাম।

_ আমরা তোকে প্রশ্ন করছি,আর তুই হাই তুলে ঘুমাচ্ছিস। ( ঝর্ণা)

আমি উত্তর দিলাম

_ তোমরা তো নিজেরাই নিজেদের মতো উত্তর বানিয়ে নিয়েছো,এখানে আমি কি বলবো?

_ মানে? আমরা ভুল বলছি,বাবা তোকে অনুমতি দিয়েছে।

আমি ঝর্ণা আপুর কথায় সায় দিলাম। মানে হ্যা বাবা অনুমতি দিয়েছে। আমার কথায় সবাই হুররেএ বলে চিৎকার করে উঠলো।

_ সবাইকে খেতে ডাকছে।

হঠাৎ মেজ চাচির কথায় আমরা সবাই দরজার দিকে ফিরে তাকালাম। সবাই আসছি বলে দিলো। চাচি চলে গেলেন। সাথে সবার অগোচরে আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ছাড়লেন না। আমি বিনিময়ে চাচিকে একগাল হাসি উপহার দিয়েছি। আমার হাসি যেন চাচির গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলো! সে রাগে গদগদ করতে করতে চলে গেলেন। তো আমি সবার উদ্দেশ্য বললাম–

_ কথা কিন্তু ওটাই, আমি একা যাবো ফুল কিনতে। আর হ্যা ফুল কিনে যা টাকা থাকবে সব আমার। আর বাবাও কিছু দিবে বলেছেন।

আমার এই কথায় সবার মুখটা চুপসে গেছে। কারণ কথা ছিলো ভাইয়ার বাসরের ফুল কিনে যা টাকা থাকবে! তা দিয়ে ওরা আইসক্রিম খাবে। এখন সব টাকা আমি নিবো শুনে সবার মন খারাপ হলো। কিন্তু আমি তো সবার জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছি। আমি সবাকে এরিয়ে আবারও বাবার ঘরের দিকে গেলাম। সবাই অবাক হলো। হয়তো ভাবছে কখনোই তো আমি কোন কিছুর ভাগ একা নেই না,সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেই। তাহলে হঠাৎ আমার কি হলো? কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কিছু বলবো না,কারণ আমার বহুদিনের প্ল্যানটা এভাবে বাঞ্ছার হোক সেটা চাই না। বাবা-র ঘরে গিয়ে দেখি দরজাটা ভেজানো। আমি কড়া নারলাম।

_ আব্বু আসবো,তুমি ভেতরো আছো।

_ হ্যা আছি

আমি দরজা খুলে ভেতরে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবা আর মা কিছু নিয়ে হিসেব কষাকষি করছে। তাঁদের হিসেব কষাকষি হলে আব্বু আমাকে ডাকলেন।

_ নদী এখানে দশ হাজার টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে তোমার মিম আপুর জন্য টুকটাক যা দরকার সব কিনবে। মেয়েটাকে তো এক কাপড়ে নিয়ে এলাম। বিয়েটা যেভাবেই হোক আমাদের তো কিছু দায়িত্ব আছে। আর হ্যা মিমের থেকে শুনে যাবে! সে কি পোষাক পড়তে সাচ্ছন্দ্যবোধ করবে,সেটাই কিনে নিয়ে আসবে। যদি বলে শাড়ি কেনার কথা তাহলে সেটাই কিনবে,আর যদি থ্রি পিছ বলে তাহলে সেটা। আর এটাও জিজ্ঞেস করো,কারো মানরক্ষা করার জন্য নিজের পছন্দ অপছন্দ যেন সে না পাল্টায়। কারণ তুমি ঝর্ণা আমার কাছে যেমন, মিমও ঠিক আমার কাছে তেমনটা। আজ না-হয় ছেলের বউ হয়েছে, আগে তো আমার মেয়েই ছিলো। আর এই না-ও দুই হাজার, সাগরের দেওয়া তিন হাজার আর এই দুই হাজার! মোট পাঁচ হাজার দিয়ে তোমরা যা কিনতে চেয়েছিলে সেটা কিনো। সব তারাহুরো করে হলেও আমার সন্তানদের জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিনে যেন কোন কমতি না থাকে।

বাবা-র এমন চিন্তাভাবনা দেখে আমার চোখের কোণে জল জমলো। অন্য কেউ হলে কি এতটা ভাবতো। কি জানি।

_ চাচ্চু আমায় ডাকছিলেন?

হঠাৎ বর্ণ ভাইয়াকে বাবার ঘরে আসতে দেখে আমি বাবা-র কাছ থেকে সরে দাঁড়ালাম।

_ হ্যা বাবা ডেকেছি,তুমি একটু নদীর সাথে যা-ও তো? আমি তোমার উপরে একটু ভরসা পাই। নদী খুব হিসেবি হলেও একা একটা মেয়ে এতোগুলা টাকা নিয়ে বের হবে বিষয়টা ভালো নয়। নদীকে যা বোঝানোর আমি বুঝিয়ে দিয়েছি,তুমি বাকিটা ওর থেকে শুনে নিও।

_ না না বাবা,আমি একাই পারবো। আমি না-হয় আপুকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।

_ কেন? কোন সমস্যা।

_ না,কিন্তু তিনি কেন আমার সাথে যাবে।

_ যাক,একজন পুরুষ সাথে থাকলে ভরসা। যতোই তুমি চেনা পরিচিত জায়গায় যাও! শহরের মানুষগুলো তো সব তোমার চেনা নয়। বিপদ কোথা থেকে আসে কেউ জানে না। তাই সাবধান হও।

_ কিন্তু আব্বু চাচি যদি রাগ হয়।

_ মেজো বউ রাগ কেন হবে? আচ্ছা চলো আমি অনুমতি নিয়ে দিচ্ছি।

আব্বু আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে গেলেন। সবাই একসাথে বসে গল্প করছে। আব্বুকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালো।

_ মেজো বউ বর্ণ একটু নদীর সাথে মার্কেটে যাবে? টুকটাক কিছু কেনাকাটার জন্য। কোন অসুবিধা নেই তো তোমার?

_ ছি্ ছি্ ভাই আমার থেকে অনুমতি নেওয়ার কি আছে। যাবে যাক।

_ তোর চাচিও অনুমতি দিয়ে দিলো। এবার যা রেডি হয়ে বেরিয়ে পর।

_ আচ্ছা আব্বু

আমি চাচির দিকে একটু আঁড়চোখে তাকালাম। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে চাচিকে এটা বোঝালাম। কাউকে বিব্রতবোধ করতে কেমন লাগে এবার বুঝলেন।

—————–

রিক্সার পাশাপাশি দু’জন বসে আছি। হুরহুর করে কানের মধ্যে বাতাস ঢুকছে। হাল্কা শীত শীত অনুভব করছি। বর্ণ ভাইয়া একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেক বার আমাদের মাখখানে ফাঁকা অংশটার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো তিনি ভাবছে,রিক্সার একটু খানি সিটে কীভাবে দু’জন বসার পরেও ফাঁকা এতোখানি। হঠাৎ তাঁর কপালে বিরক্তিকর একটা ভাজ পড়লো। তিনি যে আমার এমন ব্যবহারে খুব বিরক্ত হলেন,তা ভালোই বুঝলাম।

_ ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?

_ দেখছি না,ভাবছি।

_ কি ভাবছেন?

_ ভাবছি আমার শরীরে কোন ছোঁয়াচে রোগ আছে কিনা? যেটা আসলে আমি জানি না।

_ মানে?

_ মানে? তুই যেভাবে একপাশে চেপে বসে আছিস,মনে হচ্ছে আমার শরীরে ছোঁয়া লাগলেই তোর ছোঁয়াচে রোগ হয়ে যাবে।

_ হতেও পারে।

_ যদি এমন কিছুই তুই জানতিস, তাহলে আগে বললি না কেন? তাহলে আমি দু’টো রিক্সা নিতাম। আমাকে তো তোর বডিগার্ড হিসেবে চাচ্চু পাঠিয়েছে। পিছন পিছন আসলেই তো হতো? এভাবে পাশাপাশি বসেও যদি দূরুত্ব নিয়ে থাকিস! তাঁর থেকে অন্য রিক্সায় আসা আমার জন্য ভালো ছিলো।

_ আপনিও তো জানতেন, তাহলে ঢেংঢেং করতে করতে এলেন কেন?

_ কি বললি তুই।

বর্ণ ভাইয়া হুট করেই আমার দুই বাহু ধরে রিক্সা থেকে ফেলে দিতে নিলো। আমি রিক্সা থেকে ঝুলে আছি এমন ভাবেই সে ধরে রেখেছেন। একটু এদিক ওদিক হলেই আমি পিচঢালা রাস্তায় পড়ে হামাগুড়ি খাবো। এমনও হতে পারে আমি শেষ।

_ কি করছেন বর্ণ ভাইয়া আমি পড়ে যাবো। আল্লাহ আমার আব্বু আমাকে কার সাথে পাঠালো। আব্বু গো কাকে রক্ষক হিসেবে পাঠালা,এতো দেখি তোমার মেয়েকে আজ হার্টঅ্যাটাক করিয়ে ছাড়বে। আরে ছাড়েন,আমি তো শেষ হয়ে যাবো।

_ আগে বল আর দূরে চাপকে বসবি।

_ না, না, একদম না। আমি চেপে চেপে বসবো আপনার কাছাকাছি। দরকার হলে আপনার কোলে বসবো, তাও আমায় ছেড়ে দিন। আমার খুব ভয় করছে।

_ মনে থাকবে

_ হুম থাকবে

বর্ণ ভাইয়া আমায় ছেড়ে দিয়ে নিজের শার্টের কলার ঠিক করলো। আর এদিকে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। হঠাৎ আমি উনার দিকে চেপে বসলাম সাথে একটু ধাক্কা দিলাম। হঠাৎ আমার ধাক্কা সামলাতে পারেননি,তাই তো পরতে পরতে বেঁচে গেলেন। আমি মুখটাকে বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরে রইলাম। দেখো কেমন লাগে,আমার সাথে বাঁদরামি তাই না। আমি কি চিজ সেটা স্যান্ডউইচ খেলেই বুঝবে হু।
#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১১

দুপুরের চড়া রোদে আমার অবস্থা নাজেহাল। কমবেশি সব কিছুই কেনা শেষ! শুধু কাঁচা ফুল বাকি। বিয়ের বাজার কি মুখের কথা নাকি। আর আব্বু আমার সাথে যাকে পাঠিয়েছে, না সে কোন কাজের, না কোন কাজ করতে জানে। দরদাম করা থেকে শুরু করে শপিং ব্যাগগুলোও আমাকে টানতে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে আপু বা নয়নকে নিয়ে এলেই কাজ হতো। আমি একবার বর্ণ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তিনি নীরবে পরিদর্শন করছে চারিপাশ। আমি কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস ছারলাম।

_ কিরে এতো জোরে শ্বাস ছারলি কেন?

_ আপনাকে বলতে যাবো কোন দুঃখে।

_ এখানে সুখ-দুঃখ কোথা থেকে এলো।

_ জানি না,আচ্ছা আমার মতো একজন অসহায় মেয়েকে দিয়ে এতো খাটাতে আপনার বিবেকে বাঁধছে না।

_ খাটাচ্ছি, কোথায় খাটাচ্ছি। তুই তো সব কিছুর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিস! আমি তো নিরীহ মানুষ শুধু তোর সঙ্গ দিতে এসেছি।

_ শুধু সঙ্গ দিতে আসতে কে বলেছে আপনায়? তাঁর থেকে ভালো রাস্তার কাউকে সাহায্য করতে বলি।

_ বল,যদি তোর উপর কারো দয়া হয়। আমার তো হলো না।

_ আপনি আমায় বিদ্রুপ করছেন।

_ না

_ দাঁড়ান আমি দেখাচ্ছি, আপনার থেকে রাস্তার মানুষ গুলোর সত্যিই দয়ামায়া বেশি।

এই কথা বলেই আমি একটু সামনে এগিয়ে গেলাম। ঠিক তখনই আচমকা আমাকে বর্ণ ভাইয়া হাত ধরে টান দিলো। আমি তাকাতেই তিনি চোখ গরম করে চাইলেন।

_ কি হলো?

_ ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস।

_ মানুষ ডাকতে, কেউ যেন আমায় একটি হেল্প করতে পারে সেই জন্য।

_ কোথাও যেতে হবে না। ওই যে তিনটে দোকান পরেই ফুলের দোকান! তারপর বাড়ি যাবো।

_ ততোক্ষণে ব্যাগগুলো কে ধরবে?

_ আমি ধরবো

_ সত্যি

_ আমি তোর মতো মিথ্যা বলি না।

_ একদম বাজে বকবেন না। রাস্তায় এসেও আমার সাথে ঝগড়া করে যাচ্ছেন

_ তুই কি,তুইও তো আমার সাথে সমান তালে ঝগড়া করে যাচ্ছিস।

_ অহেতুক তর্ক না করে ব্যাগগুলো নিন।

আমি ডান হাতের সব ব্যাগগুলো বর্ণ ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিলাম। হাতটা একটু ঝাঁকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম। আর ঠিক তখনই খুব বাজে ভাবে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড তো হলো না হাতটা খালি হয়েছে, এরমধ্যেই আবারও হাতের চাকরি চলে এলো। এই জন্যই বলে বিপদ কখনোই বলে কয়ে আসে না। পার্স থেকে ফোনটা হাতে নিলাম। ফোনকলে জ্বলতে থাকা সেভ নামটা দেখে বিরক্ত কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। কারণ ফোন করেছে শাওন। বর্ণ ভাইয়ার সামনে কিছুতেই বিরক্ত প্রকাশ করা যাবে না। তাই কোন মতে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলাম।

_ আসসালামু আলাইকুম।

_ ওয়া আ’লাইকুমুস সালাম। কেমন আছো? তোমার কোন খোঁজ নেই। আপুকে কল করলাম, তিনি ধরলেন না। সকালে থেকে তোমায় ফোন দিলাম তুমিও ধরলে না। তোমরা কি এখনো গ্রামের বাড়িতে আছো।

_ আস্তে, আস্তে প্রশ্ন করুন। একসাথে এতো প্রশ্ন করলে কোনগুলি রেখে কোনগুলোর উত্তর দিবো।

_ সময় নিয়ে সবগুলোর দাও।

_ আচ্ছা। আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। আপু হয়তো ব্যস্ত তাই ফোন ধরছে না। আর আমি সকালে শপিংমলে এসেছি,এখনো শপিং করছি তাই ফোনটা বাজলেও শুনতে পাইনি। এখন পেয়েছি তাই এখন ধরলাম। আর আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে কাল রাতেই চলে এসেছি। কারণ বিয়েটা মিম আপুর থাকলেও বিয়েতে সাগর ভাইয়াও জড়িয়ে গেছে। মানে মিম আপু আর সাগর ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে।

_ মানে? কিভাবে কী?

_ সে অনেক কথা এখন বলতে পারবো না।

_ আচ্ছা বলতে হবে না। শপিং করতে কি তুমি একা গেছো?

_ না

_ তাহলে সাথে কে এসেছে? আন্টি না আঙ্কেল।

_ তাঁরা কেউ না, আমার এক কাজিন।

_ ছেলে নাকি মেয়ে?

_ কেন?

_ না এমনই বলছিলাম।

_ ছেলে

_ ওহহ

_ কোন অসুবিধা আপনার,যদি আমার সাথে আমার কোন ছেলে কাজিন থাকে।

_ আমি কিন্তু সেভাবে কথাটা বলিনি নদী। তুমি কথাটা উল্টো ভাবে নিচ্ছো। তোমার ভালো খারাপের খবর নিতেই ওটা জিজ্ঞেস করেছি।

_ আপনার প্রশ্নটাই করা হয়নি! তাই আমার ভাবনাটা উল্টো হয়েছে।
আপনি এখন ফোনটা রাখুন,কাজিন পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। খারাপ ভাবতে পারে।

_ বাড়িতে পৌঁছে ফোন দিও।

_ আচ্ছা

আমি ফোনটা পার্সে ঢুকিয়ে বর্ণ ভাইয়াকে বললাম —

_ ভাইয়া চলেন

_ কি বললো তোর হবু বর?

_ তেমন কিছু না।

_ কিন্তু আমার মনে হলো, তিনি তোর সাথে আমার আসাটা পছন্দ করেনি।

_ আপনি ভুল ভাবছেন।

_ তাহলে সঠিকটা কি তুই আমায় বলে দে।

_ কি বলবো?

_ কি বললো তোর হবু বর।

_ কী হবু বর, হবু বর করছেন? তাঁর একটা নাম আছে, শাওন। সেটা ধরেই ডাকুন,শুনতে ভালো লাগবে।

_ দু’দিন পরে সে-তো তোর বর হবেই। তাঁর সাথেই তোর বিয়েই হবে! তাহলে বর ডাকলে সমস্যা কোথায়।

_ আপনি কি এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট করবেন।

_ সিনক্রিয়েট আর আমি, একদম না। আগে যদি জানতাম তোর সাথে আসলে তোর হবু বর রাগ করবে, তাহলে কোন মতেই তোর সাথে আমি বর্ণ আসতাম না। চাচ্চু বলার সাথে সাথেই না করে দিতাম।

_ ও শুধু জানতে চেয়েছে আমার কাজিন ছেলে না মেয়ে। এটাও কি ওর অন্যায়। আপনার ভাষায় সে আমার হবু বর! তাহলে আমার ভালো খারাপের খবর নেওয়ার তাঁর নিশ্চয়ই অধিকার আছে।

_ হ্যা অধিকার। ঠিক বলেছিস অধিকার। সে কিছুদিন তোর জীবন আসতেই যে অধিকার গুলো দেখাচ্ছে! আমরা তো তোর সাথে ছোট থেকে থাকার পরও দেখাতে পারছি না। সত্যি সে অনেক লাকী।

_ দেখুন বর্ণ ভাইয়া–

_ প্লিজ আর কিছু তোকে বলতে হবে না। অন্তত তোর হবু বরের হয়ে সাফাই তো না-ই। বাকি যা কেনার দরকার কিনে আয়! আমি রিক্সা নিয়ে অপেক্ষা করছি।

বর্ণ ভাইয়া রেগে হেঁটে চলে গেলো। আমার হঠাৎ খুব মন খারাপ হলো। আমি বুঝতে পারছি বর্ণ ভাইয়ার কেন রাগ হয়েছে। কিন্তু এখানে আমার কিছু করার নেই। আমার ভালো খারাপের জিজ্ঞেস করার অধিকার সত্যি আছে শাওনের। এখানে তাঁকে না বলার মতো কোন রাইট নেই আমার। হ্যা যদি সে কোন অভিযোগ তুলতো, কেন আমি কোন ছেলেকে নিয়ে শপিং করতে এসেছি? তাহলে তাঁকে দুই-চারটা কথা শুনিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু — আমি আর কিছু ভাবলাম না। সোজা ফুলের দোকানে চলে গেলাম। সেখান থেকে ফুল কিনে নিলাম। বড় ফুপির জন্য রজনীগন্ধা ফুল কিনতে ভুললাম না। ফুল কেনা শেষ হলে আমি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়াতেই একটা রিক্সা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখলাম বর্ণ ভাইয়া মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আমিও উঠে বসলাম রিক্সায়। আমি বসতেই বর্ণ ভাইয়া নেমে গেলো। রিক্সা ওয়ালাকে বললো একটু সামনে এগিয়ে যেতে। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এলেন। হাতে একটা প্যাকেট। আমি তেমন মাথা ঘামালাম না। আসার সময় যতটা উত্তেজনা নিয়ে এসেছিলাম! যাওয়ার সময় ঠিক ততোটাই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বসে ছিলাম দু’জন। আসার সময় আমাদের মাঝখানে দুরুত্ব আমি রেখেছিলাম! কিন্তু এবার বর্ণ ভাইয়া রেখেছে। তিনি কি বুঝতে পারছে না আমি কষ্ট পাচ্ছি। তিনি তো নিজের কষ্টটা আমাকে দেখাতে পারছে,কিন্তু আমি তো সেটাও পারছি না। চাপা কষ্ট গুলো সব থেকে ভয়াবহ। না যায় কাউকে দেখানো না যায় সহ্য করা। আমি তো ভেতর থেকে খুব কষ্ট পাচ্ছি। পৌঁনে একঘন্টা সময় লেগেছে বাড়িতে ফিরতে। এই পৌঁনে এক ঘন্টা একবারের জন্যও বর্ণ ভাইয়া আমার দিকে তাকায়নি। আমিও তেমন কিছু বলিনি! কারণ যেচে গিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার কোন মানে হয় না। সব কিছু ঝর্ণা আপুকে বুঝিয়ে আমি গোসলে ঢুকে গেলাম। প্রথমে চোখেমুখে পানি ছেটালাম। বর্ণ ভাইয়ার কাছাকাছি আর হওয়া যাবে না। তাহলে আমি আরো দুর্বল হয়ে পরবো। আমাদের মতো প্রতিবন্ধী মেয়েদের দুর্বল হতে নেই। শরীরে শীতল পানি দিতেই কেন জানি আমার কান্না এলো। ভিষণ কান্না পেলো। চোখটা অসম্ভব জ্বলতে শুরু করলো। কিছুতেই আমার কান্না আমি আঁটকে রাখতে পারছি না। আচ্ছা আমার এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? বর্ণ ভাইয়ার খারাপ লাগা দেখে,নাকি সে আমার সাথে কথা বলছিলো না তাই। হঠাৎ দু-চোখ ভরে জলের ধারা নেমে এলো। আমার কান্নার কোন শব্দ নেই! কিন্তু জলের কোন কমতি নেই। অবশেষে আধঘন্টা পর বেরিয়ে এলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকে মেজো চাচিকে দেখে,এবার ভেতরে চাপিয়ে রাখা আমার কষ্টটা যেন কয়েক গুন বেড়ে গেলো।

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here